#মায়ায়_জড়ানো_সেই_তুই
#পার্ট_৭
জাওয়াদ জামী
অনেকদিন পর ভার্সিটির অঙ্গনে পা রাখে তানিশা। সোজা ডিপার্টমেন্টের দিকে যায়। বান্ধবীদের কাছ থেকে জেনে নেয় গত কয়েকদিনের ক্লাসের খুঁটিনাটি।
অনেকদিন পর এসেছে তাই পুরো ক্লাস করেই তবে বাড়ি ফিরছে। আবারো অপেক্ষা কখন রিক্সার দেখা পাবে।
হুট করে সামনে একটা বাইক এসে দাঁড়ায়। কালো বাইকে আরোহীর পড়নে কালো শার্ট, কালো জিন্স আবার হেলমেটও কালো। তানিশার কাছে মনে হলো এ যেন কালোর দোকান। আরোহী হেলমেট খুলে ফেললে তানিশা চিনতে পারে।
” তা ম্যাডামের ক্লাস শেষ হলো? একটা রিক্সাও তো নেই ম্যাডাম। কিভাবে যাবেন বাড়িতে! তবে আপনি চাইলে এই অধম বান্দা আপনার উপকার করতে পারে। ” স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ইশান বলে চলেছে।
এদিকে তানিশা ভাবছে এই লোকটার সাথে বারবার দেখা হয় কেন!
” আপনি কি সারাদিন রাস্তায়ই টইটই করে ঘুরে বেড়ান! নাকি কার, কখন, কি উপকার করতে হবে তার খোঁজ করেন রাস্তায় টহল দিয়ে? ”
” বুঝলেন ম্যাডাম, এইযে সারাদিন রাস্তায় টহল দিই এতেও কিন্তু অনেকেরই উপকার হয়। ”
তানিশা এই উদ্ভট লোকের কথার কোন আগামাথা পায়না। তাই চুপ করে থাকে। একবার কথা বলতে শুরু করলে তানিশার মাথা গুলিয়ে দিবে।
” জানি আমি লিফ্ট দিতে চাইলেও নিবেননা। যদিও লিফ্ট নিলে অন্যের উপকার হত। তবুও থাক। ”
” আমি লিফ্ট নিলে অন্যের উপকার হত কিভাবে! ”
” যেমন ধরেন আমার মত ড্যাশিং ছেলের সাথে বাইকে যাচ্ছেন। রাস্তার সুন্দরী মেয়েরা তা দেখে আপনার উপর জেলাস হবে। এতে করে আমার চাহিদা বেড়ে যাবে। ওরা চাইবে আপনাকে সরিয়ে নিজেরা সেই স্থানে আসতে। আমিও স্বাচ্ছন্দে তাদের গ্রহন করব। কষ্ট করে আমার আর মেয়েদের পেছনে ঘুরতে হবেনা। মেয়েরাই আমার চারপাশে লাটিমের মত ঘুরবে। এভাবে কয়েকটা জিএফ জুটে যাবে। এবং আমার মত নীতিবান, সৎ একটা ছেলে ওদের কপালে জুটবে। দ্বায়িত্বসহকারে আমি ওদের সাথে প্রেম করব। ছ্যাঁকা দেয়ার কথা চিন্তাও করবনা। ওরা ধোঁ*কা, ছ্যাঁ*কা থেকে মুক্ত থাকবে। ফলে আ*/ত্ন/*হ*/ত্যা, নেশা মুক্ত দেশ গড়ে উঠবে। বুঝাতে পেরেছি ম্যাডাম? ”
এবার সত্যিই তানিশার মাথায় চক্কর দিচ্ছে। এই লোকের পরিকল্পনা মারাত্মক!
” দুঃখিত, আমি আপনাকে মেয়েদের উপকার করতে সাহায্য করতে পারলামনা। আপনি বরং অন্য কাউকে বাইকের পেছনে বসান। এখন আসছি। ” একটুও দেরি না করে স্থান ত্যাগ করে।
” তিনমাস আগেই বাইকের পেছনটা বুকিং হয়েছে ম্যাডাম। যার ভড়কে যাওয়া মুখশ্রী আমার বুকের মধ্যেখানে তোলপাড় করে। যার শান্ত স্বভাব আমার অশান্ত সাগরে প্রলেপ দেয়। কিন্তু আফসোস, সে বুঝেনা। আমাকে দেখলেই পালাই পালাই করে। ” গলায় যেন নেশা জড়ানো ইশানের।
গেষ্টরুমকে নিজের মত করে সাজিয়ে নিয়েছে। সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর ঐ রুমে যাবেনা। এবার নিজেকে বদলাতে হবে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এখন পাল্টা জবাব দেয়ার সময় এসে গেছে। সে চুপ থাকে তারমানে এই নয় যে তার কোন আত্মসম্মান নেই।
গতকাল সোহাকে দেখেই বুছে গেছিল কি হতে চলেছে। কয়েক বছর পর সোহা এ বাড়িতে পা রেখেছে, জায়গা ছেড়ে দিতে নয় নিশ্চয়ই । তানিশার বিয়ের পর রাগ করে এ বাড়িতে সে আসেনি। এখন তার রাগ পরে গেছে, নিশ্চয়ই সাদিফকে নিজের করে পেতেই এসেছে। এখন চুপচাপ সবকিছু সহ্য করা মানে আত্মসম্মান বিসর্জন দেয়া। যা কিছুতেই করতে পারবেনা ও।
ভার্সিটি থেকে ফিরে অল্পকিছু খেয়েই বই নিয়ে বসেছে। এখন কোন কাজ নেই। মাগরিবের নামাজ আদায় করে তবেই রাতের খাবারের আয়োজন করবে। অনার্স ফাইনালের আর বেশিদিন নেই।
রাতে সবাই একসাথে খেতে বসলেও সোহা খায়না। তানিশা বুঝতে পারে সে সাদিফের জন্য অপেক্ষা করছে। হায়রে নিয়তি একমাস আগেও তানিশা সাদিফের খাওয়ার পর খেত কিন্তু আজ থেকে আর ওকে সাদিফের জন্য অপেক্ষা করতে হবেনা।
খাবার শেষে জামিল চৌধুরী তানিশাকে নিজের রুমে ডাকেন একা একা কথা বলার জন্য। তানিশা শ্বশুরের কথামত সেখানে যায়।
” বউমা, তুমি ভালো করেই জানো আমি তোমাকে ছেলের বউ কম নিজের মেয়ের মত দেখি। আমি চাইনা তুমি কোন কথা আমার কাছে লুকাও। সোহার এ বাড়িতে আসা আমার মোটেও পছন্দ নয়। আর এই অপছন্দের কারণ তোমার মোটেও অজানা নেই।
মাগো, আমার ভুলের মাশুল তোমাকে দিতে হচ্ছে। তালিব ভাইয়ের কাছ থেকে তার আদরের মেয়েকে একপ্রকার জোড় করে পুত্রবধূ করে এনেছিলাম এই বাড়িতে। খাঁটি সোনার পরশে আমার ছেলের জীবনকে রাঙ্গাতে চেয়েছিলাম। খাঁটি সোনা আমি ঠিকই চিনেছিলাম। কিন্তু আমার নাকউঁচু স্ত্রী, অমানুষ ছেলেটা খাঁটি সোনা চিনলনা। সে তার বোনের মেয়েকে ছেলের বউ করতে বদ্ধ পরিকর। এবার তোমার ঘুরে দাঁড়ানোর সময় এসেছে মা। নিজের অধিকার বুঝে নেয়ার সময় এসেছে। তোমার এই যুদ্ধে আমাকে সবসময়ই তোমার পাশে পাবে। পঁয়ত্রিশ বছর ধরে আমি শায়লার সাথে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছি মা। এখন আর ধৈর্য নেই সন্তানদের সাথে যুদ্ধ করার। আমি এবার মুক্তি চাই মা, একটু বাঁচতে চাই। তবে তোমার পাশে আমি ছায়ার মত থাকব। ” অসহায় মানুষটার করুণ স্বর তানিশার বুকে কাঁপন ধরাচ্ছে। এই মানুষটা এত বছর ধরে সব সহ্য করে গেছে!
” বাবা আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে আমি কিছুই করতে পারবনা। যেখানে কোন ভালোবাসা নেই, সেখানে জোড় করে অধিকার আদায় করতে যাওয়া বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। আমি এতগুলো দিন এই বাড়িতে পার করেছি ভালোবাসাহীনতায় তবুও সব সহ্য করেছি। কারন আপনি ছিলেন আমার আরেকটা বাবা। কিন্তু আজ সেই পাহাড়ের মত অটল মানুষটার হতাশাগ্রস্ত মুখ দেখে এই বাড়িতে থাকার ইচ্ছে মরে গেছে। তাছাড়া সোহার সাথে বিতন্ডায় জড়াতে আমার মোটেও ভালো লাগবেনা। তাই যে কয়দিন এখানে আছি নিজের মত করে থাকব। আমার কথায় কষ্ট পাবেননা বাবা। হয়তো আমিই আপনাদের যোগ্য নই। ”
” আমাকে মাফ করে দিও মা। আমি তোমায় যথাযথ মর্যাদা এনে দিতে পারিনি এ বাড়িতে। আমি একজন স্বামী হিসেবে ব্যর্থ, একজন বাবা হিসেবে ব্যর্থ অবশেষে একজন ব্যর্থ শ্বশুরের তকমাও পেয়ে গেলাম। তবে মনে রেখ তুমি এ বাড়িতে না থাকলেও এই বাবা সব সময়ই তোমার সাথে থাকবে। এই বাবার দোয়া তোমার সাথে থাকবে। জীবনে অনেক বড় হও মা। ” এরপর আর কোন কথা থাকেনা। এখন শুধু গন্তব্য ঠিক করার পালা।
জামিল চৌধুরীর সাথে কথা বলে তানিশা ড্রয়িংরুমে বই হাতে নিয়ে বসে। সাদিফ আসলে দরজা খুলতে হবে।
” এই যে তানিশা, তুমি যেতে পারো। সাদিফ আসলে আমিই দরজা খুলে দিব। তোমার এখানে থাকার প্রয়োজন নেই। ”
” প্রয়োজন আছে কি না সেটা আমি বুঝবো। বরং তুমিই বলো, এখানে তোমার কি প্রয়োজন? একজন স্ত্রী হয়ে আমি স্বামীর অপেক্ষায় আছি। তুমি কেন অপেক্ষা করছ? তোমার কি রাইট আছে অপেক্ষা করার? যেখানে সাদিফের নিজের বোন তার ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করেনা সেখানে তুমি ওর কাজিন হয়ে আমাকে প্রয়োজনীয়তা শেখাচ্ছ! এই তোমার ম্যানার! আর ম্যানার্স নিয়ে অন্যকে জ্ঞান দাও। সেইম অন ইউ! সো এখন আসতে পারো। ”
তানিশার এভাবে বলা সোহার জন্য একটু বেশিই হয়ে গেছে। যে মেয়ে কখনো কারো জোড়ে কথায় অভ্যস্ত নয়, সেই মেয়েকে তানিশা এভাবে বলেছে! রাগে দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে তানিশাকে থাপ্পড় মারতে তেড়ে আসে। থাপ্পড় মারতে গেলেই তানিশা ওর হাত ধরে ফেলে।
” এখন যা করলে তার সীমা এই পর্যন্তই রেখো। ভবিষ্যতে এমন করতে এসোনা।
হাত আমারো আছে এবং সেই হাত তোমার চেয়েও মজবুত। আমার একটা থাপ্পড়ের ওজন নেয়ার ক্ষমতা তোমার নেই। আর আমাকে অবলা নারী ভেবোনা। এতদিন চুপ করে ছিলাম এটা আমার ভদ্রতা, কিন্তু দুর্বলতা নয়। কেউ আমাকে ঢিল ছুঁড়লে আমি তাকে ইট মা*র*বো। আর কেউ ইট মা*র*লে পাটকেল তার জন্য অবশ্যম্ভাবী। এখন ভদ্র মেয়ের মত নিজের রুমে যাও। সেখানেই খাবার দিয়ে আসছি। ”
সোহা জীবনে চরমভাবে অপমানিত বোধহয় আজকেই হয়েছে। রাগে ফর্সা মুখ টকটকে লাল হয়েছে। এক দৌড়ে রুমে চলে যায়।
তানিশা বইয়ের পাতায় মনযোগ দিয়েছে। কলিংবেলের আওয়াজ শুনে বই বন্ধ করে দরজা খুলতে যায়।
তানিশাকে দরজা খুলতে দেখে সাদিফ মনে মনে খুশি হয়। কিছু না বলে উপরে উঠতে গেলে তানিশা বলে, ” তারাতারি ফ্রেশ হয়ে নিচে আসেন। আমি খাবার গরম করছি। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে পারবনা। ”
সাদিফ মাথা ঝাঁকিয়ে চলে যায়।
সাদিফের প্লেটে এক টুকরো মাছ দিতেই সে বলে, ” শ্বশুর বাড়ি থেকে আনা হাঁসের মাংস নেই? ”
” আছে। কিন্তু আপনি তো এক তরকারি দুইবার খাননা! ”
” অভ্যাস কি বদলাতে পারেনা! ”
” অপেক্ষা করেন গরম করে নিয়ে আসছি। ”
তরকারি গরম করে আনলে সাদিফ তৃপ্তি নিয়ে খায়। তানিশার যেন এই সাদিফকে চিনতে কষ্ট হচ্ছে।
” তুমি খাবে কখন? নাকি রাতেরটা সহ সকালে খাবে। ”
সাদিফ জানে আমি খাইনি! এটা কিভাবে সম্ভব! তানিশা একটু ধন্দে পড়ে যায়। একটু ভেবে নিজেকে শক্ত করে উত্তর দেয়, ” আমার চিন্তা না করলেও চলবে। আপনি খেয়ে নেন। ”
” হুম আজকাল মনে হচ্ছে তোমার চিন্তা করার মানুষের অভাব নেই। ”
” আমার নিজের চিন্তা নিজেই করতে পারি। অন্য কাউকে লাগেনা। ”
এইভাবে একে অপরের বাক-বিতন্ডায় খাবার পর্ব শেষ হয়। সাদিফ খাওয়া শেষে কিছুক্ষণের জন্য বাইরে যায়। ততক্ষণে তানিশা নিজে খেয়ে টেবিল গুছিয়ে , পরিস্কার করে, এঁটো থালাগুলো পরিস্কার করে নিয়েছে।
সাদিফও ততক্ষণে এসে গেছে। তানিশাও রান্নাঘরের বাতি নিভিয়ে এসেছে।
” তানিশা, রুমে এসো। ” বলেই সিঁড়ির দিকে পা বাড়ায় সাদিফ।
” সরি। আমি গেষ্টরুমেই ঠিক আছি। ”
” এবার বোধহয় বারাবাড়ি হচ্ছে। তর্ক না করে যা বলছি করো। ”
” বললামো সরি। না আমি বারাবাড়ি করছি আর না তর্ক করতে চাই। এসবে আমি ইন্টারেস্টডেড নই। ” তানিশা নিজের রুমের দিকে পা বাড়াতে গেলেই সাদিফ ওর হাত ধরে ফেলে।
” তুমি কি চাইছো, একটু বলবে? কেন এমন করছো?” ভেজা গলায় বলে সাদিফ।
” আমি কারো প্রিয়জন হতে চেয়েছিলাম, প্রয়োজন হতে নয়। কিন্তু আপনার জীবনে আমার প্রয়োজনীয়তা বিদ্যমান। প্রিয়জন আর হতে পারলাম কই! এতদিন প্রয়োজন হয়েই প্রিয়জনের আশায় কাটিয়েছি। এখন আমি প্রিয়জনের স্বপ্নও দেখিনা আর কারো প্রয়োজন হবার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করিনা। ” সাদিফের হাতের বাঁধন ঢিলে হয়ে আসে।
তবে তানিশার জীবনে তার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে!
কয়েক বছর যে দুইজন মানুষ একই ঘরে কাটিয়েছে আজ তারা একই বাড়িতে থেকেও আলাদা।
তানিশা নিজের সাথে অনেক বোঝাপড়ার পর নিজেকে শক্ত করেছে। ও আর কারো হাতের পুতুল হতে চায়না। সাদিফের কাছে নিজেকে আর মেলে ধরতে চায়না। একটু ভালোবাসা পেতে আর ছোট হতে চায়না। আজ যদি সাদিফকে আঘাত করে কথা না বলত তবে ও নিজেই দূর্বল হয়ে যেত। দূর্বলতা প্রকাশ করতে চায়নি জন্যই এত কঠিন কথা সে বলেছে। কিন্তু সাদিফের জন্য ওর ভালোবাসা এক বিন্দুও কমেনি। সেই এইচএসসি পরীক্ষার পর এ বাড়িতে বউ হয়ে এসেছে। দেখতে দেখতে চার বছর হয়ে গেছে। ছটফটে এক কিশোরী বউ হয়ে পা রেখেছিল এই বাড়িতে। ক্রমেই নানা ঘাত-প্রতিঘাতে কিশোরী মন অল্পতেই পরিনত হয়েছে। প্রথমদিকে দুই বছর সাদিফ ওকে ছুঁয়েও দেখেনি। তারপর আস্তে আস্তে কামনার কাছে হার মেনে সাদিফ ওকে খুব কাছে ডেকেছে। যতটা কাছে ডাকলে একেজনের হৃৎস্পন্দনের কম্পন আরেকজন অনুভব করতে পারে। যতটা কাছে ডাকলে একটা পুরুষের কাছে একজন নারীর লজ্জা থাকেনা। কয়েকদিন আগেও সাদিফ কত দুরছাই করেছে তানিশাকে। কিন্তু আজ যখন তানিশা নিজ থেকেই সরে যাচ্ছে তখন সাদিফ কেন ওকে আঁকড়ে ধরতে চাইছে!কিন্তু আজ আর তানিশা কোন বাঁধনে আটকা পরতে চায়না। একবার আটকা পরে গেলে এতদিনের কষ্ট করে তৈরী করা ধৈর্যের মুখোশ আর রাখতে পারবেনা। ধৈর্য ধরতে ধরতে আজ ক্লান্ত সে। এতদিনের সাদিফের করা সকল অবহেলা সহ্য করলেও তানিশা জানত সাদিফ ওকে ভালোবাসেনা। কিন্তু এখনকার সাদিফের আচরণ তানিশার কাছে অচেনা লাগে। এখন স্বেচ্ছায় সাদিফের সাথে জড়িয়ে গেলে সাদিফ কখনো ওকে অবহেলা করলে তানিশা সহ্য করতে পারবেনা। তারচেয়ে দুজনের দূরত্ব ভালো।এই কষ্ট মানতে পারবে। কিন্তু পরে সাদিফ কষ্ট দিলে তা হবে মৃত্যুর সমতুল্য। আর সোহা এত সহজে পিছু ছাড়বেনা। তানিশার ভাগ্য এতটাও সহজ নয়।
সাদিফ ডিভানে বসে আছে। মাথায় চিন্তারা ভিড় জমিয়েছে। কেন তার এমন হচ্ছে! আগে তানিশাকে নিয়ে চিন্তাও করতনা। কিন্তু এখন মন-মস্তিস্ক জুড়ে তানিশার বাস। না চাইতেও তানিশা হানা দেয় সবখানে।
” আমি তো সোহাকে ভালোবাসি। তবে কেন ঐ মেয়েকে রুমে আসতে বললাম। মম চায় আমি সোহাকে বিয়ে করি। হয়তো করতেও হবে। তবু কেন এমন হচ্ছে? আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি! ”
” সাদিফ আসবো? ” সোহার ডাকে সাদিফের ভাবনারা উড়াল দেয়।
” এতরাতে তুমি? ঘুমাওনি এখনো! ”
” আমার চিন্তা তুমি আদৌ করো সাদিফ? একটা সময় আমার গলা না শুনলে তোমার দিন শুরু হতনা। শুতে যাবার আগে আমার সাথে কথা না বললে তুমি ঘুমাতে পারতেনা। কিন্তু আজ যখন আমি না খেয়ে আছি, তোমার বউ যখন আমাকে থাপ্পড় মেরেছে, তখন তুমি খেয়েদেয়ে নিশ্চিন্তে আছো। ” কান্নার দমকে কথা বলতে পারছেনা সোহা।
সাদিফের কানে একটাই কথা বারি খাচ্ছে। তানিশা সোহাকে মেরেছে!
” তোমাকে মেরেছে? কেন? তুমি কিছু বলেছিলে ওকে? ও কাউকে মারার মত মেয়ে নয়। ”
” তুমি আমাকে অবিশ্বাস করছ সাদিফ! তুমি আর সেই সাদিফ নেই, যে আমার জন্য পাগল ছিল। আমি শুধু তোমার বউয়ের কাছে আবদার করেছিলাম তুমি আসলে একসাথে খাব। তাতেই অনেক কথা শোনায়। আমিও একটু উত্তেজিত হয়েছিলাম। পরে নিজেকে সামলে ওকে বলেছি, অনেকদিন পর এখানে এসেছি তাই যে কয়টাদিন আছি সাদিফের সাথেই খেতে চাই। ঠিক তখনই ও আমাকে থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। এখন বলো এই কথাও তুমি বিশ্বাস করছনা। আসলে সব দোষ আমার, এখানে আসা আমার মোটেও ঠিক হয়নি। আমি কালই চলে যাব। আমি ভুলে গেছিলাম এই বাড়িতে এখন তানিশার রাজত্ব চলে। আমি এই বাড়ির মেহমান মাত্র। আমার কোন সম্মান থাকতে নেই। ” কাঁদছে আর বলছে সোহা।
এদিকে এমনিতেই সাদিফের মাথা গরম হয়েছিল। সোহার কথায় তা আরো বেড়ে যায়। সোহার হাত ধরে সোজা নিয়ে আসে তানিশার রুমের সামনে। জোরে ধাক্কাতে থাকে রুমের দরজা।
তানিশা চুপচাপ শুয়ে ছিল। দরজায় ধাক্কার আওয়াজে উঠে এসে খুলে দেয়।
বাইরে সোহার হাত ধরে সাদিফকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যা বোঝার বুঝে নেয়।
সাদিফ রুমে ঢুকে সোহাকে নিয়ে।
” তুমি সোহাকে মেরেছো কেন? ” সাদিফের সোজা প্রশ্ন।
” আমি কাউকে মারিনি। ইনফ্যাক্ট কাউকে মারার রুচি আমার নেই। ”
” তানিশা সোজা প্রশ্নের উত্তর সোজাভাবে দিতে হয় সেটাকি ভুলে গেছো তুমি? ” সাদিফের রাগ তরতর করে বেড়ে যায়।
” আমি অনেক কিছুই জানিনা আবার জানলেও মানতে পারিনা। এটা আমার বদভ্যাস মনে করে নিন। ”
” তোমার বারাবাড়ি বেশি হয়ে যাচ্ছে। ”
” একদিন তো সবকিছু ঠিকমতই ছিল তবুও আমিই দোষী ছিলাম। তাই ভাবলাম একটু বারাবাড়ি করে দেখি। এতে অ্যাডভেঞ্চারও হলো আবার মানসিক শান্তিও পাওয়া গেল। ”
” তুমি মানসিক শান্তির জন্য সোহাকে মেরেছ বেয়াদব মেয়ে? উত্তর দাও। আসলে তোমার মত মেয়েকে দাম দিতে নেই। তাহলে তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করে। তুমি এখনই সোহার কাছে ক্ষমা চাইবে। রাইট নাউ। ”
” সরি পারবোনা। আর আপনি সোহার হয়ে আমার কাছে জবাবদিহিতা করতে এসেছেন, আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন কি হয়েছিল? সোহার প্রায়োরিটি আপনার কাছে অধিক ঠিক আছে মানলাম। কিন্তু আমি কে? আমার স্থান কোথায়? ”
” তুমি কেউ নও, নাথিং । বুঝেছো? তুমি কোথাও নেই। কোথাও থাকার যোগ্যতাও তোমার নেই। ”
” বুঝলাম। এবার আসতে পারেন। আর আজকের দিনটা মনে রাখবেন। একদিন অনুশোচনা করবেন আর বলবেন, ঐ দিনে তানিশাকে আ*ঘা*তে আ*ঘা*তে জ*র্জ*রি*ত করেছিলাম যা মোটেও উচিত হয়নি। ”
হাতের ইশারায় ওদের দরজা দেখিয়ে দেয় তানিশা। সাদিফরা বের হয়ে গেলে তানিশা দরজা বন্ধ করে এসে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে।
কতক্ষণ এভাবে কেঁদেছে বলতে পারেনা। নিজেকে যতই সামলে নেয়ার চিন্তা করছে বুকটা ততই ভারি হয়ে কান্নার মিছিল নামছে চোখে।
চলবে……