স্রোতধারা পর্ব -০২

#স্রোতধারা
দ্বিতীয়_অধ্যায়
দ্বিতীয়_পর্ব
~মিহি

আসন্ন নিকট ভবিষ্যতের অঘটনের কথা ভেবে নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করতে লাগল কিন্তু মাতাল ছেলেটার দানবীয় শরীরের সমস্ত ভর তার উপর। ছেলেটার বিশ্রি হাতের স্পর্শ তাকে ছুঁলো বলে। ঘৃণায় কেঁদে ফেলতেই ছেলেটা সজোরে থাপ্পড় লাগালো ধারার গালে। নিস্তেজ শরীরে একজোড়া হাতের এলোমেলো বিশ্রি স্পর্শে কেঁপে উঠছিল ধারা। আচমকা তুরাগ ছেলেটির মাথায় পেছন থেকে আঘাত করে। ছেলেটা ছিটকে পড়ে যায়। ধারা নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়ায়। পালানোর সুযোগ নেই। ছেলেগুলো ঘিরে ধরেছে তাদের দুজনকেই। ধারার এ মুহূর্তে নিজেকে একেবারে নিঃস্ব মনে হচ্ছে। চোখ বন্ধ করতেই স্রোতের চেহারাটা ভেসে উঠছে বারবার। বিকট শব্দ কানে আসতেই চোখ খুলল ধারা। ছেলে চারজন চারদিকে পড়ে আছে। হুশ না থাকায় অল্প আঘাতেই মাটি আঁকড়ে পড়েছে তারা। কিন্তু আঘাতটা করলো কে? ঝাপসা চোখে কেবলমাত্র সিগারেটের তীব্র ধোঁয়া ব্যতীত আর কিছু দেখতে পেল না ধারা।

“চুপ করে দাঁড়িয়ে না থেকে বাড়ি চলে যান।” রূক্ষ স্বরে কোন একজন পুরুষ বলে উঠলো। অতঃপর অদ্ভুত রকমের সুরে শিস বাজাতে বাজাতে সামনে অগ্রসর হলো।

“আপা, গাড়িতে উঠেন চলেন।” তুরাগের কণ্ঠে হুশ ফিরলো ধারার। পরম করুণাময়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে অস্ফুট স্বরে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে উঠল ধারা। অপরিচিত একজন এসে এমন ঘোর বিপদে সাহায্য করে গেল অথচ ধন্যবাদটুকুও দিতে পারলো না ধারা। নিজের উপর খানিকটা বিরক্ত হয়ে গাড়িতে উঠে বসলো সে।

__________________

বাড়িতে ফিরতে ফিরতে ন’টা বাজলো ধারার। স্রোত প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে ধারার ফোন ট্রাই করছে অথচ এখনো সুইচড অফ বলছে। স্রোত পুলিশ স্টেশনে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়েছিল, সায়ান চৌধুরী আটকাল তাকে। আজকের রাতটা অন্তত দেখতে বলল।

বাড়িতে ঢুকেই স্রোতের চিন্তিত মুখ দেখে গলা শুকিয়ে আসলো ধারার। অন্যদিকে ধারার এলোমেলো চুল, শরীরে ওড়নার অনুপস্থিতি, গালে ফুটে ওঠা রক্তিম লাল আভা যেন স্রোতকে পাগল করে দিল। হায়া দ্রুত এসে চাদর জড়ালো ধারার গায়ে। ধারা যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। তুরাগকেও ধন্যবাদ জানায়নি সে। কথা বলার জন্য ন্যূনতম সামর্থটুকুও যেন সে হারিয়ে ফেলেছে।

“আপা, কী হয়েছে তোমার? তোমায় এরকম লাগছে কেন?” হায়ার প্রশ্নের উত্তর দিল না ধারা। আচমকা তাকে জড়িয়ে ধরে সশব্দে কেঁদে উঠলো। স্রোতসহ উপস্থিত সবার চিন্তা ক্রমশ বাড়তে লাগল। পরিস্থিতি বুঝে স্রোত ধারাকে ঘরের উদ্দেশ্যে নিয়ে যেতে চাইল কিন্তু ধারা অনড়।

“কী হয়েছে ধারা? কিছু বলতে চাও তুমি? নির্দ্বিধায় বলো।” শাহরীন চৌধুরীর কথায় কান্না থামায় ধারা। তিনি ধারার মাথায় হাত বোলাতেই লক্ষ করেন তার হাত রক্তে ভিজে উঠেছে। সাথে সাথেই তিনি খেয়াল করেন ধারার মাথায় আঘাতের চিহ্ন।

“স্রোত, ধারার মাথায় আঘাত লেগেছে। তাড়াতাড়ি ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে আয়।” শাহরীন চৌধুরীর কথায় দ্রুত ফার্স্ট এইড বক্স এনে ধারার ক্ষতস্থানে মলম লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে স্রোত।

“এসব কীভাবে হলো?” চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করে স্রোত।

ততক্ষণে খানিকটা স্বাভাবিক হয়েছে ধারা। ভুল রাস্তায় যাওয়া থেকে শুরু করে সবটুকু বললো ধারা। অজ্ঞাত ব্যক্তিটির সাহায্যের কথা শোনার পর স্রোতের কপালে ভাঁজ পড়লো। কে সেই অপরিচিত ব্যক্তি? সাহায্য করলো অথচ আত্মপ্রকাশ করলো না! এ নিয়ে ধারাকে আর কেউ কিছু বললো না। স্রোত ধারাকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো।

ধারার এই অবস্থায় তিতিরের কথাটা আর ধারাকে বলে উঠতে পারছে না স্রোত। অন্যদিকে ধারারও সত্যিটা বলার কথা মাথায় আসলো না। স্রোত সযত্নে ধারাকে বিছানায় শুয়ে দিয়ে তার জন্য খাবার আনতে গেল। ঘরভর্তি শূন্যতা ধারার ভেতরটাকে কাঁপিয়ে তুলছে ক্রমশ। একটা ঘটনা তাকে ভেতরে ভেতরে এতটা ভীতু করে তুলবে সে কখনো ভাবেনি। আনমনে বিছানা ছেড়ে উঠে জানালার দিকে তাকাতেই নিচের দিকে পুরুষ অবয়বের উপস্থিতি টের পেল ধারা। অর্থাৎ বাড়ির সামনের রাস্তায় কেউ আছে। জানালাটা খোলার চেষ্টা করতেই কাঁধে কারো হাতের উপস্থিতি টের পেল ধারা। ভয়ে কেঁপে উঠলো সে।

“কী হয়েছে ধারা? কাঁপছো কেন এভাবে?” স্রোতের কণ্ঠে ধারার ভীতি সামান্য হলেও কাটলো। স্রোত অবিলম্বে ধারাকে বুকে জড়িয়ে নিল। ভালোবাসার মানুষের বাহুবন্ধনে বোধহয় এতটাই শান্তি থাকে যে জাগতিক অশান্তিগুলোও তুচ্ছ মনে হয়। পরম আবেশে স্রোতের বুকে মুখ গুঁজে দাঁড়িয়ে রইল ধারা।

___________________

“ভাবী ঠিক আছে এখন? আমি বরং কালকেই বাসায় চলে আসবো।” চিন্তিত কণ্ঠে বলল সৌহার্দ্য।

“এত ব্যস্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই। আমার আপার জন্য আমি আছি, ভাইয়াও আছে। আপনি আপনার কাজ শেষ করে তারপর আসেন।”

“কাজ প্রায় শেষ। আমার সাথে যারা আছে, ওরা চাচ্ছিল দিনদুয়েক ছুটি কাটাতে। আপাতত আমি পেখানে শামিল হচ্ছি না।”

“কেন? পাকিস্তানে আছেন! এত সুন্দর জায়গা, আর আপনি ছুটি কাটাবেন না? জানেন, আমার একসময় কাশ্মীর ভ্রমণের খুব শখ ছিল।” আহ্লাদী কণ্ঠে বলে উঠলো হায়া।

“এটা তুমি আগে বলোনি কেন আমাকে?”

“বললে কী হতো?”

“কিছু না। অনেক রাত হয়েছে, ঘুমিয়ে পড়ো।”

সৌহার্দ্যের এমন কথায় বিদায় জানাতেও ইচ্ছে হলো না হায়ার। খট করে কলটা কেটে গেল। সারাদিন কল করেনি সৌহার্দ্য। হায়া একবার কল করায় বলেছিল ব্যস্ত, পরে ফোন করবে। এখন রাতে ফোন করে পাঁচ মিনিট কথা না হতেই ঘুমাও? হায়া আর সৌহার্দ্যের সম্পর্ক যদিও এখনো গড়পড়তা স্বামী-স্ত্রীর মতো হয়নি তবে এ অল্প কয়েকমাসে হায়া চেষ্টা করেছে সৌহার্দ্যের সাথে স্বাভাবিক হতে কিন্তু বারংবার ধ্রুব নামক স্মৃতির দেয়ালটা তার মানসপটে আঘাত করেছে। ফোনের ভাইব্রেশনে ঘোর কাটলো হায়ার। স্ক্রিনে সৌহার্দ্যের নম্বরটা জ্বলজ্বল করছে। ধরবে কি ধরবে না ভাবতে ভাবতে ফোনটা রিসিভ করেই বললো হায়া।

“বউ…” সৌহার্দ্যের মুখে ডাকটা শুনে যেন জমে গেল হায়া। হৃদস্পন্দনের ক্রমশ ঊর্ধ্বগতিটাও স্পষ্ট অনুধাবন করতে পারছিল সে।

“হায়া, শুনছো?” হায়ার উত্তর না পেয়ে পুনরায় প্রশ্ন করলো সৌহার্দ্য।

“হুম বলুন।” মৃদু কণ্ঠে প্রত্যুত্তর করলো হায়া। এখনো ‘বউ’ ডাকটার ঘোর থেকে বের হতে পারেনি সে। অদ্ভুত রকমের একটা শিহরণ অনুভব করছে।

“তোমার জন্য একটা ডিল আছে।”

“কী?”

“আগামী সপ্তাহ থেকে যেহেতু তোমার পরীক্ষা, তো তুমি যদি এবার ভালোমতো পাশ করতে পারো তাহলে আমি তোমার একটা ইচ্ছে পূরণ করবো। সেটা যত বড় ইচ্ছেই হোক না কেন।”

“ভেবে বলছেন?”

“আমি না ভেবে কথা বলি না।”

“আমার যেকোনো ইচ্ছে পূরণ করবেন?”

“হুম।”

“আমি যদি আপনাকে ছেড়ে যেতে চাই?”

কিছুক্ষণ পিনপতন নীরবতার পর ‘আচ্ছা’ বলে ফোনটা কেটে দিল সৌহার্দ্য। হায়া কলব্যাক করার আগেই তার ফোন বন্ধ হয়ে গেল। ফোনটা চার্জে দিয়ে সেলফে থাকা একটা বই পড়তে আরম্ভ করলো সে। ইদানিং রাত জাগার একটা বদ অভ্যাস হয়েছে। সৌহার্দ্য রাত একটা-দুটো অবধি কাজ করে। যদিও সৌহার্দ্য লাইট অফ করেই কাজ করে যেন হায়ার অসুবিধা না হয় তবুও হায়ার ঐ মুহূর্তে ঘুমোতে ইচ্ছে হয় না। ল্যাপটপের সামনে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বসে থাকা সৌহার্দ্যকে দেখতে তার ভালো লাগে। পরক্ষণেই ধ্রুব নামক মানুষটার জন্য তার মাথায় রাগ চড়ে বসে। ধ্রুব হয়তো তার আবেগ ছিল কিন্তু এ আবেগটাকে পেছনে ফেলে সে এগোতে পারছে না। ধ্রুব নামক মানুষটার ক্ষণিকের উপস্থিতি তার জীবনে না থাকলেও পারতো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুয়ে পড়ল হায়া।

হায়ার সকালটা শুরু হলো অন্যরকম ভাবে। আধো ঘুমভাঙা চোখে পাশে তাকাতেই চমকে উঠে সে। সৌহার্দ্য ক্লান্ত মুখে মুগ্ধ নয়নে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। হায়া শুনেছিল প্রেমে পড়লে মানুষ সব জায়গায় ভালোবাসার মানুষকে দেখে। হায়া কি তবে সৌহার্দ্যের প্রেমে পড়ল? সৌহার্দ্য এখানে নেই তবুও সে সৌহার্দ্যকে কেন দেখছে? এটা কি হ্যালুসিনেশন? ভাবতে ভাবতে সামনে সৌহার্দ্যের উপস্থিতিটা যে ভ্রম তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য সৌহার্দ্যের গালে সজোরে একটা থাপ্পড় দিল। বিছানার একেবারে কিনারায় থাকা সৌহার্দ্য হায়ার থাপ্পড়ের কারণে ধপ করে বিছানা থেকে পড়ে গেল। হায়া বিব্রত দৃষ্টিতে আর সৌহার্দ্য বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে পরস্পরের দিকে তাকালো।

চলবে…

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here