#তুমি_বললে_আজ_২
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ২৪.
.
দূরত্ব যদি মানুষের আবেগ ভুলে যেতে সাহায্য করে, তাহলে আমি কেন পারি নি? কিশোরী বয়সের সদ্য জন্ম নেওয়া ভালোবাসা নামক আবেগকে কেন ভুলে থাকতে পারি নি। সময় ও বয়সের সাথে সাথে অনুভূতি গুলো কেনই বা এতটা প্রখরতা হয়ে উঠলো। ওনার সাথে বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি বলেই কি? একে অপরের সাথে গভীরভাবে জুড়ে গেছি বলেই কি ওনার প্রতি আমার অবাধ্য অনুভূতি গুলো উপচে বেরিয়ে এসেছে?
তাসফি ভাই দু’ গালে আলতো করে হাত রেখে ডেকে যাচ্ছেন আমায়, ওনার কণ্ঠ ভেসে আসতেই বন্ধ চোখ দুটো আবারও খোলার চেষ্টা করে গেলাম। মিটমিট করে চোখ দুটো খুলে ভেসে উঠলো ওনার মুখ। ভালোভাবে দেখতেই খেয়াল করলাম অনেকটা অস্বাভাবিক লাগছে ওনাকে দেখতে। উঠে বসার চেষ্টা করলে বাঁধা দিলেন উনি, শুয়ে থাকতে বললেন। ওনার হাত জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে আস্তে করে বললাম,
“কি হয়েছে? এমন লাগছে কেন আপনাকে?”
আমার কথার কোন জবাব দিলেন না উনি। বললেন,
“তুমি ঠিক আছো তো রুপু? কেমন লাগছে এখন, খুব বেশিই খারাপ লাগছে কি?”
“উহুম! ঠিক আছি তো আমি।”
“তোমার এই ‘আমি ঠিক আছি’ কথাটা বিশ্বাস হয় না আমার, একদম বিশ্বাস হয় না। যখনি বলো ‘আমি ঠিক আছি’ তখনই তুমি অসুস্থ হয়ে যাও। একটু আগেও বলেছিলে ঠিক আছো, তাহলে এতটা অসুস্থ হয়ে গেলে কেন?”
একটু থেমে জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিলেন। কিছুটা সময় নিয়ে আবারও বললেন,
“ইস্! আমারই উচিত হয় নি তোমাকে নিয়ে আসাটা। সাগর রাহাতদের কথায় কেন যে রাজি হলাম? আমার জন্য এতটা অসুস্থ হতে হতো না তোমায়।”
ওনার দিকে তাকিয়ে পরিমাপ করার প্রয়াস চালিয়ে গেলাম ওনার চিন্তিত হবার। কিন্তু ঠিক ধরতে পারলাম না, শুধু বুঝতে পারলাম আমাকে নিয়ে ওনার উদ্বিগ্নতা। কেন জানি অকারণেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। ওনার দিকে তাকিয়ে হালকা হেঁসে উঠলাম, কিছুটা অবাক চোখে তাকালেন তাসফি ভাই। সেদিকে পাত্তা না দিয়ে দু’ হাত বাড়িয়ে ওনার গলা জড়িয়ে নিলাম, গলার ভাঁজে মুখ ডুবিয়ে চুপ করে রইলাম কিছুক্ষণ। একটু সময় নিয়ে বললাম,
“আপনি আমার সাথে আছেন তো, কি হবে আমার? আপনি আমার পাশে থাকলে কোন ক্ষতিই আমাকে ছুতে পারবে না।”
“দিবো না আমি। আমি যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন তোমার কিছু হতে দিবো না। আমি যখন থাকবো না, তখন শুধু নিজেকে প্রটেক্ট করে নিও। আগলে রেখ নিজেকে।”
“কি বলছেন এসব? কি হবে আপনার? পারবো না আমি নিজেকে প্রটেক্ট করতে, নিজেকে আগলে রাখতে পারবো না আপনি ছাড়া। আপনাকেই আমাকে সামলাতে হবে।
“কেন? সারাজীবন তো আর বেঁচে থাকবো না আমি, কোন এক সময় তো দাদুভাই আর নানু মনির মতো তোমাকে ছেড়ে যেতেই হবে। হয়তোবা খুব তারাতাড়িই হবে, তখন তো সামলাতে হবে নিজেকে।”
“না… এসব কথা আর বললেন না আপনি, একদম বলবেন না।”
ধমকের সুরে কথাটা বলতেই হেঁসে উঠলেন উনি। দু’ হাতে নিজেও জড়িয়ে নিয়ে বললেন,
“ইস্! বউটা যে আমাকে এতটা চোখে হারাচ্ছে, সেটা তো জানতামই না। সাথে ভালোবাসতেও শুরু করেছে দেখি।”
“মোটেও না। কে বলেছে, আপনাকে আমি চোখে হারাচ্ছি? আর ভালোবাসা…. সেরা তে একদমই না।”
“ওও… তাই না? তাইলে আমাকে হারানোর এতটা ভয় কেন তোমার?”
ওনার কথার কোন জবাব না দিয়ে নিরুত্তর হয়েই রইলাম। কি জবাব দিবো ওনার কথার? আমি তো নিজেই জানি না ওনাকে ভালোবাসি কি না, কিন্তু হারাতে চাই না ওনাকে। আরও একবার হারাতে চাই না ওনাকে।
হঠাৎ কিছু একটা মাথয় আসতেই তড়িৎ গতিতে তাসফি ভাইয়ের থেকে সরে আসার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ওনার শক্তপোক্ত হাতের বাঁধনে আঁটকে থাকার ফলে বৃথা গেল আমার চেষ্টাটা। ওনার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতেই ধমকে উঠলেন উনি।
“অসুস্থ শরীর নিয়েও পেঙ্গুইনের মতো লাফালাফি না করলে হচ্ছে না?”
“ছ্..ছাড়েন প্লিজ, সরে যান না একটু।”
আমার কথা কানেই নিলেন না উনি। কথাটা না শোনার ভান করে চুপ করে রইলেন। লজ্জা আর অস্বস্তিতে কিছুই বলতে পারছি না ঠিকভাবে। যখন বুঝতে পেরেছি একই চাদরের আড়ালে লেপ্টে রয়েছি ওনার সাথে, ঠিক তখন থেকেই একরাশ লজ্জা আর অস্বস্তিতে ঘিরে রেখেছে আমায়। ওনার এতটা কাছে, এভাবে একই বিছানায়, একই চাদরের নিচে কখনোই আসা হয় নি আমার। এতটা গভীরভাবে ছোঁয়া কখনোই পাই নি। কেমন জানি অদ্ভুত এক অনুভূতিতে ঘিরে ধরলো আমায়, সাথে বুকের টিপটিপ শব্দের প্রতিধ্বনি।
মাথা সরিয়ে আবারও ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। ওনার এতটা কাছে থাকা দায় হয়ে উঠেছে যেন। এবার উনিও মাথা তুলে তাকালেন আমার দিকে। কপাল কুঁচকে ভুরু উচিয়ে বললেন,
“কি…. একটু শান্ত হয়ে চুপ করে থাকা যায় না?”
“প্লিজ ছাড়েন। কেমন জানি লাগছে আমার, অস্বস্তি হচ্ছে অনেক।”
“কেমন লাগছে? হুম!”
“জানি না আমি, বোঝাতে পারবো না আপনাকে। সরে যান একটু।”
প্রতিত্তোরে কিছু না বলে হাসলেন উনি। গালে আলতো করে ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে বললেন,
“কিন্তু এখন থেকে তো এভাবেই আমাকে তোমার অভ্যাস করে নিতে হবে বউ। আর কিছুদিন পর এভাবেই প্রতিটা রাত কা*টাতে হবে আমার সাথে।”
.
অন্ধকার রুমে হারিকেনের মৃদু হলদেটে আলোতে আবছায়া আলোয় পরিণত হয়ে আছে রুমটা। মাটির ঘুর বাইরে তুমুল ঝড় বৃষ্টির আভাস পরিপূর্ণ ভাবেই বোঝা যাচ্ছে। বৃষ্টির ফোঁটা টিনের চালায় তাদের নিজ গতিতে প্রতিধ্বনি তুলছে। থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে সাথে বাজ পড়ার তীব্র শব্দ। হুট করেই ঝড়বৃষ্টির তান্ডবটা প্রখর হয়ে উঠেছে। রাত ঠিক কতটা, জানা নেই আমার। ঘুমহীন চোখে তাসফি ভাইয়া কে জড়িয়ে আছি তখন থেকে। বিদ্যুৎ চকমকানোর তীব্র শব্দে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার সাহসটা আর হয় নি। সেই সাথে শরীরের মৃদু কম্পনে, ওনার শরীরের একটুখানি উষ্ণতা পাওয়ায় আর ছাড়িয়ে নিয়ে ইচ্ছে হয় নি।
হঠাৎই তাসফি ভাইয়ের কাছ থেকে আজ জানতে ইচ্ছে হচ্ছে, কেন সেদিন হুট করে চলে গিয়েছিলেন উনি। কেন আমার থেকে নিজেকে আড়াল করে রেখেছিলেন। খুব করে জানতে ইচ্ছে হচ্ছে আজকে। উনি যে ঘুমান নি সেটা বুঝতে পেরে ডেকে উঠলাম ওনাকে। ওনার কোন সারা না পেয়ে আবারও ডাকলাম। উনি আস্তে করে হুম বলতেই আমি বললাম,
“একটা কথা বলবেন?”
“হুম….”
“চার বছর আগে কি এমন হয়েছিলো? হুট করে কেনই বা চলে গিয়েছিলেন আমেরিকায়?”
মাথা তুলে তাকালেন উনি। হারিকেনের মৃদু আলোয় খুব ভালোভাবেই ওনার মুখটা নজরে এলো আমার। বললেন,
“হঠাৎ এই কথা?”
“জানি না। হঠাৎ কেন জানি জানতে ইচ্ছে হলো, তাই জিজ্ঞেস করলাম।”
“এসব কথা আজকে থাক রুপু, পরে একসময় নললো। মন ভালো আছে, খারাপ করতে চাইছি না।”
ওনার শক্ত গলায় বলা কথাটা ঠিক পছন্দ হলো না আমার। জানার জন্য জেদ চেপে গেল যেন। কিছুটা জেদ করেই বললাম,
“না… আমি এখুনি জানতে চাই। কেন চলে গিয়েছিলেন হঠাৎ? কি হয়েছিলো আপনার?”
“বললাম না পরে বলবো, এখন মুড খারাপ করতে চাইছি না। চুপচাপ ঘুমানোর চেষ্টা কর।”
“কোন ঘুমানোর চেষ্টা করবো না আমি। আপনাকে বলতেই হবে, কেন সেদিন আপ….”
কথাটা শেষ করার আগেই মুখটা বন্ধ হয়ে গেল আমার, চোখ দুটো বড় বড় আকৃতির ধারণ করলো হঠাৎ নিজের ঠোঁটে ওনার ঠোঁটের স্পর্শ পেয়ে। এক মুহুর্তের জন্য যেন নিজের স্তম্ভিত হারিয়ে ফেলেছি আমি, স্তব্ধ হয়ে মস্তিষ্কে ধারণ করার চেষ্টা করে চলেছি ঠিক কি হচ্ছে আমার সাথে। ব্যাপারটা যতক্ষণে বুঝতে পারলাম ততক্ষণে আমার ঠোঁট দু’টো ছেড়ে দিয়েছেন নিজের ঠোঁটের বাঁধন থেকে। হালকা হেঁসে উঠে বললেন,
“এভাবে কথা বললে কিন্তু আমার-ই লাভ রুপু, তোমার এই ফালতু কথাগুলো বন্ধ করার উছিলায় চুমু তো খেতে পারবো।”
“ছি! অ*সভ্য লোক একটা। কি করলেন এরা আপনি?”
“কেন? কি করেছি বুঝতে পারছো না?”
“না… পারছি না। দেখি ছাড়েন আমায়, অ*সভ্য বজ্জাত লোক একটা।”
“তাহলে মুখে নয়, বরং ঠোঁট দিয়েই দেখিয়ে দেই কি করেছি।”
বলেই একটু থামলেন উনি। হাত দিয়ে আলতো করে আমার ঠোঁটে স্পর্শ করলেন। কিছুটা কেঁপে উঠলাম। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বললেন,
“তুমি বললে আজ শুধু চুমু নয়, অনেক কিছুই হতে পারে রুপু। ইউ নো হোয়াট, আমার কিন্তু সেই অধিকারটা আছে।”
কথাটা বলে একটুও সময় ব্যায় করলেন না। গভীরভাবে ছুঁয়ে দিলেন ওনার শুষ্ক ঠোঁট দু’টো আমার ঠোঁটের ভাঁজে। আবারও কেঁপে উঠলাম আমি। হাত দু’ টো সহসায় চলে গেল ওনার ঘারে। খারাপ নয়, কেন জানি ভালো লাগার অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগলো। চোখ দু’টো বন্ধ করে অনুভব করে গেলাম ওনার স্পর্শগুলো। কিছুটা সময় নিয়ে আমাকে ছেড়ে দিলেন, মাথা তুলে সরে যেতেই চোখ খুলে তাকালাম ফট করে। ওনার হঠাৎ ছাড়িয়ে নেওয়াটা যেন ঠিক মেনে নিতে পারলাম না আমি। সময় না নিয়ে মাথা উঠিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম ওনার ঠোঁটের স্পর্শ পেতে। উনি চট করে আমার দিকে চোখ দু’টো নিবদ্ধ করতেই থমকে গেলাম আমি। স্তম্ভিত ফিরে পেলাম নিজের। সাথে সাথে ছিটকে সরে এসে বালিশে মাথা দিয়ে চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে নিলাম। ইস্! কি করতে গিয়েছিলাম আমি এটা, কিভাবেই বা এমনটা করলাম? উফ্! ওনার দিকে তাকাবো কিভাবে আমি? থাকবো কিভাবে আমি ওনার সামনে?
“রুপু…..”
ওনার ঘোর লাগা কণ্ঠে কেঁপে উঠলাম আমি। ওনার ডাকে৷ সারা দেবার সাহস নেই আমার, আর না আছে ওনার দিকে তাকানোর সাহসটা। একটু সময় নিয়ে আবারও ডেকে উঠলেন উনি। বললেন,
“রুপু…. এই রুপুসোনা, তাকাও আমার দিকে। এ্যাই মেয়ে…. ”
ওনার আবেগী মাখা কণ্ঠস্বরে কেন জানি ফেরাতে পারলাম না ওনাকে। মনে অনেকটা সাহস নিয়ে টিপটিপ করে চোখ খুলে তাকালাম। আস্তে করে কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,
“স…সরি! আর হবে না, আসলে তখন হঠাৎ….”
“আমাকে পাগল বানিয়ে, আর হবে না কেন বলছো বউ? আমি তো সামলাতে পারছি না নিজেকে। তোমার এই ছোট্ট পাগলামিতে পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি।”
ওনার এই ঘোর লাগা কণ্ঠে ধরে রাখতে পারলাম না নিজেকে। ঈষৎ কেঁপে উঠে অজান্তেই দু’ হাতে খামচে ধরলাম ওনার ঘারে। প্রথম পুরুষের প্রথম ছোঁয়ায় হাজারো অনুভূতিতে ঘিরে ধরলো আমায়। এতদিনের দমিয়ে রাখা সুপ্ত অনুভূতি গুলো ডানা ঝাপটিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইলো। বুকের তীব্র টিপটিপ প্রতিধ্বনির সাথে শ্বাস প্রশ্বাসের আনাগোনাও বেড়ে যেতে লাগলো। তখনই ভেসে আসলো ওনার কণ্ঠস্বর।
“রুপু…. এ্যাই রুপুসোনা!”
“হুম….”
“তুমি বললে আজ আমার এতদিনের যত্ন করা ভালোবাসা দিয়ে ভালোবাসার চাদরে তোমায় মুড়িয়ে নিতে পারি, তোমার সবকিছু নিজের করে পেতে পারি, আমার এত দিনের যত্নে গড়া জিনিস গুলো একান্তই আমার করে নিতে পারি।”
.
.
চলবে…..
রি-চেকই দেওয়ার সময় হয় নি, ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। পরের পর্ব আগামী বুধবারে পাবেন। ভালোবাসা অবিরাম।🖤