স্রোতধারা পর্ব -০৪

#স্রোতধারা
দ্বিতীয়_অধ্যায়
চতুর্থ_পর্ব
~মিহি

অন্ধকার ঘরটাতে ধীরে ধীরে প্রবেশ করে সৌহার্দ্য। রাত এগারোটা পেরিয়েছে। এত দেরি করে আসার কারণ একটাই, তাকে যেন হায়ার মুখোমুখি হতে না হয়। কিন্তু কথায় আছে না যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যে হয়? চট করে ভূতের মতো সৌহার্দ্যের সামনে এসে উপস্থিত হলো হায়া। কোমড়ে হাত গুঁজে ভ্রু কুঁচকে সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে আছে সে।

“মতলবটা কী আপনার? সারাদিন ফোন ধরেননি আবার বাসায় আসছেন অসময়ে? কী সমস্যা?”

হায়ার প্রশ্নে চুপ করে রইল সৌহার্দ্য। আপাতত এমন কিছু করতে হবে যেন হায়া রেগে তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে চলে যায়। সামনে পরীক্ষা মেয়েটার। আবেগের স্রোতে গা ভাসালেই বিপত্তি। বেশ কিছুক্ষণ ভেবে সৌহার্দ্য উত্তর দিল,
“আমার কী সমস্যা সেটা তোমাকে বলতে হবে কেন? তাছাড়া একবার কল কেটে দিলে তোমার বোঝা উচিত আমি ব্যস্ত। বারবার কল দিয়ে বিরক্ত করার মানে কী? অফিসে তো কাজ থাকে, কাজ বাদ দিয়ে আমি সারাদিন তোমার সাথে গল্প করবো? সেরকম সম্পর্ক কি আদৌ আছে আমাদের মধ্যে?”

সৌহার্দ্য শুধুমাত্র হায়াকে রাগাতে চেয়েছিল কিন্তু তার বলা কথাগুলো হায়ার হৃদয়টাকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে ফেলল নিমেষেই। এতটা পর ভাবে সৌহার্দ্য তাকে? বিয়ের রাতে তো সৌহার্দ্য অনেক বুঝদারের মতো কথা বলেছিল।এখন কোথায় গেল এসব? নিজের অজান্তেই হায়ার চোখ বেয়ে টপটপ করে অশ্রু গড়াতে লাগলো।

“ধন্যবাদ আমাকে আমার জায়গাটা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য!” হাতের উল্টোপিঠে অশ্রুটুকু মুছে হায়া বারান্দার দিকে এগোলো। সৌহার্দ্যের ঘরের বারান্দায় একটা দোলনা আছে। হায়ার মন খারাপ হলে প্রায়ই সেখানে বসে থাকে। সৌহার্দ্য এতক্ষণ নীরব দর্শকের মতো সবটা দেখল। হায়াকে রাগাতে গিয়ে সে মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। এটা তো চায়নি সে। এখন হায়ার রাগ ভাঙাবে কিভাবে?

হায়ার কান্না থামছে না। এত বড় একটা কথা কত নির্দ্বিধায় বলে ফেলল সৌহার্দ্য! এর জন্য তাকে কখনো ক্ষমা করবেনা হায়া। ‘উহুম..উহুম’ সৌহার্দ্যের মেকি কাশির শব্দে হায়ার রাগ যেন আরো বাড়লো। সৌহার্দ্যের থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকালো হায়া। সৌহার্দ্য বুঝলো এত সহজে মহারানির রাগ ভাঙানো যাবে না। সৌহার্দ্য চুপচাপ গিয়ে হায়ার পাশে বসলো। তাতে হায়ার রাগ বাড়লো বই কমলো না। সে উঠে যেতে নিতেই হাতে সৌহার্দ্যের হাতের স্পর্শ অনুভব করলো।সৌহার্দ্য তার হাত দিয়ে হায়ার কব্জিতে শিকলের মতো বেঁধে ফেলেছে। অদ্ভুত রকমের একটা হৃদমাঝারে কম্পন ধরানো অনুভূতি উপলব্ধি করলো তখন হায়া কিন্তু রাগের অগ্নির কাছে সে অনুভূতির ছিঁটে নিতান্তই ঠুনকো। আচমকা সৌহার্দ্য হায়ার হাত ধরে টান দিতেই খানিকটা বেসামালভাবে সৌহার্দ্যের কোলে বসে পড়লো হায়া। সৌহার্দ্য মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। সে মনে করার চেষ্টা করলো প্রথম দেখার সময়কার সেই ছেলেসুলভ হায়াকে। ঐ হায়া কি এ হায়ার চেয়ে বেশি সুন্দর ছিল? অবশ্য সৌন্দর্য তো বাহির দেখে হয় না, সৌন্দর্য কেবলই মানবমনের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার-স্যাপার। সৌহার্দ্যের দৃষ্টি অনুসরণ করতে গিয়ে অস্বস্তিতে পড়লো হায়া। এমন করে কেন তাকিয়ে আছে ছেলেটা?

“হাত ছাড়েন আমার। আমার ঘুম পাচ্ছে, আমি ঘুমাবো।”

“আ’ম স্যরি হায়া। আমি মোটেও ওভাবে বলতে চাইনি। আসলে..কাল রাতে আমি একটা ভুল করে ফেলেছিলাম। ঘুমন্ত অবস্থায় তোমাকে চুমু খাওয়াটা আমার উচিত হয়নি। তাছাড়া তুমি বিষয়টা ধরে ফেলায় আমার আরো অস্বস্তি লাগছিল। তাই আমি চাচ্ছিলাম তোমার থেকে দূরে দূরে থাক..” কথা শেষ করার আগেই সৌহার্দ্য খেয়াল করলো হায়া তার দিকে অনেকটাই ঝুঁকে পড়েছে। তাদের মধ্যে বড়জোর এক ইঞ্চির ফারাক রয়েছে। গলা শুকিয়ে আসছে সৌহার্দ্যের। এই বুঝি নিঃশ্বাস বন্ধ করে সে মারা যাবে। হায়ার চোখজোড়া বন্ধ, রীতিমতো ঠোঁট কাঁপছে তার। হায়া আসলে কী চাচ্ছে? সৌহার্দ্য এগোতে নিয়েও যেন পারছে না। বারবার ঢোক গিলছে। এরই মধ্যে হায়া চোখ খুলে সৌহার্দ্যের ভীত সন্ত্রস্ত মুখ দেখে মনে মনে বেশ হাসলো। অতঃপর সৌহার্দ্যের চুলের ভাঁজে হাত দিয়ে সৌহার্দ্যকে অনেকটা কাছে টেনে নিল। শরীরে বিদ্যুৎ স্পর্শ করলে যেমন ঝিনঝিন করে, তেমন অবস্থা এখন সৌহার্দ্যের। হায়ার উত্তপ্ত নিঃশ্বাসের উষ্ণতা আরো মাতাল করে তুলছে সৌহার্দ্যকে। আচমকা সৌহার্দ্যের ফোন বেজে উঠলো। সৌহার্দ্য-হায়া উভয়েরই ঘোর কাটলো। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো দুজনেই। সৌহার্দ্য মনে মনে ফোনটাকে গালি দিয়ে বারান্দা থেকে চলে গেল।

_________________

গতকাল রাত থেকেই একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে ধারা। আপাতত কলেজে এসে সে তার পরিচিত ডাক্তার আফিয়া ম্যামকে খুঁজছে। ম্যামের এসিস্ট্যান্টের সাথে দেখা করে ধারা জানতে পারলো ম্যাম হসপিটালের কেবিনে আছে। ধারা নিজের বোকামিতে বিরক্ত হলো। আসলেই তো! এ সময় তো ম্যাম কেবিনেই থাকবে। নিজেকে বকা দিতে দিতে আফিয়া রাহমানের কেবিনের দিকে গেল ধারা।

“ম্যাম আসবো?” দরজায় দাঁড়িয়ে মিষ্টিমুখে প্রশ্ন করলো ধারা।

“আরে এসো।” ধারাকে দেখেই মুচকি হেসে ভেতরে ডাকলেন আফিয়া।

“কেমন আছেন ম্যাম?”

“আছি বেশ। তুমি বলো। নতুন সংসার জীবন কেমন কাটছে?”

“আলহামদুলিল্লাহ ম্যাম। সব ভালো। আমি আসলে একটা বিষয়ে কথা..”

ধারা কথা শেষ করতে পারলো না। গুলির তীব্র শব্দে চারিদিকে হৈচৈ পড়ে গেল। আফিয়াও চমকে উঠে দাঁড়ালেন। বাইরে থেকে মানুষের ক্রমশ চেঁচানোর শব্দ ভেসে আসছে। ধারা দ্রুত কেবিনের দরজা খুলতেই একজন পুরুষ হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢোকে। ধারা কিছু বলার আগেই ছেলেটি ধারার মুখে হাত চেপে ধরে। ধীর গলায় বলে,

“প্লিজ শব্দ করবেন না। যে গুলি চালানো হয়েছে, তা আমাকে মারার জন্য। ওরা হসপিটালের কারোর কোনো ক্ষতি করবে না। আমাকে একটু সময় দিন আর কিছুক্ষণ এখানে থাকতে দিন। ওদের ব্যবস্থা আমি করবো।”

ধারা ছেলেটির থেকে সরে আসলো। ছেলেটির কপাল বেয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে। বোধহয় শক্ত কিছু দিয়ে তার মাথায় আঘাত করা হয়েছে। ধারা বুঝতে পারছে না ছেলেটাকে কি ব্যান্ডেজ করার কথা বলবে? শেষমেশ আফিয়াই বলে ফেললেন,
“তোমার কপাল থেকে রক্ত পড়ছে। ফার্স্ট এইড বক্স আছে এখানে। তুমি বসে ব্যান্ডেজ করিয়ে নাও।”

“আপনি দিন, আমি করে নিচ্ছি ম্যাম। থ্যাংকস আ লট ফর হেল্পিং মি।”

কপালে ব্যান্ডেজ শেষ করে ছেলেটি নিজে থেকেই পরিচয় দিল,
“আমি তেহযীব, তেহযীব রাশিদ। আমার নাম বোধহয় আপনারা শুনেছেন।”

“তুমি রাজনীতি করো সেই ছেলেটা না? বিরোধী দলের তো তুমি, সরকারের অনেক দুর্নীতি প্রকাশ্যে এনেছো।”

“জ্বী ম্যাম। এজন্যই ওরা চাচ্ছে আমাকে মেরে ফেলতে। শুধু ওরাই না, আমার নিজের দলের লোকেরাও সরকারি দলের থেকে অনেক টাকা নিয়েছে আমাকে মারার জন্য। এসব খবর খুবই কনফিডেন্সিয়াল। দুঃখিত আমি শেয়ার করতে পারছি না। আপনারা আমাকে সাহায্য করেছেন তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।”

ধারা চুপচাপ সবটা দেখছে। ছেলেটার কণ্ঠ বড্ড পরিচিত ঠেকছে তার। কোথাও যেন শুনেছে এমন কণ্ঠ। বেশ কিছুটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর বাইরের হৈচৈ কমে আসলো। তেহযীব আরেকবার ধারা এবং আফিয়া ম্যামকে ধন্যবাদ জানিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। ধারার কথাবার্তা গুলিয়ে যাচ্ছে। আফিয়া ম্যাম হসপিটালের রোগীদের অবস্থা জানার জন্য বাইরে গেলেন। গুলিতে কেবলমাত্র একটা ফুলের টব ভেঙেছে। গুলিটা হসপিটালের দেয়ালে বিদ্ধ এখনো। কোনো রোগীর কোনো ক্ষতি হয়না। ধারার মাথায় এখনো কিছু ঢুকছে না। যদি তেহযীবকে মারার উদ্দেশ্যেই গুলি চলে, তবে হসপিটালেই কেন? আর সাইলেন্সার ছাড়া গুলি চালিয়ে সবাইকে জানানোর মতো ভুল তো কোনো অপরাধী করবে না। যে তেহযীবকে মারতে চেয়েছিল, সে কি কোনভাবে হসপিটালে হৈচৈ এর পরিবেশ সৃষ্টি করতে চেয়েছিল? কিন্তু কেন?

চলবে…

[অনুগ্রহপূর্বক ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিবেন এবং গঠনমূলক মন্তব্য করবেন💜]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here