“ধারা আপু কখনো মা হতে পারবে না ভাইয়া, আপনি আমাকে বিয়ে করে নিন প্লিজ। বিয়ে করবেন ভাইয়া আমাকে?” নববধূ সাজে সজ্জিত তিতির স্রোতের পায়ের কাছে বসে পড়লো। হতভম্ব স্রোত চট করে তিতিরের দুই বাহু ধরে তাকে তুললো। এমন সময় তিতির একটা অঘটন ঘটিয়ে বসলো। অকস্মাৎ তিতির স্রোতকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। স্রোত এক ঝটকায় তিতিরকে সরিয়ে সজোরে থাপ্পড় লাগিয়ে দিল। তিতির ছিটকে চেয়ারের সাথে ধাক্কা খেল। তিতিরকে ধরে চেয়ারে বসালো স্রোত।
“নাও পানি খাও।” পানির গ্লাসটা তিতিরের দিকে এগিয়ে দিল স্রোত।
তিতির কাঁপছে ভয়ে। স্রোত ঠিক কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। তিতিরকে একটু স্বাভাবিক হওয়ার সময় দিচ্ছে সে। লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সহজ হলো তিতির।
“বললেন না তো ভাইয়া, আমাকে বিয়ে করবেন?” তিতিরের প্রশ্নে প্রচণ্ড রাগ হলো স্রোতের কিন্তু তা নিয়ন্ত্রণ করলো। তিতিরের উপর চেঁচিয়ে লাভ নেই। এসবের প্রেক্ষাপটটা কী তা জানতে হবে।
“দেখো তিতির, তুমি এসব কেন করছো সেটা আমাকে বলো। আমি পারলে অবশ্যই তোমাকে সাহায্য করবো কিন্তু আমার আর ধারার সম্পর্ক এতটাও ঠুনকো নয় যে সামান্য একটা কারণে ভেঙে যাবে।”
“বাচ্চা কখনো সামান্য কারণ হয় না ভাইয়া। আপনি প্লিজ আমায় ফিরিয়ে দিয়েন না তাহলে আমি মরে যাবো। আজ আমার বিয়ে না হলে আমি কাউকে মুখ দেখাতে পারবো না।”
“তিতির, তুমি বাড়াবাড়ি করছো। এক্ষুণি এখান থেকে বেরিয়ে যাও তুমি। ভেবেছিলাম মাথা ঠাণ্ডা রেখে তোমার সমস্যা শুনবো কিন্তু আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে।” তিতির সত্যি সত্যিই উঠে কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে গেল। স্রোত পিছু ডাকলো না। সরাসরি ধারাকে ফোন দিল। ধারার ফোন সুইচড অফ বলছে। চিন্তার ভাঁজ খেলে গেল স্রোতের কপালে। আরো আধঘণ্টা অবধি রোগী দেখার কথা তার। অনেকেই এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে ফেলেছে। রোগীদের চাপে দুপুরের নাস্তাটা অবধি করতে পারেনি সে। চিন্তিত কণ্ঠে পরবর্তী রোগীকে পাঠাতে বললো স্রোত।
_______________
“ভাইয়া তোকে কখনো ছেড়ে যাবে না আমি আগেই বলেছিলাম। অযথা আমাকে দিয়ে এই নাটকটা করালি আপু। আমি এখন ভাইয়ার দিকে আর তাকাতেই পারবো না লজ্জায়। ছিঃ!” গলা থেকে গয়না খুলতে খুলতে খুলতে বলল তিতির।
“এত বেশি ভাবিস কেন? স্রোতকে আমি আজকেই সব সত্যি বলে দিব তো। ও রাগ করবেনা তো?”
“অন্য কারো থেকে জানলে আরো বেশি রাগ করবে আপু। তাছাড়া রাগ করলে তুই আদর করে মানিয়ে নিস।”
“অসভ্য মেয়ে! যা তো বের হ।” তিতিরকে মারার ভঙ্গি করে হেসে উঠলো ধারা। হসপিটাল থেকে চারদিনের ছুটি নিয়ে তিতিরের এক বান্ধবীর বিয়েতে এসেছিল ধারা। একটানা পড়াশোনা-হাসপাতাল আর সংসারের চাপে খানিকটা হাঁপিয়ে উঠেছিল ধারা। বিয়ের তিন মাসেই সংসারের সব দায়িত্ব আয়ত্তে আনার চেষ্টায় শরীরের দিকে গুরুত্ব দিতেও ভুলে গেছে। স্রোত একরকম জোর করেই ধারাকে বিয়েতে পাঠিয়েছিল। বাড়ির সব দায়িত্ব এখন হায়ার কাঁধে, তাই ধারা চাইলেও এখানে শান্তিতে বসতে পারছিল না। তিতিরের বান্ধবী তিতিরের জন্যও একই রকম বিয়ের শাড়ির ব্যবস্থা করেছিল। তিতিরকে বধূসাজে দেখে ধারার মাথায় অদ্ভুত একটা শয়তানি বুদ্ধি চাপলো।
“স্প্যারো গ্রুপের অজস্র ধোকাধারির পোস্ট দেখে তোর মাথাটা গেছে আপু। অযথা ভাইয়াকে চেক করার ভূত তোর মাথায় চাপলো।”
“আশেপাশে যা দেখি তার জন্য ভয় হয় রে। আমি স্রোতকে হারিয়ে ফেললে একেবারে মরে যাবো।”
“বিশ্বাস একটা সম্পর্কের ভিত্তি। ভাইয়ার উপর বিশ্বাস রাখ। আমার কাল সকালেই ক্লাস আছে। চাইলেও মামাবাড়িতে থাকতে পারবো না। তুই কি এখন মামীর কাছেই থাকবি নাকি শ্বশুরবাড়ি যাবি?”
“এইতো বের হবো এখন। স্রোতকে দেখিনা চারদিন হলো। আমার আর কিছু ভালো লাগছে না।”
“উহুম উহুম..আমার বোন দেখি ভাইয়ার প্রেমের জলে একেবারে ডুবে গেছে।” বলেই মুচকি হাসলো তিতির।
তিতিরের দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙালো ধারা তবে কথাটা তিতির ভুল বলেনি। স্রোত ধারার সাথে এমনভাবে মিশে গেছে যেন একে অপরকে ব্যতীত তাদের বিচরণ সম্ভব নয়।
মা-বাবার থেকে বিদায় নিয়ে তিতিরের সাথেই বের হলো ধারা। তিতিরকে ওর হোস্টেলে নামিয়ে দিয়ে সে বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করলো। বের হতে এত দেরি করে ফেলেছে যে রাস্তার মধ্যেই এশার আযান দিল। তাছাড়া তিতিরকে ড্রপ করতে গিয়েই অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। ট্যাক্সির ড্রাইভারটাকেও কেমন যেন লাগছে ধারার।
“উফ ধারা! ইদানিং তুই সবার উপর অকারণেই সন্দেহ করছিস।” মনে মনে নিজেকে ধমকে ফোন বের করতেই গাড়ি সজোরে ব্রেক করলো। ধারা চারপাশে তাকালো। নিস্তব্ধ-শুনশান রাস্তা, এ রাস্তায় কাজ চলছে বলে রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ড্রাইভারটা কি জানতো না নাকি বদ মতলবে এদিকে আনলো? বুঝে উঠতে পারছে না ধারা।
“আপামণি, এ রাস্তা তো বন্ধ। আমি তো জানতাম না। এটার বিকল্প রাস্তা আছে কী?” ড্রাইভার বেশ সভ্যভাবেই জিজ্ঞাসা করাতে ধারার সন্দেহ দূর হলো।
“জ্বী মামা। একটু ব্যাকে গিয়ে পাশের রাস্তা নিন।”
“আচ্ছা আপা। আসলে আমি এ শহরে নতুন আসছি। আমার নাম তুরাগ। গ্রামে বিয়ে করে বউ রেখে আসছি। পড়াশোনা মেট্রিক অবধি করে লাভ হয়নি। গরিবের ছেলের আবার পড়ে কী হইতো? শেষে বাধ্য হয়ে এখন ট্যাক্সি চালায়।”
“বিয়ে করে বউকে একা রেখে এখানে থাকেন? বউ কষ্ট পাচ্ছে না?”
“কষ্ট তো একটু পায়ই তবে সপ্তাহখানেক পর যখন যাই তখন ওর খুশি ধরে না। বিশ্বাস করেন আপা, আমি যে এখানে আছি, ঐ আমারে কখনো চুল পরিমাণ সন্দেহ করে নাই। কখনো বলে নাই তোমার ফোন বন্ধ ক্যান, এত দেরিতে আসো ক্যান! বিশ্বাস শব্দটা ছোট তবে এই জিনিসটার মূল্য দাঁড়িপাল্লায় তুলে মাপা যাবে না আপা।”
ধারার বুকে ক্ষীণ ব্যথা শুরু হলো। একজন স্ত্রী তার স্বামীর থেকে দিনের পর দিন দূরে বসেও কতটা বিশ্বাস নিয়ে অপেক্ষা করছে অথচ মাত্র চারদিনের দূরত্বে ধারা এ কী করেছে? স্রোতকে সন্দেহ করে সে তিতিরকে পাঠিয়েছিল যাচাইয়ের জন্য? এতটা অবিশ্বাস কবে ঢুকলো তাদের সম্পর্কে?
গাড়ি ব্যাকে গিয়ে একটু এগোতেই তুরাগ দেখলো রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে কিছু ছেলে মদ্যপান করছে। সম্পূর্ণ রাস্তাটাই একরকম দখল করে রেখেছে। বেশ কয়েকবার হর্ণ দিয়েও কাজ হলো না।
“আপামণি, আপনি বসেন। আমি দেখছি।” বলে তুরাগ গাড়ির দরজা খুলে বাইরে গেল ছেলেগুলোর সাথে কথা বলতে।
ছেলেগুলো নেশায় এতটা মত্ত যে তুরাগের কথা পাত্তাই দিল না। তুরাগ রাগে একজনকে ধাক্কা দিতেই সে ফিরে এসে তুরাগকে পাল্টা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। ভয়ে চেঁচিয়ে উঠলো ধারা। ফোনটা অন করার চেষ্টা করলো কিন্তু চার্জ নেই। ভয়ে হাত পা কাঁপা শুরু করেছে ধারার। ছেলেগুলো তুরাগকে ঘিরে ধরে মারছে। এখন না নামলে লোকটাকে বাঁচানো যাবে না। আল্লাহ’র নাম নিয়ে গাড়ি থেকে নেমেই আশেপাশে তাকালো ধারা। মোটামুটি শক্ত একটা ডাল রাস্তার এক প্রান্তে পড়ে আছে। দৌড়ে গিয়ে সেটা তুলে ছেলেগুলোকে আঘাত করার জন্য এগোলো ধারা। পাঁচজন মাতাল ছেলে আর ধারা একা। কোনরকম একজনকে সরাতেই তুরাগ উঠে দাঁড়ালো। কিছু করার আগেই একটা ছেলে ধারার গলা চেপে ধরলো। গাছের সাথে সজোরে ধারাকে চেপে ধরলো। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো ধারা। ছেলেটা ধারার গলা থেকে ওড়না সরিয়ে বিশ্রিভাবে গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করছে। তুরাগ পেছন থেকে ছেলেটাকে টেনে সরালো।
“আপা, তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠেন। যান দৌড় দেন।” তুরাগের চিৎকার শুনে ধারা আর দেরি না করে গাড়ির দিকে ছুটলো কিন্তু আরেকটা ছেলে এগিয়ে এসে ধারার হাত ধরে টেনে রাস্তায় ফেলে দিল তাকে। মাথার পেছন দিকে বেশ খারাপভাবে আঘাত লেগে রক্তপাত শুরু হলো ধারার। কী করবে বুঝে উঠার আগেই ছেলেটা ধারার গায়ের উপর ওঠার চেষ্টা করলো। সভ্রম বাঁচানোর তাগিদে ক্রমাগত হাত পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে একসময় নিস্তেজ হয়ে পড়লো ধারা। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো তার। আসন্ন নিকট ভবিষ্যতের অঘটনের কথা ভেবে নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করতে লাগল কিন্তু মাতাল ছেলেটার দানবীয় শরীরের সমস্ত ভর তার উপর। ছেলেটার বিশ্রি হাতের স্পর্শ তাকে ছুঁলো বলে। ঘৃণায় কেঁদে ফেলতেই ছেলেটা সজোরে থাপ্পড় লাগালো ধারার গালে।
চলবে…
#স্রোতধারা
দ্বিতীয়_অধ্যায়
সূচনা_পর্ব
~মিহি
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। অনুগ্রহপূর্বক গল্প সম্পর্কে নিজেদের মতামত জানাবেন💜]