স্রোতধারা পর্ব -০৩

#স্রোতধারা
দ্বিতীয়_অধ্যায়
তৃতীয়_পর্ব
~মিহি

“আরে লাগতেছে তো, ছাড়েন! আমি কি ইচ্ছে করে করছি?” ব্যথায় মৃদু আর্তনাদ করে উঠে হায়া। সৌহার্দ্য হায়ার কান ধরেছে। আলতোভাবে ধরেছে তবুও হায়া ব্যথায় চেঁচাচ্ছে।

“আজব তো! আস্তে চেঁচাও। সবাই কী না কী ভাববে!” সৌহার্দ্য সতর্কতামিশ্রিত গলায় বলে উঠলো।

“আপনি এত তাড়াতাড়ি আসলেন কীভাবে?”

“তোমার সাথে যখন কথা হয়, তখন এয়ারপোর্টে ছিলাম। সাড়ে তিন ঘণ্টার ফ্লাইট আর আড়াই ঘণ্টা বাই রোড জার্নি। তারপর বাড়িতে এসে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ছি।”

“ডাকেননি কেন আমাকে?”

“তুমি গভীর ঘুমে ছিলে। ডাকতে ইচ্ছে করেনি।”

“খাননি তো কিছু। নিচে চলেন। নাস্তা করেন।”

“খেয়েছি। সকাল সকাল মিষ্টিমুখ করে পেট ভরে গেছে।”

“কিসের মিষ্টি খেলেন? আপনি তো এতক্ষণ বিছানায় শুয়ে ছিলেন।”

“বুঝবে না, বাদ দাও।”

“না, বুঝান আমাকে।” হায়ার বাচ্চাদের মতো জেদ করা দেখে মুচকি হাসছে সৌহার্দ্য। শেষ রাতে ঘরে ফিরে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বিছানায় শুয়েছিল সে। একটু বাদেই হায়ার অস্পষ্ট আওয়াজ তার কানে আসে। হায়ার মুখের কাছে কান এগোতেই সে টের পায় হায়া বিড়বিড় করে বলছে, “সৌহার্দ্যের বাচ্চা! ইতর লোক, খালি কল কাটে। ভাব নেয়? আমার সাথে ভাব? এবার আসুক খালি, একেবারে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবো।” হায়ার এ কথা শোনার পর হাসি আটকাতে পারেনা সৌহার্দ্য। অর্ধাঙ্গিনীর ঘুমন্ত মুখ অবলোকন করতে করতে রাত্রি পেরোয়। ভোরের দিকে একটা দুঃসাহসিক কাজ করে বসে সে। হায়ার ঠোঁটের কোণে নিজের কম্পিত ঠোঁটের স্পর্শ দেয়। এ কাজের জন্য অনেকটা সাহস জমিয়েছিল সে। হায়াকে চুমু খাওয়ার বিষয়টা বললে হয়তো এতক্ষণে তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে ফেলতো। ওকে বলে আর কাজ নেই তাই চুপ করে রইল সৌহার্দ্য।

“আপনি আমায় চুমু খেয়েছেন? অসভ্য! নির্লজ্জ লোক একটা! আমার ঘুমের সুযোগ নিয়ে! ছিঃ!”

“এহ ওয়েট, তুমি কীভাবে জানলে আমি চুমু খেয়েছি? তুমি জেগে ছিলে? আটকাওনি কেন তখন? তোমারও ইচ্ছে ছিল তার মানে। অযথা আমাকে ব্লেম করবা না।”

“বেশরম লোক, আয়না দেখেন যান। ঠোঁটে লিপস্টিকের দাগ নিয়ে ঘুরতেছে, চোখেও দেখে না। আর আমাকে দোষ দেয়!”

হায়ার কথা শুনে আয়নার দিকে তাকালো সৌহার্দ্য। আসলেই ঠোঁটে লিপস্টিকের আবছা উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে। ইশস রে! এখন হায়াকে কিভাবে ফেস করবে সে? কোনরকম হায়ার থেকে পালিয়ে ঘর ছেড়ে বেরোলো সে। যে করেই হোক, এখন হায়ার থেকে দূরে দূরে থাকতে হবে। কোনভাবেই হায়ার সাথে কথাবার্তা বলার মতো ভুল করা যাবে না। যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। একছুটে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল সে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল হায়া।

________________

“ধারা উঠো, হসপিটালে যাবে না?” স্রোতের মোলায়েম কণ্ঠে যেন আলস্য বৃদ্ধি পেল ধারার। গতরাতের পাওয়া আঘাতগুলো যেন স্রোতের ভালোবাসায় মিইয়ে গেছে খুব সহজেই। মুচকি হাসলো সে।

“আজকে যেতেই হবে? আমি অসুস্থ তো।”

“অসুস্থ দেখেই তো যাবে। চেক-আপ করাবো তোমার, মাথায় গভীরভাবে লেগেছে কিনা দেখতে হবে তো।”

“আমি আজ কোথাও যাবো না। তুমি যাও, খবরদার আমার সামনে আসবে না।”

ধারার কথার মধ্যে রাগের আভাস পাচ্ছে স্রোত। অদ্ভুত তো! রাগ করার মতো কি এমন বলেছে স্রোত? মেয়েটা ইদানিং হুটহাট রেগে যায়। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ধারার দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠে স্রোত। ধারা রক্তচক্ষু মেলে তারই দিকে তাকিয়ে। ঢোক গিলে ধারার কোলে মাথা রাখে স্রোত।

“কী হয়েছে সোনা তোমার? এমন বাঘিনীর মতো করে কেন তাকিয়ে আছো?”

“কীহ? আমি বাঘিনী? বিয়ের আগে তো আমার চাহনিতে মুক্তো ঝরে পড়তো আর এখন বাঘিনী? করবো না তোমার সং…”

কথা শেষ করতে পারলো না ধারা। স্রোত তার ডান হাতের তর্জনী আঙুল ধারার ঠোঁটে ঠেকিয়েছে। অতঃপর বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে ক্রমশ ধারার ঠোঁটে এলোমেলো স্পর্শে মত্ত হয়ে পড়লো। স্রোতের স্পর্শের উষ্ণতা দিব্যি অনুভব করতে পারছিল সে।

“সকাল সকাল কী শুরু করলে স্রোত? ছাড়ো ফ্রেশ হবো।”

“আমি কলের সেই জলের ছিঁটে হবো যা তোমার ক্লান্ত মুখে ঝরে পড়বে,
আমি সেই শীতের চাদর হবো যা আলিঙ্গন করে রাখবে তোমার কোমল শরীরটাকে।” কাব্যিক ভঙ্গিতে কথাটুকু শেষ করতেই ধারা চট করে স্রোতের ঠোঁটের কোণে একটা চুমু খেল। লাজুকতা খেলে গেল স্রোতের মুখে। ছেলেটা মাঝে মাঝে মেয়েদের মতো লজ্জা পায়। ধারার তা দেখতে বেশ ভালোই লাগে। ইচ্ছে করেই হুটহাট কাছে গিয়ে স্রোতকে লজ্জায় ফেলার চেষ্টা করে সে।

“আচ্ছা হসপিটালে না গেলে বাসায় থাকো। বিকেলের মধ্যে আমি ফিরবো। তারপর একসাথে বেরোবো একটু।”

“কোথায়?”

“সেটা এখনি কেন বলবো? তুমি রেডি থাকবে, আমি এসে পিক করবো। এখন ফ্রেশ হয়ে নিচে চলো। খাওয়া দাওয়া করে তারপর যা করার করবে।” স্রোতের কথায় মাথা নেড়ে সম্মতি দিল ধারা।

________________

হায়ার প্রচণ্ড বিরক্ত লাগছে। সৌহার্দ্য না খেয়ে অফিসে চলে গেছে। যাওয়ার আগে একটিবার তাকে বলার প্রয়োজনও বোধ করেনি। রাগে ঘণ্টা দুয়েক সৌহার্দ্যকে ফোনও দেয়নি সে কিন্তু তারপর থেকেই অস্বস্তি লাগছে। সৌহার্দ্য রোজ অফিসে পৌঁছে ফোন দেয়, হায়া সেটাকে ততটা গুরুত্ব কখনোই দেয়নি কিন্তু আজ যেন সেই সামান্য ফোন কলটুকুরও অভাবই তীব্রভাবে বোধ হচ্ছে। শেষমেশ থাকতে না পেরে রাগ আর আত্মসম্মানকে বিসর্জন দিয়ে সৌহার্দ্যের নম্বরে কল দিল হায়া। প্রথমবার কল রিসিভ করলো না সৌহার্দ্য। দ্বিতীয়বার কল করতে গিয়ে হায়া ফোন বন্ধ পেল। রাগে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে তার। এত সাহস ছেলেটার? আচ্ছা, সৌহার্দ্য কি তাকে শুধু দায়িত্বই ভেবে এসেছে? সেজন্যই কি সৌহার্দ্য তার কাছে ঘেঁষতে চাইছে না? অবশ্য সেও তো সৌহার্দ্যকে একরকম বাধ্যবাধকতা ভেবে চলেছে। কাছাকাছি আসার জন্য তো ভালোবাসা প্রয়োজন। নিজে না ভালোবেসে সৌহার্দ্যের কাছে সে কিভাবে ভালোবাসা প্রত্যাশা করতে পারে?

__________________________________________

বিকেলবেলা স্রোত ধারা আর হায়াকে নিয়ে বেরিয়েছে। যদিও তাদের দুজনের যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু হায়াকে মনমরা দেখে তাকেও সাথে নেয় স্রোত। আপাতত ঘোরাঘুরি শেষ পর্যায়ে একটা পার্কে এসে দাঁড়িয়েছে তারা। মোটামুটি মানুষজনের উপস্থিতি সেখানে, বেশ কয়েকটা রাইডও দেখা যাচ্ছে। ধারা আর হায়ার দিকে তাকিয়ে বুঝলো দুজনেই ক্লান্ত। পার্কে না এনে রেস্টুরেন্টে যাওয়া যেত। কিছু একটা খাওয়া দাওয়া করে বাসায় ফেরা যেত। কী ভেবে যেন রেস্টুরেন্টে যাওয়ার প্রস্তাব রাখলো স্রোত। ধারা আর হায়া একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরির পর দুজনের আসলেই ক্ষুধা লেগেছে কিন্তু রেস্টুরেন্টে যেতে আবার কতক্ষণ যে লাগে। স্রোত আবার গাড়ি নিয়ে বের হয়নি। রিকশা চড়ে শহর ঘোরার নাকি অন্যরকম আনন্দ অথচ বেচারাটাকে রিকশার হুডে বসতে হয়েছে প্রত্যেকবারই। পার্ক থেকে বের হতে যাবে এমন সময় পরিচিত একটা সুর কানে বাজে ধারার। শিসের শব্দ, ঠিক গতকাল রাতের অজ্ঞাত লোকটার শিসের মতো সুর। উদভ্রান্তের মতো আশেপাশে তাকিয়ে শেষমেশ ক্ষান্ত হলো ধারা। রেস্টুরেন্টে যাওয়ার প্ল্যান বাদ দিয়ে সরাসরি বাড়িতেই গেল।

বিকেল থেকে ঘোরাঘুরির চক্করে সৌহার্দ্যের কথা খানিকটা ভুলেই ছিল হায়া কিন্তু আবারো প্রশ্নটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। সৌহার্দ্যের অবহেলাটা ঠিক মেনে নিতে পারছে না। সৌহার্দ্যকে আরেকবার কল দিল হায়া। কল ঢুকেছে কিন্তু রিসিভ হলো না। রাগ করে ফোনটা বিছানায় ঢিল দিয়ে ছুঁড়ে বসে রইল সে। আজ সৌহার্দ্য আসুক! তার একদিন কী..না না এখন তো রাত! তার একরাত কী হায়ার একরাত! আচমকা হায়ার মাথায় সকালের ঘটনাটা ঘুরপাক খেতে লাগলো। সৌহার্দ্য কি লজ্জায় হায়ার মুখোমুখি হচ্ছে না? নতুন একটা প্রশ্ন তবে এটার সমাধান হায়ার কাছে আছে। সমাধানটা ভেবেই হেসে কুটিকুটি হলো সে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here