অনিন্দিতা পর্ব -০২

#অনিন্দিতা
#২য়_পর্ব
#স্নিগ্ধতা_প্রিয়তা

তাজের মা দরজা খুলেই নিজের ছেলেকে অনির সাথে দেখে চমকে যায়৷ তাও আবার বউ সাজে! অনিকে যে তাজ বিয়ে করে এনেছে তা বুঝতে বাকি থাকে না উনার৷ উনি তাজের দিকে তাকিয়ে বলল,

–“এটা তুই কেন করলি বাবা? আমাকে একবার জানানোর প্রয়োজন মনে করলি না? আমি কি তোর কাছে এতটাই অপ্রয়োজনীয়? ”

চোখের জলটাকে আটকে রাখতে পারছিলেন না। তাজ অনিকে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে এসে নিজের মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলল,

–“আমাকে ক্ষমা করে দাও মা! পরিস্থিতিটা এমন ছিলো যে আমি তোমাকে জানাতে পারিনি।”

তাজের মা অনিকে লক্ষ্য করে একটু কঠোর সুরে বললেন,

–“আমার বাড়িতে বউ হয়ে আসার এতো ইচ্ছে ছিলো তা আমাকে একবার জানালেই পারতে। আমি নিজে তোমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যেতাম! আমাকে তুমি কি অনেক খারাপ মানুষ ভাবো! তোমার বাবা কি জানে তুমি তাজের সাথে এসেছো? পালিয়ে কেন আসলে?”

উনার মুখে এমন কথা শুনে তাজ আর অনি দুজনেই অনেক অবাক হয়ে যায়৷ অনি কিছু বলার আগেই তাজ ওর মাকে বলে,

–“মা তুমি আমাদের ভুল বুঝছো। তুমি যা ভাবছো তা নয়! অনির পরিবার থেকেই আমাদের বিয়েটা দিয়েছে!”

তারপর তাজ ওর মাকে সবটা খুলে বলে। ইমতিয়াজ আর পিহু কি করে অনিকে ধোঁকা দিয়েছে। আর অনি কোন পরিস্থিতিতে তাজকে বিয়ে করেছে।

পুরোটা শোনার পর তাজের মা নিজের ছেলে আর অনিকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–“তোমরা দুজনে কি আসলেই খুশি এই বিয়েতে?”

মায়ের প্রশ্ন শুনে তাজ ততক্ষণাত উত্তর দেয়,

–“হ্যাঁ মা, আমি খুশি! ভীষণ খুশি! ”

অনিকে চুপ থাকতে দেখে তাজের মা আবার বলে,

–“অনিন্দিতা, তুমি চুপ করে আছো কেন? তুমি কি এই বিয়েতে খুশি নও?”

অনি তাজের মাকে ভীষণ ভয় পায়৷ তাই এইবার ভয়ে-ভয়ে উত্তর দেয়,

–“হ্যাঁ আন্টি, আমিও ভীষণ খুশি তাজকে মানে তাজওয়ারকে বিয়ে করে!”

তাজের মা এমন পরিস্থিতিতেও হেসে ফেলে৷ তারপর অনির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,

–“আমাকে তুমি এখন থেকে মা বলতে পারো৷ আন্টি বলতে হবে না৷ আর তাজওয়ারকে তুমি যা খুশি ডাকতে পারো।তবে স্বামী হিসেবে একটু মান্য করেই কথা বলো! তাহলেই হবে!”

একথা শুনেও অনির ভয় দূর হয়না। মনে মনে ভাবে যে, যার থেকে সব সময় একশ হাত দূরে থাকার চেষ্টা করতো আজ তার পাশে বসে থাকতে হচ্ছে! আসলে তাজের মা ওকে অপছন্দ করে তা নয়! বরং নামাজ-কালাম আর হাদীসের কথা শুনায় বলে অনির কাছেই উনাকে ভালো লাগে না! ভয় লাগে, কখন কী বলে বসে!

–“তুমি কি আমাকে ভয় পাও?”

তাজের মায়ের কথায় চমকে উঠে অনি। তারপর নিজের ভয়টাকে যথাসাধ্য লুকানোর বৃথা চেষ্টা করে আমতা-আমতা করে বলে,

–“না!… মানে…. আসলে!…”

ওকে এমন আমতা-আমতা করা দেখে তাজের মা তাজকে বলে,

–“বৌমাকে ঘরে নিয়ে যা! ”

তাজ অনিকে নিয়ে ঘরে যাচ্ছে এমন সময় আবার কলিংবেল বেজে উঠে৷ তখন তাজ দরজা খুলতে গেলে ওর মা ইশারায় ওকে রুমে যেতে বলে নিজেই দরজা খুলে দেয়৷ আর সাথে-সাথেই পাশের ফ্ল্যাটের মহিলাটা হুড়মুড় করে বাসায় ঢুকে বলতে থাকে,

–“তাজ নাকি বউ নিয়ে এসেছে? আমার মেয়েটা বলছিলো যে, ‘তাজ ভাইয়া একটা বউ এনেছে! ‘ আমারতো প্রথমে বিশ্বাস-ই হচ্ছিলো না! ছোট মানুষ ভুলভাল বকছে! কিন্তু বাইরে নতুন হিল দেখে সন্দেহ হলো তাই!…”

তাজের মা হাসিমুখে উনাকে ভেতরে এসে বসতে বললেন। তারপর বললেন,

–“তুমি ঠিক-ই শুনেছো৷ আমার তাজওয়ার একটা টুকটুকে বউ নিয়ে এসেছে৷ আসলে আমার অনুষ্ঠান করার কোনো ইচ্ছে ছিলো না! তাই এমন হুটহাট করে বিয়ে করালাম। ”

আসলে তাজের মা চাচ্ছিলো না যে, কেউ জানুক তাজ কীভাবে বিয়ে করেছে। মহিলাটাও অনেক চালাক প্রকৃতির ছিলো। তিনি তাজের মাকে বললেন,

–“সে আমরা বুঝি আন্টি! এখনকার ছেলে-মেয়েদের কর্মকাণ্ড! তা বউয়ের মুখটা কি দেখা যাবে? নাকি বউকেও লুকিয়ে রাখবেন আমাদের থেকে?”

তাজের মা হেসে বললেন,

–“না তা কেন হবে মিনা! আমি এক্ষুনি আমার বউমাকে ডেকে দিচ্ছি৷ ”

একথা বলে অনিকে ডাকতে যাবে তখনি সেখানে অনি এসে হাজির। আসলে মিনাকে আসতে দেখে তাজ অনিকে বসার ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে।

অনি ওখানে দাঁড়িয়ে পড়লো। তারপর মিনাকে সালাম দেওয়ার পর তাজের মা খুশিমনে অনিকে ওখানে বসতে বলল।

অনিকে দেখার সাথে-সাথেই মিনা চেঁচিয়ে উঠল,

–“আরে অনি যে! আমি আগেই সন্দেহ করেছিলাম এই দুইটার মধ্যে কিছু চলছে! আন্টিকে বলতে চেয়েছিলাম, আন্টি বিশ্বাস করবে না ভেবে বলিনি আর! তাহলে আমার ধারণাটাই ঠিক ছিলো!”

কথাগুলো শুনে বোঝা যাচ্ছিলো যে, অনিকে তাজের বউ হিসেবে দেখতে পেয়ে উনি যেন ভীষণ খুশিই হয়েছে! তারপর আবোলতাবোল গল্প শুরু করে দিলো মিনা। তার কোন-কোন আত্মীয় লাভ ম্যারেজ করেছে! তাদের পরিণতি কি হয়েছে! আরো অনেক কিছু। তাজের মা যখন বুঝতে পারলো যে, মিনা যাওয়ার নাম নিচ্ছে না তখন তিনি বললেন,

–“মিনা ডিনার করে যাও! বসো আমি সব রেডি করছি। আমাদের এখনো ডিনার হয়নি, একসাথে করা যাবে!”

একথা বলার পর মিনা উঠে বলল,

–“না আন্টি আমি উঠি আজ৷ অনেকক্ষণ হলো এসেছি! ওদিকে আমার বাসায় কি হচ্ছে কে জানে! কাল আবার আসবনে!”

বলেই মিনা চলে গেলো। তাজের মা অনিকে নিয়ে উনার মেয়ে আফিয়ার ঘরে গেলেন। তারপর ওর একটা ড্রেস অনিকে দিয়ে বলল,

–“যাও এসব চেঞ্জ করে নাও! তাজওয়ারকে বলব কাল তোমাকে শপিং করাতে নিয়ে যেতে। এখনকার মতো এটা পড়ে নাও।”

অনি কি বলবে বুঝতে পারছিলো না। তাই চুপ করে ড্রেসটা নিয়ে নিলো৷ তাজের মা বলল,

–“আমি খাবার রেডি করছি, তুমি তাজওয়ারকে নিয়ে চলে আসো।”

–“আমি এখন কিছু খাবো না। আসলে…”

অনিকে থামিয়ে দিয়ে তাজের মা বলল,

–“রাতে না খেয়ে থাকতে হয়না। একটু কিছু হলেও মুখে দেবে!”

অনি নিজের রুমে চলে এলো। দেখলো সেখানে তাজ নেই৷ ও অহিকে ফোন করলো। অহি ফোন ধরেই কান্না করে দিলো। তারপর বলল,

–“আপু তুই ঠিক আছিস? তোর জন্য আমার খুব খারাপ লাগছে৷ বাবাও খুব চিন্তা করছেন!”

অনি অহিকে শান্ত করে বলল,

–“বাবাকে বল আমাকে নিয়ে চিন্তা না করতে। আমি এখানে ভালই আছি৷ তাজের মাকে আমি যতটা খারাপ ভাবতাম উনি ততটাও খারাপ নয়! বাবা কিছু খেয়েছে?”

–“না, নামাজ পড়তে গেছে। তোর ওই পিহুকে কেউ মেনে নিচ্ছে না! চাচিতো সোজা বলে দিয়েছে যে, ওই মেয়েকে কিছুতেই ছেলে-বৌ হিসেবে মেনে নিবে না! চাচাও ভীষণ রেগে আছে। কেউতো ওর সাথে কথাও বলছে না! ইমতিয়াজ ভাইয়াকে না আমার খু*ন করতে মন চাচ্ছে! তোর সাথে এমনটা করতে পারলো! আমি হলে উনাকে খু*ন করে দরকার হয় জেলে যেতাম!”

–“পাগলী কোথাকার! এসব নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না! তুই শুধু বাবার খেয়াল রাখবি। আর হ্যাঁ, নিজের খেয়ালটাও এখন থেকে তোকেই রাখতে হবে।”

–“তুমি এমনভাবে কথাগুলো বলছো যেন আর কোনোদিনও এ বাড়িতে আসবে না! আচ্ছা কাল আমরা তোমাকে আনতে যাবো না?”

–“জানিনা! তাজের মা যা বলবে তাই! উনি এখন কি বলবেন!”

তারপর আরো কিছুক্ষণ কথা বলার পর অহিকে বিদায় জানিয়ে কল কেটে দিলো অনি। তারপর ড্রেস চেঞ্জ করতে যাবে তখনি ওর বান্ধবী লোপা কল করলো। অনি কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে লোপা বলে উঠলো,

–“কিরে অনি, খুবতো বলেছিলি যে, তোর ইমতিয়াজ তোকে ভীষণ ভালবাসে! এই তার পরিচয়! এক পিহুর রূপকেই সামাল দিতে পারলো না!”

অনি লোপার কথায় রেগে গিয়ে বলল,

–“তুই কি আমার বান্ধবী নাকি শত্রু! আমার এত বড় সর্বনাশ হয়ে গেলো আর তুই মজা নিচ্ছিস!”

লোপা তখন তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,

–“কে যেন তার ভালবাসার মানুষ নিয়ে গর্ব করেছিলো! চ্যালেঞ্জতো তুই-ই করেছিলি! এখন হেরে গিয়ে এমন লাগছে কেন?”

অনির তখন সেদিনের কথাটা মনে পড়ে গেলো। ইমতিয়াজ যেদিন দেশের বাইরে থেকে আসে। ও ওর বান্ধবীদের সাথে আড্ডা দেওয়ার সময় গর্ব করে বলেছিলো,

–“আমাকে ইমতিয়াজ ভীষণ ভালবাসে। কোনোকিছুই তাকে আমার থেকে আলাদা করতে পারবে না!”

তখন লোপা হেসে উত্তর দিয়েছিলো,

–“আমাদের পিহুর রূপের কাছে যেকোনো ছেলে কুপোকাত! তোর ইমতিয়াজ আর কি!”

অনিও রেগে গিয়ে বলেছিলো,

–“দেখা যাক তোমাদের পিহুর রূপের আ*গুন আমার ভালবাসাকে জ্বালাতে পারে কিনা!”

কথাটা বলেই অনি ওখান থেকে উঠে চলে আসে। কিন্তু সেটাতো বান্ধবীদের সাথে মজা ছিলো! সেটাকেই পিহু সিরিয়াসলি নিয়ে নিয়েছে! তারমানে পিহু কি ইমতিয়াজ এর সাথে ভালবাসার অভিনয় করছে?

–“কিরে এখন চুপ হয়ে গেলি কেন? বেলুনের হাওয়া বের হয়ে গেছে বুঝি! ”

লোপার কথায় সম্বিৎ ফিরে পায় অনি। তারপর রেগে বলে,

–“তুইও আমার সাথে কথা বলবি না!”

–“কেন? তাজকেতো পেয়েছিস! আর কি লাগে!”

–“কিসের তাজ! আমি কি তাজকে শখ করে বিয়ে করেছি নাকি! বড্ড বড় ভুল করে ফেলেছি এই তাজকে বিয়ে করে! তখন যে আমার কি হয়েছিল! কেন যে আমি এই তাজকে….”

কথাটা বলে পিছনে ফিরে তাজকে দেখে চমকে যায় অনি। তারপর লোপার কল কেটে দিয়ে তাজকে বলে,

–“তাজ, তুই কখন আসলি? আসলে আমি লোপার সাথে কথা বলছিলাম! আসলে কথাগুলো ওভাবে বলতে চাইনি। আসলে…”

তাজ ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

–“তুই এটা কেন করলি অনি? আমিতো ভেবেছিলাম তুই আমাকে অন্তত ভালো বন্ধু ভাবিস! কিন্তু..”

–“তাজ এমন কিছুই নয়। ব্যাপারটা আসলে এমন যে, সবকিছু হুটহাট করে হয়ে গেলো! তাই মানিয়ে নিতে একটু কষ্ট হচ্ছে!”

–“আমাকে বিয়ে করে তুই রিগ্রেট করছিস তাইনা? ”

–“ব্যাপারটা এমন নয় তাজ!”

অনি আরকিছু বলার আগেই তাজ ওখান থেকে মন খারাপ করে চলে যায়। অনি কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। ও তাজের সাথে কথা বলার জন্য রুম থেকে বের হওয়ার আগেই তাজের মা রুমে প্রবেশ করে বলে,

–“তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে অনিন্দিতা! ”

চলবে…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here