তুমি বললে আজ ২ পর্ব -৩৪ (প্রথমাংশ)

#তুমি_বললে_আজ_২
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ৩৪ ( প্রথমাংশ)

.
বেডের সাথে হেলান দিয়ে তাসফি ভাইকে বসে থাকতে দেখে ছলছল করে উঠলো চোখ দুটো। পা দু’টো ভারী হয়ে সেখানেই থেমে গেল। কেন জানি সাহস হয়ে উঠলো না ওনার কাছে যাবার। গত কয়েক দিনের মতো গায়ে এত এত নল লাগালো না থাকলেও শরীরের প্রায় অর্ধেকাংশ জুড়ে ব্যান্ডেজ করা। বিশেষ করে পায়ে ও মাথায়।
রিফাপু হাত ধরে টান দিতেই যেন একটু ঘোর কাটলো। আস্তে করে এগিয়ে আসতে বলে টেনে নিয়ে এলো বেডের কাছে। এতক্ষণে সকলের দৃষ্টিতে নিবদ্ধ হলাম আমি। সকলের চোখে কান্নার রেশ থাকলেও ঠোঁটে লেগে আছে হাসি।

ঘাড় ঘুরিয়ে তাসফি ভাইও তাকালেন আমার দিকে। গভীর চোখে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। চোখের ভাষায় বোঝাতে চাইলেন কিছু একটা। পা ফেলে ওনার কাছে একটু এগিয়ে যেতেই ঘাড় ফিরিয়ে নিলেন, আস্তে করে কিছু একটা বললেন ফুপিকে। বেডডের কাছে যাওয়ার আগেই ফুপি ওনাকে ধরে আলগোছে শুইয়ে দিলেন। ধুক করে উঠলো বুকে, সহসায় মনে হলো উনি কি আমাকে দেখেই এমন করলেন? নাকি ভুলে গেলেন আমাকে?
বুকের টিপটিপ শব্দের তীব্রতা যেন বেড়েই যেতে লাগলো। ওনার আমাকে ভুলে যাবার ভীতিটা ভীষণ ভাবে গেঁথে গেল মনে। জিজ্ঞেস করতে চাইলাম ওনার অবস্থা, কিন্তু আশ্চর্য! কোন কথায় যেন গলা দিয়ে বেরুতে চাইলো না।

রিফাপু আমার অবস্থাটা বুঝতে পারলো কি না জানি না। বলে উঠলো,
“ফুপি তাসফি ভাই…. তাসফি ভাই সবাইকে চিনতে পারছে তো?”

“হ্যাঁ! ও সবাইকে চিনতে পারছে রিফা। কিছুক্ষণ আগেই আতিক স্যার এসে দেখে গেছেন, সবকিছু ঠিক আছে। মাথা ও পায়ের অবস্থা তো দেখতেই পারছো? আপাতত ওর রেস্টের প্রয়োজন। এখন ঘুমালে স্বাভাবিক ঘুমটায় হবে, ভয়ের কোন কারণ নেই।”

রিফাপুর উত্তর দিয়ে সাদিক ভাইয়া বলে উঠলো। বড়মাকে উদ্দেশ্য করে আবারও বললো,
“মা, আপনি আর ফুপি বাসায় চলে যান। এখন তো আর এতজনকে থাকতে হবে না। আমি তো আছি, কোন কিছু প্রয়োজন হলে আমি ম্যানেজ করে নিবো।”

বড়মা সাদিক ভাইয়ার কথায় সায় জানালেও ফুপি শুনলো না। ছেলেকে একটা রেখে কিছুতেই যাবে না, সাফ জানিয়ে দিলো সেটা।

এতকিছুর মাঝে কেন জানি তীব্র যন্ত্রণা হতে লাগলো আমার মনে। তাসফি ভাইয়ের একটুখানি কাছে যাবার জন্য হাসফাস করতে লাগলো মনে। কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে গেলাম ওনার বেডের কাছে, কিছু বলার উদ্যোগ হতেই চোখটা বন্ধ করে ফেললেন উনি। চমকে উঠলাম আমি, বুকের টিপটিপ শব্দটা ক্রমশ্য বৃদ্ধি পেল। হঠাৎ সাদিক ভাইয়া বলে উঠলো,

“রূপা, তুমিও বাসায় চলে যাও। এখানে থেকে কি করবে? এমনিতেই তোমার শরীর ঠিক নেই, খাওয়া দাওয়া ও করছো কয়েকদিনে। বাসায় গিয়ে রেস্ট নাও।”

“ভাইয়া… ভাইয়া উনি কথা বললেন না কেন?”

“এত বড় একটা এক্সিডেন্ট, মাত্র জ্ঞান ফিরেছে, একটু সময় নিয়ে তবেই স্বাভাবিক হবে তো। তুমি রিফা সাথে বাসায় যাও, হসপিটালে থাকার প্রয়োজন নেই।”

“বাসায় গিয়ে আমি থাকতে পারবো না ভাইয়া। যাবো না আমি, এখানেই থাকবো।”

জোর করে বাসায় পাঠিয়ে দিতে চাইলেও আমি শুনলাম না কারোর কথা। সমস্ত ভাবনা বাদ দিয়ে মাথায় শুধু একটা কথায় ঘুরতে লাগলো, একটু স্বাভাবিক হলেই কথা বলতে হবে তাসফি ভাইয়ের সাথে, ক্ষমা চাইতে হবে ওনার কাছে। উনার তো কোন ভুল ছিলো না। সব ভুল তো আমি করেছি, ওনার ভালোবাসায় আঘাত করেছি আমি, অসম্মান করেছি ওনার পবিত্র ভালোবাসার।

.
গত এক সপ্তাহের বেশি সময় চলে গেছে। তাসফি ভাইয়াও বেশ কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। তার সেবায় সবসময় নিয়জিত ছিলেন ফুপি, আম্মু ও বড়মা। আমি শুধু দূর থেকে দেখেই গেছি। ওনার প্রতি সবার সেবার কাছে আমার সেবা যেন কিছুই ছিলো না, তাই ওনার কাছে যাবার কোন প্রয়োজনও পরে নি। তবে গত কয়েক দিনে বেশ খেয়াল করেছি, তাসফি ভাই বাকি সবার সাথে টুকটাক কথা বললেও আমার সাথে একটা বাক্যও উচ্চারণ করেন নি। অবশ্য সাদিক ভাইয়া বলেছিলেন, এক্সিডেন্টের জন্য মুড সুইং হওয়ার কথা। তাই হয়তো ঠিক ভাবে কথা বলছে না।
কিছুক্ষণ আগেই ডাক্তার এসে ওনার চেক-আপ করে গেছেন। বলেছেন, ভয়ের কোন কারণ নেই। কিছুদিন পর এসে মাথা ও পায়ের ব্যান্ডেজ খুলে নিলেই হবে, তবে পায়ের কারণে প্রপার বেড রেস্ট থাকতে হবে।

সবকিছু গুছিয়ে নেওয়া হতেই তাসফি ভাইয়ার বন্ধু বান্ধবরা কেবিনে ঢুকে গেল। সেই সাথে আসলো কিয়ানা আপুও। গত কয়েক দিনেই কিয়ানা আপু এসেছে হসপিটালে। ওনার সাথে কথা না বললেও শুধু দেখে চলে গেছে। আজকে অবশ্য তার ব্যাতিক্রম হলো। সবার সাথে কিয়ানা আপুও কথা বলতে চাইলো তাসফি ভাইয়ের সাথে। ঠিক তখনই উনি ধীর গলায় বললেন, ওনার ভালো লাগছে না, পরে সবার সাথে কথা বলবেন। এখন বাসায় যেতে চান উনি।
বাকিদের মতো আমি মোটেও অবাক হলাম না। আমার মতো হয়তো কিয়ানা আপুও অবাক হলো না। আড়চোখে তাকালো আমার দিকে, ধীর পায়ে এগিয়ে এসে আমার সামনে দাঁড়ালো কিয়ানা আপু। বললো,

“আমি জানি রূপা, তাসফির কাছে আমার এই ভুলের কোন ক্ষমা নেই। তুমিও হয়তো কখনো আমাকে ক্ষমা করবে না। শুধু একটা কথায় বলবো, আগলে রেখ তোমার ভালোবাসা, যত্ন করে রেখে দিও। তাসফি কে আর কখনোই কারোর কথায় অবিশ্বাস করো না। ওর মতো করেই ওকে ভালোবেসো। ভালো থেক রূপা, তাসফির খেয়াল রেখ। আসছি!”

“কিন্তু উনি…..”

দ্রুত পায়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল কিয়ানা আপু, সুযোগ দিলো না আমাকে কিছু বলার। তাসফি ভাইয়ের বাকি বন্ধুরাও এক এক করে বেরিয়ে গেল। কিয়ানা আপুর আমার সাথে কথা বলায় কিছুটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো, আমি তাকাতেই চোখ ফিরিয়ে নিলেন উনি। হয়তো বোঝার চেষ্টা করতে চাইলেন, আবারও কি কথা বলতে পারে আমাকে।

.
বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা রাত হয়ে গেল। সবার সাহায্যে উপরে নিয়ে যাওয়া হলো তাসফি ভাইয়াকে, ওনার রুমে। আম্মু বাসায় থাকায় সবকিছু আগে থেকেই গুছিয়ে রেখেছিলো। ঢাকার এই দোতলা ছোট খাটো ডুপ্লেক্স বাসাটা ফুপিদের নিজের বাসা। প্রথম প্রথম এখানে থাকলেও নিজ শহরের টানে আর বেশিদিন থাকে নি এখানে, সাথে ফুপার অফিসের কারণে একেবারেই বগুড়া চলে যায়। শুধু তাসফি ভাই ওনার পড়াশোনার জন্য এখানেই থেকে যেতেন। তাসফি ভাইয়া আমেরিকা যাবার পর বাসাটা পুরোপুরি ফাঁকাই ছিলো। যত্নে রাখার জন্য ফুপা ফুপি মাঝে মাঝে এসে শুধু ঘুরে যেতেন।

ঘুমে এসে হসপিটালের জামা কাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। সময় নষ্ট না করে চলে এলাম তাসফি ভাইয়ের রুমে। দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই তাসফি ভাইয়ের হাস্যজ্বল চেহারা ভেসে উঠলো। সবার সাথে বেশ হাসি খুশিতেই কথা বলতে লাগলেন। এতদিন পর ওনার হাস্যজ্বল চেহারা দেখে মনে প্রশান্তির ছোঁয়া লেগে গেল। ইস্! ওনাকে হাসলে সত্যিই মারাত্মক লাগে।

ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম ভেতরে। রিফাপুর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। আম্মু, বড়মা, ফুপি গল্পে মসগুল থাকলেও তাসফি ভাইয়ের নজর এড়ালাম না আমি। নিমিষেই বিলীন হয়ে গেল ওনার ঠোঁটের হাসিটা, গম্ভীর হয়ে উঠলো ওনার মুখটা। ওনার এই হঠাৎ পরিবর্তনে অবাক হলাম আমি। আমার অবাকের মাত্রাটা বাড়িয়ে দিয়ে উনি সবাইকে উদ্দেশ্য করে গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন,

“অনেক তো কথা হলো, শরীর খুব ক্লান্ত লাগছে এখন। ঘুমাবো আমি একটু। কালকে কথা হবে তোমাদের সাথে। মামী, আম্মু তোমরাও এখন রেস্ট নাও, বাকিদেরও নিয়ে যাও।”

.
.
চলবে…..
🖤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here