একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব -৫১

#একটি_নির্জন_প্রহর_চাই
৫১
#WriterঃMousumi_Akter.

ছোঁয়া আর তন্ময় বাসর ঘরে প্রবেশ করেছে।বাইরে সিঁড়িতে দ্বীপ আর মৃন্ময় গালে হাত দিয়ে বসে আছে।দেখে মনে হচ্ছে পালের জোড়াগোরু মারা গিয়েছে।আমি পিহু আর তরী তিনজনে অন্য রুমে বসে গল্প করছি।

পিহু বলল, ‘আচ্ছা তরী আপু, ভাইয়া আর ভাইয়ার বন্ধুর কী হয়েছে?’

তরী বলল, ‘জানি না তো।’

পিহু বলল, ‘ জিজ্ঞেস করে আসি।’

সিঁড়ির দিকটা বেশ অন্ধকার।পিহু দ্বীপকে মৃন্ময় ভেবে দ্বীপের কাঁধে হাত রেখে বসে পড়ল আর বলল, ‘ভাইয়া কী হয়েছে তোমার?বাবাকে কি বলব তোমার বন্ধুর বিয়ে দেখে তোমারও বিয়ে করতে মন চাচ্ছে?’

দ্বীপ এক লাফ দিয়ে সিঁড়ি থেকে নেমে বলল, ‘ওহ মাই গড! মেয়ে মানুষের স্পর্শ! সব শ্যাষ আমার!এইখানে মেয়ে এলো কইত্তে?’

পিহু এবার বুঝতে পারল এটা তার ভাই না। ভাইয়ের বন্ধু।”মেয়ে মানুষের স্পর্শ, আমি শ্যাষ।”এই কথাটা শুনে পিহুর বেশ প্রেসটিজে লাগল।পিহু দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘কী ব্যাপার ষাঁড়ের মতো চিল্লাচ্ছেন কেন? অদ্ভুত!’

দ্বীপ বুকে ফুঁ দিয়ে বলল, ‘তুমি আমার গায়ে হাত দিয়েছ কেন?মেয়ে মানুষকে আমি ভ**য় পাই।এই প্রজাতি থেকে দূরে থাকার চেষ্টায় আছি।’

‘তাই বলে আপনি ষাঁড়ের মতো চিল্লাবেন?আমি ভাইয়া ভেবেছিলাম।এমন ভাবে বললেন, “ওহ মাই গড! মেয়ে মানুষের স্পর্শ আমি শ্যাষ।”যেন মেয়ে মানুষের স্পর্শে বিষ আছে।’

‘কী ফাজিল মেয়ে!সিনিয়রকে ষাঁড় বলছে।’

‘ষাঁড় তো পুরুষ লিঙ্গ। খারাপ কী?গোরুর বেটা ছেলে জাতকে ষাঁড় বলে।’

‘হাইরে মাইয়া মানুষ!কী লজিক রে বাবা!’

‘আপনি মেয়েদেরকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলবেন আর আমি ছেড়ে দিব?’

‘মেয়ে মানুষ বি*ষের থেকেও খারাপ।কী আছে এই মেয়েজাতির মাঝে আমি বুঝি না!দাম্ভিক রোশান স্যারের চাল-চলনই সারাহ বদলে দিয়েছে।তন্ময় এক ছোঁয়ার জন্য যা করল তা আর না-ই বা বললাম।আর মৃন্ময় বাচ্চা কালে প্রেমে পড়া কোন মেয়েরে আজও ভুলতে পারল না!’

‘যান কেন মেয়েদের কাছে?আমরা বলেছি না কি?’

দ্বীপ মৃন্ময়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দেখ তোর বোন কী ঝ*গ*ড়ু*টে!এই মেয়েরে বিয়ে দেওয়া যাবে না।’

মৃন্ময় হেসে বলল, ‘দেখলাম তো।’

তরী আর আমি ততক্ষণে বাইরে বেরিয়েছি।তরী খিলখিল করে হেসে দিল।দ্বীপের উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ মুখটা ঝ*গ*ড়া*য় পরাজিত হয়ে থমথমে হয়ে আছে।তরীর খিলখিল হাসির দিকে মৃন্ময় আচমকা তাকাল।মৃন্ময়ের চোখজুড়ে মুগ্ধতা খেলা করছে।তরীর খিলখিল হাসির শব্দ মৃন্ময়ের কর্ণকুহরে যেন শ্রুতিমধুর শোনাচ্ছে।না হলে কেউ ওইভাবে দুই ঠোঁট কিঞ্চিৎ ফাঁকা করে মৃদু হেসে তাকিয়ে থাকে কারো মুখপানে!আজ আমি বহুবার এটা নোটিস করেছি যে মৃন্ময় গভীর ভাবে তাকাচ্ছে তরীর দিকে।মিনিটে কয়েকবার করে তাকাচ্ছে।

পিহু এইবার কটমট করে বলল, ‘তরী আপু চলো আমরা বাসায় যাই।এদের সাথে আর থাকব না।’

তরী বলল, ‘হ্যাঁ চলো রোহান ঘুমিয়ে পড়েছে।ওকে কোলে করে নিয়ে যাওয়াটাই মুশকিল হয়ে যাবে।’

‘বেশি দূর তো না;চলো ভাগে যোগে নিব।’

আমিও বললাম, ‘আমাকেও যেতে হবে। ‘

মৃন্ময় বলল, ‘সবাই যাবে আমরা কি বাসর ঘর পাহারা দিব? আমরাও যাব।’

‘তো চল একই সাথে যাওয়া যাক।’

দ্বীপ মৃন্ময়ের হাতে চিমটি কেটে বলল, ‘কী রে চলেই যাব?আমাদের প্লান ছিল ওদের একবার ডিস্টার্ব করা। মনে নেই তোর?’

মৃন্ময় দুষ্টি হাসি দিয়ে বলল, ‘তন্ময়ের বাসর রাত আর আমরা ডিস্টার্ব করব না তাই আবার হয়?’

দ্বীপ আর মৃন্ময় হুট করে গিয়ে তন্ময়ের ঘরের দরজা ধাক্কাতে শুরু করল আর বলল, ‘এই তন্ময় দরজা খোল।গিফট তো দিলাম না।’

তরী বলল, ‘আরে আরে এসব কী করছেন হুম?ছিঃ! ছিঃ!’

বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর তন্ময় দরজা খুলে বুকে হাত বেঁধে দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, ‘কী সমস্যা,ঘুমোবি আমাদের সাথে?’

মৃন্ময় পকেট থেকে কিছু একটা বের করে তন্ময়ের হাতে দিয়ে বলল, ‘সারাহকে যে গিফট দিয়েছি তুই পাবি না তাই কি হয়!’

তন্ময় মৃন্ময়ের মুখে প্যাকেটটা গুঁজে দিয়ে বলল, ‘শালা তুই খা।’

দ্বীপ তন্ময়ের শেরওয়ানির দিকে উঁকি-ঝুকি দিয়ে কিছু একটা দেখছে।মৃন্ময়ও তাই করছে।তন্ময়ের চোখ-মুখ ভালো ভাবে দেখছে।

তন্ময় ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘কী কাহিনি? কী দেখছিস?’
আস্তে করে মৃন্ময় বলল, ‘লিপিস্টিক খাইছিস কি না চেক করলাম।’

‘শালা ডাফার।’ বলেই তন্ময় দরজা লাগিয়ে দিল ঘরের।

আমরা যে যার বাসার উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়লাম।আকাশ কেমন মেঘলা হয়েছে হঠাৎ।শীত প্রায় চলে এসেছে।এই অসময়ে আবার আকাশ মেঘলা কেন!মৃন্ময়ের কোলে রোহান রয়েছে।
হাঁটতে হাঁটতে তরী মৃন্ময়কে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আপনি তো খুব ফাজিল আছেন।’

দ্বীপ চিল্লায়ে বলল, ‘রাইট। আপনি রাইট বুঝেছেন।’

মৃন্ময় চোখ রাঙিয়ে দ্বীপের দিকে তাকিয়ে বোঝাল।’ডোন্ট ডিস্টার্ব আস।’আমাদের মাঝে কথা বলিস না।অনেক কষ্টে কথা বলার একটু সুযোগ পেয়েছি।

মৃন্ময় বিস্ময়ের সাথে তরীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কেন কেন?

‘কেন,শুনতে চান?
‘হুম চাই।’
‘তন্ময় ভাইয়াকে বলা কথাটা আমি শুনে ফেলেছি।’

মৃন্ময় বেশ লাজ্জা পেল।তরীর দিকে তাকিয়ে লজ্জামশ্রিত হাসি দিল।অতঃপর বলল, ‘কংগ্রাচুলেশন।প্রথম দিনেই আপনি বিজনেসে বাজিমাত করেছেন। একটা ট্রিট পাচ্ছি তো।’
‘হুম দেওয়া যাবে।আর ধন্যবাদ সাহায্যর জন্য।’
‘ওয়েলকাম।’

সবাই যে যার মতো বাসায় ফিরে গেল।আমিও ফিরে এলাম।রুমে এসে দেখি উনি বই পড়ছেন।হাতের পার্সটা ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে হাতের চুড়ি খুলতে খুলতে বললাম,
‘কী ব্যাপার বই পড়া হচ্ছে?’

উনি বই থেকে চোখ তুলে আমার দিকে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে বললেন, ‘কী আর করা!যার বউ সময় দেয় না তার বই-ই সঙ্গী।’

‘এখন কিন্তু আমার ওই বইয়ের উপর হিংসা হচ্ছে।আপনি আমার অভাব ওই বই দিয়ে মিটাচ্ছেন?’

‘তাহলে কী করব?বউয়ের অভাব তো কিছু একটা দিয়ে মেটাতে হবে।’

‘কেন মেটাবেন আপনি?আমি না থাকলে আমার জন্য ছটফট করবেন।আমাকে মিস করবেন।’

বেশ রেগেই কথাটা বললাম।বই একটা জড়বস্তু সেটা নিয়েও অযথা রেগে যাচ্ছি কেন আমি!

উনি এবার আমার দিকে তাকিয়ে একটু অন্য ভাবে বললেন, ‘অভাব তো আরেকটা বউ দিয়ে মেটাচ্ছি না তাই না?বই দিয়ে মেটাচ্ছি।’

আমি ভ’য়া’নক রাগী চোখে উনার দিকে তাকালাম।উনি বোধহয় ভ*য় ই পেলেন।সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিয়ে আবার বইয়ের দিকে মনোযোগ দিলেন।

আমি তেজস্ক্রিয় ভাব নিয়ে বললাম, ‘কী বললেন আপনি?আরেকটা বউ?এসবও ভাবেন আপনি?

উনি আমার মুখের কাছে কান এগিয়ে বললেন, ‘কী বললে?শুনিনি।’

‘শোনেননি তাই না? ঘরের সব কিছু ভে**ঙে ফেলব আমি।আপনাকেও ভে**ঙ্গে চুরে ফেলব।আপনি আরও একটি বিয়ের কথা ভাবতে শুরু করেছেন!’

উনি বইটা বন্ধ করে থুতনিতে চার আঙুল ঠেকিয়ে আমার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছেন।কী যেন দেখছেন আমার রাগী চোখে-মুখে তাকিয়ে।উনার দু’চোখ জুড়ে মুগ্ধতা।এই মানুষটা কি জানে না তার এই চাহনিতে আমি এলোমেলো হয়ে যায়!মাদকের মতো কাছে টানে আমাকে।উনি একটুও এদিক-সেদিক তাকাচ্ছেন না।এক দৃষ্টিতে তাকিয়েই আছেন আমার দিকে।আমি ঝ*গ*ড়ার মুডেই বললাম,
‘ওভাবে তাকিয়ে কী দেখছেন?’
‘ভাবছি।’
‘কী?’
‘তুমি এত সুন্দর কেন সুইটহার্ট? ‘

এই যে ‘সুইটহার্ট’ শব্দটা শুনে হঠাৎ বুকের মাঝে কেমন অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করল।সেই ভালো লাগা বুঝতে না দিয়ে অভিমানের সুরে নিয়ে বললাম,
‘আমি সুন্দর তাও আরেকটা বিয়ে করতে চান!অসুন্দর হলে কয়টা বিয়ে করতেন?

উনি হেসে বললেন, ‘তোমাকে রা* গা* নো কত সহজ দেখো।আরও একটা বিয়ে তো দূরে থাক।অন্য কোনো মেয়ের দিকে কোনোদিন তাকানোর রুচিও আমার আসবে না।আমার দু’চোখ তোমার মুগ্ধতায় আটকে গিয়েছে।নির্দিষ্ট কারো মুগ্ধতায় দু’চোখ আটকালে কি অন্যকিছু দেখতে ইচ্ছে করে?’

‘শুনুন আমি যদি ম* রেও যায় তবুও কিন্তু আপনি আরেকটা বিয়ে করবেন না।’

কথাটি বলেই আমি জানালা লাগাতে গেলাম।বাইরে এলোমেলো বাতাস শুরু হয়েছে। মনে হচ্ছে ঝ*ড় আসবে এখনি।এরই মাঝে আড়ষ্ট দুটো হাত আমার কোমরে নেমে এলো।আমি বুঝতে পারলাম মানুষটা উনি ছাড়া আর কেউ না।কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে উষ্ণ নিঃশ্বাস ছাড়লেন।আলতো করে কোমর জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ গুঁজে বললেন,
‘কী সব বলো তুমি।এসব বলতে নেই।তোমাকে মিস করছিলাম, তীব্র ভাবে মিস করছিলাম।একটা সময় রাগ হচ্ছিল,বিরক্তও হচ্ছিলাম।তাই তোমাকেও একটু রাগিয়ে দিলাম।’

‘এখানে উঠে এলেন কীভাবে?কষ্ট হয়নি আসতে?’

‘কিছু পেতে হলে তো কষ্ট করতেই হয় তাই না?’
‘কী পাওয়ার কথা হচ্ছে?’

‘পরীক্ষার পরে গিফট দেওয়ার কথা ছিল।আমি কিন্তু ভুলিনি।’

মুহূর্তের মাঝে চোখ-মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেল আমার।উনি সেই কথা এখনো ভোলেননি।আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম।লজ্জায় চুপ করে রইলাম আমি।’

উনি নেশাক্ত কন্ঠে বললেন, ‘এই উস্কানিমূলক আবহাওয়া বলছে, সেই গিফট পাওয়ার উত্তম সময় এখনই।’

চলবে?

(রেসপন্স করবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here