বসন্ত বিলাস পর্ব -০৫

#বসন্ত_বিলাস
#আমিনা_আফরোজ
#পর্ব:-৫

(কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ)

অভিদের স্কুল ছুটি হলো বিকেল চারটায়। আজ ক্লাস রুম থেকে আগেই বেরুলে মেহুল। আশেপাশে না তাকিয়েই খোলা মাঠটা পেরিয়ে চলে গেলো গেটের দিকটায়। অভি ভেবেছিল মেহুলের সাথেই যাবে আজ কিন্তু মেহুলকে একা একা চলে যেতে দেখে অভি ছুট লাগালো মেহুলের দিকে। পিছন থেকে মেহুলের নাম ধরে ডাক দিলো বার দুয়েক কিন্তু মেহুল পিছন ফিরে দেখে নি। অগত্যা অভিকে আরো জোরে ছুট লাগালো মেহুলের দিকে। স্কুলের গেট পেরোলেই শুরু হয় পিচ ঢালা রাজপথ। সেই রাজপথের বেশিরভাগটাই এখন
স্কুলের ছেলেপেলেদের হাতে। দলে দলে সবাই হেঁটে যাচ্ছে যে যার গন্তব্যের দিকে।

মেহুল একাই হাঁটছিল। মনটা আজ ভিষন খারাপ ওর। আজ অনেক দিন পর মন কেমনের দিন এসেছে মেহুলের জীবনে। এর আগে যখন একবার অভি মেহুলকে ফেলে শীতের ছুটিতে ওর মামা বাড়ি গিয়েছিল তখন এই মন কেমনের দিন এসেছিল মেহুলের কাছে, তাও সেইটা আজ থেকে বছর তিনেক আগের কথা যখন মেহুল আর অভি ক্লাস সেভেনে পড়তো। তারপর আর কখনোই অভি মেহুলকে একা ফেলে আর কখনোই একদিনের জন্যও দূরে ঘুরতে যায় নি। আর সেই অভিই কি না গতকাল গোটা একটা রাত আর আজকের সারাটা দিন ওর সাথে কথা না বলে কাটিয়ে দিলো! এতোটা বদলে যায় মানুষ, যে পুরোনো অভ্যেস, পুরোনো মানুষ সবকিছু ভুলে যায়।

মেহুলের হঠাৎ ভিষন কান্না পেলো। বুকের বা পাশটাতে শুরু হলো তীব্র ব্যাথা। পায়ের গতি শিথিল হয়ে এলো, চোখ দুখানা ভরে গেলো নোনা পানিতে। ঠিক সেসময় অভি এসে হাত ধরলো মেহুলের। শক্ত হাতের মুঠোয় আবদ্ধ হলো নরম হাতখানা। মেহুল বার দুয়েক হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো বটে কিন্তু অভির সাথে পেরে উঠলো না। দুজনেই পাশাপাশি হেঁটে চলল। প্রথমে পার হলো মনা কাকার দোকান তারপর সুদীর্ঘ হাঁটা পথ। অবশেষে সরু গলির মোড়ে এসে মেহুলের নরম হাতটা ছেড়ে অভি মেহুলের কানের কাছে মুখ লাগিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,

–” তোকে ছেড়ে আসার কারনটা জানতে চাইলে সন্ধ্যার পর ছাদে চলে আসিস। অনেক কথা বলার আছে তোকে। ”

অভিকে এই প্রথম কাছে আসতে দেখে কেঁপে উঠল মেহুলের নরম শরীরটা। পুরুষালি কন্ঠস্বরে শিরশির করতে লাগলো মেহুলের শরীরের প্রতিটি লোমকূপ। বিদুৎ খেলে গেলো পুরো শরীর জুড়ে । বসন্তের এক দমকা হাওয়া এসে দোল দিয়ে গেল মেহুলকে। মেহুল মেকি রাগ দেখিয়ে বলল,

–” যে আমাকে কোন কারন ছাড়ায় চলে আসে তার ডাকে আমি সারা দেই না। ”

–” মন থেকে বলছিস তো?”

–” মন থেকে বলছি না তো কি অন্য কিছু থেকে বলছি নাকি। আমি ছাদে যাবো না ব্যাস।”

–” সে না হয় সন্ধ্যা বেলায় দেখা যাবে। চল এখন বাড়ি ফেরা যাক। বিকেল গড়াচ্ছে । এরপর আর দেরি করলে মা আর কাকিমা হয়তো চিন্তা করবে।”

মেহুল ভেংচি কাটল। বাড়ির দিকে পা বাড়িয়ে বলল,

–” আমার নিজেরো এখানে দাঁড়িয়ে থাকার কোন ইচ্ছে নেই। নেহাত কেউ হাত আটকিয়ে রেখেছিল এতক্ষন, নাহলে সে কখন বাড়ি চলে যেতাম।”

অভি হাসল কিন্তু প্রতিউত্তর করলো না। বরং মেহুলের নরম তুলতুলে হাতটা আবারো বাগিয়ে নিলো নিচের শক্ত মুষ্টিমেয় হাতের মুঠোয় ‌। অবসন্ন বিকেল, কুসুমরঙা আকাশ। ঝাঁঝে ঝাঁকে পাখি উড়ছে সেই কুসুম রঙা আকাশের এদিক সেদিক। সাদা মেঘগুলোয় যেন সে কুসুম রঙ ধারন করে রেখেছে নিজেদের গায়ে।সূর্যের সেই রঙ এসে পড়ছে মেহুদের বেনুনী করা চুলা, গালে আর স্কুল ড্রেসে। অভি তন্ময় হয়ে দেখে সে কাঁচা কমলা রঙখানা। বুকের বা পাশটায় হঠাৎ করেই শুরু হয় অন্য এক অনুভুতি। ধীরে ধীরে সেই অনুভূতির অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে থাকে অভি।

অবসন্ন বিকেল শেষ ধরনীতে ছড়িয়ে পড়েছে অন্ধকারের দল। কর্মমুখর জগতটায় সে অন্ধকারের সাথে মিশে গিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। যান্ত্রিক শব্দগুলোয় ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। মেহুল বিকেল বাড়ি ফিরে সেই যে নিজের ঘরে ঢুকেছে আর বেরোয়। মেহুলের মাও ওকে ঘাঁটাতে আসে নি আজ। মেহুল অভির কথাই ভেবে চলেছে এতক্ষন ধরে। ভেবে চলেছে তন্ময় হয়ে যাওয়া সেই দুটো চোখ নিয়ে। তবে মেহুলের অনুভূতির মতোই কি অভিরো নতুন অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে? নাকি অন্য কোন কারণ আছে এর পিছনে।মেহুল থমকালো, মুহুর্তেই চঞ্চল হয়ে ওঠলো চোখ । থাই গ্লাস দিয়ে অন্ধকার মাখা বাহিরটা দেখল। ছটফট করতে লাগলো মনের লুকানো অনুভূতির দলেরা। আর ঘরে থাকতে না পেরে শেষমেষ মেহুল ছুটলো ছাদের দিকে।

জ্যেৎস্না বিধৌত পৃথিবী। অনেক আগের তৈরী পুরোনো ছাদটা ফেসে যাচ্ছে চাঁদের শুভ্র আলোতে। ঝিরিঝিরি বাতাসে ভেসে আসছে বেলী ফুলের কড়া গন্ধ। মেহুল ছাদের এক কোনে দাঁড়িয়ে দূরের আকাশের চাঁদ দেখতে লাগলো। নীল আকাশে তখন সাদা সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছিল । দূরের তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে আচমকা মেহুলের মন খারাপ হয়ে গেল। কান্নার দমক ওঠলো ভেতর থেকে। অভি আসে নি তখনো। মেহুলের চোখের পানি যখন আঁখি পল্লব পেরিয়ে চিবুক বরাবর গড়াতে লাগল ঠিক তখনি একটা বলিষ্ঠ হাত এসে লুফিয়ে নিলো সে নোনা পানিটুকু। মেহুল এবার আর চমকালো না। এই বলিষ্ঠ হাতের অধিকারীকে ও চেনে, জানে, ভালোয়বাসে মানুষটাকে।

অভি মেহুলের চোখের পানি মুছে বলল,

–” কিছু মানুষের চোখের পানি অমূল্য হয়, সেগুলোকে এভাবে মাটিতে ফেলতে নেই।”

–” তাই বুঝি?”

–” হুম। তা এই ভর সন্ধ্যায় ছাদে এসে চোখের পানি ফেলছিলিস কেনো? আমার কথা মনে পড়ছিল বুঝি?”

মেহুল মুখ বাঁকিয়ে বললো,

–” না রে। ঐ তারাগুলো দেখে দাদুর কথা মনে পড়ছিল খুব । যদিও তাদের মুখটা আজ আর মনে নেই আমার। মনে থাকবেই বা কি করে বল? কত ছোট ছিলাম আমি। বছর দুই হবে। জানিস যেদিন বাবা গ্রাম ছেড়ে একেবারে চলে আসে সেদিন নাকি দাদু খুব কেঁদেছিল। আমি জন্মাবার পর বছর খানেক এসে ছিলেন আমাদের বাসায়। তারপর চলে গেলো না ফেরার দেশে। বাবা বলে আমি নাকি দাদুর প্রিয় নাতনী ছিলাম।”

অভি মেহুলের পিছনে এসে দাঁড়ালো। মেহুলের কমল পিঠ ঠেকল অভির বুক বরাবর। অভি গম্ভির গলায় বলল,

–” আমার ওপর রাগ করে আছিস এখনো?”

অভিকে এমন কাছে আসতে দেখে এমনিতেই মেহুলের অবস্থা খারাপ তখন। তারওপর গম্ভির কন্ঠস্বরে তখন ওর মর মর অবস্থা। কোন মতে মেহুল বলল,

–” বাহ্ রে ওনি আমার সাথে রাগ করে কথা বন্ধ করতে পারবেন,আর আমি রাগ করতে পারবো না?”

–” সরি বলছি তো। এখন কি আমাকে কান ধরতে হবে মহারানীর রাগ ভাঙ্গানোর জন্য? আসলে সেদিন রিয়াদকে তোর এত কাছে দেখে রাগ উঠে গিয়েছিল। তুই তো জানিস ছোট বেলা থেকেই আমি তোর পাশে অন্য কাউকেই সহ্য করতে পারি না। ”

–” এসেছেন আমার মহাপুরুষ । সত্যিটা না জেনেই চলে এলি কেন? সেদিন রিয়াদ আমার হাত ধরেছিল এইটা দেখলি অথচ কেন ধরেছিল সেইটা জানার ইচ্ছে হলো না।”

মেহুলের কথা শেষ না হতেই কোথা থেকে যেন এক দমকা হাওয়া এসে এলোমেলো করে দিল মেহুলের চুলগুলো। চুলের আলতো ঝাপটা এসে লাগলো অভির মুখেও। অভি আলতো করে সরিয়ে একপাশে রাখলো চুলগুলো। তারপর মেহুলের ফাঁকা কাঁধে নিজের চিবুক রাখলো অভি। রিনরিনে এক অনুভুতি ছড়িয়ে পড়লো দুজনেই শরীরেই। অভি কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে আবারো বলল,

–” আহা বাদ দে না। সরি বললাম তো। আর রাগ করে থাকিস না প্লিজ।”

মেহুল অভির দিকে মুখ ফিরাতেই মুখোমুখি হলো দুজনের মুখ। মেহুল অভির দিকে তাকিয়ে বলল,

–” দেখ আজ কত বড়ো চাঁদ ওঠেছে আকাশে। ”

অভির বুকের ভেতরে কেউ যেন তখন দামামা বাজিয়ে চলছিল। আনন্দ, ভয়, ভালোলাগা সব কেমন যেন একসাথে দলা পাকিয়েছে তখন। মেহুলকে আগে কখনোই এতটা কাছ থেকে দেখে নি অভি। চাঁদের স্নিগ্ধ আলো খেলা করছিল মেহুলের ভিজে যাওয়া গালটায়। অভি আজলায় অভি তুলে নেয় মেহুলের মুখটা। বহুদিনের বহু পুরোনো অনুভূতিগুলো আজ শিকল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে চাইছে যেন। নেশা জড়ানো গলায় অভি বলে,

–” আজ আমি শুধু তোকে দেখবো মেহুল। আজ আমি আমার চাঁদকে দেখবো শুধু।”

মেহুল মুচকি হেসে অভির পায়ের উপর ভর দিয়ে নিজের ঠোঁট দিয়ে স্শর্শ করে অভির ঠোঁট জোড়ায়। প্রথম। চুম্বনের উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে দুজনাতে। সময় থমকে যায়, থমকে যায় আশেপাশের কোলাহল। দুজন দুজনাতে মত্ত। অভি দুইহাতে জড়িয়ে নেয় মেহুলের শরীরটা। এক সময় মধুর সেই সময়ের সমাপ্তি ঘটে। মেহুল লজ্জায় মাথা নত করে অভির থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পিছাতে থাকে। আর অমনি পুরনো ছাদের নড়বড়ে হয়ে যাওয়া রেলিঙটায় ভর দিতেই ভেঙ্গে পড়লো সেটা। অভি হাত বাড়িয়ে মেহুলকে ধরতে গেলো কিন্তু পারলো না। মধ্যকর্ষণের টানে সেই ভাঙ্গা রেলিঙের সাথে সাথে মাটির দিকে গড়াতে লাগলো মেহুল।

চলবে

( আসসালামু আলাইকুম। আগের দিন বলেছিলাম একটা টুইস্ট থাকবে আজকের পর্বে। কেমন লাগলো টুইস্টটা? আজকের পর্ব নিয়ে মতামত জানাবেন। ভালো থাকবেন সবাই। )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here