মেঘে ঢাকা আকাশ পর্ব -১০+১১

#মেঘে_ঢাকা_আকাশ
#পর্ব_১০
কলমে রোকেয়া পপি।

জলি আবাক বিস্ময়ে সজীবের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কতো স্বাভাবিক ভাবেই না বলছে জলি কড়া করে এক কাপ চা নিয়ে এসো তো।
ওর ভাবতেই অবাক লাগছে রাতে এই মানুষটাই কতোটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে। অথচ এখন তার চেহারা দেখে কিছুই বোঝার উপায় নেই। যেন ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে জানে না।

কি হলো এভাবে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছো কেন? তোমাকে না চা করে আনতে বললাম।

চা পরে খাবে। আগে বলো আমার যে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট হয়েছে সেই খবরটা কি তুমি জানো?

জানব না কেন? জানি।

এমন একটা গুড নিউজ জেনেও তুমি মদ খেয়ে মাতাল হয়ে কিভাবে ঘরে ফিরলে! তোমার কি উচিত ছিল না আমার জন্য অন্ততপক্ষে একটা গোলাপ ফুল এনে উইশ করা।

সজীব হাত নেড়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বললো এটা কোন খবর হলো‌ নাকি, যে ফুল কিনে এনে পায়ে ফেলতে হবে।

বিয়ের আগে তো কথায় কথায় ফুল কিনতে।

বিয়ের আগে মানুষ অনেক কিছুই করে। প্রেমের জন্য ছেলেদের ছ্যাচড়া হতে হয়। কিন্তু বিয়ের পর ছেলেদের আর ছ্যাচড়ামি মানায় না।

তাই নাকি! তা বিয়ের পর পুরুষদের কেমন হতে হয়?
মদ খেয়ে মাতাল হয়ে রাত দুপুরে ঘরে ফিরে বউয়ের শরীর টাকে ছিঁড়ে খুঁড়ে খেতে হয় বুঝি।

জলি তুমি আজকাল খুব বেশি কথা বলা শিখে গেছো। যাও চা নিয়ে এসো।

বললাম তো চা পরে হবে। আমার ভর্তির জন্য কাগজ পত্র গোছাতে হবে। আমি আজ নাস্তা খেয়ে আমাদের বাসায় যাব। তুমি কি সাথে যাবে?

তুমি কোথাও যাবে না। বিয়ের আগে যা করেছো, করেছো। এখন আর ওসব মাথায় রেখো না। এ বাড়িতে থাকতে হলে সংসারে মনোযোগ দিতে হবে। ঘরের বাইরে এক পাও ফেলতে পারবে না।

মানে কি? আমি ডাক্তারি পড়বো না?

মানে খুব সহজ। তোমার পড়াশোনা করা চলবে না। বাচ্চা দিয়ে দিব, বাচ্চা মানুষ করবে।

ডাক্তার হওয়া আমার স্বপ্ন। আমার পরিবারের স্বপ্ন।
আমি যে কোন মূল্যে আমার স্বপ্ন পূরনের রাস্তা বের করে নিব।

সজীব খুব তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করে বলল, আরে যা। স্বপ্ন।‌ ওসব স্বপ্ন নিজের সন্তানের সাথে পূরণ‌ করিস মাগি।

কি বললে তুমি?
তুমি আমার সাথে মুখ খারাপ করলে!

মুখ খারাপের দেখছিস কি? এরপর অবাধ্য হলে গায়ে হাত উঠবে। আমি তোকে শেষ বারের মত বলছি। যদি ভালো চাস তো, আমার সামনে আর কখনো পড়াশোনার কথা তুলবি না। ঘরের বাইরে এক পাও ফেলবি না। এটা আমার শেষ কথা।

তাহলে তুমি ও শুনে রাখো আমার শেষ কথা। তোমার এ সংসার আমার না করলেও চলবে।
আমি তোমাকে ছাড়তে রাজি আছি, কিন্তু পড়াশোনা ছাড়তে নই।

সজীব কে এখন ঠিক জানোয়ারের মতো দেখাচ্ছে। ও রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে উঠে এসে জলির চুলের মুঠি ধরে দেওয়ালে একটা জোরে বাড়ি দিয়ে বললো, এই বাড়ির বাইরে আমার পারমিশন ছাড়া এক পা ফেললে এ বাড়ির দরোজা তোর জন্য চিরদিনের মতো বন্ধ হয়ে যাবে। যা এখন চা বানাতে যা। আমি গোসল করে বের হয়ে এসে যেন দেখি চা রেডি।

সজীব জানে জলির যাবার মতো কোন জায়গা নেই। ও মনের সুখে শিষ বাজাতে বাজাতে বাথরুমে ঢুকে গেল।

জলির কপালে একপাশ ফুলে ঢিবির মতো হয়ে গেছে। চোখ মুখ অন্ধকার হয়ে আসছে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে।

ওর বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো যে ওর ভালোবাসার মানুষটি আজ ওর গায়ে হাত তুলছে!
সেই সাথে এটাও বুঝতে পারছে যে, সজীব কে বিয়ে করা ওর জীবনের কতো বড় একটা ভুল ডিসিশন ছিল। সেই মুহূর্তে যদি আবেগকে কন্ট্রোল করতে পারতো, তাহলে হয়তো আজ ওকে এমন পরিস্থিতিতে পরতে হতো না।
ও চোখ মুছে অনেক বড়ো একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো।

সজীব চায়ের খোঁজে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিলো। বারান্দায় ওর মার সঙ্গে দেখা।

মা বললেন, বৌমা কোথায় গেলো রে?

সজীব বিরক্ত হয়ে বললো, আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন? যখন যেতে দেখলে তখন তুমি তোমার বৌমাকে জিজ্ঞেস করলে না কেন?

জিজ্ঞেস করেছিলাম তো। সে তো বলল জিগাতলা যাচ্ছে।

তাহলে সেখানেই গেছে।

জলি খুব ইতস্তত বোধ করছে ভেতরে ঢুকতে। এভাবে রাগ করে চলে আসাটা বোধহয় ঠিক হলো না। অন্ততপক্ষে বাবার সাথে দেখা করে আসা উচিত ছিল। এতো সকালে আপা নিশ্চিত বাসায়। আপা আমাকে দেখে কিভাবে নিবে আল্লাহ জানেন।

ও সুরা পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখে আপা খুব তাড়াহুড়ো করে গরম চায়ে ফু দিয়ে খাচ্ছে। মেজপা ও চায়ে রুটি ভিজিয়ে খাচ্ছে।

পলি প্রথমে জলিকে দেখলো। চা খাওয়া থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলো, আরে বড়ো লোকের বউ দেখি গরীবের বাড়িতে। তা কি মনে করে এখানে আসা হয়েছে শুনি? বিয়ের পর প্রথম আসলে তো মিষ্টি মুখ করাতে হয়। বাসায় তো কোন মিষ্টি নেই। এক চামচ চিনি আনি। চিনি খাবি?

জলির চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। ও মাথা নিচু করে বললো, আপা আমি ঢাকা মেডিকেলে চান্স পেয়েছি।

জানি। এটা জানানোর জন্য তোর এতো কষ্ট করে এ বাড়িতে আসার কোন দরকার ছিল না। এখন তুই আসতে পারিস। আমার অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে।

আপা আমি একবারে চলে এসেছি। আমি আর ও বাড়িতে ফিরে যাব না।

সেকি রে! এক সপ্তাহের মধ্যে প্রেম শেষ!

আপা প্লিজ। আমি খুব বেশি ক্লান্ত। আমি জানি আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করে ফেলেছি। অল্প সময়ের মধ্যে আমি আমার ভুলটা ধরতে পেরে নিজেকে শুধরে নিতে চাইছি। তোমরা আমাকে আর কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিও না প্লিজ।

মলি এতোক্ষণ চুপচাপ বসে দেখছিলো দুই বোনের বাকবিতন্ডা। এবার ও কথা না বলে পারলো না। আপা তুমি অফিসে যাও। তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।
অফিস থেকে ফিরে যা বলার বলো।

জলি ঘরে গিয়ে রেস্ট নে। আমার নয়টা থেকে পরীক্ষা। আমি ও বের হচ্ছি। তুই মায়ের দিকে একটু খেয়াল রাখিস। মায়ের রাতে জ্বর ছিল। ঘুম থেকে উঠলে মাকে সাথে নিয়ে নাস্তা খাস। আমরা আসি।

সরফরাজ খান দুপুরে খেতে এসে দেখেন পুরো বাড়ি নিশ্চুপ। কোথাও কোন সাড়া শব্দ নেই। পুস্প এক গ্লাস পানি এনে হাতে দিয়ে বললো, খালুজান আপনার পানি। আর এই চিঠি টা ভাবিসাব আপনারে দিতে বলছে।

তোর ভাবি কোথায়?

জানি না খালুজান। আপনি দোকানে চলে যাওয়ার পরেই ভাবিসাব ও বের হয়ে গেছে। তয় বার বার চোখের পানি মুছতে দেখছি। হাতে একটা ছোট ব্যাগ ও ছিল। ভাইজান মনে হয় কোন আকাম ঘটাইছে।

আচ্ছা ঠিক আছে তুই টেবিলে খাবার সাজা। আমি দেখতেছি।

পুস্প সামনে থেকে চলে যাওয়ার পর সরফরাজ খান চিঠি টা খুললেন।

বাবা
আমার সালাম নিবেন। আমি খুব চেয়েছিলাম সজীবের সাথে মানিয়ে নিতে। কিন্তু পারলাম না। আমি আমার স্বপ্ন পূরনের উদ্দেশ্যে চললাম।
আমার বাবা নেই। আপনার আদর স্নেহের কাঙাল এই আমি চেয়েছিলাম বাবাকে আঁকড়ে ধরে এখানেই পরে থাকতে।
সেটা তো হলো না।
আমার অবাধ্যতা/ বেয়াদবি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
ইতি
আপনার অভাগী মেয়ে।

সরফরাজ খান মন খারাপ করে নিজের রুমে গিয়ে দেখলেন দিলারা বেগম তার স্বভাব সুলভ নিয়মে শুয়ে শুয়ে সিরিয়াল দেখছে। তিনি রিমোট দিয়ে টিভি অফ করা মাত্র দিলারা বেগম ধরফরিয়ে উঠে বসলেন।

আপনি কখন আসলেন? শুনছেন বৌমা তো বাপের বাড়ি চলে গেছে। আর নাকি ফিরবে না। গরীবের তেজ কতো!

যাবে না তো কি করবে? তোমরা মা ছেলে মিলে মেয়েটার ভবিষ্যত নষ্ট করে দেওয়ার প্লান করবা। পড়তে দিবা না। আর সে তাই মেনে নিয়ে সারাদিন রান্না ঘরে পরে থাকবে, আর বছরে বছরে বাচ্চা পয়দা করবে, তাই না।

বিয়ের পর আবার পড়াশোনা কি? বিয়ের আগে যা করেছে, করেছে।

বিয়ে করে তো পাপ করেনি যে সব ছেড়ে দিতে হবে?

পাপ-পুণ্যের কোনো ব্যাপার না। আপনি ঠান্ডা মাথায় একবার ভাবেন তো, এমনিতেই আমাদের বৌমা দেখতে ডানাকাটা পরী। তারপর যদি পড়াশোনা করে ডাক্তার হয়, আমার সজীবকে সে কি স্বামী হিসেবে এক পয়সাও দাম দিবে?
সজীব তো তখন বৌমার পায়ের নিচে পরে থাকবে।

তোমার ছেলে কি এমন রসগোল্লা যে মেয়েটা ডাক্তার হবার স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে তোমার ছেলের পায়ের নিচে পরে থাকবে?

চলবে….

অনুগ্রহ করে কমেন্ট সেকশনে জানাবেন কেমন লাগলো। আপনার একটি গঠনমূলক মন্তব্য আমার লেখায় অনুপ্রেরণা যোগাবে।#মেঘে_ঢাকা_আকাশ
#পর্ব_১১
কলমে রোকেয়া পপি।

মমতা বেগমের প্রেশার আবারো বেড়েছে। বেড়েছে মানে যেন তেন রকম বাড়া না, রীতিমতো শয্যাশায়ী।
বাসায় একজন নার্স রাখা হয়েছে। নার্সের নাম মালতি। তিনি একটু পর পর প্রেশার মাপছেন।

রোজিনা একটা বাটিতে তেল নিয়ে মমতা বেগমের মাথায় তেল ঢলে দিচ্ছে। মমতা বেগম খুব আরাম পাচ্ছেন। আরামে চোখ প্রায় আধাবোজা।

শুদ্ধ পরীক্ষা শেষ করে ফিরে এসেই আগে মায়ের খোঁজ নিতে আসলো‌। দরোজায় হালকা টোকা দিয়ে বললো, মম আসব?

এসো। রোজিনা আর তেল দিতে হবে না। তুই বাইরে। যা। মালতি তুমি ও যাও। আমি একটু শুদ্ধর সাথে একা কথা বলতে চাই।

মালতি বের হবার আগে বললো, ঠিক আছে ম্যাম। তবে উত্তেজিত হবেন না প্লিজ।

শুদ্ধ রুমে ঢুকে দেখলো, দিনের বেলায় ও রুমটাকে ভারি পর্দা দিয়ে অন্ধকার করে রাখা হয়েছে। মাথার কাছে একটা টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে হালকা আলোর ব্যাবস্থা করা হয়েছে। এসির বিজবিজ শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। মনে হচ্ছে যেন লোকালয় ছেড়ে কোন বরফের দেশে চলে আসা হয়েছে।

মমতা বেগম চোখ না খুলেই বললেন, দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো। আমার সামনের চেয়ারটাতে বসো।

তারপর তোমার পরীক্ষা কেমন হচ্ছে?

ভালো হচ্ছে মম।

হুম তোমার পরীক্ষার মধ্যে আমার অসুস্থতা যেন কোন প্রভাব না ফেলে, সেটা মাথায় রেখো। এটা আমার সাধারণ একটা অসুখ। প্রায়ই হয়। এগুলো নিয়ে টেনশন করবে না।

আমি টেনশন করছি না মম। তবে দুই দিন পর পর তোমার এমন অসুস্থতা আমাকে বেশ ভাবাচ্ছে। আমার মনে হয় তোমার কিছু দিনের জন্য কোথাও ঘুরে আসা প্রয়োজন।

আর ঘুরতে যাওয়া। তুমি কি শুনেছো তোমার বাবা তোমার পেয়ারের মলির নামে বারিধারার ফ্লাটটা লিখে দিচ্ছে।

হুম শুনেছি। বাবার সম্পত্তি, বাবা যাকে খুশি তাকে দিতেই পারেন। এটা একান্তই বাবার নিজস্ব সিদ্ধান্ত।
তবে আমার মনে হয় না মলি তা গ্রহণ করবে। ওর ব্যক্তিত্ববোধ অন্যরকম।

রাখো তোমার ব্যক্তিত্ববোধ। ফ্রি খাইতে সবার ভালো লাগে। তবে তোমার বাবা যা শুরু করেছে তাতে দুই দিন পর ভিক্ষার থালা হাতে নিয়ে ঢাকা শহরে ঘুরে বেড়াতে হবে।

মম তুমি এতো ভেবো না তো। মলি কখনো নিজের নামে ফ্লাট নিবে না এ বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকো।
আসলে তুমি স্ট্যাটাস স্ট্যাটাস করে মাথা গরম করে ফেলেছো। তোমার আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব দের কিভাবে মলিদের বাসায় নিয়ে যাবে! সমাজে তোমার মাথা নাকি হেট হয়ে যাবে।
তাই বাবার ধারণা হয়েছে মলির নামে যদি একটা ফ্ল্যাট লিখে দেওয়া হয় আর সেখান থেকে বিয়েটা হয়। তাহলে তোমার সন্মান ও রক্ষা হবে, স্ট্যাটাস ও মেন্টেন হবে আর কিছুই না।

বাবা শুদ্ধ তোমার জন্য আমি মলির চেয়ে ও সুন্দরী মেয়ে এনে দিব। তুমি মলিকে বিয়ে করো না । তুমি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে তোমার বাবাকে বলো এ বিয়েতে তোমার মত নেই।

শুদ্ধ ঠোঁট টিপে এমন ভাবে হাসলো ওর মায়ের বাচ্চামি দেখে, যার মানে তোমার কথা মেনে নিলাম অথবা মেনে নিলাম না, দুটোই দাঁড়ায়।

সরফরাজ খান বড় একটা কাঠের চেয়ারে পায়ের ওপর পা তুলে রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে আছেন। তার পরনে সাদা রঙের হাফ-সিল্কের পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবি তে সাদা সুতোয় হাতে কাজ করা।

চেয়ারটা বাইরের উঠানে বসানো। তিনি বাইরের উঠানে বসে শেষ বিকেলের মিষ্টি রোদ গায়ে মাখছেন। তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে জলির কাণ্ডকারখানাও দেখছেন।

হঠাৎ করে তার আগমনে জলি দিশেহারা বোধ করছে। ও বুঝতে পারছে না বাবাকে ঠিক কি দিয়ে আপ্যায়ন করবে। যদিও তার শশুর অনেক মিষ্টি এবং ফলমুল নিয়ে এসেছেন। কিন্তু এগুলো দিবে নাকি দৌড়ে গিয়ে বাইরে থেকে কিছু ভাজাপোড়া কিনে আনবে তা ঠিক বুঝতে পারছে না।
ওর কাছে ওর শশুরের দেওয়া টাকা গুলো এখনো আছে। সুতরাং টাকা কোন সমস্যা না। সমস্যা হলো বাবাকে একা বাসায় রেখে সে বাইরে যাবে কিভাবে! ওর মায়ের শরীর বেশ খারাপ। সারাদিন বিছানাতেই। বড়োপা বা মেজপা কেউ এখনো ফিরেনি। ঘরের যা অবস্থা তাই লজ্জায় আর ভেতরে না ঢুকিয়ে বাইরে চেয়ার দিয়ে বসতে দিয়েছে। এখন তার সামনে দিয়ে সে বাইরে যায় কিভাবে?

ও ফ্রিজ থেকে লেবু বের করে এক গ্লাস সরবত বানিয়ে যখন শশুরের হাতে দিচ্ছে ঠিক সেই মুহূর্তে মলি গেট ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতে গিয়ে অবাক বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে গেল। ও ভেতরে ঢোকার মুখে দেখেছে বাইরে একটা খুব সুন্দর কাল রঙের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।
আবার ভেতরে ঢুকে দেখে জমিদার জমিদার ভাব একজন মাঝ বয়সী লোককে জলি খুব যত্ন করে সরবত দিচ্ছে। ও কি করবে বুঝতে না পেরে সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জলির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

মলিকে দেখে যেন জলি প্রাণ ফিরে পেল। ও মনে মনে বললো, যাক বাঁচা গেল। এখন মেজপা যা করার করবে। ও বড়ো করে একটা শ্বাস নিয়ে বললো, মেজপা এসো। তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। আমার বাবা।
বাবা এটা আমার মেজপা মলিপা। আর বড়োপা অফিসে। এখনি চলে আসবে।

ঠিক আছে মা। তুমি ব্যাস্ত হয়ো না। আরেকটা চেয়ার এনে আমার সামনে বসো।

জলি একটা প্লাস্টিকের চেয়ার এনে সামনে রেখে বললো, মেজপা তুমি বসো।

আমি ফ্রেস হয়ে আসতেছি। তুই গল্প কর ততোক্ষণে।

মলি ভেতরে এসেই আগে পলিকে ফোন দিয়ে তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে বললো। সাথে হালকা কিছু নাস্তা ও কিনে আনতে বললো। সেই সাথে জলির শশুর আসছে সেই তথ্য টাও জানিয়ে ও হাত মুখ ধুয়ে বাইরে এসে বসলো জলির পাশে।

সরফরাজ খান বললেন, তোমার মা কোথায়?

জলি তার দিকে না তাকিয়েই বলল, বাবা আমার মায়ের শরীরটা বেশ খারাপ। তাই দুপুরে ওষুধ খেয়ে ঘুমাচ্ছে।

আমি যে এভাবে হুট করে চলে আসছি, তাতে কি তোমাদের কোন সমস্যা হচ্ছে?

জি না।

জলি তোমার মায়ের নাম কি?

আমার মায়ের নাম রেবা।

তোমার মায়ের নাম রেবা?

জি বাবা।

আমার বোনের নাম ছিল রেবা। আমার বাবা অবশ্য আমার বোনকে আদর করে রেবু বলে ডাকতেন।
খুব বেশি আদরের ছিল আমার এই বোনটা। আমার পাঁচ বছরের ছোট ছিল। আমার কাছে আমার বোনটা ছিল জীবন্ত এক খেলনা।

আমার বোনটাও তোমার মতো একটি ভুল করেছিল। প্রেম করে পালিয়ে চলে গিয়েছিল পাশের গ্রামের এক ছেলের সাথে। এক সপ্তাহ পর আমরা ওর লাশ পাই আখ ক্ষেতের ভেতর। যাকে বিশ্বাস করে, যার হাতটা ধরে বেরিয়ে গিয়েছিল চোখে রঙিন স্বপ্ন এঁকে। সে ছিল বিশ্বাসঘাতক। সে তার বন্ধুদের নিয়ে আমার আদরের বোনটাকে..
সরফরাজ খান পকেট থেকে রুমাল বের করে আলতো করে চোখের পানি মুছে কিছু সময় চুপ করে রইলেন। তারপর ধরা গলায় বললেন

আমি আমার পারিবারিক একটা লজ্জার কাহিনী কোনো রকম সঙ্কোচ ছাড়া বলে ফেললাম দেখে তোমরা আবার কিছু মনে করো না। তিনি আবারও চোখের পানি মুছে বললেন,

তোমাদের মায়ের নাম রেবা শুনে খুব ভালো লেগেছে। রেবা নামটা শুনে আমার নিজের বোনের কথা মনে পড়ল। বোনের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।

মলি খুব আদ্র গলায় জানতে চাইলো, যে ছেলেটা আপনার বোনকে নিয়ে গিয়েছিল সে ধরা পরেনি?

সরফরাজ খান জবাব দিলেন না।

পলি অফিস থেকে ফিরে এসেছে। সে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনেছে। সে দেখল মাঝ বয়সী লোকটার দুই চোখ ভিজে উঠেছে। কঠিন চোখ হঠাৎ ভিজে গেলে অন্য এক ধরনের কোমলতা চলে আসে। পলি তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে দেখলো এই চোখ মমতায় আর্দ্র চোখ।

পলিকে দেখে শরফরাজ খান হালকা হেসে বললেন, এসো মা তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তুমি নিশ্চয়ই পলি।

আসসালামু আলাইকুম। জি আমি পলি।

পলিকে দেখে দুই বোন উঠে দাঁড়িয়ে আপার হাত থেকে ব্যাগ গুলো নিয়ে ভেতরে চলে গেল।
ওদের বাসায় গ্রীল দেওয়া বারান্দায় ডাইনিং টেবিল। সেখানে দুই বোন মিলে হরেক রকম নাস্তা সাজাতে ব্যাস্ত হয়ে গেলেও তাদের কান দুটো সজাগ, বাইরে কি কথা হচ্ছে তা শুনতে।

পলি কোন রকম ভনিতা না করেই বললো, আপনি মনে হয় জলিকে নিতে এসেছেন তাই না?
তাহলে নিয়ে যান। আমাদের পারমিশনের কোন দরকার নেই।

না মা। আমি ওকে নিতে আসিনি। আমি দেখতে এসেছি আমার মেয়েটা ঠিক মতো বাসায় আসছে কিনা। দুই দিন পর ওর মেডিকেল ভর্তি। এই সময়ে বাসায় না ফিরে ও যদি কোন বন্ধুর বাসায় গিয়ে ওঠে তাহলে তো আরেক সমস্যা হতো।

পলি মুখ কঠিন করে বললো, আমি সোজাসুজি কথা বলতে পছন্দ করি। শুনতে খারাপ লাগলেও ওর ভর্তির দায়িত্ব আমি নিব না। ভর্তির জন্য তিলে তিলে জমানো টাকা গুলো ও যাওয়ার সময় সাথে করে নিয়ে গিয়ে ফুর্তি করছে। ফুর্তি করা শেষ এখন আবার ফিরে এসেছে!
আমার তো টাকার গাছ নেই যে, ওর যখন যা ইচ্ছে করে তাই করবে। আর আমি শুধু টাকা ঢালব।

মাগো জলিকে আমি আমার মেয়ের স্থানে বসিয়েছি। ওর পড়াশোনার সব দায়িত্ব আমার। টাকা নিয়ে তুমি ভেবো না।

আপনি কিছু মনে করবেন না প্লিজ। আমি আসলে চাই না, যে মেয়ে বড়ো দুটো বোন রেখে বোনদের সন্মানের কথা না ভেবে বাসা থেকে বের হয়ে যায় নিজের স্বার্থে। তাকে বোন বলে পরিচয় দিতে লজ্জা হয় আমার। আমি চাই না ও এখানে থাকুক।

সরফরাজ খান বেশ কিছু সময় চুপ করে থম ধরে বসে রইলেন। তারপর মুখ তুলে পলির চোখে চোখ রেখে বললেন, হ্যা জলি ভুল করেছে। কঠিন ভুল করেছে। ওর যে বয়স। সেই বয়সের মেয়েরা খুব বেশি আবেগপ্রবণ হয়। ভালো মন্দ বোঝার মতো জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা তাদের থাকে না। যদি থাকতো তাহলে জলির মতো এমন সুন্দরী মেধাবী মেয়ে কখনো সজীবের মতো মাকাল ফলের প্রেমে পড়তো না। দুই দিন আগে জলির যাকে ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব বলে মনে হতো, তাকে এখন দেখলেই হয়তো করুনা হয়। আরো কিছু দিন পর এই সজীব কে দেখেই জলি নিজেকে নিজে গালি দিবে এই বলে যে, ছিঃ ছিঃ জলি তোর রুচি এতো খারাপ!

শোন মা একটা কথা বলি, মেয়েরা কখনো খারাপ হয় না। এরা কঠিন শাসনের মধ্যে বড়ো হয়। মেয়েদের কোন বাজে অভ্যাস নেই। এরা মদ খায় না, সিগারেট খায় না, রাস্তায় দাঁড়িয়ে বন্ধুদের নিয়ে ছেলেদের দেখে শীষ বাজায় না।

এরা করার মধ্যে করে শুধু একটাই ভুল। সেটা হলো না বুঝেই অসময়ে ভুল জায়গায় প্রেমে পড়ে।
তখন শাসন না করে বোঝাতে হয় যে এই ভুলের পরিণতি কি হতে পারে।

আমি চাইলেই আমার বাসায় রেখে মেয়েটার স্বপ্ন পূরণ করতে পারি। কিন্তু আমি সেটা চাই না।

কেন আপনার বাসায় থেকে পড়লে সমস্যা কোথায়?

সমস্যা আছে গো মা। ভয়ঙ্কর রকমের সমস্যা….

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here