আমি_ফাইসা_গেছি(৪৪)
মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ
যেকোনো মানুষের জীবনে বাবা মা এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। মা এর ভালোবাসা এর মধ্যে কোনো ভেজাল নেই, নেই কোনো মলিনতা। যেকোনো পরিস্থিতি হোক না কেন মায়েরা সবসময় তাদের সবকিছু বিলিয়ে দেয়।মা ‘শব্দটির মধ্যে আছে এক অদ্ভুত পরিতৃপ্তি ; এক অনাবিল শান্তি । তবে পরিস্থিতির বিপাকে পড়ে যাদের মা ছাড়া জীবন যাপন করতে হয় তাদের মতো অসহায় এবং দুর্ভাগা মানুষ বুঝি আর হয় না । মা ছাড়া জীবন এককথায় শুষ্ক মরুভূমির মতো ,জলহীন সমুদ্রের মতো ও বায়ুহীন প্রকৃতির মতন।মায়ের কোল যে কত বিশাল একটি আশ্রয় তা একজন যোগ্য সন্তান ছাড়া আর কেউ বোঝে না। আর সেই মা ‘কে ছাড়া যখন থাকতে হয় তখন এক মুহূর্তও হয়ে ওঠে দুর্বিষহ আর শ্বাসরুদ্ধকর ।
কুশানকে যদিও তার মাকে ছাড়া অসহায় আর দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে হয় নি তবুও এতো দিন পর নিজের মায়ের খোঁজ পেয়ে জীবন টা কেমন যেনো খাঁ খাঁ করতে লাগলো তার।পুরো জীবনটাই যেনো ব্যর্থতায় ভরা মনে হচ্ছে।এটা কি হলো তার সাথে?যাদের কে এতোদিন সে আপন ভেবে আসলো তাদের সাথে কুশানের যে রক্তের কোনো সম্পর্কই নেই।আর যে মানুষ টিকে সে জানে না,ভালোভাবে চেনে না,দুই একদিন দেখা হয়েছে মাত্র সেই জামিলাই নাকি তার গর্ভধারিণী মা হয়।
সোলেমান চৌধুরীর মুখে সত্য টা জেনে কুশানের পায়ের তলার মাটি যেনো সরে যেতে লাগলো।সে আকাশের পানে চেয়ে ভাবতে লাগলো এমন টা তার সাথে না হলেও পারতো।
কুশানের সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগছে এই ভেবে যে তার মায়ের সন্ধান পেয়েও একটিবার তার পা জড়িয়ে ধরে কান্না করারও সৌভাগ্য হলো না তার।বা একটিবার তার মাকে জড়িয়ে ধরে বলতে পারছে না,
আমাকে ক্ষমা করে দিও মা,তোমার খারাপ দিনগুলো তে তোমার পাশে থাকতে পারি নি আমি।জীবনের কঠিন মুহুর্ত গুলো তোমাকে একা একা পার করতে হয়েছে।অন্যদিকে কুশানের বাবা, মানে জামিলার হাজব্যান্ড তিনি কিছুদিন হলো মারা গিয়েছেন।কোনো এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে টাকার অভাবে চিকিৎসা করতে না পেরে তাকে মৃত্যু বরন করতে হয়েছে। এটা অবশ্য তার পাপের শাস্তিই ধরা যায়।তিনি জামিলার সাথে অনেক বেশি অন্যায় করেছেন।সংসার জীবনে সুখী ছিলো না জামিলা বেগম।সারাদিন কটু কথা শোনানোর পাশাপাশি কুশানের বাবা জামিলাকে মারধরও করতেন।সেজন্যই তো কুশানের বাবার সাথে জামিলার ছাড়াছাড়ি হয়েছে।জীবনের এই কঠিন সংগ্রামে জামিলা নিজেই নিজেকে আজ প্রতিষ্ঠিত করেছে।তবে এর জন্য তাকে অনেক বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে।কিন্তু আজ প্রতিষ্ঠিত হয়েও যেনো জামিলা আবার প্রকৃতির কাছে হেরে গেলো।নিজের ছেলের পরিচয় জেনেও তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলতে পারছে না বাবা আমিই তোর অভাগী মা হই,যে তোকে আগলে রাখতে পারে নি।
কুশান তার মা বাবার কথা মনে করে আরো বেশি কষ্ট পাচ্ছে।তার বাবা মার জীবন টা কত কষ্টের ছিলো।বিশেষ করে তার মায়ের জীবন টা সবচেয়ে বেশি কষ্টের ছিলো।আর কুশান কত আভিজাত্যের মধ্যে বড় হয়েছে।অভাব,দুঃখ, কষ্টের ছিটাফোঁটাও তার শরীরে লাগতে দেয় নি জারিফ চৌধুরী আর কামিনী চৌধুরী। তার নানু সুলেমান চৌধুরী তো আদর করে সব সম্পত্তি তার নামে অনেক আগেই করে দিয়েছে।আর এদিকে তার নিজের মা কত দূর্বিষহ জীবন পার করেছে।এখন আবার জামিলা জেলে আছে।সেলিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে এট্যাক করায় জামিলার জেল হয়েছে।সে ছেলে হয়েও কিছুই করতে পারলো না তার মায়ের জন্য।কুশান অনেক বেশি ভেঙে পড়লো।মেয়ে হওয়ার সুবাদে তার মনের সকল দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা নিমিষেই দূর হয়ে গিয়েছিলো।কিন্তু নতুন করে আবার তার মন টা ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো।
তবে কুশানের চোখ দিয়ে একটুও জল বের হলো না আজ।কারণ তার বুকের ভিতর টা একদম জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিলো।একটু কাঁদলেই হয় তো তার যন্ত্রনা কিছুটা কমতো।কিন্তু আজ কেনো জানি তার একটুও পানি আসলো না চোখে।সে তার নানুর মুখে সব সত্যি কথা শুনেও একটি কথাও বললো না বরং তার নানুর রুম থেকে বের হয়ে সোজা নিজের রুমের দিকে যেতে লাগলো।
মেহমানরা এখনো আছে বাসায়।কুশানের মেয়েকে নিয়ে সবাই অনেক বেশি আনন্দ করছে।কুশানকে দেখামাত্র কামিনী ডাক দিয়ে বললো,
বাবা কুশান!এদিকে একটু আয় তো বাবা!
কুশান যেনো কামিনীর কথা শুনতেই পেলো না।কারণ সে বেশ অন্যমনস্ক হয়ে আছে এখন।কামিনী তখন নিজে গিয়ে দাঁড়ালো কুশানের সামনে।আর কুশানের হাত ধরে বললো,
তোর নানু তোকে রুমে আলাদা করে ডেকে নিয়ে গিয়ে কি কথা বললো বাবা?
কুশান মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিলো কিছু বলে নি।
এই বলে সে তার রুমের ভিতর প্রবেশ করলো।সে কামিনীর দিকে তাকালোও না আবার তার সাথে কোনো কথাও বললো না।
কারণ কুশানের আজ কামিনীর উপর একটু অভিমান হলো।সে মনে করে কামিনী আর তার নানী অনেকটাই দোষী। তারা যদি সেদিন সেলিনার থেকে তাকে না কিনে নিতো তাহলে আজকের এই দিনটা দেখতেই হতো না।সে তার মায়ের সাথেই থাকতো।তার মা রাগ করে সেলিনাকে মারতেও যেতো না,আর তার মায়ের এতো বড় শাস্তিও হতো না।
পরক্ষনেই কুশান নিজে নিজেই হেসে উঠলো।কি স্বার্থপর ছেলে সে!যে আম্মু তাকে এতো ভালোবাসে,এতো আদর দিয়ে তাকে বড় করেছে আজ তাকেই সে অপরাধী ভাবছে।না,কেউ অপরাধী না।সব তার ভাগ্যেরই দোষ।
কুশানের মাথাটা যেনো একদম এলোমেলো হয়ে গেলো।নানা রকম চিন্তাভাবনা আসতে লাগলো মাথায়।
এদিকে কামিনী কুশানের এমন ব্যবহারে একদম হা হয়ে গেলো।তার ছেলে তাকে এভাবে এড়িয়ে যেতে পারলো?কেনো ভালোভাবে কথা বললো না কুশান এই টেনশনে কামিনী আবার নিজেই গেলো তার বাবার কাছে।
🖤
তোড়া মেয়েকে দোলনায় শুয়ে রেখে তার ড্রেসগুলো গুছিয়ে রাখছে।কারণ মেহমানদের অনেকেই তার মেয়ের জন্য ভালোবেসে রঙবেরঙের ড্রেস এনেছে।কেউ কেউ এনেছে হরেক রকমের খেলনা,সোনার আংটি পর্যন্ত দিয়েছে। গোলাপ সাহেব ভালোবেসে নাতনীর জন্য এক জোড়া ছোটো ছোটো স্বর্নের চুড়ি বানিয়ে এনেছে।অন্যদিকে সোলেমান চৌধুরী একটা স্বর্ণের চেইন গিফট করেছে।জারা আর শ্রাবন ও আংটি দিয়েছে কুশানের মেয়েকে।তারা নিজের হাতে পড়িয়েও দিয়েছে কথামনির হাতে।
তখন পাশ থেকে কেউ একজন হাসির ছলে বলেছে, ছেলের বউকে আংটি পড়িয়ে দিচ্ছে জারা আর শ্রাবণ। কথাটা হাসি আর ঠাট্টার ছলে হলেও জারা স্পষ্ট বলে দিয়েছে কুশান ভাইয়া আর তোড়া ভাবি যদি রাজি থাকে তাহলে এখনি ছেলের বউকে নিয়ে যাবো আমি।নিজের ছেলে আর বউকে একসাথে বড় করে বিয়ে দেবো।শ্রাবণ অবশ্য কিছু বলে নি।কারণ সে হাসি মশকরা তেমন একটা পছন্দ করে না।শ্রাবণের রাগান্বিত লুক দেখে জারা থেমে গেলো।সে আর কিছু বললো না।
কুশান রুমে প্রবেশ করেই তার মেয়ের দোলনার পাশে গিয়ে বসলো।আর দোল দিতে লাগলো।তারপর ঘুমন্ত মেয়েকেই চুমু দিতে ধরলে
তোড়া চিৎকার করে বললো,
এই? কি করছো?ঘুমন্ত অবস্থায় চুমু দিচ্ছো কেনো?এতে মেয়ে কিন্তু তোমার ভীষণ রাগী হবে।এমনিতেই তো তোমার মেয়ে একটু জেদি হবেই তা আমি আগে থেকেই আন্দাজ করতে পারছি।
কুশান তোড়ার কথা শুনেও কোনো উত্তর দিলো না।সে হঠাৎ দোলনার পাশেই ধপাস করে বসে পড়লো।
তোড়া তা দেখে বললো,
কি হলো কুশান?ওভাবে ফ্লোরে বসে পড়লে কেনো?মেয়েকে চুমু দিতে দিলাম না দেখে কি বুকটা ফেটে যাচ্ছে?ও কি সারাক্ষণ ঘুমাবে নাকি?একটু পড়েই উঠে যাবে।তখন ইচ্ছামতো চুমু দিও।
কুশান এবারও কিছু বললো না।
তোড়া তখন কাপড় গুছানো বাদ দিয়ে এগিয়ে এসে কুশানের ঘাড়ে হাত দিয়ে বললো,
কুশান?কি হইছে তোমার?কোনো কথা বলছো না যে?এই বলে তোড়া কুশানের মুখ টি উপরে তুললো।কিন্তু কুশান তার মুখটি উপরে তুলতে দিলো না।তোড়া তখন নিজেও কুশানের সামনে গিয়ে বসলো।আর আবার জিজ্ঞেস করলো,কি হয়েছে তোমার?আমি সেই থেকে একাই শুধু বকর বকর করছি।তুমি কিছুই বলছো না।না,মেয়েকে পেয়ে আমাকে একদম ভুলেই গেলে।একদিনেই দেখি আমার জায়গা মেয়ে কেড়ে নিলো।
কুশান হঠাৎ তোড়াকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।
এই জড়িয়ে ধরা ব্যাপারটা কিন্তু মারাত্মক সুন্দর।
মন খারাপে, রাগে, অভিমানে, ক্ষোভে প্রিয় মানুষটাকে জড়িয়ে ধরলেই অনেকের এক নিমেশেই সকল মন খারাপ ভালো হয়ে যায়। মাঝে মাঝে কোন যৌ*ন আবেদন ছাড়াও প্রিয় মানুষটাকে কাছে টেনে এভাবে জড়িয়ে ধরতে হয়।
এতে করে বিপরীত মানুষটাও অনুভব করতে পারে জীবনের যেকোন মুহূর্তে অন্তত কেউ একজন আছে যে তাকে শক্ত করে বুকের মাঝে আগলে রাখবেই।একটুখানি মানসিক প্রশান্তি হয়ে তার পাশে থাকবেই। এই অনুভূতি টুকো মানুষকে স্বস্তি দেয়, ভরসা যোগায়।
তোড়া বুঝতে পারলো কুশানের আবার মন খারাপ হয়েছে।সে নিশ্চয় কোনো একটা বিষয় নিয়ে ভীষণ টেনশন করছে।সেই টেনশন এতোটাই তীব্র যে তাকে মানসিক অশান্তির মধ্যে রেখেছে।
তোড়া তখন আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না কুশানকে।সে নিজেও কিছুক্ষন জড়িয়ে ধরে থাকলো কুশানকে।তারপর কুশানকে উঠিয়ে বেডে নিয়ে যেতে ধরলে কুশান বললো,
যদি তুমি কোনোদিন শোনো যে ফ্যামিলিতে তুমি বড় হয়েছো,যাদের কে বাবা মা বলে ডাকছো তারা তোমার আসলে নিজের কেউ নয়।আর যে মানুষ টাকে তুমি বাহিরের মানুষ ভেবে এসেছো,যাকে কোনোদিন নিজের আপনজন বলে কল্পনাও করো নি সেই যদি তোমার নিজের রক্তের সম্পর্কের হয় তখন তোমার মনের অবস্থা কেমন হবে তোড়া?একবার এই সিচুয়েশনে নিজেকে বসিয়ে দেখবে একটু?আমার কেনো জানি ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।
তোড়া কুশানের কথা শুনে বেশ আশ্চর্য হলো।কুশান কি তাহলে তার ফ্যামিলির খোঁজ পেয়েছে?তোড়া তখন বললো,
তুমি কার কথা বলছো কুশান?কে তোমার ফ্যামিলির লোকজন?
কুশান চোখ মুছতে মুছতে বললো জারা আমার আপন বোন।আমরা জমজ ভাই বোন তোড়া।আর জেলে বন্দি সেই জামিলা আন্টিই আমার মা হয়?
তোড়া কুশানের কথার কি উত্তর দেবে? আর সে কুশানকে কিভাবে শান্ত্বনা দেবে সে ভাষাই খুঁজে পেলো না।জামিলাই যে কুশানের নিজের মা তোড়া এটা কল্পনাও করে নি কখনো।এটা কিভাবে সম্ভব?তার মানে জামিলা এই কারণেই সেলিনাকে মারতে চেয়েছিলো।আজ দিয়ে পুরো ব্যাপার টা ক্লিয়ার হয়ে গেলো তোড়ার কাছে।
তোড়া এবার কুশানকে তার বুকের সাথে ভালোভাবে জড়িয়ে ধরে রাখলো।আর কুশানকে বোঝাতে লাগলো সব ঠিক হয়ে যাবে কুশান।তুমি এতো বেশি চিন্তা করছো কেনো?তোমাকে চিন্তিত দেখলে সবার মন খারাপ হয়ে যাবে।নিজেকে শক্ত করো কুশান।জামিলা আন্টি ঠিক ছাড়া পাবে।আব্বু আর নানু তো চেষ্টা করছে?তাছাড়া তুমি কি ভাগ্যের উপর দিয়ে তোমার হাত বাড়াতে পারবে?সব ভাগ্যে লিখা ছিলো।তুমি তো নিজেও সবসময় এটাই বলো।
এরই মধ্যে আবার কামিনী সোলাইমান চৌধুরীর কাছে জানতে গিয়েছে সবকিছু।সোলাইমান চৌধুরী এখনি কামিনী কে কিছু বলতে চাইছিলো না।কিন্তু কামিনী এমন ভাবে জিদ ধরে বসলো যে সোলাইমান চৌধুরী কামিনী কে সবকিছু বলেই দিলো।
কামিনী সবকিছু শুনে নিজেও ভীষণ টেনশনের মধ্যে পড়ে গেলো।তার নিজের প্রতি এতো বেশি ঘৃণা হচ্ছিলো যে নিজেই নিজেকে চড় মারলো কয়েকটা। এটা তারা কি করেছে?জামিলার মতো এরকম অসহায় একটা মেয়ের কোল তারা কি করে খালি করতে পারলো?আজ ছেলেটা তার কাছে থাকলে কিছুটা হলেও জামিলা সুখ ফিরে এতো।এই দুনিয়ায় স্বামী ছাড়া একজন মেয়ের বেঁচে থাকা আর নিজে উপার্জন করে চলাফেরা করা সত্যি অনেক বেশি সাহসের কাজ।তার উপর জারাকেও লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করতে হয়েছে তাকে।কামিনী কোন মুখ নিয়ে আর কুশানের সামনে যাবে।নিশ্চয় কুশান সবকিছুর জন্য তাকেই দোষারোপ করছে।এখন কি করে সে তার কুশানের মুখে হাসি ফোঁটাবে?কামিনী মনে মনে ভীষণ অসুস্থ হয়ে গেলো।কারণ এই অপরাধবোধ বার বার তার মনে জেগে উঠতে লাগলো।
সুলেমান চৌধুরী আর জারিফ চৌধুরী প্রানপন চেষ্টা করছে জামিলাকে ছাড়িয়ে আনার জন্য।তারা যে করেই হোক কুশানের মুখের সেই হাসি ফেরত আনতে চায়।আগের সবকিছু ভুলে এখন অন্তত কুশান তার মায়ের সাথে যাতে থাকতে পারে এখন সেই ব্যবস্থায় করবে সবাই।
🖤
আজ কথামনির জন্মের সাতদিন হলো।আজকেই আকীকা সম্পন্ন করানোর কথা ছিলো তার।কিন্তু কুশানের মন ভালো নেই বিধায় অনুষ্ঠান পিছিয়ে নেওয়া হলো।সোলেমান চৌধুরী নিজে ঘোষণা দিলেন ২১ দিনের মাথায় আকীকা করানো হবে।কুশান সেই কথা শুনে বললো,
নানুভাই আমি ঠিক আছি।কিছুই হয় নি আমার।আপনারা ডেট পিছায়েন না।সাতদিনে করার কথা ছিলো সাতদিনের দিনই হবে আকীকা।
সোলেমান চৌধুরী সেই কথা শুনে বললো,
তুই কি আমার থেকে বেশি বুঝিস?আমি ২১ দিনের দিনে করতে চাচ্ছি সেজন্য সেদিনই হবে।কুশান সেজন্য আর কোনো জিদ করলো না।সে চুপচাপ থাকলো।
এইভাবে দেখতে দেখতে ২১ দিনের দিন আসলো।অনেক মেহমান কে ইনভাইট করেছে সোলেমান চৌধুরী আর জারিফ চৌধুরী।কুশান বার বার বলেছিলো কোনো অনুষ্ঠান করতে চায় না সে।শুধুমাত্র কয়েকজন নিকটতম আত্নীয়স্বজনকে নিয়ে আকীকা সম্পন্ন করা হবে।কিন্তু সোলেমান চৌধুরী কিছুতেই শুনলো না সে কথা।তিনি বিরাট বড় অনুষ্ঠান এর আয়োজন করলেন।কুশান আর তোড়ার নতুন করে বিয়ের অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিলো সেটাও আর হলো না। সেজন্য কুশানের মেয়ের আকীকার অনুষ্ঠানে সমস্ত মেহমানদের ডাকা হলো।
কুশান রেডি হওয়া বাদ দিয়ে তার মেয়েকে কোলে করে বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে আছে।আর দূরে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে।
তোড়া তা দেখে বললো কুশান মেয়েকে আমার কোলে দাও।আর তুমি রেডি হয়ে নাও।নানু ঝটপট রেডি হতে বললো।
কুশান তা শুনে বললো, নানু একটু বেশি বেশি করছে।উনি কি জানেন না আমার মন ভালো নেই।তারপরেও এতো বড় আয়োজন কেনো করেছেন উনি?আমার এসব ভালো লাগছে না তোড়া।তুমি রেডি হয়ে চলে যাও।আমি যাবো না কোথাও।এই বলে মেয়েকে তোড়ার কোলে দিয়ে বেলকুনি থেকে রুমের ভিতর চলে গেলো কুশান।
তোড়া আর কুশানকে কিছু না বলে মেয়েকে রেডি করে চামেলি বেগমের কোলে দিলো।আর সে কুশানের পাশে এসে বসলো।
কুশান অন্য মুখ হয়ে আছে তোড়া তখন বললো,
কুশান!তোমার খুশির জন্যই কিন্তু এই আয়োজন করা হয়েছে।যাতে সবাইকে দেখে তোমার কিছুটা হলেও কষ্ট দূর হয়।তোমার এমন গোমড়া মুখ দেখতে কারো ইচ্ছা করছে না কিন্তু।
কুশান সেই কথা শুনে বললো,
যাকে দেখলে আমি খুশি হবো এখন,যাকে দেখলে আমার সমস্ত কষ্ট দূর হয়ে যাবে সেই মানুষটিকেই কেউ হাজির করতে পারলো না।তখন অন্য মানুষ কে দেখে আমার মনে কি করে শান্তি ফিরে আসবে?
“তোমার বোন জারাও কিন্তু এসেছে।” তুমি ওর সাথে কথা বলেও তো নিজের কিছুটা কষ্ট দূর করতে পারো।”
“আমার মাকে দেখতে চাই আমি।তাকে এনে দাও তোমরা।না যদি আনতে পারো তাহলে আর কোনো কথা বলো না তোমরা।”
তোড়া কুশানের এমন মেজাজ দেখে আর কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইলো না। সে চলে যেতে ধরলো।
কুশান তখন বললো,
আম্মু কই?আম্মু কেনো জানি আর আমার রুমে আসে না?
“কিভাবে আসবে তোমার রুমে?তুমি তার সাথে ঠিক করে কথা বলেছো এ কয় দিন?আসলে পর পরই হয়।যেই নিজের মায়ের খোঁজ পেলে আর সাথে সাথে তোমার এই আম্মুকে ভুলে গেছো।মানছি উনি অপরাধ করেছেন,কিন্তু উনি তো তোমাকে নিজের মায়ের মতো করেই বড় করেছেন।আর তুমি তাকে কথাও দিয়েছো কোনো দিন কষ্ট দিবে না,বা তাকে ছেড়ে যাবে না।”উনি যে অসুস্থ সেটা জানো?
কুশান তোড়ার কথা শোনামাত্র কামিনীর রুমে চলে গেলো। কামিনী রুমের মধ্যেই শুয়ে আছে।এ কয় দিন ধরে তার শরীর টা ভালো যাচ্ছে না।এতো টেনশনের মধ্যে কি ভালো থাকা যায়?
কুশানকে রুমে দেখামাত্র কামিনী উঠে বসলো।আর বললো,
বাবা তুই?কিছু বলবি?
কুশান কোনো কথা না বলে কামিনীর হাত ধরে বললো,
আম্মু ক্ষমা করে দিও আমাকে।আমি তোমাকে অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলছি।তোমার খোঁজখবর পর্যন্ত রাখি নি।তুমি নাকি অসুস্থ।কি হয়েছে আম্মু তোমার।
কামিনী তা শুনে বললো,কিছু হয় নি বাবা।আমি ঠিক আছি।আর কিসের কষ্ট বাবা?তুই তো কোনো কষ্ট দিস নি আমাকে।কষ্ট তো আমি তোকে দিয়েছি।আমার জন্য তুই তোর নিজের মায়ের কাছে থাকতে পারছিস না।আমার জন্য তোর মা আজ জেলে।আমার কি শাস্তি হলে তুই খুশি হবি সেই শাস্তিই দে আমাকে।এই অপরাধবোধ নিয়ে আমি আর বেঁচে থাকতে পারছি না।নিজেই নিজেকে শেষ করার ইচ্ছা হচ্ছে আমার।
কামিনীর কথা শুনে কুশান তার আম্মুকে জড়িয়ে ধরে বললো, আম্মু প্লিজ চুপ করো।এভাবে বলো না তুমি।তোমার উপর সত্যি আমার কোনো রাগ নেই।
হঠাৎ জারিফ চৌধুরী রুমে প্রবেশ করলেন।আর কুশানকে বললেন,
বাবা কুশান আমরা তোকে কি দিয়েছি জানি না তবে আমাদের কারণেই যে তোর মাকে ছেড়ে তোকে এতোদিন থাকতে হয়েছে এটা তো আর মিথ্যা না।তুই মনে মনে আমাদের নিয়ে যেটাই ভাবিস না কেনো আমরা কখনোই তোর ক্ষতি চাই নি।তোর জীবন থেকে যে দিন গুলো হারিয়ে গেছে সেগুলো আর ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়,আমরা ইচ্ছা করলেও আর ফিরিয়ে দিতে পারবো না।তবে বাকি জীবন টুকু যাতে তুই তোর মায়ের সাথে কাটাতে পারিস তার জন্য তোর নানু আর আমি অনেক চেষ্টা করেছি।আর আজ আমরা সফলও।
কুশান জারিফ চৌধুরীর কথা শুনে একদম চমকে উঠলো।
জারিফ চৌধুরী তখন বললো,জামিলা পাঁচ দিন আগেই ছাড়া পাইছে।আজকের দিনে অনুষ্ঠান করার একমাত্র উদ্দেশ্য তোর মায়ের সাথে সবার পরিচয় করে দেওয়া।তুই যে জামিলার ছেলে সেটা তোর নানু আজ সকল মেহমানদের সামনে ঘোষনা করতে চায়।
জারিফ চৌধুরীর কথা শুনে কুশানের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগলো।এদিকে কামিনীও কাঁদছে।
জারিফ কামিনী কে কাঁদা দেখে বললো, তুমি আবার কাঁদতেছো কেনো?অন্যজনের ছেলেকে আর কত দিন নিজের নামে চালাতে চাও?এবার যার সন্তান তাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দাও।খবরদার কান্দাকাটি করবে না।
কামিনী তখন বললো,
তুমিও তো কাঁদছো?তুমি কতদিন এভাবে অন্যজনের ছেলেকে নিজের বাড়ি রাখতে চাও।যার ছেলে তার হাতে স্বসম্মানে তুলে দাও।আমি নিজেও আর অন্যজনের ছেলে রাখতে চাই না এই বাড়িতে।
কুশান তখন চিৎকার করে বললো,
তোমরা প্লিজ চুপ করবে এবার।এরকম করতেছো কেনো তোমরা?আমি কখন বললাম আমি আর থাকবো না এই বাড়িতে আর কখন বলেছি তোমাদের অস্বীকার করবো।আমি যতদিন বেঁচে থাকবো ততোদিন পর্যন্ত তোমরাই আমার বাবা মা হয়ে থাকবে।আর কখনো যেনো শুনি না আমি এই কথা।
এবার সোলেমান চৌধুরী প্রবেশ করলো রুমে আর কুশানকে বললো, যা তোর মায়ের সাথে কথা বল।আর কামিনী তুই ও যা।জামিলার কাছে ক্ষমা চেয়ে নে।নিজের অপরাধ স্বীকার কর।আজকের এতোকিছু সব তোর জন্য হয়েছে।তোকে খুন করলেও আমার মনের দুঃখ যাবে না।
কুশান তখন বললো,
নানু!কি বলছো এসব?আম্মুকে বকছো কেনো তুমি?আম্মু কে বকবে না খবরদার।আর আম্মু কারো কাছে ক্ষমা চাইবে না।আমার আম্মুকে আমি কারো কাছে ছোটো হতে দিবো না।দরকার হলে আমি ক্ষমা চেয়ে নেবো।
এই বলে কুশান জামিলার সাথে কথা বলতে গেলো।
এদিকে কামিনী গলা ফাটিয়ে কাঁদতে লাগলো।তার আজ এতো কষ্ট কেনো হচ্ছে।কুশান তার মাকে ফিরে পেয়েছে,তার তো খুশি হওয়ার কথা।এ কয় দিন ধরে তো সে এই দোয়ায় করতে লাগলো যাতে কুশান আর জামিলার দেখা হয়।
🖤
জামিলা ছেলের জন্য রুমে অপেক্ষা করছে।সে বুঝতে পারছে না ছেলেকে দেখার পর তার মনের অবস্থা কেমন হবে?এতোদিন কুশানকে অন্যজনের ছেলে ভেবে এসেছে সে।আজ যখন সেই কুশানই তার নিজের সন্তান আর তাকেই মা বলে ডাকবে সেই অনুভুতি টা কেমন হবে?
হঠাৎ কুশান প্রবেশ করলো রুমে।জামিলা তার জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রইলো।কিন্তু কুশান এগিয়ে গেলো জামিলার কাছে।মা ছেলে দুইজনই চুপচাপ। কি দিয়ে শুরু করবে দুইজন সেটাই ভুলে গেলো।অথচ এ কয় দিন ধরে দুইজনই পাগল ছিলো দুইজনকে দেখার জন্য।মা তার ছেলেকে কিভাবে কাছে টেনে নেবে আর ছেলেই বা তার মাকে কিভাবে ডাকবে কত প্রস্তুতি হচ্ছিলো মনে মনে।আজ সব প্রস্তুতি গোল্লায় গেলো তাদের।
চলবে,#আমি_ফাইসা_গেছি(৪৫)
#অন্তিম_পর্ব
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ
আন্টিকে হঠাৎ করে কিভাবে সরাসরি মা বলে ডাকা যায়?এতোদিন কুশান যাকে আন্টি বলে ডেকেছে আজ হঠাৎ করে তাকে মা বলে ডাকতে ভীষণ ইতস্তত বোধ করতে লাগলো কুশান। সেজন্য কুশান জামিলার দেখা পেয়েও বোবাগুলোর মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।অথচ মনে মনে জামিলার প্রতি তার ভালোবাসা যেনো উপচে উপচে পড়ছে।সে এতোদিন ভেবেছে যেদিন তার মায়ের সাথে ফাস্ট দেখা হবে সেদিন তাকে সাথে সাথে বুকে জড়িয়ে ধরে মা মা বলে ডাকবে।তার পায়ে পড়ে কামিনীর হয়ে ক্ষমা চাইবে।কিন্তু আজ সবকিছু উলটো হয়ে যাচ্ছে।
এদিকে জামিলা বুঝতে পারলো কুশানের মনের অবস্থা। কুশান যে তাকে মা বলে ডাকতে লজ্জাবোধ করছে এটা আর বুঝতে বাকি রইলো না তার।সেজন্য জামিলা নিজেই কথা বললো কুশানের সাথে।
জামিলা জিজ্ঞেস করলো, বাবা তুমি কেমন আছো?
কুশান উত্তর দিলো জ্বি ভালো আছি।তারপর আর কুশান নিজের থেকে কিছু জিজ্ঞেস করলো না।সে কিছু বলতে ধরে বার বার আটকে যাচ্ছে।কুশান সেজন্য আজ নিজেই নিজেকে চিনতে পারছে না।সে বুঝতে পারছে না এমন কেনো হচ্ছে তার সাথে?কেনো সে জামিলার সাথে কথা বলতে পারছে না?
জামিলা কুশানের এমন নিশ্চুপতায় ধরে নিলো নিশ্চয় কুশান তাকে মন থেকে মেনে নিতে পারে নি।সেজন্য জামিলা কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
বাবা কুশান!তুমি আমাকে আন্টি বলেই ডাকো বাবা।তবুও কথা বলো আমার সাথে।তোমার কথা শোনার জন্য আমার বুকটা একদম ফেটে যাচ্ছে।তোমাকে মা বলে ডাকতে হবে না বাবা।আমি তোমাকে বড় করি নি ঠিক আছে কিন্তু জন্ম তো দিয়েছি।সেই হিসেবে একটু তো অধিকার আমার আছেই।প্লিজ বাবা কিছু বলো।
কুশান জামিলার মুখে এরকম কথা শুনে একদম কেঁদেই ফেললো।সে সাথে সাথে জামিলাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
মা এসব কি বলছেন?মা তো মা ই।মা কে আবার কেউ আন্টি বলে ডাকে নাকি।পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর ডাক হলো মা। মায়ের কোনো তুলনা হয় না।দয়া করে আমাকে ভুল বুঝবেন না আপনি।আমি আপনাকে মন থেকেই মেনে নিয়েছি।আসলে এতো দিন ধরে শুধু একজনকেই মা ডেকে আসছি।সেজন্য হঠাৎ করে তাকে বাদ দিয়ে আপনাকে মা ডাকতে ভীষণ শঙ্কা লাগছে আমার।তাই বলে ভেবে নিয়েন না আপনাকে আমি অস্বীকার করছি।
আমার জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা, আমাকে দেখাশোনা করানো, সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা- সব অন্য মায়ের হাতে হলেও আপনি যে আমার গর্ভধারিণী মা এটা তো কখনোই অস্বীকার করতে পারবো না।
জামিলা কুশানের মুখে এরকম কথা শুনে নিজেও কাঁদতে লাগলো।কুশান যে তাকে এতো সহজে মেনে নিবে সত্যি জামিলা বুঝতে পারে নি।
মা আর ছেলে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকলো।মনেই হচ্ছে না তাদের আজ মা ছেলের ফাস্ট আলিঙ্গন এটা।কেমন যেনো স্পর্শ টা চেনা চেনা লাগছে দুইজনের ই।মনে হচ্ছে কত বছর ধরে চেনা পরিচয় তাদের।আসলে মায়ের সঙ্গে সন্তানের এই মধুর সম্পর্ক টা যে সৃষ্টির শুরু থেকেই।এই সম্পর্ক কখনো ভোলার নয়।
কুশান হঠাৎ জামিলার পায়ে ধরে বললো,
আপনি দয়া করে আমার কামিনী আম্মুকে ক্ষমা করে দিয়েন।মনের ভিতর ওনার উপর কোনো ক্ষোপ বা অভিমান রাখিয়েন না।প্লিজ আমার এই রিকুয়েষ্ট টা রাখিয়েন মা।
“ছিঃ বাবা। কি করছো?ওঠো।” এই বলে জামিলা কুশানকে তার পা থেকে নিজে ওঠালো আর বললো,
কামিনীর উপর আমার বিন্দুমাত্র অভিমান নাই বাবা।তাছাড়া এ ফ্যামিলির প্রতিটা সদস্য দের কাছে আমি আগে থেকেই ঋনি।তোমরা সবাই আমার মেয়েটাকে নতুন করে সংসার দিয়েছো।এখন আবার সুলেমান চৌধুরী আর জারিফ চৌধুরী কত পরিশ্রম করে আমাকে ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করলো।ওনাদের কারো প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নাই।
কুশান জামিলার কথা শুনে বললো,আপনি সত্যি অনেক ভালো একজন মানুষ। কত সহজে আম্মুকে ক্ষমা করে দিলেন।সত্যি আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি আপনার গর্ভে জন্ম নিয়ে।
জামিলা তখন বললো, তোমার কামিনী আম্মু কোথায়?ওনার সাথে আমি কথা বলতে চাই।নিশ্চয় উনি তোমার টেনশনে একদম শেষ হয়ে যাচ্ছেন।উনি যে তোমাকে কত বেশি ভালোবাসেন তা আমি নিজের চোখেই দেখেছি।তুমি সেদিন অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায় তোমার মাও সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে গেলো।সত্যি তুমি অনেক বড় ভাগ্যবান এমন মাকে পেয়ে।
কুশান জামিলার কথা শোনামাত্র তাকে কামিনীর কাছে নিয়ে গেলো।
এদিকে কামিনী ছেলেকে হারানোর ভয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে।জারিফ চৌধুরী এতো করে শান্ত্বনা দিচ্ছে তবুও কামিনী কিছুতেই থামছে না।
কামিনী কে এভাবে কাঁদা দেখে জামিলা এগিয়ে এসে বললো,
আপনি এভাবে কাঁদছেন কেনো আপা?আপনার ছেলেকে আমি নিয়ে গিয়ে কি করবো?আমি তো শুধু ওকে জন্মই দিয়েছে।কিন্তু আপনি ওকে বড় করেছেন,ওর দেখভালো করেছেন।ওর উপর পুরো অধিকার শুধু আপনারই আপা।এভাবে কাঁদলে আপনার ছেলেটাও কিন্তু ভীষণ ভেঙে পড়বে।প্লিজ কাঁদবেন না।
কামিনী জামিলার কথা শুনে তার কান্না থামানোর চেষ্টা করলো।তবুও দু চোখ বেয়ে বেয়ে বেয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়তে লাগলো কামিনীর।সে যে তার মনকে কিছুতেই বোঝাতে পারছে না।
কামিনীর চোখের পানি দেখে কুশান কামিনী কে জড়িয়ে ধরে বললো, আম্মু এখন প্লিজ একটু চুপ করো।তোমার চোখের পানি কিন্তু আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারছি না।মানুষ মারা গেলেও তো এভাবে কেউ কাঁদে না।প্লিজ আম্মু।আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না।এই তোমায় ছুঁয়ে কথা দিলাম।
কামিনী তখন কাঁদতে কাঁদতে বললো, আমি খুশিতে কাঁদছি কুশান।শেষ মেষ তুই যে তোর মাকে ফিরিয়ে পেয়েছিস সেজন্য কাঁদছি।আমি তোকে হারানোর ভয়ে কাঁদছি না।আর তুই কি আমার নিজের সন্তান নাকি?যে তোকে জোর করে ধরে রাখবো আমি?যার সন্তান তুই তার সাথেই থাকবি এখন।
জামিলা বেগম কামিনীর কথা শুনে বললো,
আপা আমি আবারও বলছি আপনার কুশানকে নিয়ে আমি কি করবো?আপনার ছেলে আপনার কাছেই থাকবে।ওকে যে আমি ফিরিয়ে পেয়েছি,আর ও আমাকে মা হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে এটাই অনেক বড় পাওয়া আমার কাছে।এর থেকে বেশি কিছু চাই না আমি।
কামিনী সেই কথা শুনে বললো, আপনি বললেই হবে নাকি?সারাজীবন আমি শুধু স্বার্থপর দের মতো নিয়েই যাবো।আপনার সন্তান এখন থেকে আপনার কাছেই থাকবে।যা কুশান,তুই তোর মায়ের সাথে চলে যা।
কুশান তার দুই মায়ের কথা শুনে বললো,
তোমরা প্লিজ এবার একটু দুইজনই চুপ থাকো।আমি কারো সাথেই যাবো না।না আমি কামিনী আম্মুর সাথে এ বাড়িতে থাকতে চাই না আমি জামিলা মায়ের সাথে তার বাড়ি যেতে চাই।আমি আমার বাড়ি থাকবো আজ থেকে।আর তোমরা দুইজন আমার সাথে থাকবে।যেহেতু আমি তোমাদের দুইজনেরই ছেলে হই সেজন্য ছেলে হিসেবে তোমাদের দুইজনের প্রতিই আমার কিছু দায়িত্ব আছে।আর আমার প্রথম আর প্রধান দায়িত্ব হলো তোমাদের দুইজনকে একসাথে নিয়ে একবাড়িতে বসবাস করা।
জারিফ চৌধুরী সেই কথা শুনে বললো, কি বলছিস এসব কুশান?কোথায় থাকতে চাচ্ছিস তুই?আমাদের ছেড়ে থাকতে পারবি? শুধু মায়েদের কথাই বললি।আমরা কার কাছে থাকবো?
কুশান সেই কথা শুনে হাসতে হাসতে বললো, আব্বু তুমিও কি মেয়ে দুই টার মতো পাগল হয়ে গেলে?আমি কাউকে ছেড়ে কোথাও যাবো না।আমরা সবাই মিলে এক বাসাতেই থাকবো।
জামিলা সেই কথা শুনে বললো কিন্তু কুশান আমি তোমাদের সাথে এ বাড়িতে থাকতে পারি না।আমার নিজস্ব একটা পরিচয় আছে।আমি সেখানেই থাকতে চাই।তুমি আগে যেখানে ছিলে সেখানেই থাকো।
কুশান সেই কথা শুনে বললো, তাহলে মনে হয় আপনি নিজেই আমাকে মন থেকে মেনে নেন নি মা।যদি মন থেকে মেনে নিতেন তাহলে এমন কথা বলতেন না।
“না মানে,,।আমি সেভাবে বলি নি বাবা।তুমি মন খারাপ করো না।আমি আসলে বলতে চাচ্ছি,,,,”
“” আমি এতো কথা শুনতে চাই না।আমি আমার দুই মা, আব্বু,নানু,আমার স্ত্রী সন্তান সবাইকে নিয়ে এক বাড়িতেই থাকবো।আর এটাই আমার ফাইনাল ডিসিশন।”
এদিকে বাহিরে সবাই কুশানের নতুন মাকে দেখার জন্য ভীড় ধরে আছে।কুশান আর দেরী না করে জামিলাকে সবার সাথে পরিচয় করে দিলো।সে মাঝখানে দাঁড়িয়ে তার দুই মাকে দুই পাশে নিয়ে সবাইকে তার মনের অনুভূতি সম্পর্কে জানালো।তারপর তার বোন জারাকেও পাশে নিলো।জারা যখন জানতে পারলো কুশান তার আপন ভাই সে তার নিজের খুশিকে ধরে রাখতে পারলো না।কারন সে নিজেকে ভীষণ দুঃখী আর নিঃসঙ্গ মেয়ে মনে করতো যার এই দুনিয়ায় মা ছাড়া কেউ নাই।সে সবসময় আফসোস করতো ইসঃ তার যদি একটা বাবা থাকতো, না হয় একটা ভাই বা বোন থাকতো।আজ কুশানকে ভাই হিসেবে পেয়ে জারা এতো বেশি খুশি হলো যে সে কাঁদতে কাঁদতে বললো, ভাইয়া আমি অনেক বেশি খুশি হইছি।আমি সত্যি বোঝাতে পারছি না কি পরিমান খুশি হইছি আমি।এই বলে সে কুশানকে জড়িয়েও ধরলো।কুশান নিজেও জারাকে বোন হিসেবে পেয়ে ভীষণ খুশি হলো।কুশান এবার শ্রাবণ এর সামনে গিয়ে বললো,
জারা কিন্তু আপন বোন হয় আমার।সেই হিসেবে তুমি কিন্তু আমার আপন দুলাভাই হও।বোনটার যত্ন করিও ভালো করে।এতোদিন যা যা করেছো সবকিছু ভুলে যাও।
শ্রাবণ কুশানের কথা শুনে জারার দিকে তাকালো।কারন শ্রাবণ ভেবেছে জারা নিশ্চয় তার নামে কম্পিলিন করেছে।তা না হলে এভাবে বলছে কেনো কুশান।
কুশান শ্রাবনকে এদিক ওদিক তাকানো দেখে বললো দুলাভাই চলেন এখন,আমার বোনের পাশে দাঁড়ান।এখন কয়েকটা ফ্যামিলি ফটো তোলা হবে।এই বলে শ্রাবণ কে জারার পাশে দাঁড় করালো কুশান।অন্যদিকে ইরা,মিরা,লিরা কে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা দেখে কুশান বললো, আপুরা?তোরা এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?যা আম্মুর পাশে গিয়ে দাঁড়া।ইরা,মিরা,লিরা সেই কথা শুনে বললো, ভাই আমরা তো তোর নিজের বোন নই।তুই তো এখন নিজের মা বোন সবার খোঁজ পেয়ে গেছিস।আমাদের কে কি আগের মতো আর ভালোবাসবি?
কুশান সেই কথা শুনে বললো না বাসবো না।তোদের কি কি কোনো কালে আমি ভালোবেসেছিলাম?
“এভাবে বলতে পারলি ভাই?”
“তো কিভাবে বলবো?তোরা যেভাবে কথা বলছিস আমিও সেই ভাবেই কথা বললাম।এখন বেশি কথা না বলে চুপচাপ আম্মুর পাশে গিয়ে দাঁড়া।আর দুলাভাই রা কই?
পিছন দিক থেকে তখন তিন ভাই একসাথে ডাক দিলো,এই যে আমরা এখানে।
কুশান তখন তার বোন আর দুলাভাইদের ও দাঁড় করালো।
কুশান এবার সবার উদ্দেশ্যে বললো,
আজকের দিনের এই খুশির মুহুর্ত টুকু আমি আমার আব্বু আর নানুর নামে উৎসর্গ করলাম।কারণ তারা না থাকলে আজকের এই মুহুর্ত টা কখনোই আসতো না।আমার আব্বু আর নানু সবসময় এভাবে আমার মুখে হাসি ফুটিয়েছেন। তারা কখনোই আমাকে কাঁদতে দেন নি।আমার মন খারাপ হলেই তারা আমার মন ভালো করার জন্য সবসময় উঠেপড়ে লেগেছেন।
সোলেমান চৌধুরী সেই কথা শুনে বললো, হইছে তোর প্রশংসা করা?যদি হয়ে থাকে তাহলে এবার তোর আসল খুশির মানুষ কে নিয়ে আয়?কই সে?তাকে কেনো দেখছি না?তাকেও ডেকে আন।
স্বর্ণা তখন কুশানের মেয়েকে এগিয়ে এনে বললো, এই যে এখানে।তোমরা সবাই আমাদের কথামনিকে তো একদম ভুলেই গেছো।
কুশান তার মেয়েকে দেখামাত্র দৌঁড়ে চলে গেলো স্বর্ণার কাছে।আর ওর কোল থেকে মেয়েকে নিয়ে ইচ্ছামত কয়েকটা চুমু খেয়ে বললো,
আমার আরেকজন খুশির মানুষ। যে দুনিয়ায় আসার সাথে সাথে আমি নিজে এতো টা চেঞ্জ হইছি যে, আমার এখন সমস্ত ভাবনা আমার মেয়েকে নিয়েই।
কামিনী আর জামিলা একসাথে এগিয়ে এসে বললো, দে আমার কোলে দে মনাকে।
কুশান দুইজনকে একসাথে আসা দেখে একবার কামিনীর দিকে তো আরেকবার জামিলার দিকে তাকাতে লাগলো।এখন সে কার কোলে দেবে তার মেয়েকে।
জামিলা তখন বললো, আচ্ছা তোমার আম্মুর কোলেই দাও ওকে।কামিনী তা শুনে বললো, না, না,কুশান।তোর মায়ের কোলেই দে।
কুশান এখন কার কোলে দেবে মেয়েকে সেটাই ভাবতে লাগলো।তখন জারিফ চৌধুরী এগিয়ে এসে বললো,
তোমরা দুইজনই হাত পাতো।
“কেনো?”
“আরে পাতো আগে হাত।তারপর বলছি।”
কামিনী আর জামিলা একসাথে হাত পাতলে কথামনিকে দুইজনার হাতের উপর রাখলো জারিফ চৌধুরী।আর বললো, আজ আমাদের কথামনি দুইজন দাদীর কোলে একসাথেই থাকবে। এই ক্যামেরা ম্যান ক্লিক ক্লিক করে কয়েকটি ছবি উঠিয়ে দাও তো।
সবাই জারিফ চৌধুরীর কথা শুনে একদম হো হো করে হেসে উঠলো।
কুশান হঠাৎ করে খেয়াল করলো এতো মানুষের ভীড়ে সবাই থাকলেও তোড়া তো নেই।তোড়া আবার কোথায়?কুশান তখন সবাইকে রেখে তার রুমে চলে গেলো।রুমে গিয়ে দেখে দিনের বেলাতেও রুম একদম অন্ধকার।জানালার পর্দা গুলো টেনে রাখা।কুশান তখন তোড়া তোড়া বলে চিৎকার করতে লাগলো।ঘর এমন অন্ধকার দেখে ভয়ে তার শরীর একদম শুকিয়ে গেলো।
কুশান তখন বেলকুনিতে চলে গেলো।গিয়ে দেখে তোড়া বেলকুনিতে একা একা দাঁড়িয়ে আছে।তোড়াকে দেখামাত্র কুশান ওকে জড়িয়ে ধরে বললো,
পুরো ঘর অন্ধকার করে এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেনো তোড়া?বাহিরে সবাই কত আনন্দ করছে আর তুমি একা একা দাঁড়িয়ে আছো?
তোড়া তখন উত্তর দিলো,
আমার কে আছে?যে আমি সবার সাথে গিয়ে আনন্দ করবো?কেউ কি আমার একবারের জন্য খোঁজ নিয়েছিলে?
কুশান তোমার এমন অভিমান মাখা কথা শুনে বললো,সরি।একদম ভুলে গিয়েছিলাম।এই মায়ে দের চক্ররে পড়ে সত্যি ভুলে গিয়েছিলাম।চলো এখন প্লিজ।
“না,যাবো না আমি।” এই বলে তোড়া বিছানায় গিয়ে শুইলো।”
কুশান তা দেখে নিজেও তোড়ার পিছু পিছু চলে গেলো।আর একলাফে সেও তোড়ার পাশে শুইলো।আর তোড়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
তুমি হলে আমার অভিমানী বউ।একটুতেই তুমি রেগে যাও।তোমার মান ভাঙাতে এখন আমার এক যুগ কেটে যাবে।তবুও তোমার অভিমানী মনের বরফ আমি গলাতে পারবো না কিছুতেই।প্লিজ সোনা নিজের থেকে তোমার অভিমানের বরফ টুকু গলিয়ে নাও না।আজ যে আমার তোমার অভিমান ভাঙার একটুও সময় নাই।হাতে সময় থাকলে এতো রিকুয়েষ্ট করতাম না কিন্তু।অন্যভাবে রাগ ভাঙিয়ে নিতাম।
তোড়া কুশানের কথা শুনে অন্য পাশ হলো।
কুশান তখন তোড়াকে পাশ ফিরিয়ে বললো,
প্লিজ তোড়া।এরকম করো না।তা না হলে কিন্তু জোর করে নিয়ে যাবো।
তোড়া এবার রাগ করে উঠে যেতে ধরলে কুশান ওর হাত টেনে ধরে বললো,
সময় টা অনেক খারাপ যাচ্ছে।ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কিছু করতে পারছি না।শুধু দিন আসতে দাও,তারপর খেলা দেখাবো।এই বলে কুশান জোর করেই তোড়াকে কোলে ওঠালো।
তোড়া তা দেখে চিৎকার করে বললো, কুশান ছেড়ে দাও।বাহিরে এতো লোকের মধ্যে তুমি আমাকে কোলে করে নিয়ে যাবে?
“হ্যাঁ যাবো।তুমি তো এটাই চাচ্ছো।”
“” নামিয়ে দাও আমাকে।আমি একাই যাচ্ছি।”
“না,দেবো না।”
এই বলে কুশান তোড়াকে কোলে করেই সবার মাঝে নিয়ে গেলো।
তোড়াকে এরকম কোলে করে আনা দেখে সবাই দৌঁড়ে গেলো কুশানের কাছে।আর জিজ্ঞেস করতে লাগলো কি হয়েছে তোড়ার?
তোড়া কিছু না বললেও কুশান বললো, ও পায়ে ব্যাথা পেয়েছে।সেজন্য আসতে পারছিলো না।কিন্তু আজ এতো বড় একটা খুশির দিনে ও ঘরে থাকবে সেটা কি মানা যায়?সেজন্য নিয়ে আসলাম।এই ক্যামেরাম্যান ছবি ওঠাও।আর তোমরা সবাই যে যার জায়গায় আবার দাঁড়িয়ে যাও।
এতোক্ষনে ফ্যামিলিটা কম্পিলিট হলো।
তোড়া এবার ফিসফিসিয়ে বললো,এই মিথ্যা কথাটা বলার শাস্তি কিছুক্ষন পর টের পাবে তুমি।যখন ব্যাথায় হাত টনটন করবে তখন কি করবে?তখন তো ঠিক নামিয়ে দেবে।
“সেটা পরে দেখা যাবে।এখন চুপচাপ ক্যামেরার দিকে তাকাও।
হঠাৎ কুশানের সায়কের দিকে নজর গেলো।এই খুশির দিনে সোনিয়া আর সায়কের বিয়ের এনাউন্সমেন্ট করলে কিন্তু মন্দ হয় না।যেই ভাবা সেই কাজ।কুশান এবার তোড়াকে নামিয়ে দিলো।
তোড়া তখন বললো, হাত লেগে গেছে নাকি?পাঁচ মিনিটও রাখতে পারলে না?
“শুধু মিনিট না,আমার যতক্ষন জীবন আছে ততোক্ষনই ধরে রাখতে পারবো তোমায় কিন্তু এখন আমার একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে।এই বলেই কুশান জারিফ চৌধুরীকে ডেকে নিয়ে ব্যাপার টা জানালেন।জারিফ চৌধুরী সেই কথা শুনে বললো,
ওদের প্রেমের কথা প্রকাশ করার কোনো দরকার নাই।আমি ঘটকের মাধ্যমে বিয়ের ব্যবস্থা করে দিবো।সবাই ভাববে এই বিয়েটা প্রস্তাবের মাধ্যমেই হয়েছে।
“” আব্বু তোমার এতো বুদ্ধি?”
“যে ফ্যামিলিতে যে নিয়ম।তোর নানু এসব প্রেম ভালোবাসা পছন্দ করে না।উনি শুনলে রাগ করবেন ভীষণ। এজন্য এ বুদ্ধি।তোর বিয়ে টাও কিন্তু আমি এভাবেই দিয়েছি।”
“মানে?” তুমি আগে থেকেই জানতে তোড়ার কথা?
“তো কি মনে হয় তোর?তোড়াকে দেখতে যাওয়া কাকতালীয় ভাবে হয়েছে?
কুশান একদম হা হয়ে গেলো।
জারিফ চৌধুরী তখন বললো,তুই লুকিয়ে তোড়ার সাথে প্রেম করছিস,ওর সাথে রোজ রোজ কথা বলেছিস,আবার ওর সাথে দেখা করতেও গিয়েছিস,
সব জানি আমি।তুই যেমন এসব কাজ লুকিয়ে লুকিয়ে করেছিস আমিও তেমন লুকিয়ে লুকিয়েই সব ব্যবস্থা করেছি।
কুশান সেই কথা শুনে বললো, তুমি লুকিয়ে সবকিছু না করে অন্তত আমাকে জানাতে পারতে ব্যাপার টা। তাহলে তোড়ার পরিবারের লোকজন কে সেদিন ওভাবে অপদস্ত হতে হতো না।তুমি নিজেও তো ওয়াশ রুমে যেতে যেতে একদম শেষ হয়ে যাচ্ছিলে।
জারিফ চৌধুরী তখন হাসতে হাসতে বললো কে জানতো তোরা লুকিয়ে লুকিয়ে আবার এই ফন্দি এঁটেছিস?সেদিনের কথা মনে হলে আর এভাবে লুকিয়ে কোনো প্রেমিক যুগল কে মিলিয়ে দিতে ভীষণ ভয় লাগে আমার।
কুশান জারিফ চৌধুরীর কথা শুনে একদম হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে লাগলো।অনেকদিন পর তার মুখে এরকম হাসি দেখা গেলো।
প্রস্তাবের মাধ্যমে সায়ক আর সোনিয়ার বিয়ে হয়ে গেলো।এদিকে সোনিয়ার বিয়ে হওয়ার পর থেকে স্বর্ণা আর সুমনের মধ্যে একটা ভাব গড়ে উঠলো।
জারিফ চৌধুরী যখন এদের প্রেমের ব্যাপার টা জানতে পারলো তখন তিনি আবার আরেকটা ফন্দি আঁটলেন কিভাবে এই দুই জুটিকে মিলাতে পারবেন।
আসলে জারিফ চৌধুরী প্রেম ভালোবাসাকে ভীষণ সাপোর্ট করেন।তিনি মনে করেন যে যাকে ভালোবাসে তার তাকেই বিয়ে করা উচিত।ভালোবাসার মানুষের সাথে বিয়ে হলে সেই কাপলদের আর আলাদা করে সুখ খুঁজতে হয় না।ভালোবাসার মানুষ কে বিয়ে করার মাঝে আছে আলাদা রকমের একটা তৃপ্তি। যেহেতু আগে থেকে তাদের চেনা পরিচয় থাকে নতুন করে কাউকে চিনতে হয় না আর জানতেও হয় না।
জারিফ চৌধুরী আর শায়লা দুইজন দুইজনকে ভীষণ ভালোবাসতো।কিন্তু তাদের ভালোবাসা কেউ সাপোর্ট করে নি বা তাদের কেউ হেল্পও করে নি।শায়লা মেয়েটার অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে যায়।
সেজন্য জারিফ চৌধুরী প্রতিটা কাপলদের মিলিয়ে দিলে যেনো অন্য রকম এক শান্তি খুঁজে পান।তার হারানো ভালোবাসাকে প্রতিটা কাপলদের মাঝে তিনি দেখতে পান।
🖤
দেখতে দেখতে কথামনির ছয় বছর পূর্ন হলো।সে সারাক্ষন এখন চিল্লায়ে চিল্লায়ে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে রাখে।কুশানের মেয়ে এতো বেশি জেদি আর রাগী হয়েছে যে বাড়ির প্রতিটা সদস্য কে সে দৌঁড়ের উপর ই রাখে সবসময়।কুশান আর তোড়ার কোল জুড়ে আরো একজন ছেলে সন্তান এসেছে।যে দেখতে অবিকল কুশানের মতোই হয়েছে।বড় হলে কেমন হবে সেটা এখনি বলা যাচ্ছে না।তবে মেয়ে যে পুরোপুরি তোড়ার মতো হয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
কুশান যখন তার একজন মা কে ডাকে তখন একসাথে তিনজন মা চলে আসে।সেজন্য কথামনি কুশান কে বলে,
বাবা তুমি বড্ড বোকা।তোমার একটুও বুদ্ধি নাই।আমি শিখিয়ে দিচ্ছি তোমাকে।যখন তুমি আমাকে ডাকবে তখন বলবে আমার লক্ষী মা কোথায়?আর যখন দাদীদের ডাকবে তখন বলবে আমার এক নাম্বার মা কোথায় আর আমার দুই নাম্বার মা কোথায়।
কুশান তার মেয়ের কথামতো সেভাবেই ডাকবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো। কিন্তু কামিনী আর জামিলা দুইজনই এক নাম্বার মা হতে চায়।কেউ আর দুই নাম্বার মা হতে চায় না।কুশান পড়ে গেলো আবার বিপদে।
কথামনি তখন জানিয়ে দেয় বাবা তাহলে শুধু তাকেই মা বলে ডাকবে।তোমাদের কাউকে মা বলে ডাকার প্রয়োজন নাই তার।কারণ তোমরা পুরাতন হয়ে গেছো।নতুন জিনিস দের কদর সবসময় বেশি।আমিই এখন বাবার একমাত্র মা। তাই না বাবা?
কুশান মেয়ের মন রক্ষার জন্য মাথা নাড়ে।কারণ সে যদি তার কথার অবাধ্য হয় তাহলে সারাদিন রাত ধরে চলবে তার অভিমান ভাঙানোর পালা।তবুও তার অভিমান ভাঙবে না।
কথামনি শুধু তার দাদীদের জায়গায় দখল করে নেয় নি,সে তোড়াকে পর্যন্ত কুশানের কাছে আসতে দেয় না।কথামনি সারাক্ষন কুশানের সাথেই থাকে।এমনকি রাতেও কুশানের গলা জড়িয়ে ধরেই সে ঘুমায়।কুশান অপেক্ষা করে কখন তার মেয়ে ঘুমিয়ে যাবে আর সে চুপি চুপি তোড়ার পাশে চলে যাবে।কিন্তু সেটা আর হয় না কখনো।কথামনি ঘুমিয়ে গেলে কুশান ধীরে ধীরে তাকে সরাতে ধরলে সে কুশানকে আরো জোরে জড়িয়ে ধরে ঘুমায়।এদিকে তোড়া রাগ করে ফুলে থাকে।মাঝে মাঝে সে কাঁদতে কাঁদতে বলে মেয়েকে পেয়ে আমাকে একদম তুমি ভুলেই গেছো।খবরদার আমার কাছে আর কখনোই আসবা না।
কুশান যে তোড়ার রাগ ভাঙাবে সে সুযোগ টাও দেয় না তার মেয়ে।তোড়ার সাথে সে আর আগের মতো একাকি সময় কাটাতেও পারে না।যখন জারিফ চৌধুরী নাতি নাতনিদের নিয়ে একটু বাহিরে বেড়াতে যায় তখন একটু সময় পায় তোড়া কুশান।তখন আবার জামিলা আর কামিনী গল্পের আসর বসায় কুশানের সাথে।কারন তারাও যে আর আগের মতো কুশানের সাথে ঠিকভাবে কথা বলতে পারে না।কারণ কুশানকে এখন তার মেয়ের সাথে সবসময় খেলতে হয়,তাকে গল্প শোনাতে হয়,তার প্রশ্নের জবাব দিতে হয়।অন্য কাউকে সে সময় দিতেই পারে না।
এভাবেই চলছে কুশানের জীবন।
সমাপ্ত