#মেঘভাঙা_রৌদ্র
#পর্ব-১
বিয়ে হয়ে সবেমাত্র শ্বশুরবাড়ি এসেছি। গাড়ি সদর দরজায় দাঁড়িয়ে। আমি নামার জন্য পা বাড়াতেই পাশে থেকে আবির বলে উঠলো-
– দাঁড়ান, একা একা নামবেন না, আম্মু আসুক, তারপর নামবেন।
আমি মুখে কিছু না বলে বাড়ানো পা টা ভেতরে টেনে নিলাম। এবং এটা ভেবে অবাক হইলাম এই ছেলে এতক্ষণ অব্দি একটাও কথা বলেনি, পুরো রাস্তা জুড়ে কেমন যেন চুপচাপ পাশে বসে ছিলো! অবশ্য আমি নিজেও যে খুব কথা বলেছি তা নয়, হয়তো এটা বুঝেই সে চুপ ছিলো। যাইহোক গাড়ির ভিতরে বসে আছি, এসি চলছে তবুও ঘেমে যাচ্ছি, ছেলেটি কি বুঝলো কে জানে! এসির পাওয়ার টা বাড়িয়ে দিলো। এদিকে চারিদিকে হৈ-চৈ শুরু হয়ে গেছে- বউ এসেছে, বউ এসেছে বলে। আমি তখনো বসা, পাশে ছেলেটি। এমন সময় একজন মধ্যবয়সী মহিলা সাথে কয়েকজন মেয়েকে নিয়ে এসে, গাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন-
– দেখো কান্ড! এরা তোমাকে এইভাবে বসিয়ে রেখেছে! এসো মা, তাড়াতাড়ি নেমে এসো।
বলেই উনি আমার হাত টা ধরে নিচে নামালেন, এবং দাঁড়িয়ে থাকা সবার দিকে তাকিয়ে বললেন– “তোদের এই দুষ্টুমি গুলা কবে যাবে বলতো? বৌমা কে ভেতরে না নিয়ে গিয়ে এইভাবে বসিয়ে রেখেছিস!”
এই কথা শুনে আরিবা বলে উঠলো- আম্মু তুমি শুধু শুধু বকা দিচ্ছো! আবির ভাইয়া তো তোমাকে ডাকতে বললো, তার জন্যই তো তোমাকে ডাকতে গেছিলাম, আমাদের কি দোষ বলো! তোমার ছেলেই তো…এই কথায় শাশুড়ি বলে উঠলেন – ‘থাম- আমাকে এত বুঝাতে আসিস না- তোরা যে কি আমি ভালই মত জানি।
কথা শুনে বুঝলাম ইনিই শাশুড়ি। আর মেয়েটি আবিরের বোন, ওকে আগেই চিনেছি, বিয়েতে গিয়ে আগেই পরিচিত হয়েছে। খুব মিষ্টি মেয়ে বুঝায় যায়, এই বছরেই ইউনিভারসিটি তে এডমিশন নিয়েছে।
আমি নিচে নেমে শাশুড়ি কে সালাম দিতেই উনি সালামের উওর দিয়ে বললেন- অনেকটা রাস্তা এসেছো, এখন তাড়াতাড়ি ভিতরে যাবে চলো, এমনিতেই এরা তোমাকে অনেক্ক্ষণ বসিয়ে রেখেছে!
উনার এই কথা শুনে আবির গম্ভীরভাবে বললো-
– আমি কি জানি! ভাবলাম হয়তো এটায় নিয়ম, তাই তোমার অপেক্ষায় থাকতে বলেছিলাম। যাইহোক তুমি উনাকে নিয়ে যাও আমি ভিতরে গেলাম।
বলেই ও দ্রুত পায়ে আমাদের পাশ দিয়ে ভিতরের দিকে চলে গেলো। ওর অমনভাবে যাওয়া দেখে একটা মেয়ে শাশুড়ি কে বললেন, দেখছো খালা আবির ভাইয়া ইচ্ছে করেই কিন্তু ভাবিকে নিয়ে বসে ছিলো, এখন এটা ভাব দেখালো আর কি ! বুঝিতো তোমার ছেলে বিয়ে করতে না করতেই বউকে মায়া করতে শুরু করেছে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসি দিলো! আমি কি বলবো ভেবে না পেয়ে চুপ করে রইলাম। এমন সময় শাশুড়ি ওদের ধমক দিয়ে বললেন, তোদের এই পিছনে লাগা অভ্যেস টা গেলোনা! এতদিন তো ছেলেটার পেছনে লাগতি এখন মেয়েটার পেছনেও পড়লি, তোরা পারিস ও বটে! এই কথা বলে শাশুড়ি আমাকে বললেন-
– ওদের কথায় কান দিওনা। সবগুলা ফাজিলের দল।
আমি মাথা নেড়ে বুঝালাম যে আমি ওদের এসবে কিছুই মনে করিনি। কিন্তু শাশুড়ি তবুও বললেন –
– জানো তো মা, এরা একটু বেশিই লাগে। আমার আবির টা একটু শান্তশিষ্ট বলে এরা সারাক্ষণ ওকে জালিয়ে মারে। তুমিতো আসলে এরপর তোমার সাথেও লাগবে।
উনার কথায় আমি মুখে কিছু না বলে একটু স্মিত হাসলাম।
উনি হাটছেন, উনাকে অনুসরণ করে আমিও উনার পাশেপাশে হাটছি। সাথে মেয়েগুলো ও যাচ্ছে। উনি সদর দরজা পার হয়ে বড় একটা লিভিং রুমে ঢুকলেন, সাথে আমিও ঢুকলাম, দেখলাম পুরো ঘরে আত্মীয়স্বজনে ভরা। আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাত সামনের দেয়ালে চোখ পড়তে যা দেখলাম তা দেখার জন্য এই মুহূর্তে অন্তত প্রস্তুত ছিলাম না! পুরো দেয়াল জুড়ে ফ্যামিলি ফটো দিয়ে সাজানো আর তার মাঝে একটা গ্রুপ ফটোও আছে! সেটা আবিরের সাথে অয়নের ! এ দেখে এত বেশি আশ্চর্য হয়েছি যে কি করবো ভেবে না পেয়ে ছবিটার দিকে থ- হয়ে তাকিয়ে রইলাম! আমি যে নতুন বউ মাত্র এসেছি কিংবা পুরো ঘরে যে আত্মীয়স্বজনে ভরে আছে, বেমালুম ভুলে ছবির দিকে তাকিয়ে রইলাম! ছবিতে আবিরের সাথে অয়ন হাস্যজ্জ্বল মুখে দাঁড়িয়ে আছে! আর এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যেন আমার দিকে তাকিয়ে আমাকেই স্বাগত জানাচ্ছে! ওকে দেখে নিজের মনে নিজেই আশ্চর্য হয়ে গেছি! যাকে ভুলবো বলে এতদূর আসা তাকেই চোখের সামনে এইভাবে দেখবো কল্পনাও করিনি! তাও কিনা আমার সদ্য বিয়ে হওয়া শ্বশুর বাড়িতে! এরচেয়ে কাকতালীয় আর কি হতে পারে! অথচ গতকাল রাতে পর্যন্ত ভেবেছি, অতীত কে ভুলতে না পারলেও চেষ্টা করবো, আমার জন্য না হোক আমার ফ্যামিলির জন্য এইটুকু আমাকে পারতেই হবে। তারজন্যই সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব কে ঝেড়ে ফেলে এই বিয়েতে মত দিয়েছি। কিন্তু যাকে ভুলার চেষ্টায় এই সংসারে আসলাম সেই কিনা এখন আমার সামনে! ওকে দেখার পর পুরো পৃথিবী টা এক নিমিষে যেন নড়ে উঠলো! ও এখানে কেন এই প্রশ্ন টা বারবার মাথার ভিতরে ঘুরপাক খাচ্ছে! কি করবো ভেবে না পেয়ে দিশাহারা হয়ে ছবির দিকে অপলক তাকিয়ে রইলাম – ‘সেই চোখ, সেই মুখ এবং ঠোটের কোণে সেই ভুবনজয়ী হাসি!’ যে হাসি তে একসময় আমি রোজ একবার করে ওর প্রেমে পড়তাম, সেই ওকে আমি এতদিন পর এইভাবে দেখবো কল্পনাও করতে পারিনি!
কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম নিজেও জানিনা- পাশে থেকে শাশুড়ি বলে উঠলেন-
– ও আমার ছোট বোনের ছেলে অয়ন। আর পাশের টা আবির। কলেজে থাকাকালীন তোলা।
শাশুড়ির কথায় সম্বিৎ ফিরে পেলে লজ্জ্যায় মাথা নিচু করে নিই। এদিকে শাশুড়ি তখনো বলে যাচ্ছেন-
– ছোট বেলা থেকে অয়ন এইখানেই মানুষ। কারণ, আবির অয়ন ছাড়া থাকতে চাইতো না, আবার অয়ন ও তাই। তাই অয়নের মা আর আমি ভেবেচিন্তে দুইজনকে একসাথে স্কুলে ভর্তি করাই। সেখান থেকে কলেজ অব্দি ওরা একসাথেই পড়ে, শুধু ইঞ্জিনিয়ারিং টা একসাথে ছিলোনা, দু’জনের দুই জায়গায় এডমিশন হয়। আবির আর অয়ন মাত্র কয়েক দিনের ছোট বড়। এইজন্য ওরা দুইজন ভাইয়ের চেয়ে বন্ধু ই বেশি। তবে অয়ন এখন এইখানে নেই। তিন বছর আগে স্কলারশিপ নিয়ে বাইরে গেছে, ওইখানে পড়ার পাশাপাশি চাকরীও করে। তোমার শ্বশুর অসুস্থ হওয়ায় আবির যাওয়ার চেষ্টা করেনি দেশেই চাকরি নিলো। তুমিতো এই বাড়িতে নতুন এসেছো, পরে এমনিতেই সব জানতে পারবে। আবিরের বিয়েতে আমার অয়ন টা আসতে পারেনি বলে খুব মন খারাপ করছিলো। খুব করে বলছিলো আর কয়েক মাস পরই ও আসতে পারবে, তখন ই যেন বিয়েটা দেই। ও নেই অথচ আবিরের বিয়ে দিচ্ছি এটা ও মানতেই চাইছিলো না। কিন্তু কি করবো- উপায় নেই- অয়নের আসতে দেরি হবে, এদিকে তোমার শ্বশুরের শরীর টা দিনকে দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে- উনার কথা ভেবেই, এত তাড়া। সত্যি বলতে তোমার শ্বশুর অসুস্থ হবার পর এত বড় সংসারের দায়িত্ব টা একা আর নিতে পারছিলাম না। এদিকে অয়ন থাকতে বাড়িটাকে সব সময় হাসি খুশিতে ভরিয়ে রাখতো ও চলে যাওয়ার পর বাড়িটা চুপচাপ হয়ে গেছে। তাছাড়া আবির এমনিতেই শান্ত প্রকৃতির আর এখন তো বাড়িতে প্রায় সময় থাকেইনা, বেশিরভাগ সময় টা অফিস নয়তো ট্যুর নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বলতে গেলে সংসারের ব্যাপারে একেবারে উদাসীন, কোন কাজে থাকতেই চায় না। ওর নাকি এসব ঝামেলা লাগে। এইজন্যে ওর বিয়ে দেয়া, যদি একটু ঘরমুখো হয়।
উনার কথা শুনে কয়েকজন মহিলা বসা থেকে উঠে এসে আমার হাত ধরে উনাদের পাশে বসিয়ে বললেন- ” বাহ! আমাদের আবিরের বউ তো মাশা আল্লাহ! বুবু, দেখো তুমি, আজকের পর আমাদের আবির ঘরমুখো হবেই হবে। কি মিষ্টি বউ! আমাদের আবিরের ভাগ্য তো অনেক ভালো!”
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- তুমিতো আমাদের চেনো না, আমরা আবিরের চাচি, খালা, মামি লাগি। আমি সালাম দিতেই, আর একজন হেসে বললেন, আমাকেও চিনে রাখো, আমিও কিন্তু তোমার জা হই। আমি একটু মাথা ঝুকিয়ে হ্যাঁ বললাম। এমন সময় শাশুড়ি বললেন- মেয়েটা মাত্র এসেছে, আপনিই ধীরে ধীরে সবাইকে চিনে যাবে। ওকে আমি একটু আবিরের বাবার ঘরে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে নিয়ে আসি। উনি অনেকবার জিজ্ঞাসা করেছেন আবির আর বউ মা এসেছে কিনা। যাই মানুষটাকে দেখিয়ে নিয়ে আসি।
তারপর আমাকে নিয়ে উনি সামনের করিডর বেয়ে এগিয়ে গেলেন। করিডর পার হতেই সামনে সিঁড়ি আর সিড়ির ঠিক পাশেই একটা বড় রুম। উনি রুমে ঢুকেই বললেন-
– উনি তোমার শ্বশুর, গিয়ে সালাম দাও।
আমি সালাম দিয়ে দাঁড়াতেই উনি ধীরেধীরে চোখ খুললেন আর বললেন-
– আয়েশা এই বুঝি আমার আবিরের বউ?
উত্তরে শাশুড়ি বললেন-
– হ্যা, তোমার সাথে দেখা করাতে নিয়ে আসলাম। তুমি ওকে দোয়া করো, ও যেন আমার আবিরের সাথে সুখি হয়।
উনাদের কথার ফাঁকে চারিদিকে আলতো করে চোখ বুলালাম। খুব সুন্দর সাজানো গোছানো ঘর। অনেক পুরনো আমলের সমস্ত জিনিসপত্র দিয়ে সাজানো তবে সেইগুলোই আভিজাত্যের ছোঁয়া স্পষ্ট। একপাশে বড় একটা খাট, খাটের একপাশে আলমারি, ড্রেসিং; অন্যপাশে একটা ইজি চেয়ার, ইজি চেয়ারে উনি শুয়ে আছেন, শাশুড়ির কথা শুনে স্পষ্ট উনার চোখে পানি দেখলাম! উনাকে দেখিয়ে শাশুড়ি আফসোস করে বললেন-
– আসলে উনি তো প্যারালাইজড ঠিকমতো হাটাচলা করতে পারেন না। আজকের এত আয়োজন উনি কিছুই চোখে দেখলেন না। অথচ একমাত্র ছেলেকে নিয়ে উনার কতই না স্বপ্ন! এইজন্য বাড়িতে ঢুকেই আগে তোমাকে দেখাতে নিয়ে আসলাম।
শুনে শ্বশুর বললেন-
– এসব কথা থাক আবিরের মা। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। এসব নিয়ে আফসোস করোনা। তাছাড়া এই দুনিয়ায় আর কয়দিন বলো? উনার ভালতেই তো আমাদের ভালো। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-
– আমার পাশে একটু বসো তো মা।
উনার কথায় একটা চেয়ার টেনে উনার কাছে বসলে আমার মাথায় হাত রেখে বললেন-
– দোয়া করি, সুখি হও। আজ থেকে তোমার কিন্তু অনেক দায়িত্ব বুঝলে মা? জানতো আমি অসুস্থ হবার পর তোমার শাশুড়ি একা হাতে পুরোটা সামলাচ্ছে। আজকের পর এই সংসারটা কিন্তু তোমার বুঝলে?
কথাগুলো বলার সময় উনার দু-চোখ বেয়ে পানি ঝরে পড়লো। আমি কি বলবো ভেবে না পেয়ে বললাম-
#চলবে…
#লিখা: #Nilufar_Yasmin