বসন্ত বিলাস পর্ব -০৬

#বসন্ত_বিলাস
#আমিনা_আফরোজ
#পর্ব:- ০৬

–” একি কে আপনি? এমন হুটহাট আমার ঘরে ঢুকে পড়েছেন কেন?”

মেহুলের উচ্চস্বরে খানিকটা বিরক্ত হয় অভি । সবে সেই দিনের সেই দুর্ঘটনার সাতদিন পর আজ বাড়ি ফিরেছে মেহুল। এখন কি আর মেহুলের এমন দুষ্টমি করা সাজে? তাই একটু রুক্ষ স্বরেই অভি বলে,

–” দেখ মেহুল, এখন কিন্তু কোন রকম ইয়ার্কি ভালো লাগছে না আমার। এদিকে আয় , ভেজা চুলগুলো ভালো করে মুছে দেই। তাছাড়া ঠান্ডা লেগে যাবে তোর।”

মেহুল আবারো অবাক স্বরে বলে উঠল,

–” কে আপনি? আর এভাবেই বা আমাকে তুই তুই করেই বা ডাকছেন কেনো?”

মেহুলের কথায় অভি থমকালো। মনের কোনে ভীড় জমালো কালো মেঘের দল। অজানা আতঙ্কে কেঁপে উঠল অভির বুকটা। মেহুলের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে যেয়েও থেমে গেলো অভি। ভাবতে লাগলো এই মুহূর্তে অভির করণীয় কি? গত সাতদিন হাসপাতালের করিডরে পালা করে রাত জেগেছে অভি ও মেহুলের দুই বাড়ির সকলে। রাতের পর রাত প্রার্থনায় কেটেছে সবাই। তাই হয়তো বিপদ কেটে গেছে মেহুলের। হাসপাতাল থেকে ফেরার আগে ডক্টর মেহুলের সুস্থতা সম্পর্কে নিশ্চয়তা দিয়েছে। তবে গত সাতদিনে একটা মূহুর্তও মেহুলকে একা ছাড়ে নি অভি। সব সময় ছায়ার মতো থেকেছে ওর সাথে। তাহলে আজ কি মেহুলকে একা ছাড়তে হবে অভিকে?

মেহুলের চিৎকারে ঘরের ড্রয়িং রুম থেকে ছুটে এলেন মেহুলের মা। এতক্ষন তিনি মৃন্ময়ী দেবীর সাথেই আলাপ করছিলাম মেহুলের সুস্থতা নিয়ে। মেয়ের এমন চিৎকারে শঙ্কিত তিনি। ঘরে ঢুকে মেহুলকে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে দেখে মেয়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন,

–” কি হয়েছে মা? এভাবে চিৎকার করছিস কেনো? কোন অসুবিধা হচ্ছে তোর? ব্যাথা করছে কোথায়ও?”

মেহুল মাথা নাড়িয়ে না সূচক সম্মতি জানালো। অভি দূর থেকে বলল,

–” দেখো না কাকিমা তোমার মেয়ে কি বলছে? ও নাকি আমাকে চিনে না। এখন এই অবস্থাতেও কি তোমার মেয়ে মজা করবে আমার সাথে?”

–” সে কি? মেহুল এখন কি মজা করার সময়? ছেলেটা গত সাতদিন একটানা তোর সাথে হাসপাতালে ছিল। একদন্ড বিশ্রাম করে নি তোর জন্য। আর তুই কিনা এখন মজা করছিস ওর সাথে?”

–” মা আমি সত্যি বলছি এই ছেলেটাকে আমি চিনি না। কে ও? হুটহাট আমার ঘরে ঢুকে পড়েছে। ”

মেহুলের কথা শুনে আবারো চোখ রাঙ্গালেন মেহুলের মা অপূর্ণা দেবী। হালকা থমক দিয়ে বললেন,

–” ফের মজা নেওয়া হচ্ছে। বলি কবে ও এই বাড়ি বা ঘরে ঢোকার আগে অনুমতি নিতো তোর কাছে। বরং অনুমতি নিলে তুইই তো তুলকালাম কান্ড বাঁধাতিস। অনেক বাঁদরামো হয়েছে মেহুল, এবার বন্ধ কর এ নাটক। ছেলেটার মুখ চোখের দিকে তাকিয়ে দেখ , তোর চিন্তায় চিন্তায় কি হাল হয়েছে ছেলেটার।”

মেহুল কিছু বলল না বটে তবে বিরক্তর ছাপ স্পষ্ট ওর পুরো মুখ জুড়ে। অভি ক্ষনকাল তাকালো মেহুলের মুখে। ভাবলো মেহুলের শরীরটা বোধহয় খুব একটা ভালো লাগছে না তাই এমন ভুলভাল বকছে। এজন্য অপূর্ণা দেবীর হাত ধরে মেহুলের ঘরের থেকে বাহিরে যেতে যেতে বলল,

–” আহা, কাকিমা তুমি এসো তো আমার সাথে। মেহুলের হয়তো শরীর ভালো লাগছে না এখন, তাই এসব ভুলভাল বকে চলেছে। চলো আমরা বরং এখন বাহিরে যাই। মেহুল একটু বিশ্রাম নিক। ”

–” হবে হয়তো। অত কি আর আমি বুঝি বাপু…….

ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে এলো অপূর্ণা দেবী আর অভির ভরাট কন্ঠস্বর। ঘরের দরজাটা সটান বন্ধ করে বিছানায় এসে বসল মেহুল। মাথার পিছনের দিকটা এখনো দপদপ করছে ওর। ব্যাথাটা যেন ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে। সব কিছুই অসহ্য লাগছে মেহুলের কাছে। এর কারন জানা নেই মেহুলের। আপাতত নিশ্চিন্তে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিতে চায় ও।

সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পর। অভি ফ্রেশ হয়ে আবারো হাজির হয়েছে মেহুলদের বাড়িতে। অপূর্ণা দেবী তখন রান্নাঘরে মেয়ের জন্য বাহারী পদ রান্নায় ব্যস্ত। অভি আর বিরক্ত করে নি কাকীমাকে। দ্রুত পা চালিয়ে চলে এসেছে মেহুলের ঘরের সামনে। কিন্তু একি! মেহুলের ঘর যে ভেতর থেকে বন্ধ। মেহুলের নাম ধরে অনেক ডাকাডাকিও করলো অভি কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না। মেহুল দরজা খুলল না। অভি ভাবলো হয়তো ঘুমিয়ে আছে মেহুল তাই আর মেহুলকে বিরক্ত না করে অপূর্ণা দেবীকে বিদায় জানিয়ে চলে গেলো অভিদের বড়ো ছাদটায়।
আজকে ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদ উঠেছে আকাশে। চাঁদের অর্ধেকটা দেখা যাচ্ছে। ম্রিয়মান চাঁদের আলোয় অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বড়ো ছাদটা। সেই কার্ণিশের দিকটা এখনো ভাঙ্গা অবস্থাতেই পড়ে আছে। সাড়ানোর সময় হয়ে ওঠে নি ওদের। ভাঙ্গা জায়গাটার দিকে তাকিয়ে অভির মনে পড়লো সেদিনের সেই অমোঘ সন্ধ্যেটার কথা।

সেদিন মেহুল পড়ে যেতেই অভি ভয়ে তারস্বরে চিৎকার জুড়ে দিয়েছিল । অভির চিৎকারে ছুটে এসেছিলেন অভি ও মেহুলের পরিবারসহ আশেপাশের আরো বেশ কয়েকজন প্রতিবেশী। দুতলা থেকে নিচে পড়ে গিয়ে মেহুলে মাথার পিছন দিক থেকে তখন শুরু হয়ে গিয়েছিল রক্ত ক্ষরণ। মেহুলের রক্ত দেখে পাগল প্রায় হয়ে যায় অভি। সবাই মিলে দ্রুত মেহুলকে হাসপাতালের দিকে নিয়ে যায়। মেহুলের তখনো জ্ঞান ছিল কিছুটা। অভির কোলে শুয়ে অভির হাত ধরে ওর মুখের দিকে আধো আধো দৃষ্টিতে তাকিয়ে সেদিন মেহুল বলেছিল,

–” এই হাঁদারাম, শোন তোকে আজ একটা কথা বলি। আমি না তোকে সেই ছোট্ট বেলা থেকে ভালোবাসি বুঝলি। কিন্তু তুই কখনোই আমাকে সে নজরে দেখিসনি। মাঝে মাঝে তোর মতো হাঁদারামের উপর রাগ হতো আমার ,তারপর একসময় মনে হলো তুইও আমায় ভালোবাসিস কিন্তু তুই নিজেই তোর অনুভূতি সম্পর্কে জানিস না। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম তোর জন্য। জানতাম ঠিক একদিন না একদিন তুই তোর অনুভূতি বুঝবি ,তারপর ছুটে চলে আসবি আমার কাছে। আমরা দুজনে মিলে তখন বসন্ত বিলাসে মেতে উঠবো। এই তুই একবার জানতে চেয়েছিলি না যে আমি কোন ঋতু পছন্দ করি। আজ বলছি শোন, আমার বসন্ত ঋতু পছন্দ। বসন্তে যখন পলাশ, ক্যামেলিয়া, রক্তকাঞ্চনে সব পথঘাট ঢেকে যাবে তখন আমি আর তুই মিলে তাদের সাথে বসন্ত বিলাসে মেতে উঠবো কেমন। এই শোন, কখনো ভুলে যাস না আমায়। আমার কিন্তু তোর সাথে বসন্ত বিলাস করা বাকি রইল।”

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলেই চুপ করে গিয়েছিল মেহুল। অভি মেহুলের সঙ্গাহীন দেহ নিজের সাথে আরো নিবিড় করে জড়িয়ে নিয়ে কান্না ভেজা গলায় বলেছিল,

–” মেহুল তোর কিছু হবে না দেখে নিস। আমরা একসাথে জীবনের বাকি বসন্তগুলো পার করবো। কিছুই হতে দেবো না তোর।”

হাসপাতালে ভর্তি করার পর টানা তিনদিন মেহমুদের জ্ঞান ছিল না। মেহুলের এমন অবস্থা দেখে হাল ছেড়ে
দিয়েছিল ডক্টররা কিন্তু সেদিন হাল ছাড়ে নি শুধু অভি। অভির মনের জোরেই মেহুল মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফিরে এসেছিল। মেহুলের আঘাত লেগেছিল ডান হাত আর মাথার পিছন দিকটায় । এছাড়া আর কোথাও আঘাত পায় নি সেদিন মেহুল। ডিসচার্জের আগে ডক্টর ওদের বলেছিল মেহুলের যত্ন নিতে। অভি নিজে মেহুলের দায়িত্ব নিয়ে ওকে বাড়িতে নিয়ে এসেছে। কিন্তু এখন মেহুল ওকেই চিনতে পারছে না। মেহুলকি আগের মতোই মজা করছে ওর সাথে নাকি সত্যিই চিনতে পারছে না ওকে?

অভি আর ভাবতে পারছে না কিছুই। মনের কোনে জমা কালো মেঘের দলগুলো ভারি হচ্ছে ক্রমশ। চোখ ভরছে নোনা পানিতে। তবে কি কোন অশুভ ঝড় উঠতে চলছে মেহুল অভির জীবনে?

চলবে

( দুঃখিত গত কয়েকদিন ফেসবুক থেকে জুকারবার্গ কাক্কুর রেসস্ট্রিকটেড দেওয়ার কারণে গল্প দিতে পারি নি এতদিন। এখন আবার নিয়মিত পাবেন #বসন্ত_বিলাস গল্পটি। আপনাদের কি মনে হচ্ছে? মেহুল অভির জীবনে কি ঘটতে চলেছে আগামীতে?)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here