দুপাতার পদ্ম পর্ব -০১

সারারাত মেহের ঘুমাতে পারে নি। কারণ মাহি সারারাত জেগে ছিলো। তাই মেহেরও মাহির সাথে জেগে ছিলো। সকালে একটু ঘুম চোখে লেগে আসলেও ঘুমানোর সুযোগ হয় নি। আজ মেহেরের চাচার ছেলে আয়াত বিদেশ থেকে ফিরে আসবে তাই বাসায় অনেক কাজ। মা আর আর চাচীর সাথে টুকটাক কাজ করতেই নিজের ঘুমকে বিসর্জন দিয়ে নিচে নেমে আসলো। সব রান্না মা আর চাচীই করছে, মেহের সবকিছু কেটে দিচ্ছে বা ধুয়ে এগিয়ে দিচ্ছে। তাদের কাজ আর অল্প থাকতেই মেহের উপরে উঠে নিজের ঘরে গিয়ে দেখলো তার ছোট বোন কাসফি এখনো আয়নার সামনে বসে আছে। লাল রঙের একটা থ্রি পিস পরেছে। এমনিতে বাসায় কাসফি থ্রি পিস পরে না তবে আজ পরেছে। কৌতূহলী দৃষ্টিতে মেহের কাসফিকে বললো,
“কিরে কাসফি সকাল থেকে আয়নার সামনে কি করছিস তুই?”
মেহের আপুর দিকে তাকিয়ে দেখি সে আমার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে আছে৷ তাই আমি একটু ভাব নিয়ে বললাম,
“আজ আয়াত ভাইয়া এত বছর পর দেশে আসবে আর আমি একটু সাজুগুজু করব না এটা কি করে হয়, তুমিও না কিছুই বুঝো না আপু।”
“আচ্ছা বুঝেছি, এবার একটু মাহিকে কোলে নে তো। আমি ওইদিকে মা আর চাচীর সাথে বাকি কাজে একটু হাত লাগাই।”
মেহের আপুর থেকে মাহিকে কোলে তুলে নিলাম আর গালে আদর দিতে থাকলাম৷ মেহের আপু মুচকি হেসে নিচে চলে গেলো। আর মনে মনে আয়াত ভাইয়াকে নিয়ে ভাবতে লাগলাম। আমি যখন ভাইয়াকে শেষ দেখি তখন ক্লাস ফোরে পড়তাম। আর এখন নাইনে পড়ি। পাঁচ বছর পর দেখব। ভেবেই কেমন লজ্জা পেতে লাগলাম। তারপর মাহিকে নিয়ে খেলতে লাগলাম।

রান্নাঘরে মেহেরের মা ফরিদা বেগম আর আয়াতের মা আমেনা বেগম কাজ করছেন। মেহের তাদের কাছে গিয়ে বললো,
“মা চাচী তোমাদের কতটুকু আয়াত তো আর কিছুক্ষণের ভেতর চলে আসবে। বাবা এই মাত্র কল করে বললো চাচা আর বাবা আয়াতকে নিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে গেছে।”
“সব তো শেষ শুধু পায়েস টা বাকি আছে। আর পায়েস হলেই আমাদের কাজ শেষ।”
“চাচী এক কাজ করো তুমি গিয়ে গোসল টা সেড়ে ফেলো আমি না হয় পায়েস করে দিব। আর মা তুমিও যাও।”
“আচ্ছা ঠিক আছে কিন্তু মেহের তোরও তো গোসল বাকি আছে!”
“আয়াত এসেই আগে তোমাদের খুজবে তাই তোমরা যাও, আমি একটু পরে করলেও সমস্যা হবে না। আর মাহি কাসফির কাছেই আছে৷”
“ঠিক আছে।”
বলেই মা আর চাচী নিজেদের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। এদিকে আমি পায়েস বানাতে শুরু করলাম। আয়াতের আবার পায়েস খুব পছন্দের তাই এটা খুব মনোযোগ দিয়ে বানাতে লাগলাম। পায়েস হয়ে এলে নিজের ঘরে আলমারি থেকে একটা সুতির শাড়ি বের করে গোসলে যাব ঠিক তখনই গাড়ির শব্দ শুনতে পেলাম। এক মুহূর্ত দেরি না করে গোসলে চলে গেলাম, আয়াত এসে গেছে। কত বছর পর ফিরেছে দেশে, কি নিয়ে যে তার রাগ এটাও আজ অবদি কাউকে বললো না।

গাড়ির শব্দ শুনতে পেয়ে কাসফি মাহিকে নিয়ে দ্রুত উপর থেকে নিচে নেমে এলো। সিড়ি থেকেই আয়াতকে সে দেখতে পেলো। মোবাইলে ভিডিও কলে যেমন দেখেছে তার চেয়েও বেশি সুদর্শন লাগছে আয়াতকে৷ কাসফি নিজে নিজেই লজ্জা পেতে লাগলো। আয়াত সবার সাথে কথা বলে কাসফির কাছে এসে তার মাথায় একটা চাটি মেরে মাহিকে কোলে তুলে নিলো আর বললো,
“কিরে পিচ্চি কোথায় হারিয়ে গেলি, মোবাইলে তো আয়াত ভাইয়া আসো, কবে দেশে আসবে এসব বলে বলে কান ব্যাথা করে দিয়েছিস আমার। আর আজ কিনা আমি এসে দাঁড়িয়ে আছি আর তুই অন্য জগতে হারিয়ে গেছিস।”
কাসফি একটু লজ্জা পেয়ে বললো,
“তেমন কিছু না ভাইয়া, তুমি এসেছো আমার খুব ভালো লাগছে।”
“হুম তা কোথাও যাবি নাকি তুই, এভাবে সেজেছিস যে?”
“না এমনিতেই, কোনো আমাকে দেখতে খারাপ লাগছে নাকি!”
“আরে না তোকে তো আমাদের পিচ্চি পরী লাগছে।”
তারপর মাহিকে আদর করতে করতে সোফায় বসলো আয়াত। মেহেরের মা আয়াতকে বললেন,
“আয়াত বাবা তুই আগে ফ্রেস হয়ে নে তারপর খাওয়া দাওয়া করে সবার সাথে গল্প করবি।”
“ঠিক আছে।”
আয়াতের মা আয়াতের কোল থেকে মাহিকে নিয়ে ছেলের সাথে উপরে উঠে গেলো। মেহেরের মা কাসফির দিকে এগিয়ে বললো,
“এভাবে সঙ সেজে না বসে দেখে আয় মেহেরের হলো কিনা, আয়াত এসে গেছে বলে আয় তাকে।”
“যাচ্ছি, কিন্তু একটু সেজেছি বলে এভাবে বলার কি আছে! হুহ।”
“আরে ভাবি এভাবে বলছো কেনো আমাদের কাসফি মামনিকে তো খুব সুন্দর লাগছে।”
আয়াতের বাবা আফজাল সাহেব বললেন। তার সাথে যোগ দিয়ে মেহেরের বাবা আরমান সাহেব বললেন,
“ঠিক আয়াত একদম ঠিক বলেছে আমাদের কাসফিকে একদম পিচ্চি পরী লাগছে।”
বাবা আর চাচার কথা শুনে কাসফি খুশিতে নাচতে নাচতে নিজের বোনের রুমে চলে গেলো। মেহেরের রুমের সামনে এসে দেখে মেহের মাত্র বাথরুম থেকে বের হয়ে চুল মুছছে।
“একি আপু তাড়াতাড়ি করো আয়াত ভাইয়ে সে কখন এসেছে, আর তুমি এখনো দেখা করোনি!”
“হুম এইতো হয়ে গেছে আমার। তা মাহি কোথায়?”
“তোমার মেয়ে আয়াত ভাইয়ার সাথে ভাইয়ার রুমে গেছে।”
“ওহ আচ্ছা। ঠিক আছে তুই যা আমি আসছি।”
কাসফি নিচে সবার কাছে চলে গেলো। আর মেহের নিজের চুল কোনমতে মুছে নিচে চলে এলো। মেহের নিজের মা আর চাচীর সাথে খাবার টেবিলে খাবার সাজাচ্ছিলো। আর কাসফি মাহির সাথে সোফায় বসে খেলছে৷ তখনই আয়াত ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে এলো৷ সিড়ি দিয়ে আসতে আসতে তার নজর পরলো মেহেরের উপর। ঠিক আগের মতোই সাদামাটা চলাফেরা। গোসল সেড়ে চুলগুলোও ভালো করে মুছে নি। সবার হাতে হাতে কাজ করতে নিচে নেমে এসেছে। মুখে প্রসাধনীর ছিটেফোঁটাও নেই। এতটা সাধারণ কেনো এই মেয়েটা সবসময় এই প্রশ্নটাই ঘুরপাক খায় আয়াতের মাথায় আয়াতকে সিড়িতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আয়াতের মা আয়াতকে বললো,
“কিরে ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো, নিচে খেতে আয়। সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করে আছে একসাথে খাবে বলে।”
একটু হেসে আয়াত নিচে নেমে খাবার টেবিলের একটা চেয়ার টেনে বসে পরলো। মেহের আয়াতের উদ্দেশ্যে বললো,
“কেমন আছিস আয়াত?”
“এইতো ভালো আছি। তা তোমার কি অবস্থা?”
“এইতো ভালোই যাচ্ছে। আচ্ছা তুই খাওয়া শুরু কর।”
আয়াত টেবিলে তাকিয়ে দেখে সব রান্না আজ আয়াতের পছন্দের হয়েছে। কাসফি তাড়াতাড়ি এসে আয়াতের পাশের চেয়ারে বসে পরলো। সবাই খেতে বসে পরলো আর মেহের একটা প্লেটে অল্প খাবার নিয়ে সোফায় বসে নিজের মেয়ে মাহিকে খাওয়াতে লাগলো। দেড় বছরের মাহি তার খাওয়া নিয়ে অনেক বায়না। তাই মেহেরের মা বললো,
“মেহের তুই আগে খেয়ে নে তারপর না হয় মাহিকে খাইয়ে দিস।”
“এইতো মা হয়ে গেছে আর অল্প আছে।”
তারপর সবাই খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। আয়াতের খাওয়া শেষ হতেই মেহেরের মা এক বাটি পায়েস এনে আয়াতকে দিলো। আয়াত পায়েস দেখে খুশি হয়ে তা খাওয়া শুরু করলো। খাওয়ার মাঝে সে বললো,
“এটা তো চাচী বা মা তোমরা রান্না করো নি, কারণ আমি তোমাদের হাতের রান্না চিনি। এটা কে রান্না করলো?”
আয়াতের মা হেসে বললো,
“ঠিক বুঝতে পেরেছিস। এটা আমি বা তোর চাচী না এটা তো আমাদের মেহের রান্না করেছে।”
আয়াত এক পলক মেহেরের দিকে তাকিয়ে আবার পায়েস খেতে লাগলো। দুপুরের খাবার শেষ করে যে যার রুমে বিশ্রাম নিতে চলে গেলো।

মেহের মাহিকে ঘুম পাড়িয়ে কাসফিকে জিজ্ঞেস করলো,
“কাসফি আজ তোর টিচার আসবে না?”
“কি যে বলো আপু, আজ আয়াত ভাইয়া এসেছে আর আমি কিনা পড়ালেখা করবো! তাই তো স্যারকে আজ আসতে মানা করে দিয়েছি।”
“ক্লাস নাইনে পড়িস সামনে টেনে উঠবি এবার একটু মনোযোগ দে কাসফি।”
“ঠিক আছে ঠিক আছে ও না হয় আমি পড়ে নিব। কিন্তু আপু আয়াত ভাইয়া আমাদের জন্য কি এনেছে তা তো দেখা হয় নি।”
“আয়াত এখন টায়ার্ড, যখন ও রেস্ট নিয়ে উঠবে তখন দেখাবে। এখন চুপ থাক মাহি ঘুম থেকে উঠে যাবে।”
“আপু আমি একটু ভাইয়ার রুমে যাই, গিয়ে দেখি ভাইয়া কি করে?”
“একদম না আয়াত এখন ঘুমাচ্ছে একদম ওকে বিরক্ত করবি না।”
মেহেরের কথা শুনে কাসফি একটা মুখ ভেঙচি দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পরলো। আর মনে মনে ভাবলো,
“তুমি একটু ঘুমাও খালি তারপর আমি ঠিকই ভাইয়ার রুমে যাব। সবার আগে আমি আমার জিনিসগুলো ভাইয়া থেকে নিয়ে নিব।”

চোখ মেলে কাসফি দেখলো দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে দেখে নিচের বসার ঘরে সবাই বসে চা আর নাস্তা খাচ্ছে।
“আমার কি খুব দেরি হয়ে গেলো, আয়াত ভাইয়া মনে হয় সবার গিফট দিয়ে দিয়েছে আমিই একা ঘুমিয়ে ছিলাম।,”
আয়াত কাদো কাদো মুখ করে নিচে নেমে আয়াতকে জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি কি সবাইকে সবার গিফট দিয়ে দিয়েছ?”
“আরে বোকা নাকি আমাদের কাসফি পরীকে ছাড়া কি আমি ব্যাগ খুলব সেটা কি করে হয়! এইতো একটু পরেই সব খুলে দেখাবো কি এনেছি সবার জন্য।”
“আমি জানতাম তুমি কখনোই আমাকে ছাড়া ব্যাগ খুলবে না।”
“আচ্ছা তোরা বস আমি একটু ছাদ থেকে আসি।”
বলেই আয়াত সিড়ি বেয়ে চলে গেলো ছাদের উদ্দেশ্যে। ছাদের দরজা আগে থেকেই খোলা ছিলো। আয়াত ছাদের ভেতর পা রেখে দেখে মেহের দাঁড়িয়ে আছে। একটু কাছে এগিয়ে যেতেই দেখে মেহের খোলা অন্তরীক্ষের পানে চোখ বন্ধ করে আছে।

চলবে,,,,,

#দুপাতার_পদ্ম
#পর্ব_০১
#Writer_Fatema_Khan

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here