অনিন্দিতা পর্ব -০৪

#অনিন্দিতা
#৪র্থ_পর্ব
#স্নিগ্ধতা_প্রিয়তা

তাজ ওজু করে এসে দেখে অনি ঘুমিয়ে পড়েছে৷ ওকে ডেকে তুলার জন্য ওর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। ডাকতে গিয়েও এক অজানা কারণে তাজ থেমে যায়৷ ওর ঘুমন্ত মুখটা দেখতে থাকে৷ ডাকবে কিনা ভেবে পায় না।

ওর টেবিলের দিকে চোখ যেতেই একটা স্বর্ণের চেইনের দিকে নজর যায়। ওর মা ওকে দিয়েছিলো অনিকে দেওয়ার জন্য। বিয়ের রাতে স্বামীকে নাকি বউকে কিছু উপহার দিতে হয়। ওদের বিয়েটা যেহেতু হুটহাট হয়ে গেছে, তাই ওর মা নিজের একটা চেইন তাজকে দিয়েছে অনিকে দেওয়ার জন্য। ওর বউয়ের জন্য নাকি আরো কিছু গয়না গড়িয়ে রেখেছে সেগুলো পরে দিবে।

অনিকে চেইনটা দিবে কি করে ওতো ঘুমে বিভোর! ঘুমন্ত মানুষকে ডেকে তুলাটাও ঠিক হবে ন! তাই তাজ অনিকে না ডেকে ওর পাশে শুয়ে পড়ে।

তখনি তাজের মোহরানার কথা মনে পড়ে। ওর মা বলেছিলো মোহরানার আড়াই লক্ষ টাকা অনিকে নাকি আজকেই পরিশোধ করা উচিৎ। আর না হলে কিছু টাকা এখন দিয়ে ওর থেকে মাফ চেয়ে নেওয়া উচিৎ। কারণ মোহরানা হচ্ছে অনির হক। যা দেওয়া তাজের জন্য ফরজ! ওর মা এটাও জানায় যে, তাজের যোগ্যতা অনুযায়ী এতো টাকা মোহরানা করা উচিৎ হয়নি! কিন্তু ওতো এসব বিষয়ে এত জানতো না! তাই কোনো গুরুত্ব দেয়নি! ওর মায়ের কথা শুনে একটু অস্বস্তি লাগতে থাকে। ও বিছানা থেকে উঠে বেলকনিতে গিয়ে ওদের বিয়ের মুহূর্তগুলো ভাবতে থাকে!

হঠাৎ অনির ঘুম ভেঙে গেলে নিজেকে বিছানায় একা আবিষ্কার করে চমকে যায়! ওর পাশেতো অহির থাকার কথা। ওতো একা থাকতে ভীষণ ভয় পায়! তারপর অহিকে ডাকতে যাবে তখনি ওর মনে পড়ে যায় যে, আজ ওর বিয়ে হয়ে গেছে তাজের সাথে। কিন্তু তাজকেতো ও ওজু করতে বলেছিলো!

–“ওহ শিট! ”

নিজেই নিজেকে গালি দিতে থাকে অনি। তারপর পাশে তাজকে না দেখতে পেয়ে ভাবে যে, তাজ হয়তো আফিয়ার রুমে গেছে। ও বিছানা থেকে নেমে দরজার দিকে যাবে তখনি বেলকনির দিকে নজর যায়। সেখানে অন্ধকারে কারো ছায়া দেখে বুঝে যায় যে, তাজ ওখানেই আছে৷ ও আস্তে করে তাজের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর ফিসফিস করে ভয়ংকর গলায় বলে,

–“নতুন বউকে একা রেখে তুই এখানে কি করছিস! বোকা মানব! আজ আমি তোর ঘাড় মটকাবো! তারপর তোর সব রক্ত চুষে খাবো! হিহিহি….!”

তাজ চমকে পিছন ফিরে তাকায়। প্রথমে ভয় পেয়ে গেলেও পরে যখন বুঝতে পারে যে, ওটা অনি তখন কিছুটা শান্ত হয়। তারপর জোরে একটা শ্বাস নিয়ে বলে,

–“এই অভ্যেসটা তোর যাবে না নাকি!”

অনি মুখটা গোমড়া করে বলে,

–“আবার তুই!”

–“ওকে বাবা তুমি! হয়েছে? খুশি? ”

–“হুম। আমাকে ডাকোনি কেন?”

–“ঘুমাচ্ছিলে। তাই!”

–“নামাজ….!”

–“থাক! এতরাতে আর নামাজ পড়তে হবে না!”

–“মা কি ভাববে বলোতো!”

–“কিরে একদিনেই তুই আদর্শ বউ হয়ে গছিস নাকি? আমারতো মনে হচ্ছে….”

–“আবার তুই! আমি তোমার সাথে ফ্রি হওয়ার চেষ্টা করছি! বউয়ের মতো বিহেভ করার চেষ্টা করছি! আর তুমি! একটু কম্প্রোমাইজ করলেই পারো আমার সাথে!”

–“তুই কি… না মানে, তুমি কি সত্যিই আমার বউ হতে চাও? নাকি আমার মা তোমার ব্রেইন ওয়াশ করেছে বলে এমন অদ্ভুত আচরণ করছো? আমার পাঁচ বছর ধরে চেনা মানুষটাকে আজ বড্ড অচেনা লাগছে! ”

–“কারণ আমরা এক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেছি! যা হয়তো আমাকে এমন পরিবর্তন করে দিয়েছে! আমি নিজেও নিজেকে বুঝতে পারছি না! কেন জানি ওই ইমতিয়াজ….! ”

–“উনার কথা কি খুব মনে পড়ছে?”

–“আরে আমার পুরো কথাটাতো শেষ করতে দিবে নাকি! ওই ধোঁকাবাজটার কথা কেন জানি আমার তেমন মনে পড়ছে না!”

–“মনে না পড়লে কি এখন এমনি তার নাম নিলে!”

তাজ মনটা একটু খারাপ করে কথাট বলে। তারপর কথার প্রসঙ্গ বদলানোর জন্য ওর মায়ের দেওয়া চেইনটা অনির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,

–“এটা তোমার বিয়ের রাতের গিফট। মা দিয়েছিলো তোমাকে দেওয়ার জন্য! দেখো পছন্দ হয়েছে কিনা! আর মা বলছিলো মোহরানার বিষয় নিয়ে তোমার সাথে কথা বলতে। আমি যতটা পারি কাল তোমাকে শোধ করে দেবো! তুমি চাইলে আমাকে মাফও করে দিতে পারো বাকিটা!”

–“বাকিটা হবে কেন! আমি পুরোটাই মাফ করে দিলাম! আমি ওসব টাকা দিয়ে কি করব!আর তুমি এটা আমার হাতে কেন দিলে? এটা কি আংটি নাকি! এক্ষুনি আমার গলায় পড়িয়ে দাও।নইলে কিন্তু আমি নেবো না!”

তারপর তাজ অনিকে চেইনটা পড়িয়ে দেয়৷ তাজ অবাক হয়ে যাচ্ছে অনির ব্যবহার দেখে। ও কিছুই বুঝতে পারছে না!

আসলে অনি স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছে তাজের সাথে। মুখে যতই না বলুক না কেন, আসলে ইমতিয়াজ এর কথা ওর খুব মনে পড়ছে! কিন্তু তাজকে সেটা বুঝতে দিতে চাইছে না। তাজের সাথে কথা বলে ইমতিয়াজ এর কথা ভুলে থাকতে চাইছে! ভালবাসার মানুষটিকে ভুলে অন্যকাউকে মেনে নেওয়াটা কি এতটাই সহজ! তারপরও অনি প্রাণপণ চেষ্টা করছে তাজকে মন থেকে মেনে নেওয়ার জন্য!

–“আচ্ছা এসব নিয়ে কাল কথা বলা যাবে৷ এবার ঘুমিয়ে পড়ো! হঠাৎ উঠে পড়লে যে ঘুম থেকে? ”

তাজের কথায় চমকে উঠে অনি। তারপর আমতা-আমতা করে বলল,

–“পাশে কেউ না থাকলে ভয় লাগে। তাই বেশিক্ষণ ঘুমাতে পারি না। ”

–“আচ্ছা, আমিও যাচ্ছি। চলো!”

তারপর দুজনে ঘুমিয়ে পড়ে।

সকালে তাজের মা নামাজ পড়ার জন্য তাজ আর অনিকে অনেকবার ডাকলেও সাড়া না পেয়ে নিজেই নামাজ পড়ে নেয়। তারপর কোরান পড়ে নাস্তা বানাতে যায়।

হঠাৎ ফোনের রিংটোন শুনে তাজের ঘুম ভাঙলে দেখে যে আটটার বেশি বেজে গেছে। ও ধড়াস করে বিছানা থেকে উঠে পড়ে। যেহেতু অনির ফোন বেজেই চলেছে, অগত্যা অনিকে ডেকে তুলে তাজ ওয়াশরুমের দিকে চলে যায়।

অনি ঘুম-ঘুম চোখে দেখে যে অহি কল করেছে৷ কল রিসিভ করতেই অহি ওপাশ থেকে চঞ্চল কণ্ঠে বলতে থাকে,

–“আপু তুই এখনো ঘুমাচ্ছিস? কয়টা বাজে ঘড়ি দেখেছিস? আপু তুই এখন নিজের বাসায় নেই! শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিস। প্রথমদিনেই কেউ এতো বেলা করে ঘুম থেকে উঠে নাকি! সেই কখন থেকে ফোন করে যাচ্ছি কোনো পাত্তাই নেই!”

অহির কথা শুনে অনি সময় দেখে চমকে যায়। তারপর বিছানা থেকে নামতে-নামতে অহিকে বলে,

–“শোন, তোর সাথে আমি পরে কথা বলছি! দেখি মা কি করছে। কি ভাববে বলতো!”

–“আমিওতো সেটাই বলছি রে গাধী! মা থাকলে ঠিক-ই সব শিখিয়ে-পড়িয়ে দিতো! মায়ের কাজটা এখন আমাকেই করতে হচ্ছে!”

অনি হেসে দিয়ে বলে,

–“হয়েছে পাকনা বুড়ী! আর তোমার জ্ঞানের ঝুলি খুলতে হবে না! আমি জানি তুমি অনেক জ্ঞানী! আমার জ্ঞানবতী! পরে কথা বলছি!”

–“রাখি মানে! আসল কথাটাইতো বলা হয়নি!”

–“আবার কি আসল কথা? ভণিতা না করে বলে ফেল!”

–“সকালেই পিহু আপুর বড়ভাই এসেছিলো!”

–“পলাশ ভাইয়া?”

–“হুম, ওইতো উনি। সে কি কান্ড!”

অহির কথা শুনে অনি ফোনটা কানে নিয়ে বিছানার উপরে বসে পড়লো। ততক্ষণে তাজ ফ্রেস হয়ে রুমে চলে এসেছে। ফোনের ওপাশ থেকে অহি হেসে বলল,

–“এসেই পিহু আপুকে ঠাস-ঠাস করে কয়েকটা থাপ্পড় বসিয়ে দিয়েছে!”

–“সে কি? কেউ বাধা দিলো না? ইমতিয়াজ ও কিছু বলল না?”

–“আরে কে কি বলবে! পিহু আপু আর ওই ভাইয়া ছাড়া কেউ ছিলোই না!”

–“তাহলে তুই জানলি কেমনে?”

–“আমি আর ইমা লুকিয়ে দেখেছি! ”

অনি কিছুটা রেগে গিয়ে অহিকে বলল,

–“অহি, তোকে না কতবার বারণ করেছি যে, কখনো লুকিয়ে কারো কথা শুনবি না! এসব একদম ঠিক কাজ না! নেক্সট যেন আর এমন না হয়!”

–“আরে বাদ দেতো! এই পিহু আপু আর ইমতিয়াজ ভাইয়াকে যদি আচ্ছামত শিক্ষা না দিয়েছি! তো আমার নামও অহি নয়! আমার বোনের সাথে ধোঁকাবাজি! এর শাস্তিতো পেতেই হবে!”

তাজ রুম থেকে বের হয়ে গেলো। অনি সেদিকে তাকিয়ে অহির বলা কথাগুলো শুনছিলো। তাজ রুমের বাইরে যেতেই অনি অহিকে আবার একটা ধমক দিয়ে বলল,

–“খুব সেয়ানা হয়ে গেছো। তাইনা! ”

–“আরে তারপর কি হলো শোন..!

–“আচ্ছা, তাড়াতাড়ি বল! তাজের মা যে আমাকে কি ভাবছে কে জানে! তার উপরে তুই বকবক শুরু করেছিস!”

–“পিহু আপুকে কয়েকটা থাপ্পড় দেওয়ার পর পলাশ ভাইয়া সেই বকাঝকা করছে। পিহু আপুতো চুন্নি বিল্লির মতো চুপ করে ছিলো!”

–“পলাশ ভাইয়াকে দেখে ও ভীষণ ভয় পায়!”

–“তারপর হাত ধরে বলল, ‘এক্ষুণি আমার সাথে চল। এ বাড়িতে আর এক মুহূর্তও নয়! একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের এতো বড় ক্ষতি তুই কি করে করতে পারলি! তাও আবার তোর প্রিয় বান্ধবীর! তোকে আমার বোন ভাবতেই ঘৃণা হচ্ছে’!”

–“তারপর কি হলো?”

–“তারপর আর কি পিহু আপু হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘আমি যা করেছি ঠিক করেছি! আমি যাবো না এখান থেকে! এটা আমার শ্বশুরবাড়ি!’ তারপর দুই ভাইবোনে কিছুক্ষণ ঝগড়া করলো। ততক্ষণে ইমতিয়াজ ভাইয়া চলে এসেছিলো। তাই আমরা পালিয়ে চলে আসি ওখান থেকে।”

–“পিহু কি গেছে ওর ভাইয়ের সাথে?”

–“আরে না! তারপর কি হলো জানিনা! একটু পর ওই ভাইয়াটা একাই চলে গেলো।”

–“ওহ আচ্ছা!”

–“তা তোরা কখন আসবি? নাকি আমাদের আসতে হবে?”

–“জানিনা রে! তাজ আর ওর মা কি করবে! বাবা ঠিক আছেতো?”

–“হ্যাঁ। আর শোন, যাইহোক না কেন তুই কিন্তু আসবি! তাজ ভাইয়াকে নিয়ে চলে আসবি! আমাদের যাওয়াটা হয়তো ঠিক হবে না! বাণীতে আমাদের বাবা!”

–“আচ্ছা রাখি। দেরি হয়ে গেলো!”

তারপর ফোন রেখে তাড়াতাড়ি ফ্রেস হতে গেলো অনি।

তাজ রান্নাঘরে গিয়ে দেখলো ওর মা নাস্তা বানাচ্ছে। নাস্তা বানানো প্রায় শেষ। তাজকে দেখে উনি বললেন,

–“বৌমা কোথায় রে?”

তাজ নিজের মায়ের পাশে গিয়ে বলতে লাগলো,

–“মা, কাল রাতে তুমি কি অনির উপরে কোনো যাদু করেছিলে নাকি?”

ওর মা হেসে বললেন,

–“পাগল ছেলে! আমি কি কোনো যাদুকর নাকি! কেন কি হয়েছিলো?”

–“ও কেমন অদ্ভুত আচরণ করছিলো! যা কখনো করে না!”

–“তার আগে বল সেটা ভালো ব্যবহার ছিলো নাকি খারাপ?”

–“ভালো! অনেক ভালো! তাইতো আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি!”

–“একমাত্র ভালবাসার যাদুই পারে মানুষকে অনেকটা বদলে দিতে! নইলে কি দুই প্রান্তের দুইটি অচেনা মানুষ সারাজীবন একসাথে কাটাতে পারতো! এখন তোরা দুজন যে, একই বৃন্তের দুটি ফুল! আর আমার দায়িত্ব ফুল দুটিকে আগলে রাখা! তা অনি কোথায়? উঠেছে?”

–“হ্যাঁ। অহির সাথে কথা বলছিলো।”

এমন সময় অনি সেখানে এসে মাথা নিচু করে তাজের মাকে বলতে থাকে,

–“সরি মা! উঠতে দেরি হয়ে গেলো! আসলে বাসায় সকালে উঠা হয় নাতো! তাই….”

ওকে থামিয়ে দিয়ে তাজের মা বলল,

–“অভ্যেস কি আর অতো সহজে চেঞ্জ হয়! আস্তে-আস্তে ঠিক হয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ। তোমাকে শুধু কাজগুলো করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে হবে।…তোমরা যাও, নাস্তা রেডি!”

অনি একবার যায়, একবার পিছনে ফিরে, আবার যায়! ওর এমন করতে দেখে তাজের মা বলল,

–“কিছু বলবে?”

অনি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালে ওর শাশুড়ী মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলল,

–“নিজের মা ভেবে বলে ফেলো!”

চলবে..?

(গল্পটা কেমন হচ্ছে জানাতে ভুলবেন না। আর ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ!)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here