#অচিত্তাকর্ষক
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|১২|
স্মৃতি বারান্দায় দাঁড়িয়ে। রাতের আকাশ দেখছে। আর জুভান ভেতরে ল্যাপটপে কাজ করছে। বারান্দায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে স্মৃতি রুমে গেল। জুভানের পাশে বিছানায় গিয়ে বসল। কিছু প্রশ্ন তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, কিন্তু মুখ ফসকে কিছু বলতে পারছে না। জুভান রেগে গেলে ভয়ানক হয়ে উঠে। তাই সে তাকে কোনোভাবেই রাগাতে চায় না। কিন্তু প্রশ্ন গুলো না করেও থাকতে পারছে না সে। ব্যাপারটা মাথার ভেতর ঝট পাকিয়ে ফেলছে তার। সে বসে বসে হাঁসফাঁস করতে লাগল। জুভান পাশ থেকে বলল,
‘কিছু বলবে?’
স্মৃতি জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
‘জিহাদ কে আপনি কীভাবে চিনেন?’
জুভান তার দিকে তাকাল। স্মৃতি চোখের পলক ফেলল না। জুভান বলল,
‘আমাদের কম্পানির একজন কর্মচারী। এতদিন যোগাযোগ ছিল না। কাল নিজেই আমাকে কল দিয়েছিল। কিন্তু তোমার তাকে কী প্রয়োজন?’
স্মৃতি মাথা নিচু করল। কিছুটা রুক্ষ কন্ঠে বলল,
‘লোকটা ভালো না। আমার বাবার জমি নিয়ে লোকটা ঝামেলা করেছিল।’
জুভান এবার ভ্রু কুঁচকে ফেলল। কথাটা ঠিক মেলাতে পারল না। জিহাদ তো তার হয়ে কাজ করে। আজ পর্যন্ত সে যতটা জমি নিয়ে কাজ করেছে সবগুলো সে তার কথাতেই করেছে। সে নিজ থেকে তো কোনো জমি নিয়ে ঘাটাঘাটি করেনি। তাহলে এখানে স্মৃতির বাবার জমি কীভাবে এলো? জুভান তাকে প্রশ্ন করল,
‘তোমার বাবার জমি মানে? কোন জমির কথা বলছো?’
‘আমাদের একটা জমি ছিল। আমার দাদা বাবাকে দিয়ে গিয়েছিলেন। সেটার বর্তমানে অনেক দাম। বাবা এটা কোনদিনই বিক্রি করতে চাননি। কিন্তু ঐ জিহাদ আমার বাবার কাছ থেকে জোর করে জমিটা কেড়ে নিয়েছে। তার বিনিময়ে আমাদের কোন টাকাও দেয়নি। অনেক বছর যাবত আমি লোকটা কে খুঁজছি, আপনি কি উনার সাথে আমাকে যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারবেন?’
সবকিছু শুনে জুভান বিভ্রান্তিতে পড়ে গেল যেন। সে তো এত জমি নিয়ে কাজ করেছে, কই কখনো তো কোনো জমির মালিককে তার পরিচিত বলে মনে হয়নি। পরিচিতদের মধ্যে কেবল নিধির বাবার জমিটাই ছিল। কিন্তু এখানে স্মৃতির বাবার জমি কীভাবে এলো সে বুঝতে পারছে না। তাহলে কি জিহাদ তাকে না জানিয়েই নিজ থেকে কোনো জমি নিয়ে কাজ করেছে? জিহাদের তো এমন বেইমানী করার কথা না। এইদিকে স্মৃতিও নিশ্চয়ই মিথ্যে বলছে না। ব্যাপারটা তে এত গরমিল লেগেছে যে কোনোভাবেই জুভান সেটা মেলাতে পারছে না। সে স্মৃতিকে তখন জিজ্ঞেস করল,
‘এটা ঠিক কত বছর আগের কথা, স্মৃতি?’
স্মৃতি সময় নিয়ে বলল,
‘পাঁচ বছর আগের।’
‘আমাদের বিয়ের আগের?’
‘হ্যাঁ।’
জুভান এবার চিন্তায় পড়ে গেল। বিয়ের আগে হলে, হতে পারে সে জিহাদ কে দিয়ে এমন কিছু করিয়েও থাকতে পারে। কারণ তখন তো তার স্মৃতির সাথে কোনো পরিচয় ছিল না। কিন্তু সে যাদের জমি নিয়েছে সেই সব জমির মালিককেই সে দেখেছে। সেখানে তো স্মৃতির বাবাকে সে কখনও দেখেনি। নাকি দেখেছিল, এখন মনে পড়ছে না? উফফ, মাথা কাজ করছে না জুভানের। সে স্মৃতিকে বলল,
‘তুমি আমাকে জমির ডিটেইলস বলো। কত শতক জমি ছিল, এক্সেক্ট কোন জায়গাটা ছিল আর মালিক কে ছিল এইসব ডিটেইলস বলো আমাকে।’
স্মৃতি মনে মনে ভাবল, আপাতত সত্যিটা বলা যাবে না। মিথ্যে বলেই ব্যাপারটা আগাতে হবে। সে বলল,
‘পাঁচ শতক জমি ছিল, আমার বাবার নামে। জমিটা ছিল আমাদের বাড়ির ঐদিকেই।’
‘তোমার বাবার পুরো নাম কী?’
‘আশরাফুল ইসলাম।’
এই নামটা জুভান চিনে। খুব ভালো ভাবেই চিনে। কিন্তু এই নামের যেই মানুষটাকে সে চিনে তার সাথে স্মৃতির বাবার কোনো মিল নেই। আর নামে নামে মিলতেই পারে। নাম মিললেই যে মানুষ মিলবে সেটার কোনো মানে হয় না। জুভান বলল,
‘জমিটা কি রানীর বাজারের ঐদিকে? তোমাদের বাড়ি তো ঐদিকেই তাই না?’
স্মৃতি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। জুভান মনে মনে ভাবল, ঐদিকের কোনো জমির ফাইল তার কাছে নেই। তাহলে জিহাদ নিশ্চয়ই একাই সবটা করেছে তাকে না জানিয়ে। সে এবার জিহাদের উপর রেগে গেল প্রচন্ড। তাকে না জানিয়ে জমি নিয়ে একা কাজ করার সাহস হলো কী করে তার। সে চোখ মুখ শক্ত করে স্মৃতি কে বলল,
‘তুমি কি জিহাদের সাথে দেখা করতে চাও।’
‘হ্যাঁ।’
‘ঠিক আছে, কাল তোমাকে জিহাদের সাথে দেখা করাতে নিয়ে যাবো।’
এত বছর পর স্মৃতি যেন এবার কিছুটা হলেও আশার আলো দেখতে পেল। এই জিহাদ কে সে কম খুঁজেনি। কম অপেক্ষা করেনি তার জন্য। অবশেষে সে তার দেখা পেতে চলছে। এবার সব সত্য বেরিয়ে আসবে। যদি এই সবকিছুর মূলে কেবল জিহাদই থাকে তবে তাকে নিজ হাতে সে খু/ন করে বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিবে।
লাইট অফ করে জুভান এসে স্মৃতির পাশে শু’ল। স্মৃতির তখন আরেকটা ব্যাপার নিয়ে খটকা লাগল। সে জুভানের দিকে ঘুরে বলল,
‘আমার আরেকটা জিনিস জানার ছিল, জুভান।’
‘হ্যাঁ, বলো।’
‘জিহাদ তো আপনার কম্পানিতে কাজ করে। সেক্ষেত্রে সে নিশ্চয়ই আপনার আর বাবার কথাতেই সব জমি নিয়ে কাজ করে। তাহলে তো আমাদের জমিটাও আপনাদের কথাতেই সে..’
‘কী বলছো স্মৃতি? আমি তোমার বাবার জমি কেন নিব? আর নিলেও আমি তো সেটা জানতাম। রানীর বাজারের ঐদিকে আমাদের কোনো জমি কেনা হয়নি। বিশ্বাস না হলে তোমাকে আমি আমাদের সব জমির ফাইল দেখাতে পারবো।’
জুভান ভেবেছিল স্মৃতি এইটুকুতেই বুঝে যাবে। কিন্তু হলো তার উল্টো। স্মৃতি শোয়া থেকে উঠে বসে বলল,
‘আমি ফাইলগুলো দেখতে চাই।’
জুভান অবাক হলো। স্মৃতি তাকে অবিশ্বাস করছে। জুভান উঠে বসে বলল,
‘আমাকে তুমি অবিশ্বাস করছো, স্মৃতি?’
স্মৃতি শুকনো মুখে বলল,
‘না, কেবল নিজের বিশ্বাসটাকে আরো চওড়া করতে চাইছি।’
জুভান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
‘ঠিক আছে, বসো; আমি ফাইল নিয়ে আসছি।’
রুমের লাইট জ্বালিয়ে জুভান আলমারির ভেতরে তার লকারটা খুলল। সেখানে অনেক ফাইল। সবগুলো ফাইলই সে সেখান থেকে নিয়ে বিছানায় এনে রাখল। স্মৃতি কে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘নাও, সবগুলো একটা একটা করে চেক করে দেখো, তোমাদের জমির ফাইল আছে কিনা।’
স্মৃতি তাই করল। একটা একটা করে ফাইল গুলো দেখতে লাগল। জুভান চোখ মুখ শক্ত করে তার পাশে বসে রইল। সব ফাইল দেখা প্রায় শেষ। স্মৃতি যেই ফাইটাকে উদ্দেশ্য করে খুঁজছে সেটা সে এখনও পায়নি। অবশেষে লাস্ট ফাইল। স্মৃতি ভেবে নিয়েছিল এটাও সেই ফাইল হবে না। অন্তত এটা ভেবে শান্তি পাচ্ছিল যে জুভান এসবের মাঝে নেই। কিন্তু তার শান্তি বেশিক্ষণ টিকল না। ফাইল খুলেই জায়গার নাম দেখে বুকে মোচড় দিয়ে উঠল তার। তার পাশে জমির মালিকের নাম “আশরাফুল ইসলাম” দেখে আরো বেশি বুক কাঁপতে লাগল। সে কাঁপা কাঁপা হাতে ফাইলটা জুভানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘এখানে আমার বাবার নাম।’
জুভান সেটা দেখে বলল,
‘হ্যাঁ, তোমার বাবার নামে আমার একজন ক্লায়েন্ট ছিলেন। তবে উনি তোমার বাবা নন। আর এই জমিটাও তোমাদের না। জায়গার নাম দেখো, আলীনগরের ঐদিকে।’
স্মৃতি চোখ বুজে নিজেকে শান্ত করল। সে জুভান কে কীভাবে বলবে যে ঐ আলীনগরের জায়গাটাই তাদের। আর এই ফাইলটাও তাদেরই জমির। যেখানে জোর কর তার বাবার কাছ থেকে স্বাক্ষর নিয়ে তারা জমিটা হাতিয়ে নিয়েছে। স্মৃতি কে চুপ থাকতে দেখে জুভান বলল,
‘কী হলো, এখনও বিশ্বাস হয়নি। আরে বাবা তুমি মিলিয়েই দেখো না। তোমাদের জমি তো পাঁচ শতক ছিল আর এটা ছয় শতক আর তাছাড়া জায়গারও মিল নেই। শুধু মালিকের নামের মিল আছে। একই নামের তো দুই মানুষ হতেই পারে, তাই না?’
স্মৃতি কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
‘হ্যাঁ পারে, অবশ্যই পারে। নিন, এইগুলো রেখে দিন। আর সরি আপনাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য।’
জুভান ফাইলগুলো গুছাতে গুছাতে বলল,
‘তাও যে তোমার সন্দেহ দূর হয়েছে সেটাই অনেক। আর তুমি চিন্তা করো না, জিহাদ যদি তোমাদের জমি জোর করে নিয়ে থাকে তবে আমি নিজে ঐ জমি তোমাদের ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করব, প্রমিস।’
স্মৃতি প্রত্যুত্তর করল না। চুপচাপ পাশ ফিরে বিছানায় শুয়ে পড়ল। জুভান সব গুছিয়ে তার পাশে এসে শু’ল। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল তাকে। তার ঘাড়ে মুখ গুঁজে একসময় তদ্রাচ্ছন্ন হলো। কিন্তু স্মৃতি আর দু চোখের পাতা এক করতে পারল না। বুকের ব্যাথায় পুরোটা রাত সে ছটফট করল। নিম্নবিস্তারীনিবিড় নিশিতে তার নিউরনগুলো সতর্ক হয়ে উঠছিল। তারা তার দিকে বার বার প্রশ্ন ছুড়ছিল,
“স্মৃতি, তুই আবার তোর বাবার খু/নির সাথেই সংসার করছিস না তো?”
চলবে…