#তুমি_বললে_আজ_২
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ২৭.
.
প্রিয় মানুষটার হাত ধরে পাশাপাশি চলতে পারাটা সবার ভাগ্যে হয় না। যাদের হয় তারা নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান। আর আমি? আমিও হয়তো সেই ভাগ্যবাদের কাতারে নিজের নামের একাংশ লিখে ফেলেছি। হ্যাঁ, তাসফি নামটার সাথে আজকের পর থেকে গভীরভাবে নিজের নামটা মিশিয়ে ফেলেছি। জড়িয়ে নিয়েছি নিজের সাথে।
দুপুরের কিছুটা আগেই বাসায় চলে এসেছি তাসফি ভাইয়ের সাথে। বাসার সবার ভাবভঙ্গি দেখে কিছুটা অবাকও হয়েছিলাম। কেউ কোন প্রশ্ন বা কোন কথা তুলে নি আমাদের বাইরে থাকার বিষয়টা নিয়ে। অবাকের রেশ ধরে তাসফি ভাইয়ের দিকে তাকাতেই উনি নিঃশব্দে হেঁসেছিলেন। তারপর শুরু হয়েছিলো অত্যাচার, কাজিন মহলের অত্যাচার।
বড়রা কিছু না বললেও বজ্জাত কাজিন মহলের হাত থেকে কিছুতেই ছাড় পাই নি। তাসফি ভাইয়াকে কিছু না বলে, একের পর এক খোঁচা দিয়েই গিয়েছিলো আমাকে। আর মি. বজ্জাত তাসফি সবার সাথে তাল মিলিয়ে মজা নিচ্ছিলেন আমার। সবার এত এত খোঁচা দেওয়ার মাঝে কারোর নজরে না এলেও রিফাপুর ঠিকই নজরে এসেছিলো আমার গলার ভাঁজে লালচে দাগগুলো। সময় না নিয়েই তড়িৎ গতিতে তাসফি ভাই ও আমাকে উদেশ্য করে বলে উঠেছিলো,
“বনু এটা কিন্তু একদম ঠিক করলি না তোরা। আজ বাদে কাল আমার বিয়ে, অথচ তোরা বাসর সেরে আসলি? এটা কিন্তু আমার সাথে না-ইনসাফি করলি।”
রিফাপুর কথায় থমকে গিয়েছিলাম এক মুহুর্তের জন্য। চমকে উঠে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে ছিলাম তাসফি ভাইয়ের দিকে। বাকিরাও ততক্ষণে চুপ হয়ে গিয়েছিলো রিফাপুর কথায়। আমার তাকানো তে উনি হয়তো কিছুটা বুঝতে পেরেছিলেন, সবার দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে রিফাপুকে বলেছিলেন,
“দূর কিসব বাজে বকছিস রিফা? কিসের বাসর? বউকে তো বিয়ে করে ঘরেই তুলতে পারছি না, বাসর তো অনেক দূর। তোরা আসলেই মীরজাফরের বংশধর।”
“সেটা তো দেখতেই পারছি তাসফি ভাই। আহা্! বনুটা আমার সারা গায়ে লাল নীল ভালোবাসার চিহ্ন নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর ভাইটা আমার বউয়ের জন্য আফসোস করে ম*রছে। এটা কেন কথা?”
আরেক দফায় চমকে উঠলাম রিফাপুর কথায়। সাথে সাথে গায়ের ওড়না টেনে ভালোভাবে জড়িয়ে নিলাম গলায়। এদিকে খুক খুক করে কেশে উঠলেন তাসফি ভাই, ছোট ভাইবোনের সামনে অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো যেন। বাকিরা শব্দ বিহীন হেঁসে উঠলো, যা চোখ এড়ালো না আমার। হাজারো অস্বস্তি, লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছিলো যেন। চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে শ্বাস টেনে নিলাম জোরে করে, তারপরই কোন দিকে না তাকিয়ে এক ছুটে চলে আসি নিজের রুমে।
.
দুপুর গড়িয়ে বিকেল এখন, কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যা নামবে। তখন রুমে আসার পর আর বাইরে যাওয়া হয় নি আমার। আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেছিলাম। রাতে ঠিকভাবে না ঘুমানোর ফলে ঘুমটাও গাড়ো হয়ে উঠেছিলো। বেশ কিছু সময় আগে ঘুমটা ভাঙলেও অলস ভঙ্গিতে শুয়ে আছি বিছানায়। ভেবে চলেছি কালকে থেকে তাসফি ভাইয়ের সাথে কাটানো কিছু মুহুর্ত। হাতে হাত রেখে বহুদূর একসাথে পারি দেবার কিছু স্বপ্ন, শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত একসাথে পথ চলার একমুঠো ভরসা।
দরজায় নক করার শব্দে নিজের ভাবনা গুলো ছুটে গেল। বিছানা ছেড়ে উঠে বসে দরজার দিকে তাকালাম, বোঝার চেষ্টা করলাম কে হতে পারে দরজার অপর পাশে। আমার ভাবনার মাঝে আবারও বেশ শব্দ করে দরজা ধাক্কা দিলো, ভেবে আসলো তাসফি ভাইয়ের গলা। ওনার গলা শুনে ভাবলাম কিছুতেই দরজা খুলবো না, ওনার সামনে পরে আর কিছুতেই লজ্জায় পরবো না। কিন্তু আমার ভাবনাকে দূরে ঠেলে এবার ধমকে উঠলেন যেন। উপায় না পেয়ে তড়িঘড়ি করে নেমে গেলাম বিছানা ছেড়ে, দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম।
“ভাবলাম ম*রে টরে ছিলি নাকি। এতক্ষণ কি করছিলি? দরজা খুলতে এতক্ষণ লাগে? বেয়াদব!”
শান্ত সুরে কথাটা বললেও শেষ কথাটা বেশ জোরেই বলে উঠলেন। ওনার ধমকে চমকে উঠলাম কিছুটা। আমতা আমতা করে বললাম,
“না… মানে আমি তো….”
“কি না মনে… না মানে করছিস? সামনে থেকে সর, বেয়াদব!”
ওনার আরেক দফা ধমকে সাথে সাথে সরে গেলেন দরজার সামনে থেকে। উনি সময় না নিয়ে রুমে ঢুকে গেলে। হাতের ব্যাগ গুলো বিছানায় রাখতেই এগিয়ে এলাম। বললাম,
“কি এগুলো? এতগুলো ব্যাগ কেন? কিসের এগুলো?”
জবাব দিলেন না উনি, ব্যাগ গুলো রেখেই দরজার কাছে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলেন। বিছানার কাছে এগিয়ে আসতেই আবারও জিজ্ঞেস করলাম,
“কি হলো, বলছেন না কেন? কি আছে এতে, কার জন্য?”
“তোর জন্য সব, কি আছে নিজেই দেখে নে।”
অবাক প্রচন্ড। এতগুলো শপিং ব্যাগে আমার জন্য আবার কি থাকতে পারে? অনেকটা কৌতুহল নিয়ে একটা ব্যাগ থেকে ভেতরের থাকা জিনিসটা বের করতেই আরও অবাক হলাম। শাড়ি? আর সেটাও আমার জন্য? আরেকটা ব্যাগ খুলতেই আবারও একটা শাড়ি বেরিয়ে এলো। অবাক হয়ে তাসফি ভাইয়ের দিকে তাকালাম, পাত্তা দিলেন না উনি। ওনার থেকে চোখ ফিরিয়ে আরেকটা ব্যাগ খুললাম, এবার বেরিয়ে এলো জামা। প্রচন্ড অবাকের রেশ ধরে একে একে সবগুলো ব্যাগে রাখা জিনিসগুলো বের করলাম। এতকিছু দেখে অবাকের চরম পর্যায়ে চলে গেলাম যেন। শাড়ি, জামা এত এত চুড়ি সহ একগাদা জিনিস দেখে অবাকের চরম পর্যায়ে চলে গেলাম যেন। বিষ্মিত নয়নে তাকিয়ে রইলাম জিনিস গুলো দিকে। তাসফি ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে অবাকের রেশ ধরেই বললাম,
“এগুলো আমার জন্য?”
জবার দিলেন না উনি। কিছু না বলে আমার হাত টেনে নিয়ে ছোট একটা প্যাকেট একটা ধরিয়ে দিলেন হাতে।
“এগুলো আবার কি?”
বলতে বলতেই হাতের প্যাকেটটা খুলে ফেললাম। বেরিয়ে এলো কয়েকটা ওষুধ। বুঝতে পারলাম না ঠিক কিসের ওষুধ এগুলো। ওনার দিকে তাকিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই উনি বললেন,
“মেডিসিন গুলো খেয়ে নে।”
“কিসের মেডিসিন এগুলো?”
“সকালে পাইনি মেডিসিন গুলো, তাই এখন নিয়ে আসলাম। জ্বরের, ব্যাথার আর….”
“কিসের?”
“খেতে বলছি খা, এত কথা বলছিস কেন? বেয়াদব!”
“আজব তো, এমন ধমকাচ্ছেন কেন? বললেই তো হয়।”
“বললেও তোর এই মস্তিষ্ক বিহীন মোটা মাথায় কিচ্ছুটি ঢুকবে না। কথা না বলে মেডিসিন গুলো খেয়ে নে, কোন রিক্স নিতে চাইছি না।”
এবার আর কথা বাড়ালাম না, কিছুটা আন্দাজ করে নিলাম বাকি ওষুধটা ঠিক কিসের হতে পারে। কিছু না বলে ড্রেসিং টেবিলের কাছে গেলাম, পানির বোতল নেবার জন্য। যেখানে সেখানে জিনিস পত্র রাখা আমার বদঅভ্যেস বলা যা। ঠিক তেমনি পানির বোতলটাও রেখেছি ড্রেসিং টেবিলের উপর।
হাতের প্যাকেটটা রেখে পানির বোতল হাতে নিতেই পিছনে অনুভব করলাম কারোর অস্তিত্ব। সেই কেউটা যে কে, সেটা বলার ইয়ত্তা রইলো না। কিছুটা অবাক হয়ে ‘কি হয়েছে’ বলে পিছন ফিরতে নিলাম, তার আগেই উনি হাতের বাহু ধরে আঁটকে দিলেন। বেনি করা চুলটা সামনে দিয়ে কিছু একটা পড়িয়ে দিতে লাগলেন গলায়। সামনের আয়নায় তাকাতেই বুঝতে পারলাম ছোট একটা লকেট। ওনার পড়ানো শেষ হলে লকেটে হত রেখে পিছন ফিরে ওনার দিকে তাকালাম। বললাম,
“এটা কি? জানেন তো এসব আমার ভালো লাগে না, কি সব লাভ সেপের লকেট আনছেন। এসব লাভ টাভ আমি গলায় ঝুলিয়ে রাখবো?”
কপাল কুঁচকে তাকালেন আমার দিকে। বিরক্তি নিয়ে বললেন,
“চোখ খুলে দেখ আগে, বেয়াদব!”
“কি দেখবে? এটা তো আ….”
লকেটটা ভালোভাবে দেখে আবারও অবাক হলাম। যেটা ভেবেছিলাম সেই ধারণাটা যেন মুহুর্তেই পাল্টে গেল আমার। ছোট্ট একটা লকেটে ‘RT’ শব্দে অসাধারণ একটা ডিজাইন করা। যা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ না করলে সহসায় কেউ ধরতে পারবে না। অবাকের রেশ ধরে ওনার দিকে তাকালাম। উনি গলায় হাত বারিয়ে বললেন,
“খুলবি? দে আমাকে দে, আমি খুলে দিচ্ছি।”
“না…. খুলবেন কে?”
“বাহ্ রে, তোর না পছন্দ হয় নি? এসব গলায় ঝুলে রাখতে পারবি না, তাহলে? আয় এদিকে।”
“কে বলছে আপনাকে? বেশ পারবো। একদম খোলার চেষ্টা করবেন না বলছি।”
হেঁসে উঠলেন তাসফি ভাই। আমার দিকে আরও একটু এগিয়ে এসে দূরত্বটা ঘুচিয়ে দিলেন। বললেন,
“নিজেও করবি না। একদম চেষ্টা করবি না আমার নামের বাঁধন থেকে নিজেকে মুক্তি করতে।”
“উহুঁ!”
বলেই ফট করে জড়িয়ে ধরলাম ওনাকে। চোখ দুটো সহসায় ভিজে উঠলো। চার বছরের এতএত অভিমানের পাহাড় ডিঙিয়ে এই অবাধ্য ভালোবাসার অনুভূতি কি আমার সত্যিই আমার কপালে ছিলো? না-কি এ সবটাই গত চার বছরের প্রতিটি রাত দিনের মতো শুধুই মাত্র স্বপ্ন?
মিনিট দুয়েক পর সরে আসলাম ওনার থেকে। আস্তে করে বললাম,
“কবে এনেছেন এটা? দেখে তো স্বর্ণের বলে মনে হচ্ছে।”
মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানালেন, বোঝালেন যেটা বলছি সেটাই। বললেন,
“ফ্লোরিডায় থাকাকালীন বানিয়ে নিয়েছি। শুধুমাত্র আমার রুপুসোনার জন্য।”
“আর ওগুলো?”
“ওগুলোও! আসার পর তো কেউ একজন আমাকে পাত্তা দিতো না। সারাক্ষণ পালাই পালাই করতো। অভিযোগ নিয়ে থাকা অভিমানী মেয়েটাকে তখন তার ভালোলাগার জিনিস গুলো দিতে পারি নি। তাই আজকে দিলাম।”
আবারও একদল আপরাধের বাসা বাঁধলো মনে। ওনার দিকে তাকিয়ে মিনমিনে গলায় বললাম,
“সরি! তখন তো আপনার প্রতি রাগ করে….”
“উহুঁ! এসব সরি টরি তে আমার চলবে না। অন্য কিছু লাগবে।”
“কি…”
ফট করে কোমরে এক হাত দিয়ে আমাকে টেনে নিলেন। মাথা ঝুঁকিয়ে এনে বললেন,
“উহুঁ! বলবো না, দেখাবো।”
.
হৈ হুল্লোড়, আড্ডা, হাজারো কাজের ব্যাস্ততার মধ্য দিয়েই কেটে গেল আরও দু’টো দিন। এগিয়ে এলো রিফাপুর হলুদের দিন। বাকি দিনগুলোর থেকে আজকের ব্যস্ততা বহুগুণে বেড়ে গেছে। সকাল থেকেই সবাই নিজেদের দ্বায়িত্ব পালনে ব্যস্ত হয়ে পরেছে। আত্মীয় স্বজনে বাসায় পা রাখার জো নেই যেন। বিরক্তিতে ঘিরে ধরলোও ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে রাখতে হচ্ছে।
বহু কষ্টে পড়নের শাড়িটা সামলে নিচে নেমে আসলাম। রিফাপুকে বেশকিছু সময় আগেই হলুদ দেবার জন্য বসানো হয়েছে। তখন থেকেই চলছে একের পর এক ফটোসেশান। টেজের কাছে যেতে যেতে এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে খুঁজতে চাইলাম। পরক্ষণেই বুঝতে পারলাম সেই কেউটা মি. বজ্জাত তাসফি নামক ব্যাক্তি। ভেবেই এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো ঠোঁটের কোণে। আবারও তাকিয়ে ওনাকে খোঁজার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। হাসি মুখটা কালো মেঘের মতো ঘন ঘটায় ঢেকে গেল। সকাল থেকে মানুষটাকে একটা নজর দেখতে পাইনি, কথাটা ভেবে আরও চুপসে গেল মুখটা। এত কষ্টে যার জন্য একটু সাজলাম, ওনার দেওয়া শাড়িটা গায়ে জড়ালাম তাকেই এতক্ষণে দেখাতে পারলাম না, আর না সেই মানুষটার এক নজর দেখা পেলাম।
অভিমানী স্বত্বা আবারও বাসা বেঁধে উঠলো মনে। অভিমানী কণ্ঠে বলে উঠলো, ‘একদম ভাববি না তার কথা, মাথাতেও আনবি না। সে তো একটিবার দেখা দিলো না, সারাদিনে খোঁজও নিলো না। তাহলে তুই কেন খুঁজছিস তাকে?’
মনের কথাগুলোকে সায় দিলাম, আবারও দু’হাতে শাড়িটা সামলে এগিয়ে যেতে লাগলাম সামনের দিকে। হঠাৎই বাঁধ প্রাপ্ত হলো আমার হাতে শক্তপোক্ত হাতের বাঁধনে। পিছন ফিরে তাকানোর আগেই ভেসে আসলো তাসফি ভাইয়ের কণ্ঠস্বর।
“তুমি আমার প্রতিটা ভাবনার একমুঠো সুখ। তুমি আমার আঁধার রাতের ভালোবাসার অসুখ।”
বলার মাঝেই নিজের কাছে টেনে নিলেন আমাকে, বুকের সাথে আমার পিঠ ঠেকিয়ে নিলেন কিছুটা। ঈষৎ কেঁপে উঠলাম আমি, কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই উনি আবারও বলে উঠলেন,
“সেদিনের করা ভুলটা আবারও হয়ে যাবে বউ, এমতাবস্থায় তোমাকে দেখে নিজেকে সামলানো কঠিন হয়ে পরেছে আমার জন্য। অ্যাই এম ফিনিশ রুপুসোনা, অ্যাই এম ফিনিশ!”
.
.
চলবে…..
ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।🖤