#ছায়াবর্ণ
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ১৩
সেদিনের পর থেকে বর্ণ ভাই আর পড়াতে আসেন না। মা ফোন দিলেও ধরেন না। মা আমাকে বলেন —
— তুই কি বর্ণের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিস ছায়া? ছেলেটা আর আসছে না কেন?
আমি কিছুই বলি না। উদাস মুখে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকি।
অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হলো। আমি বেশ ভালো করেছি। মা বর্ণ ভাইয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন। বলে বেড়াতে লাগলেন বর্ণ ভাই ছাড়া আমার এমন ফলাফল করা সম্ভব হতো না। আমি নিজেও মানি এ’কথা। বর্ণ ভাইকে দেখি না অনেক দিন। দেখবোই বা কীভাবে? আমি তো নিজেই দেখতে চাই না তাকে, আর না চাই তার আশে পাশে যেতে। হয়তো খুব শীঘ্রই নীলা আপু এবং তার বিয়ের দাওয়াত পাবো।
আজ কোচিং ফাঁকি দিয়ে পার্কে বসে আছি। ভালো লাগে না কিছু। বর্ণ ভাই পড়ানো বাদ দেওয়ার পর থেকে আগে যেমন ছিলাম তেমনই হয়ে গিয়েছি। পড়ালেখা করি না, খাপছাড়া জীবন। রানি আমার পাশে বসে আছে। ফোন টিপছে, হয়তো কথা বলছে আফীফ ভাইয়ের সাথে। এদের প্রেম আবার জমজমাট হয়ে উঠেছে। একে অপরকে খুব ভালোবাসে তারা, চোখে হারায় এক প্রকার। আমি এক দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছি। আমার যে কি হয়েছে তা আমি নিজেও জানি না। বর্ণ ভাইকে খুব মিস করছি। তিনি তো আমার জীবনেরই একটা অংশ হয়ে উঠেছিলেন। এখনও কি আছেন? হয়তো আছেন। হঠাৎ আমার সামনে এসে কেউ দাঁড়ালো। আমি চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলাম রিফাত। বিরক্ত হলাম। রিফাতকে যত ইগনোর করছি তত যেন বেশি আমার পিছু পিছু ঘুরছে। আমি থমথমে কন্ঠে বললাম–
— সমস্যা কি রিফাত? এভাবে সামনে দাঁড়িয়ে আছ কেন? কত বার বলেছি আমার পেছনে আসবে না। তবুও কেন আসো?
রিফাত ঠাই দাঁড়িয়ে রইল। কোনো হেলদোল হলো না। আমি মুখ কুঁচকে উঠে দাঁড়ালাম। রানিকে বললাম–
— এই রানি। চল বাসায় যাবো।
এগোতে নিলেই রিফাত শক্ত করে হাত ধরে ফেললো। আমি চমকে উঠলাম। হাত মুচড়িয়ে বললাম–
— এটা কি ধরনের অসভ্যতামি রিফাত? হাত ছাড়ো আমার।
রিফাত ছাড়ে না। আরও শক্ত করে ধরে। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠি। রিফাত আবেগপ্রবণ হয়ে বলল–
— আমাকে তুমি বোঝো না ছায়া? আমি যে তোমাকে কতটা ভালোবাসি সেটা তুমি বুঝতে পারো না?
— রিফাত! কি বলছ এসব? তুমি আমার ক্লাসমেট। আমরা শুধুই বন্ধু।
— তো? ক্লাসমেট তো কি হয়েছে? আমি কি তোমাকে ভালোবাসতে পারি না? আমি তো তোমাকে বন্ধু ভাবি না।
আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম–
— রিফাত প্লিজ সিন ক্রিয়েট কোরো না। আমার হাত ছাড়ো।
রানি হতভম্ব হয়ে আমাদের দেখছে। সে বুঝতে পারছে না তার এখন কি করা উচিত। রিফাত আমার অন্য হাতও ধরে ফেললো। এই স্পর্শে আমার গা গুলিয়ে আসছে, কই বর্ণ ভাইয়ের স্পর্শে তো এমন হয় না? রিফাত কাতর কন্ঠে বলল–
— আমাকে একটু বোঝার চেষ্টা করো ছায়া। আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি।
— কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি না রিফাত। প্লিজ ছাড়ো।
রিফাত নাছোড়বান্দা। আমি যতক্ষন না তার ভালোবাসা গ্রহণ করবো ততক্ষন সে আমার হাত ছাড়বে না। এদিকটা ফাঁকা, তেমন লোকজন নেই। মাঝে মধ্যে দুই একটা লোক হেঁটে যাচ্ছে । আমি জোর করে হাত ছাড়িয়ে রিফাতকে থাপ্পড় মেরে দিলাম। রিফাত আগুন চোখে তাকালো। বলল–
— তুমি আমাকে মারলে! আমাকে! এখন দেখো তোমাকে কীভাবে অসম্মান করি।
বলেই সে আমার গলা থেকে এক টানে ওড়না খুলে ফেলে দিলো। জামার সাথে পিন লাগানো থাকার ফলে কাঁধের কাছে জামা সামান্য ছিঁড়ে কেটে গেল। আমি আর্তনাদ করে উঠলাম–
— রিফাত!
দুহাতে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করলাম।রিফাত যেন বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গিয়েছে। সে আবারও হাত বাড়াতে নিলেই এক বলিষ্ঠ হাত তার হাত চেপে ধরলো। হাত মুড়িয়ে শক্ত হাতে চড় বসিয়ে দিলো রিফাতের গালে। রানি আমাকে আগলে নিলো। রানিকে জড়িয়ে ধরে আমি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। বর্ণ ভাই রিফাত কে মেরে চলেছেন। লোকজন না থাকায় বর্ণ ভাইকে আটকানোর কেউ নেই। আফীফ ভাই কোথা থেকে ছুটতে ছুটতে এসে বর্ণ ভাইকে ঠেকিয়ে বললেন–
— ছেড়ে দে। ম’রে যাবে তো।
তীব্র আক্রোশে বর্ণ ভাই ফুঁসছেন। আমি রানিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই যাচ্ছি। বর্ণ ভাই ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে আমার ওড়না মাটি থেকে কুড়িয়ে নিলেন। রানির থেকে আমাকে ছাড়িয়ে ওড়নাটা মুড়িয়ে দিলেন। এরই মধ্যে রিফাত কোনো রকম পালিয়ে গেল। বর্ণ ভাই আমার হাত ধরে বললেন–
— চলো।
হুট করেই নীলা আপুর কথা গুলো মনে পড়লো। আমি ঝটকা মেরে তার হাত ছাড়িয়ে নিলাম। দুহাতে চোখ মুছে বললাম–
— আমাকে সাহায্য করেছেন, তার জন্য ধন্যবাদ। আর আমি বাইরের লোক। বাইরের লোকদের নিয়ে এতো চিন্তা করা আপনার সাজে না। আমি একা যেতে পারবো। আপনার তো সামনে বিয়ে আপনি বরং নীলা আপুকে সময় দিন। আমার পেছনে সময় নষ্ট করলে তিনি আপনাকে ভুল বুঝবেন।
বর্ণ ভাই শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আফীফ ভাই হতবাক কন্ঠে বললেন–
— এসব তুমি কি বলছ ছায়া?
— আমি ঠিকই বলছি। আমাকে উনি পড়াতে আসতেন বলেই ওনারা বেশি টাইম স্পেন্ড করতে পারতেন না। তাই তো আমি ওনাকে পড়াতে আসতে বারণ করেছিলাম। তাছাড়া আমি তো ওনার কেউ না, আমাকে নিয়ে এতো কিসের চিন্তা ওনার? আজ আমি যখন বিপদে পড়েছিলাম উনি কেন এলেন? একটা বাইরের মেয়ের জন্য এতোটা কেন ভাববেন উনি?
বর্ণ ভাই আবারও হাত চেপে ধরলেন। রাগে দুঃখে আমি বলা শুরু করলাম–
— হাত ছাড়ুন আমার। কোন অধিকারে আমার হাত ধরছেন আপনি? কিসের এতো অধিকার বোধ আপনার? আমি আপনাদের বাড়ির একটা সামান্য ভাড়াটিয়া ছাড়া কিছুই না। কেন এভাবে অধিকার ফলান আমার ওপর? আর পর নারীর হাত ধরতে আপনার লজ্জা করলো না? এতোটা নিচ আপনি?
কথা শেষ হতে না হতেই বাম গাল জ্বলে উঠলো। ব্যথায় চোখে পানি এসে গেল। বর্ণ ভাই মেরেছেন আমায়। আফীফ ভাই এবং রানি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। বর্ণ ভাইয়ের লাল চোখ দেখে আমি আঁতকে উঠলাম। কিছুই আর বলতে পারলাম না। বর্ণ ভাই আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে চললেন। আফীফ ভাই এবং রানিও ছুটল আমাদের পিছু পিছু।
—
জড়সড় হয়ে বসে আছি। কাঁদতেও পারছি না। গুনগুন করে কাঁদার শব্দ হলেই বর্ণ ভাই ঘর কাঁপিয়ে ধমক দিচ্ছেন। পাশেই অসহায় হয়ে আফীফ ভাই এবং রানি দাঁড়িয়ে আছে। আফীফ ভাই বর্ণ ভাইকে বললেন–
— বর্ণ! মাথাটা একটু ঠান্ডা কর।
বর্ণ ভাই কিছু বললেন না। সেই যে আমার হাত ধরে এনেছেন এখনও ছাড়েননি শক্ত করে ধরেই আছেন। যেন আমি পালিয়ে যাবো। সামনে বসে আছেন বয়স্ক কাজী। তাকে দেখেই ক্ষণে ক্ষণে গলা শুকিয়ে আসছে আমার। কাজী কিছুটা কেশে বললেন–
— মেয়ের নাম কি?
বর্ণ ভাই দেরি না করে বললেন–
— তাহসীনা ছায়া।
কাজী লিখলেন। আবার জিজ্ঞেস করলেন–
— বয়স?
— আঠারো।
আমি চোখ বড় বড় করে তাকালাম। এখনও আঠারো হয়নি আমার। এখন চলছে আগস্ট আর আমার আঠারো হবে নভেম্বরে। আমি মুখ খুলতে নিলেই বর্ণ ভাই চোখ রাঙিয়ে তাকান। আমি চুপসে যাই। কাজী আমার চোদ্দ গোষ্ঠীর তথ্য নিয়ে তারপর বললেন–
— ছেলের নাম?
— আওসাফ বর্ণ।
— বয়স?
— সাতাশ।
আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম। সাতাশ! এতো বড় উনি! দেখতে তো কচি খোকা লাগে, কে বলবে এই লোকের বয়স সাতাশ? আমি তীব্র প্রতিবাদ করতে চাইলাম, “বন্ধ করুন এই বিয়ে! আমি এই বুইড়া ব্যাটা কে একদমই বিয়ে করবো না। কিছুতেই না।” বর্ণ ভাইয়ের শক্ত চোয়াল দেখে কথা গলায় আটকে গেল। কিছু বলার সাহস পেলাম না। ছলছল চোখে আফীফ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। যার অর্থ, “আমাকে এবারের মতো বাঁচিয়ে নিন আফীফ ভাই, প্লিজ।” আফীফ ভাইকে যেন আমার থেকেও বেশি অসহায় দেখালো। কাজী বললেন–
— তাহসীনা ছায়া আপনি আওসাফ বর্ণ কে বিবাহ করিতে রাজি থাকিলে বলুন কবুল।
আমি মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইলাম। বর্ণ ভাই হাতের বাঁধন শক্ত করে নিলেন। চোখ দিয়ে ইশারা করে কবুল বলতে বললেন। আমি তবুও বললাম না। বর্ণ ভাই ঘর কাঁপিয়ে ধমক দিয়ে বললেন–
— কি হলো? কবুল বলো দ্রুত।
কাজী বললেন–
— মেয়ে কি রাজি নয়?
— আপনি আপনার কাজ করেন। আমরা সবাই রাজি। ও একটু লজ্জা পাচ্ছে।
বর্ণ ভাই আবারও বললেন–
— কবুল বলো। এতো সময় নেই আমার হাতে। তাড়াতাড়ি।
আমি কেঁদে ফেললাম। কাঁদতে কাঁদতে নাক টেনে বললাম–
— কবুল।
কাজী আরও দুবার কবুল বলালেন। বর্ণ ভাইকে বলতে বললে উনি একটুও দেরি করলেন না। যেন উনি কবুল বলে ট্রেন ধরবেন। ধমকা ধমকি করে আমাকে দিয়ে জোর পূর্বক সইও করালেন। সাক্ষী হিসেবে আফীফ ভাই এবং রানি স্বাক্ষর করলো। বিবাহ সুসম্পন্ন হয়ে আমি মিস থেকে মিসেস হয়ে গেলাম আর একলা থেকে দোকলা হয়ে গেলাম। মা বাবা জানতে পারলে কি যে ঝড় উঠবে তা ভেবেই আমার হাটু কাঁপতে লাগলো। বর্ণ ভাই আমাকে টেনে কাজী অফিস থেকে বের করলেন। আমার হাত ছেড়ে দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে জলদগম্ভীর কন্ঠে বললেন–
— আফীফ! ও’কে বলে দে বর্ণ কোনো পর নারীর হাত ধরে না। এটাও বলে দে এখন ও’র ওপর আমার কি অধিকার আছে। আমি এখন যা খুশি করতে পারি। তার ওপর সব থেকে বেশি অধিকার আমার।
একটু চুপ থেকে আবার বললেন–
— অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। তুই রানিকে বাড়িতে দিয়ে আয়। আর এ’কে রাস্তায় ছেড়ে দে। থাকুক একা একা।
বলেই হাঁটতে লাগলেন। আফীফ ভাই বাধ্য হয়ে রানিকে নিয়ে চলে গেলেন। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তার পেছনে ছুটলাম। কি পাষাণ লোক! একটা বাচ্চা মেয়েকে এভাবে কেউ একা ফেলে যায়? নিজের সদ্য বিয়ে করা বউকে ফেলে কেউ কীভাবে যেতে পারে!
#ছায়াবর্ণ
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ১৪
বর্ণ ভাইয়ের পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে হাঁপিয়ে উঠলাম। দাঁড়িয়ে কোমরে হাত দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস ফেলে বললাম–
— দাঁড়ান প্লিজ।
বর্ণ ভাই দাঁড়িয়ে গেলেন। নিজের আশে পাশে কিছু দেখে বললেন–
— আপনি কি আমাকে বলছেন?
আমি হতাশ শ্বাস ফেলে বললাম–
— হ্যাঁ আপনাকেই বলছি। আমাকে একা রেখে যাবেন না দয়া করে।
বর্ণ ভাই অবাক হওয়ার ভান করে বললেন–
— আমি কি আপনাকে চিনি? অদ্ভুত মহিলা তো আপনি! একজন পর পুরুষের সাথে যেতে চায়ছেন! মতলব কি আপনার?
আমি বুঝতে পারলাম, তখনকার সেই কথাগুলোর জন্য উনি এমন করছেন। সেই জন্যই নিজের সদ্য বিয়ে করা মানে জোর করে বিয়ে করা বউকে চিনতে পারছেন না। আমি মুখ ছোট করে বললাম–
— আমি জানি তখনকার সেই কথাগুলোর জন্য আপনি এমন করছেন। সত্যিই ওগুলো বলা আমার উচিত হয়নি। তবে আমি কি করতাম? মাথায় রাগ চেপে ছিল আমার। সেদিন ছাদে নীলা আপু আমাকে যা তা বলে অপমান করেছেন। বলেছেন আপনার থেকে দূরে থাকতে। আপনার সাথে নাকি তার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। এমনকি এটাও বলেছে যে আমি যদি আপনার থেকে দূরে না থাকি তবে আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দেবে। আমার বাবাকেও অপমান করবে। তাই আমি আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিলাম যেন আপনি আর আমাকে পড়াতে না আসেন। আমিও তাহলে আপনার থেকে দূরে দূরে থাকতে পারবো। আর আপনি আজ জেদ করে রাগের বশে যে কাজটা করলেন, এটা কি আদৌ ঠিক?
একটানা কথা বলে আমি থামলাম। নীলা আপুর কথা বলে দিতে বাধ্য হলাম। কন্ঠস্বর জড়িয়ে আসছে। কান্না গিলে ভেজা কন্ঠে বললাম–
— এরপরও আপনার যদি মনে হয় সব দোষ আমার, সব অন্যায় আমার তাহলে তাই। আমি চলে যাচ্ছি।
বর্ণ ভাইকে রেখে আগে আগে হাঁটতে লাগলাম। চোখ থেকে নিজের অজান্তেই জল গড়িয়ে পড়ছে। উনি কোনো কিছু না ভেবে না চিন্তা করে আমাকে বিয়ে করে ফেললেন! এখন কি হবে আমার? বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর হঠাৎ উনি পেছন থেকে টেনে রিকশায় উঠিয়ে নিলেন। আমি ওনার থেকে ছাড়া পাবার জন্য ছটফট করতে করতে বললাম–
— ছাড়ুন আমাকে। আপনি তো আমাকে চিনেন না। এভাবে টেনে তুললেন কেন? ছাড়ুন।
উনি দুহাত শক্ত করে চেপে ধরে গালে ঠান্ডা কিছু ছোঁয়ালেন, যে গালে উনি দাবাং থাপ্পড় মেরেছিলেন। আমি মাথা পিছিয়ে দেখলাম আইসক্রিম! কান্না জড়ানো গলায় বললাম–
— থাপ্পড় মেরে এখন দরদ দেখানো হচ্ছে? লাগবে না আপনার দরদ। এতো জোরে কেউ মারে? মুখটা বোধহয় বেঁকে গিয়েছে আমার। নি’ষ্ঠু’র লোক কোথাকার!
উনি শান্ত স্বরে বললেন–
— রাগিয়ে দিয়েছিলে আমায়। এটা তো আমাকে রাগানোর ফল।
— রেগে গেলেই চড় মেরে মুখ লাল করতে হবে! আপনি আবার কাজীকে বোকা বানিয়ে আমাকে বিয়ে করেছেন। আমার মোটেও আঠারো বছর বয়স হয়নি। এক নম্বরের মিথ্যুক আপনি! ছাড়ুন আমায়।
আমি আবারও ছটফটানি শুরু করলাম। উনি আইসক্রিম টা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে রিকশার হুড তুলে দিলেন। আমার মাথাটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরলেন। জায়গা পেয়ে আমি হু হু করে কেঁদে উঠলাম। চোখের জলে ভিজে যাচ্ছে ওনার বুকের অংশের শার্ট। রিফাতের করা কাজ থেকে বিয়ে পর্যন্ত ঘটনা! আমি ক্লান্ত, খুব ক্লান্ত। তিনি আমার মাথায় বিরামহীন ভাবে হাত বুলিয়ে চলেছেন। আমি এক হাতে ওনার শার্ট খামচে ধরে মুখ তুলে বললাম–
— আপনি রাগের বশে কেন বিয়ে করলেন আমায় কেন? আমার বাবা মা আপনার বাবা মা জানতে পারলে কি হবে ভেবেছেন আপনি? আর নীলা আপু! ওনার সাথে তো বিয়ে ঠিক হয়ে আছে আপনার।
উনি ঠোঁটে এক আঙুল রেখে বললেন–
— হুশ! কোনো বিয়ে টিয়ে ঠিক নেই। ও তোমাকে মিথ্যে বলেছে। আর কিচ্ছু হবে না।
— তাহলে উনি এমন বললেন কেন? আর আপনি আমাকে যেভাবে চুপিচুপি বিয়ে করেছেন। সেভাবে চুপিচুপি ডিভোর্স দিয়ে দিবেন। তাই না?
বর্ণ ভাই চোয়াল শক্ত করে বললেন–
— তোমাকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। এখন কেউ কিছু জানবে না। সময় হলে আমি বুঝবো কি করতে হবে আর কি করতে হবে না। এখন চুপ করে বসে থাকো।
আমি ওনার বুকে মাথা ঠেকিয়ে বসে রইলাম। নিজেকে ঠিক আদুরে বিড়াল ছানা মনে হচ্ছে। আর সেই ছানাকে আগলে রেখেছেন তিনি।
—
আজ হঠাৎ করেই বর্ণ ভাই পড়াতে এসেছেন। মা তো তাকে দেখে খুশিতে গদগদ হয়ে উঠেছেন। মা বর্ণ ভাইকে জিজ্ঞেস করলেন–
— তুমি এতো দিন আসোনি কেন বাবা? ছায়া কি তোমাকে কিছু বলেছে? আমি ফোন দিলেও ধরতে না।
— না আন্টি। আমি আসলে একটু ব্যস্ত ছিলাম। পর পর কয়েকটা ইন্টারভিউ ছিল।
— তুমি যে ভালো ছাত্র তোমার চাকরিটা ঠিকই হয়ে যাবে দেখো। আমি তো সব সময় দোয়া করি তোমার জন্য। ছায়াটা তোমার জন্যই তো ভালো রেজাল্ট করলো। তোমার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।
— আরে আন্টি! এভাবে বলবেন না। একজন টিচার হিসেবে এটা আমার দায়িত্ব।
বর্ণ ভাই রুমে এসে চেয়ার টেনে বসলেন। মাথাটা চেয়ারে এলিয়ে দিয়ে বললেন–
— দরজাটা লক করে দিয়ে এসো তো।
আমি অবাক হয়ে কিছু বলতে নিলেই বললেন–
— কোনো প্রশ্ন নয়।
অগত্যা আমি উঠে দরজা লক করে দিলাম। মা দেখে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে। উনি তো আর বুঝবেন না যে আমরা স্বামি স্ত্রী দরজা লক করলেও কিছু যায় আসে না। আজ বিয়ের তিন দিন হলো। তিন দিনে ওনার দেখা পাইনি। সে জন্য একটু মন খারাপ হচ্ছিল। উনি বসা থেকে উঠে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলেন। আমি হতবাক হয়ে এগিয়ে গিয়ে বললাম–
— একি! আপনি শুয়ে পড়লেন কেন?
উনি চোখ বন্ধ করে বললেন–
— খুব ক্লান্ত আমি। মাথাটা খুব ধরেছে। একটু টিপে দাও তো। আবার এটা বোলো না যে কোন অধিকারে আমি মাথা টিপে দিতে বলছি। কোন অধিকার সেটা তুমি খুব ভালো করেই জানো।
আমার ওনার ওপর খুব মায়া হলো। ওনার মাথার কাছে বসলাম। বসার সাথে সাথেই উনি কোলে মাথা রাখলেন। শীরদাড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। উনি ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললেন–
— কোনো কথা বলবে না। মাথা টিপে দাও। আমি এক ঘন্টা ঘুমাবো। ঘড়ি দেখে সাড়ে আটটায় ডেকে দেবে। অনেক রাত ঘুমাতে পারিনা। একটু শান্তিতে ঘুমাতে চাই।
আমি তার মাথায় হাত রেখে ফিসফিস করে বললাম–
— কেন ঘুমাতে পারেননি আপনি?
তিনি উত্তর দিলেন না। ভারি নিঃশ্বাসই বুঝিয়ে দিল যে তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। উষ্ণ নিঃশ্বাসে শরীরে শিহরণ খেলে যাচ্ছে। শরীর এক প্রকার অবস হয়ে আসছে। আমি সেসবে পাত্তা না দিয়ে আলতো হাতে তার চুল টেনে দিতে লাগলাম। কতটা ক্লান্ত দেখাচ্ছে লোকটাকে! দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেকদিন ঘুমান না তিনি।
—
হঠাৎ মায়ের ডাকে আমি লাফিয়ে উঠলাম। ওনার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে কখন যে চোখ লেগে গিয়েছিল বুঝতেই পারিনি। উনি এখনও আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছেন। আমি ওনার দিকে এক পলক তাকালাম। শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছেন, কে বলবে এই লোকের এতো রাগ? মা আবার ডাকলেন–
— এই ছায়া! শুনে যা।
আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম সাড়ে আটটা বাজতে এখনও দশ মিনিট বাকি। কোল থেকে ওনার মাথা খুব সাবধানের সাথে বালিশে নামিয়ে রাখলাম। আস্তে ধীরে উঠে দরজা খুলে বাইরে চলে গেলাম। মা ডাইনিং টেবিলে ট্রেতে নাস্তা সাজিয়ে রেখেছেন। চা, নুডুলস্ আর মিষ্টি। মা আমাকে দেখে বললেন–
— এগুলো বর্ণের জন্য নিয়ে যা। ছেলেটা কত কষ্ট করে তোকে পড়ায়। যা।
আমি হাতে ট্রে নিয়ে রুমে ঢুকে দরজা চাপিয়ে দিলাম। ট্রে টা টেবিলে রেখে দেখলাম উনি উঠে বসে আছেন। আমি অবাক হয়ে বললাম–
— আপনি কখন উঠলেন?
উনি ঘুমু ঘুমু কন্ঠে বললেন–
— তুমি চলে যাবার পর পরই।
ওনার ঘুম ঘুম কন্ঠ শুনে হার্টবিট মিস হয়ে গেল। নিজেকে সামলে বললাম–
— চোখে মুখে পানি দিয়ে আসুন। মা আপনার জন্য নাস্তা পাঠিয়েছেন।
উনি বিনা বাক্যে উঠে ওয়াশ রুমে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর মুখে পানি দিয়ে বের হলেন। এগিয়ে এসে আমার ওড়না দিয়ে মুখ মুছলেন। আমি হতভম্ব! চেয়ারে বসে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বললেন–
— আজ তো পড়াতে পারলাম না। পড়াগুলো দিয়ে যাবো এবং অবশ্যই আমার পড়া রেডি চাই।
চা পান করতে করতে পড়া দিয়ে দিলেন। চা ব্যতীত আর কিছুই মুখে তুললেন না। আমি বললাম–
— নীলা আপুকে দেখি না ক’দিন। উনি কি চলে গিয়েছেন?
বর্ণ ভাই শক্ত কন্ঠে বললেন–
— হ্যাঁ বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। খুব বাড় বেড়েছিল ও।
— ওনার তো কোনো দোষ নেই। উনি আপনাকে ভালোবাসে বলেই হয়তো..
বর্ণ ভাই তাচ্ছিল্য হেসে বললেন–
— ভালোবাসা! ও যত ছেলেদের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিল সব ভালোবাসাই ছিল! ভালোবাসার অভাব নেই তার।
বর্ণ ভাই আর কিছু না বলে প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন–
— তোমার আঠারো বছর হবে কবে?
— কেন?
বর্ণ ভাই গমগমে কন্ঠে বললেন–
— যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দাও। পাল্টা প্রশ্ন করো কেন?
আমি মুখ গোমড়া করে বললাম–
— নভেম্বরে।
একটু চুপ থেকে আবার বললাম–
— আপনি আমাকে বিয়ে করলেন কেন বর্ণ ভাই?
তিনি অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে বললেন–
— কি বললে? বর্ণ কি?
ওনাকে এই প্রথম হয়তো সম্বোধন করেছি। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই হোক, নিজের স্বামীকে ভাই ডাকা আসলেই অদ্ভুত ব্যাপার। আমি আমতা আমতা করে বললাম–
— না মানে, বর্ণ ভাই।
— আমি তোমার ভাই?
— না, কিন্তু সবার সামনে তো ভাই-ই তাই না?
তিনি সূক্ষ্ম শ্বাস ফেলে বললেন–
— আমাকে কিছু বলে ডাকার দরকার নেই। আর আজে বাজে কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো।
আমার কথা শোনার অপেক্ষা করলেন না। বের হয়ে গেলেন। আমি হতাশ শ্বাস ফেললাম। কোনো প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর দেন না। ওনাকে কিছু জিজ্ঞেস করাও বৃথা।
চলবে..
{