অনিন্দিতা পর্ব -০৩

#অনিন্দিতা
#৩য়_পর্ব
#স্নিগ্ধতা_প্রিয়তা

হঠাৎ করে চোখের সামনে তাজের মাকে দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে যায় অনি। তারপর আমতা-আমতা করে বলে,

–“জ্বি বলুন।”

–“আচ্ছা, আগে বসো। ”

তারপর দুজনে তাজের বিছানার একপাশে বসে পড়ে। তাজের মা অনিকে ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করে বলে,

–“তুমি এখনো ফ্রেস হওনি? ড্রেসটা কি তোমার পছন্দ হয়নি? আমাকে নিঃসঙ্কোচে বলতে পারো।”

–“না তেমন কিছুই না। আসলে বাসায় কথা বলছিলামতো তাই…!”

–“ওহ আচ্ছা! তা বাসার সবাই ভালই আছেতো?”

–“হ্যাঁ, শুধু বাবা একটু চিন্তা করছেন!”

–“তোমার বাবাকে বলো চিন্তা না করতে। আমরা আছিতো এখানে।”

–“হুম।”

–“আসলে তোমাকেতো বলার অনেক কথাই আছে। তবে সবতো আর একবারে বলা যাবেনা! প্রথম যে কথাটা বলতে চাই তা হলো, তাজওয়ার এখন তোমার স্বামী, আর তুমি ওর স্ত্রী! আমি জানিনা তোমাদের মনের মধ্যে এখন কি চলছে! আর জানতেও চাইনা। শুধু এটুকু বলতে চাই যে, আল্লাহ যার সাথে যার জুড়ি লিখে রেখেছেন তার সাথেই তার মিলন হবে। এতে কারোর কোনো হাত নেই! আমি তোমাকে বা আমার ছেলেকে কাউকেই দোষ দিচ্ছিনা। কারণ এটা আল্লাহ তায়ালার হুকুমেই হয়েছে। আমার কথা কি তুমি কিছু বুঝতে পারছো?”

–“জ্বি।”

–“শুধু জ্বি বললে হবে না মা! তোমার প্রতি তাজওয়ারের যেমন দায়িত্ব রয়েছে তেমনি আজওয়ারের প্রতি তোমারও দায়িত্ব রয়েছে। আমি শুধু তাজওয়ার নয়, তোমার মা হিসেবেও বলছি, নিজের জিনিস সব সময় নিজেকেই দেখে রাখতে হয়! নইলে তা হারিয়ে গেলে খুঁজে পাওয়া যে বড় মুশকিল! আজ হয়তো স্বামীর মর্ম তুমি বুঝছো না! কিন্তু তার মর্ম তুমি যত দেরিতে বুঝবে ততই বেশি পস্তাতে হবে! ”

–“মা আপনি ভুল ভাবছেন। আমার আর তাজের মধ্যে সব ঠিকঠাক আছে। আমরা একে অপরকে মেনে নিয়েই বিয়ে করেছি। আপনি এসব নিয়ে চিন্তা করবেন না।”

–“মা হিসেবে একটা কথা বলব? কিছু মনে করবে নাতো?”

–“না মা, বলেন।”

–“বিয়ের আগে হোক বা পরে! একটা ছেলে আর একটা মেয়ে কখনো ভালো বন্ধু হতে পারেনা। এইজন্য আমি তোমাকে সাবধান করতাম। আমি তোমাকে অপছন্দ করি তা নয়! আসলে আমি আমার নিজের ছেলেকেই যেখানে ঠিক করতে পারিনি সেখানে তোমাকে জোর করি কি করে!আসলে মেয়েদের সৌন্দর্য হচ্ছে চুম্বকের মতো, আর ছেলেদের দৃষ্টি হচ্ছে লোহার মতো। তাই মেয়েদের সৌন্দর্য দেখলেই ছেলেদের লোলুপ দৃষ্টি সেদিকে আকৃষ্ট হয়! মেয়েদের সৌন্দর্য চুম্বকের মতো ছেলেদের কাছে টানে। যা থেকে মেয়ে আর ছেলে কেউই বাঁচতে পারেনা!”

কথাটা শুনেই ওর পিহু আর ইমতিয়াজ এর কথা মনে পড়ে মনটা খারাপ হয়ে যায়। ওর মন খারাপ দেখে তাজের মা বলে,

–“আমি তোমাকে আজ আর তেমন কিছু বলব না। তবে তুমি চাইলে নামাজ-কালাম আর ইসলামিক জীবনের ব্যাপারে তোমাকে শাসন করতে পারি। কি দিবেতো সেই অনুমতি? ”

একথা শুনে অনি কিছুটা লজ্জা পায়৷ আর ওর মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। সারাক্ষণ ওকে আর অহিকে নামাজের জন্য বকাঝকা করতো। যখন ওরা দুবোন নামাজ পড়তো তখন ওর মা ভীষণ খুশি হতো। কই ওর মায়ের এত বকা সত্বেওতো ও কখনো ওর মাকে অপছন্দ করেনি! তাহলে তাজের মাকে ওর এত ভয় কেন লাগে?

–“কি আমাকে কি তোমার মা ভাবতে পারছো না?”

অনি তাড়াতাড়ি বলে উঠে,

–“আরে না! তা নয়! আসলে আপনার কথা শুনে আজ মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে। আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরতে পারি?”

কথাটা বলে অনি নিজেই অবাক হয়ে যায়। এসব ও কি বলল! কিন্তু তাজের মা ওকে অবাক করে দিয়ে অনিকে নিজের বুকে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,

–“আজ থেকে তুমি আমাকে তোমার নিজের মা ভাবতে পারো। কোনোকিছুর দরকার হলেই আমাকে জানাবে।”

অনেকদিন পর তাজের মায়ের বুকে অনি তার মায়ের সেই ভালবাসার উষ্ণতা খুঁজে পায়। তারপর তাজের মা বলল,

–“পারলে আজ রাতে তাজওয়ারের সাথে দুই রাকাআত নফল নামাজ পড়ে নিও মা। এটা মুস্তাহাব!”

অনি কিছু না বলে চুপ করে থাকে। আজ ওর কাছে কেন জানি তাজের মায়ের বলা কথাগুলো শুনতে অনেক ভালো লাগছে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো ও উনার বলা প্রতিটা কথা শুনে যাচ্ছে আর ভাবছে যে, যেভাবেই বিয়ে হোক না কেন তাজ এখন ওর স্বামী! আর ওকে এটা মেনে নিতেই হবে!

ড্রেসটা পরিবর্তন করে অনি আফিয়ার ড্রেসটা পড়ে ডিনার করতে যায়। ও খেতে না চাইলে তাজের মা নিজহাতে ওকে খাইয়ে দিতে থাকে। তখন তাজ ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

–“মা তুমি কি ছেলের বউকে পেয়ে নিজের ছেলেকেই ভুলে গেলে! আমাকেও একটু খাইয়ে দাও!”

বলেই হাঁ করে মায়ের দিকে মুখটা বাড়িয়ে দেয়। তাজের মা ভাতের নলাটা তাজের মুখে দিতে-দিতে অনিকে উদ্দেশ্য করে বলে,

–“তোমাকে খাইয়ে দিচ্ছি জন্য লজ্জা পেতে হবে না। আফিয়া আর তাজওয়ারকেও এখনো মাঝেমধ্যে খাইয়ে দিতে হয়! আফসোস! ছেলেটাকে নিয়মিত নামাজ-কালাম পড়ানোটাই এখনো শেখাতে পারলাম না! এখন তুমি যদি পারো!”

তাজওয়ার ওর মাকে বলে,

–“মা আমি কিন্তু যথেষ্ট বুদ্ধিমান একটা ছেলে। বাইরে সবাই আমার প্রশংসা করে, তুমি ছাড়া! আর মায়ের কাছে কি সন্তান কখনো বড় হয় নাকি!”

–“আমিও প্রশংসা করতাম যদি একটু আমার কথা মেনে চলতি! নিয়মিত নামাজ পড়লে কি এমন ক্ষতি হয়? প্রতিদিন সকাল থেকে শুরু করে কতবার তোকে নামাজের কথা বলি! সেদিকে খেয়াল থাকে তোর! ছোটবেলায় যাওবা পড়তি এখনতো একদম-ই পড়তে চাস না!”

–“মা অন্যকারো সামনে তুমি এভাবে আমাকে না বললেও পারতে! আমার মান-সম্মান বলে একটা জিনিস আছে না!”

–“অনিন্দিতা এখন এ বাড়ির বউ! বাইরের মানুষ কি করে হয়! তুই আমার কথা শুনিস না! আমার বউমা আমার কথা ঠিক শুনবে দেখিস!”

–“আচ্ছা দেখা যাবে!”

অনি শুধু মা-ছেলের খুনসুটিগুলো শুনে যাচ্ছিলো আর ওর বাসার কথা ভাবছিলো। ও আর অহিওতো ওর মায়ের সাথে কত মজা করতো! মাঝেমধ্যে ওর বাবাও যোগ দিতো! এসব ভেবে অনির চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। সবার অগোচরেই অনি সেটা মুছে ফেলে।

খাওয়া শেষে তাজের মা নিজের রুমে চলে যায়। আর রুমে যাওয়ার আগে তাজের রুমে একগ্লাস দুধ আর কিছু মিষ্টি দিয়ে যায়। অনি আগে থেকেই রুমে বসে ছিল। ওর শাশুড়ীর কথামতো ওজু করে তাজের জন্য অপেক্ষা করছিলো। তাজ রুমে ঢুকতেই অনি ওর হাত ধরে বলল,

–“সরি তাজ। আমার ভুল হয়ে গেছে। আমাকে মাফ করে দে….না মানে দাও!”

অনির মুখে ‘তুমি’ ডাক শুনে তাজ ভীষণ অবাক হয়ে যায়৷ নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তারপর অনিকে বলল,

–“আমার মা কি তোর উপরে কোনো যাদু-টাদু করলো নাকি! মুহূর্তেই তুই আমাকে তুমি করে বলছিস? আর সরি কিসের জন্য?”

–“তোমাকে বিয়ে করে আমি কোনো ভুল করিনি! ”

–“এটা কি আবেগের বশে বলছিস? নাকি আমার মায়ের কথা শুনে আমাকে করুণা করছিস?”

–“দেখো আমি তোমাকে তুমি করে বলছি। সো আশা করি তুমিও আমাকে তুমি করেই বলবে৷ আমরা এখন স্বামী-স্ত্রী!”

তাজ কিছুটা রেগে গিয়ে বলে,

–“তো? আজ থেকেই আমাকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছিস? দেখ আমাকে বিয়ে করাটা তোর আইডিয়া ছিলো! আমি তোকে জোর করে বিয়ে করিনি! সো তুই চাইলে….”

এটুকু বলেই থেমে যায় তাজ। আজ কি বলবে ভেবে রেখেছিলো আর এসব কি বলছে তাজ! নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছে না। নিজের ভালবাসার মানুষটাকে এত কাছে পেয়েও ভালবাসার কথাটা বলতে পারছে না তাজ। এর চেয়ে বড় দুঃখের বিষয় আর কি হতে পারে!

–“আমি চাইলে কি তাজ?”

–“কিছুনা। তুই চাইলে এই রুমে তুই একা থাকতে পারিস৷ আমি আফিয়ার রুমে যাচ্ছি।”

কথাটা বলেই তাজ রুম থেকে বের হতে গেলে অনি ওর হাতটা আবার ধরে ফেলে। তারপর নিজের কাছে টেনে এনে ওর মুখের সামনে গিয়ে বলে,

–“জীবনটা কোনো নাটক-সিনেমা বা গল্প-উপন্যাস নয় তাজ। এটা বাস্তবতা! আর এখানে একবার কারো বিয়ে হলে সে জীবন দিয়ে হলেও সেটা রক্ষা করে! আমিও তাই চাই!”

তাজ অনির থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,

–“কি চাস তুই?”

–“একটা স্বাভাবিক জীবন! একটা দায়িত্ববান স্বামী, একটা আদর্শবান মা, আর একটা নিষ্পাপ বোন!”

–“আর আমি কি চাই তুই একবারও তা জানতে চেয়েছিস?”

–“তুমি আমাকে তুই বলাটা বাদ দেবে প্লিজ! কথাটা এখন আমার কানে কেন যেন কাঁটার মতো বিধছে! আমি তোমাকে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে চাই। আমার জীবনের ভুলটাকে আমি ফুল ভেবে গ্রহণ করতে চাই! তুমিওতো এটাই চাও তাইনা?”

তাজ ‘হ্যাঁ’ বলতে গিয়েও কেন জানি আটকে যায়। তখন অনির বলা সেই কথাটা ওর কানে বাজতে থাকে,’ বড্ড বড় ভুল করে ফেলেছি এই তাজকে বিয়ে করে!’

–“কি হলো বলো? তুমি কি চাও?”

অনির কথায় ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে আসে তাজ। অনির বলা কথাগুলো ওর কাছে সস্তা আবেগ মনে হতে থাকে৷ মনে হয় এসব ও আবেগের বশে বলছে৷ ঠিক যেমন বিয়ের সময় বলেছিলো! পরে যদি এরজন্য আবার কষ্ট পায়! তাই নিজের ইচ্ছেগুলোকে ধামাচাপা দিয়ে রেখে তাজ অনেক কষ্টে বলে,

–“আমি কিছুই চাইনা। তুই ভালো থাকলেই হবে!তোর ভালোর জন্যইতো বিয়েটা করেছি! ভালো বন্ধুত্বের দায়িত্ব পালন করছি!”

অনি কিছুটা নিরাশ হয়ে বলে,

–“শুধুই বন্ধুত্ব?”

–“অনেক রাত হয়েছে। ঘুমিয়ে পড়! তুই চাইলে আমি আফিয়ার ঘরে…”

–“তুমি আবার সেই এক কথাই বলে যাচ্ছো! ওকে তুমিতো আমার ভালো বন্ধু তাইনা? তাহলে চুপচাপ আমি যা বলবো তাই করবে! তাহলেই আমি ভালো থাকবো! রাজি?”

তাজ কোনোকিছু না ভেবেই “হ্যাঁ” বলে দেয়। তারপর অনি ওকে বাথরুমের দিকে ঠেলে দিয়ে বলে,

–“এইবার সুন্দর করে ওজু করে আসো৷ মা আমাকে বলেছে দু রাকাআত নফল নামাজ পড়তে।”

–“এখন বুঝতে পারছি কেন তোর এত পরিবর্তন! ”

–“মানে?”

–“মা নিশ্চয়ই তোর উপরে কোনো যাদু করেছে! নইলে তোর মতো মেয়ে বলবে নামাজের কথা!”

–“তুমি আবার আমাকে তুই করে বলছো! নেক্সট এই তুই শুনলে কিন্তু ভালো হবে না বলে দিচ্ছি!”

–“আচ্ছা ঠিক আছে৷ বলব না!”

কোনো ছেলে যেন তার বান্ধবীকে বিয়ে না করে! প্রথমদিনেই এতো হুকুম! বাপরে! বাপ! আমার মা যে কি করেছে ওর তা সেই ভালো জানে! এই মোহটা যে কখন কাটবে! আর কখন আমি সেই আগের অনিকে ফিরে পাবো কে জানে! এই অস্বাভাবিক অনির সাথে থাকলে আজ আমিও অস্বাভাবিক হয়ে যাবো দেখছি! কথাগুলো ভাবতে-ভাবতে বাথরুমে ওজু করতে চলে যায় তাজ।

চলবে…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here