#স্রোতধারা
দ্বিতীয়_অধ্যায়
পঞ্চম_পর্ব
~মিহি
“ধারা, হসপিটালে অ্যাটাক হয়েছিল অথচ তুমি আমাকে বলোনি।”
“সিরিয়াস ছিল না, অল্প সময়ের জন্য একটু হৈ চৈ পড়েছিল। তাছাড়া আমি আফিয়া ম্যামের কেবিনে ছিলাম।”
“ওহ আচ্ছা। কোন পলিটিশিয়ানকে নাকি মারার জন্য হামলা হয়েছিল। নামটা খেয়াল নেই।”
“তেহযীব রাশিদ।”
“তোমার দেখি ভালোই মনে আছে।”
“আরেএ..” ধারার বিরক্ত মুখ দেখে স্রোত মজা পেল। ধারাকে বিরক্ত করতে তার খুব একটা খারাপ লাগে না। ধারার মুখ থেকে চিন্তার ছাপ এখনো সরে যায়নি। অদ্ভুতভাবে তার মনে হচ্ছে সেরাতের সেই অজ্ঞাত লোকটাই তেহযীব রাশিদ কিন্তু এ কথার কোনো প্রমাণ তার কাছে নেই। তাছাড়া সে না দেখলেও লোকটা তো তাকে দেখেছিল। তেহযীবই যদি সেই লোকটা হতো, তাহলে অন্তত কথা বলতো। অদ্ভুত রকমের একটা দোটানার মধ্যে পড়ে আছে ধারা।
_________________________
পরের একমাস বড্ড দ্রুতগতিতে চলে গেল। হায়ার পরীক্ষা থাকাকালীন সৌহার্দ্য অফিসের পাশাপাশি হায়াকে সামলেছে। পরীক্ষা ভীতি যেন হায়াকে কব্জা করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রেখেছে। হায়াও প্রস্তুতি ভালোই নিয়েছিল। ফলস্বরূপ পরীক্ষাগুলো খুব ভালোমতোই শেষ হলো। এখন সবাই মিলে বাইরে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান হচ্ছে। শাহরীন চৌধুরী এবং সায়ান চৌধুরী এসবের মধ্যে নেই। তারা চাচ্ছে বাচ্চারাই ঘুরে আসুক। অনেক কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনার পর ঠিক হলো তারা সিলেটের টাঙ্গুয়ার হাওড়ে যাবে। মাঝখান থেকে হায়া সেন্ট-মার্টিনে যাওয়ার জন্য লাফাচ্ছে। পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্য হায়া। চাইলেও কেউ ওর কথা ফেলতে পারে না তবুও সবাই চুপ রইল। কারণ হুট করে যাবো বললেই হয় না, স্রোত আর ধারাকে হসপিটালের কাজগুলো দেখে গুছিয়ে নিতে হবে, সৌহার্দ্যেরও অফিসের অনেক কাজ জমে আছে। সেসব শেষ করে তবেই ছুটি কাটানো যাবে। এর মধ্যে সবাই আরেকবার বসে ঠিক করা যাবে গন্তব্য।
কথাবার্তা শেষ করে ঘরে ঢুকতেই হায়া দরজা বন্ধ করে দিল। আপাতত তার মাথায় মারাত্মক শয়তানি একটা বুদ্ধি ঘুরছে। সৌহার্দ্য বিছানার একপাশে বসে ছিল। হায়া তার পাশে গিয়ে বসলো।
“এই যে শুনছেন।” হায়ার মধুমাখা স্বর শুনে রীতিমতো গলে গেছে সৌহার্দ্য। ঠোঁটের কোণে অন্যরকম হাসি ঝুলছে।
“বলো।”
“আমার পরীক্ষা তো শেষ। আমি শিওর ভালো রেজাল্ট করবোই। এখন আমি যা চাইবো, আপনি দিবেন?”
“এখন চেয়ে রাখো, রেজাল্ট হওয়ার পর দিবনি।”
“আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন না? আমি তো বললাম রেজাল্ট ভালো হবে।”
“করি তো বিশ্বাস। বলো কী চাই তোমার।” বলে পানির গ্লাসটা হাতে নিল সৌহার্দ্য।
“আমার একটা বাচ্চা চাই, সৌহার্দ্য।” মাত্র পানি মুখে দিয়েছিল সৌহার্দ্য। হায়ার কথা শুনে বিষম উঠে গেল তার। হায়া আলতো হাতে সৌহার্দ্যের পিঠে হাত বোলাতে লাগল। কিন্তু হায়া কাছে আসাতে সৌহার্দ্যের শরীরের তাপমাত্রা আর হৃদস্পন্দনের গতি দুইটাই যেন তরতর করে বাড়তে লাগলো। হায়ার এলোমেলো চুলের ঘ্রাণ সৌহার্দ্যের নাকে এসে ধাক্কা খাচ্ছে। সৌহার্দ্যের অবস্থা এখন এমন সে কিছু বলতেও পারছে না আবার কিছু করতেও পারছে না। হায়া বাচ্চা একটা মেয়ে। হুট করে ওর একেবারে কাছে চলে যাওয়া দুজনের জন্যই ভয়ঙ্কর হতে পারে।
“হায়া, সরো। আমি ঠিক আছি।”
“তাহলে আমি যেটা চাইলাম দেন।”
“আরেকটু বড় হও, তারপর।”
“আমি যথেষ্ট বড়। আমাকে এখনি দেন।”
“বাচ্চা কি আমি আকাশ থেকে এনে দিব মেয়ে? চুপচাপ ঘুমাও।” ঝাড়ি দিল সৌহার্দ্য। হায়ার তাতে বিন্দুমাত্র রাগ হলো না। সে হেসে কুটিকুটি। সৌহার্দ্যকে বিরক্ত করা তার উদ্দেশ্য ছিল। সেটা সফল হয়েছে। পাশাপাশি বিরক্ত করার একটা পার্মানেন্ট বিষয়ও পেয়ে গেছে। এবার সৌহার্দ্য, তুমি যাবে কোথায়? মনে মনে বারংবার হেসে উঠলো হায়া। অন্যদিকে সৌহার্দ্যের মুখের অবস্থা বিব্রত। হায়ার এসব পাগলামির সামনে সে আরো দুর্বল হয়ে পড়ছে। মেয়েটা কি একটুও বোঝে না সৌহার্দ্যে তার প্রতি কতটা দুর্বল?
______________________
ধারার ফোন বাজছে। ধারা ওয়াশরুমে। স্রোত বুঝে উঠতে পারলো না ফোনটা রিসিভ করবে কিনা। দুইবার বেজে রিং হওয়া অফ হলো। একটু বাদেই ধারার ফোনে একটা টেক্সট আসলো। কল রিসিভ করার জন্য ফোন হাতে নিয়েছিল স্রোত। আফিয়া ম্যামের টেক্সট সামনে আসতেই ওপেন করলো স্রোত,
“তোমার সমস্যা নিয়ে আমি নাদিরা ম্যামের সাথে কথা বলেছি। সমস্যাটা সিরিয়াস কিনা বোঝার জন্য তোমার সাথে আরেকবার কথা বলতে হবে। আপাতত আমি একটু শহরের বাইরে যাচ্ছি একটা মেডিকেল ক্যাম্পের জন্য। ওখানে নেটওয়ার্ক পাওয়া খুব টাফ। তোমার কোনো অসুবিধা হলে নির্দ্বিধায় নাদিরা ম্যামের সাথে যোগাযোগ করতে পারবে। টেক কেয়ার, ডিয়ার।”
টেক্সটটা পড়ে খানিকটা অবাক হলো স্রোত। নাদিরা ম্যামকে সে চেনে। বেশ নামকরা গাইনোকলজিস্ট কিন্তু ধারার কী এমন সমস্যা নিয়ে নাদিরা ম্যামের সাথে আলাপ করেছে সে? ঠিক সে মুহূর্তেই স্রোতের খেয়াল হয় তিতিরের কথা। তিতির যে বলেছিল ধারা কখনো মা হতে পারবে না। ধারার সাথে ঘটা দুর্ঘটনার পর এসব নিয়ে ধারার সাথে কথা বলেইনি সে। কিন্তু আফিয়া ম্যামের টেক্সট দেখে স্রোতের এখন মনে হচ্ছে তিতিরের কথাটাই সত্যি। কিন্তু ধারা স্রোতের থেকে এসব লুকোলো কেন? ধারা কি ভেবেছিল বাচ্চার জন্য সে তাকে ছেড়ে দিবে? এতটা অবিশ্বাস? এত বড় একটা কথা লুকিয়ে গেল ধারা?
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে স্রোতের হাতে নিজের ফোন দেখে খানিকটা চমকাল ধারা। স্রোত কখনো তার ফোন চেক করে না।
“ফোনে কী দেখো?” ধারার প্রশ্নে ফোন থেকে নজর সরায় স্রোত। ম্লান হাসে।
“তুমি কি আমার থেকে কিছু লুকিয়েছো ধারা?”
ধারার মুখটা মলিন হয়ে যায়। সে রাতের ইনসিডেন্টের পর ধারার একটা সমস্যা হয়েছে। তার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। এমনকি মাঝে মধ্যে স্রোতের স্পর্শও তার ভয় লাগে। স্রোতকে এটা বুঝতে দেয়নি ধারা কিন্তু মনের উপর জোর দিয়ে আর কতক্ষণ চলা যায়? বাধ্য হয়ে সাইকিয়াট্রিস্ট আফিয়া ম্যামের সাথে কথা বলে সে। ম্যাম ধারাকে টেনশন নিতে নিষেধ করেন। ধারার সমস্যাটা মূলত ঐ একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে। সবকিছু শোনার পর ম্যাম ধারাকে কিছু পরামর্শ দেন। ধারা চেষ্টা করছে ঘটনাটা ভুলে যেতে। তার জন্য মেডিসিনও নিচ্ছে সে। কিন্তু এসব স্রোতকে বললে যদি তার খারাপ লাগে? স্রোত যদি তাকে অবিশ্বাস করে? এ ভয়ে স্রোতকে কিছু বলতে পারেনি ধারা।
“কিছু বলছো না যে?”
“তোমার হঠাৎ এমন কেন মনে হলো যেন আমি তোমার থেকে কিছু লুকাচ্ছি?”
“এমনি বললাম।” ধারার হাত ধরে তাকে কোলে বসালো স্রোত। ধারার কিছুটা অস্বস্তি লাগছে। চাইলেও সে সবকিছু স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছে না আর না পারছে স্রোতকে সবটা বলে দিতে। আচমকা স্রোতের ফোন বেজে উঠে। স্রোত বিরক্ত হয়ে ফোন রিসিভ করে। ফোনে কথা বলার সময় স্রোতের মুখ বিবর্ণ হয়ে যায়। তড়িঘড়ি করে ধারাকে ‘আমি আসছি’ বলেই বেরিয়ে যায় স্রোত। ধারা বারবার পিছু ডেকেও লাভ হয় না। স্রোত ততক্ষণে বেরিয়ে গেছে। ধারা বুঝে উঠতে পারলো না স্রোত এত তাড়াহুড়ো করে কোথায় গেল। কারো কোনো বিপদ হলো না তো? ধারা বেশ চিন্তিত হলো। এখন স্রোতকে কল দিয়েও লাভ নেই। ড্রাইভ করছে হয়তো, রিসিভ করবেনা। অদ্ভুত দোটানায় পড়ে আছে ধারা। একটু পর ধারার ফোনটাও বেজে উঠলো। ধারা ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো তিতির কল করেছে। তিতিরের নাম দেখেই ধারার মনে পড়লো স্রোতের সাথে করা প্র্যাঙ্কটার কথা। এখনো স্রোতকে সত্যিটা জানানো হয়নি। স্রোত কি সে কথার ব্যাপারেই বলছিল একটু আগে? আজ আসলে তাকে সবটা বলতে হবে। ভাবতে ভাবতে ধারা ফোনটা রিসিভ করলো।
“আপু, সর্বনাশ হয়ে গেছে। তুই তাড়াতাড়ি মামীর কাছে যা, মামার শরীর অনেকটা খারাপ হয়ে পড়েছে। মামী কী করবে বুঝতে পারছে না।”
ধারা কিছু বলার আগেই ফোন বন্ধ হয়ে গেল। ধারা তাড়াতাড়ি ঘর ছেড়ে বেরোলো। হায়া চিন্তা করবে বিধায় কাউকে না ডানিয়ে একাই বের হলো।
চলবে…