শিশিরে ভেজা আলতা পর্ব -২৪+২৫

#শিশিরে_ভেজা_আলতা
(২য় খন্ড)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
২৪.
রাস্তা পার হয়ে শরতের কাছে এসে দাঁড়াতেই শরত শুনতে পেল শিশিরের চাপা গর্জন৷ সে অবাক হয়ে খেয়াল করতেই বুঝতে পারলো আলতাকে ধমকাচ্ছে কোন বিষয় নিয়ে। রাস্তার চারদিক লক্ষ্য করে শরত প্রশ্ন করলো, “কি হয়েছে ওকে ধমকাচ্ছিস কেন?”

“ভাই ওরে আমি কালকে পদার্থবিজ্ঞান এর এক গুরুত্বপূর্ণ সাজেশন পাঠিয়েছি হোয়াটস অ্যাপে। বারবার করে বলে দিয়েছি রাতেই যেন অর্ধেকটা কমপ্লিট করে কিন্তু তিনি এখন বলছেন ঘুমিয়ে পড়ায় পড়তে পারেননি। তার ওপর কলেজে বসেও ও একটু আধটু সময় পায় বাড়ি ফিরেও পায়। কিন্তু সে চোখ পর্যন্ত বুলিয়ে দেখেনি এখন বলছে হোয়াটসঅ্যাপেও খুঁজে পাচ্ছে না৷ মানি সিরিয়াসলি একটা কলেজ পড়ুয়া মেয়ে তার দরকারি জিনিস ডিলিট করে ফেলে বলতে পারে খুঁজে পায় না! মন তো চাচ্ছে এখুনি দুইটা কষে থাপ্পড় লাগাই।”

বলতে বলতেই শিশির চোখ রাঙাচ্ছে, ধমকাচ্ছে আলতাকে। আপনাআপনিই এক দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসলো শরতের। এই সাপে নেউলে সম্পর্কধারী দুটোকে নিয়ে সে কিনা একটু আগেই অন্য কিছু ভাবছিল! অসম্ভব এ দুটোতে জন্ম থেকেই এক অমীমাংসিত যুদ্ধ চলমান তা বোধহয় আজীবনই থাকবে। সে নিজের ভাবনা ছেড়ে শিশিরকে থামাতে চাইলো, “আচ্ছা থাম, আর বকতে হবে না। তোর কাছে তো নিশ্চয়ই আছে আবারও সেন্ড করিস এবার আর ভুল হবে না ওর তাইনা আলতা!”
আলতাকে ইশারা করতেই সে দ্রুতবেগে মাথা নাড়লো যার অর্থ এবার আর ভুল হবে না। তারপর তিনজনেই হাল হাকীকত জানার পর শরত বলল, “চল কোথাও বসি তিনজনে আজ একসাথে খাই। তারপর আমি রওনা দেব আর হ্যা এটা তোর।”

একটা পলিব্যাগ আলতাকে এগিয়ে দিলো শরত। আলতা হাতে নিয়ে দেখলো নাড়ুর বক্স। সে খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে জানতে চাইলো, “শিফা মামী দিছে তাইনা! আমি বলছিলাম মামীকে নাড়ুর কথা।”

বাড়িতে প্রায় সকলেই জানে আলতা শিফা মামী নাড়ু পছন্দ করে আর এবার মামী বানিয়েছিলও কিন্তু আসার দিন মনে করে সাথে দেওয়া হয়নি। শরত জানে বাড়ি ফিরলেই কাকী, মা আর ফুপুআম্মাও বকবে কেন সে কাউকে না বলে এসেছে। তাই কিছুটা বুদ্ধি করেই নাড়ুর বক্সটা এখন অনুর দেখিয়ে দেওয়া শপ থেকে কিনেছে। ভাগ্যিস কিনেছিল নইলে পিচ্চিটার এমন খুশি দেখা হতো না।
আলতার কথা শুনে শিশির আবার ব্যঙ্গ করে বলল, বলদ কোথাকার বক্স দেখে বোঝেও না ভাই এটা কোন দোকান থেকে কিনে এনেছে।”

“কি ব্যাপার শিশির তুই এখানেও ওকে এত বকিস কেন বলতো! এটা তো আমাদের বাড়ি না। দুজনে বাড়ি ছেড়ে এত দূরে থাকিস বিপদে আপদে দুজনের খেয়াল রাখতে হবে সেখানে তোরা আগের মতই লড়াই করিস!”

“আমি করি না শরত ভাই অযথাই আমাকে বকে সবসময়।”

নালিশ করার মত করে বলল আলতা। তিনজনে মিলে একটা বাসস্ট্যান্ডের কাছেই ছোটোখাটো রেস্টুরেন্টে ঢুকল। রাতের খাবারটা দ্রুতই সেরে শরত বিদায় নিল। আটটার বাসে সে রওনা দিতেই শিশির আগে আলতাকে হোস্টেলে পৌঁছে দিয়ে নিজেও হলে ফিরে গেল। আজ তার সন্ধ্যার লাস্ট টিউশনি মিস করতে হয়েছে এরজন্য কাল এক্সট্রা সময় দিতে হবে। আজ রাতে আর তাদের ফোনালাপ কিংবা চ্যাট কিছুই হলো না। পরের দিন কলেজে যাওয়ার পথে আবারও ভয় মনে এগিয়ে গেল আলতা কিন্তু না তার সৌভাগ্য আজও সুমন পথ আগলে দাঁড়ায়নি। কলেজে ঢুকেই নাহারের সামনে পড়তেই জানা গেল সুমন কেন আর বিরক্ত করছে না আর করবেও না। একদিকে যেমন স্বস্তি মিলল অন্যদিকে তেমন একটা ভয় ঢুকে গেল মনে। নাহারের ভাই আলতার ফোন নম্বর চেয়েছে এদিকে শিশির ভাইয়ের কড়া নিষেধ খুব কাছের কোন বান্ধবীকে ছাড়া কাউকেই যেন ফোন নম্বর না দেয় এমনকি তার সাথে ফোন আছে এ কথাটাও না জানে। আলতা কথা রেখেছিল সে কাউকে বুঝতে দেয়নি তার ফোন আছে তবে পথে একবার শিশিরের সাথে ফোন কথা বলার সময় কোন এক ক্লাসমেট দেখেছিল। সেই থেকে মোটামুটি কয়েকজন জানতে পেরেছে কথাটা। ভ্যাপসা একটা গরম হাওয়া বইছে ক্লাস জুড়ে তাই আলতা একটু হাস ফাঁস করছিল তা চোখে পড়ল কেমিস্ট্রি টিচারের। মোটামুটি ত্রিশের কাছে বয়স ভদ্রলোকের কিন্তু এখনও অবিবাহিত আর স্বভাবে একটু মেয়েলি দোষও আছে। লোকটা ক্লাসের প্রায় প্রতিটি সুন্দরী মেয়ের দিকেই লোলুপ দৃষ্টিতে তাকায়। এতে অনেক স্টুডেন্টই দারুণ মজা পায় কিন্তু তারমধ্যে আবার কিছু স্টুডেন্ট খুবই অস্বস্তি বোধ করে৷ এই যে এখন আলতা একটু নড়েচড়ে উঠতেই লোকটা বাজে নজরে তাকাচ্ছে তার দিকে সেটা দেখেই আলতার গা কাটা দিয়ে উঠল। সে সোজা হয়ে বসে একবার নিজেকে খেয়াল করল। নাহ, হিজাব তার ঠিকঠাকই আছে তবুও মনে হচ্ছে লোকটা তাকে বাজেভাবে দেখে নিচ্ছে।

“কি হয়েছে আয়শা তুমি এমন নড়াচড়া করছো কেন? কোন সমস্যা!”

স্যার প্রশ্ন করলেন আলতাকে। এই ভয়টাই পাচ্ছিলো। লোকটা কথার সুযোগ পেলে একদম সামনে আসবে তারপর টেনে টেনে প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রয়োজনের কথাই বেশি বলবে। ঠিক তাই হলো এখন, স্যার প্রশ্ন করেই এগিয়ে আসছে তার দিকে। বসা থেকে দাঁড়িয়ে আলতা আমতা আমতা করতে লাগল তা দেখে নাহার হুট করে দাঁড়িয়ে বলল, “স্যার আয়শা একটু অসুস্থবোধ করছে। তার এক্ষুনি মাথায় একটু পানি না দিলে অজ্ঞান হয়ে পড়বে। প্লিজ স্যার আমি কি ওকে একটু ওয়াশরুমে নিয়ে যাব?”

ফটাফট কয়েকটা মিথ্যে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেই আলতার বাহু ধরলো। ভাবখানা এমন যেন আলতা এক্ষুনি মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাবে। স্যারও ভড়কে গেল হঠাৎ এমন অবস্থা দেখে। তিনি সাথে সাথে আলতার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, আসো আসো এদিকে আসো ওয়াশরুমে গিয়ে পানি দাও।”

তৎক্ষনাৎ নাহার একটু ঠেলে আলতাকে বিপরীত দিকে ইশারা করলো। কারণ স্যারের পাশ দিয়ে গেলেই লোকটা গা ছুঁতে চেষ্টা করবে। দুজন বিপরীত দিক থেকে বের হয়ে যাওয়ায় একটু অসন্তোষই হলো স্যার তাদের ওপর। ক্লাস পেরিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকতেই নাহার বলল, “এত মেনিমুখো হয়ে থাকো কেন বলোতো! ওই ব্যাটা এমনিতেই মেয়ে দেখলে লালা ঝরায় আর তোমার মত সুন্দরীর জন্য তো তার রীতিমতো কলিজাখানা ফরফরায়।”

শেষের বাক্যটা নাহার স্যারের উদ্দেশ্যে বলল। আলতা বলতে গেল তার ভয় লাগে স্যারকে কিন্তু বলতে পারলো। মনে হলো ওই স্যারের মতই ভীতি একদিন এই নাহারের জন্যও কাজ করবে আর তা অতিশিগ্রই। কিছুসময় দুজন ওয়াশরুমেই দাঁড়িয়ে ছিল। নাহার ইনিয়েবিনিয়ে ফোন নম্বরের কথা তুলতেই আলতা বলল, ক্লাসে যাই চলো।

শরত ফিরেছে শেষ রাতে। তার কাছে ঘরের চাবি থাকলেও বাইরের গেইট খোলার জন্য কাউকে না কাউকে কল করে জাগাতেই হবে বলে সে আর বাড়ি ফেরেনি। বাজারেই থেকে গেছে নিজের দোকানে। ভাগ্যিস দোকানের চাবিটা তার সাথেই ছিল সেই সাথে শীতও নেই। নইলে রাত কাটানো বেজায় মুশকিল হয়ে পড়ত তার। ভোরে বাজার সরগরম, বাজারের বেশিরভাগ দোকানী দোকানের ঝাপ খুলে রেখেই হোটেলের নাশতায় পেটপূর্তি করে কেউ কেউ আবার চায়ের দোকানে আড্ডায় বসে চা আর পাউরুটিতেও নাশতা সারে। দোকানের মেঝেতে স্বল্প লম্বাটে জায়গাটাতেই শুয়েছিল শরত মাথার নিচে কাঠের ছোটো জলপিঁড়ি পেতে। এটা সচরাচর তার কর্মচারী রুহুল কবে যেন এনে রেখেছিল তাই বালিশের কাজটা এতেই করেছে। এতে ঘুম ঠিকঠাক না হলেও তার ঘাড়ের যে দূরাবস্থা হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। বালিশ পরিমাণ উঁচু হলেও চলতো কিন্তু এর উচ্চতা অধিক হওয়ায় এখন মনে হচ্ছে শরীর থেকে ঘাড়টা আলাদা হয়ে গেছে। শরত উঠে দাঁড়িয়ে আগে শার্ট টেনেটুনে ঠিক করেছে। তারপরই দোকানের ঝাপ তুলে বাইরে তাকাতেই বুঝলো এখনও খুব ভোর। ফোনটাতে একটুও চার্জ না থাকায় সেটা বন্ধ পড়ে আছে। হাত, পা, ঘাড় নেড়ে একটু আড়মোড়া ভেঙে সে চায়ের দোকানে গেল। শরত যে দোকানে ঢুকল সেটা রফিক কাকার দোকান। শরতকে দেখতেই রফিক কাকা বলল, “কি বাজান রাইতে বাড়ি যাও নাই? কালকে দেখলাম দোকান খুলো নাই সব ঠিকঠাক তো!”

“না কাকা কাল ঢাকায় গিয়েছিলাম কাজে তাই ফিরতে ফিরতে শেষ রাত হওয়ায় আর বাড়ি যাইনি দোকানেই ঘুমাইছি।”

“ঢাকা তো শিশির আর নকশির মাইডাও থাহে না!”

“হ্যাঁ কাকা দেখে আসছি তাদেরও। কাকা চা দিয়েন এক কাপ।”৷ বলেই শরত তার দোকানের দিকে তাকালো। দুটি ছেলের মধ্যে একটা এসে গেছে তাকে দেখে এদিকেই আসছে।”

“শরত ভাই কাল মালের লিস্ট করার কথা ছিলো! ”

“ওহ এটা কি করে ভুলে গেলাম৷ কালই তো মাল আনতে যেতাম। তুই নাশতা করে আসছিস? না করলে হোটেল থেকে করে দোকানে গিয়ে বস আমি বাড়ি থেকে ঘুরি আসি তারপরই কাজ ধরছি।”

বিমর্ষ মুখে কথাগুলো বলে সে রফিক কাকার বানানো চা নিলো। চা টুকু শেষ করে আর বসেনি। বাড়ি ফিরে প্রথমেই মায়ের সম্মুখীন হলো শরত। তিনি বিশ্বাস করতে চাইলেন না শরতের কথা। যে ছেলে আজ অবধি এলাকার বাইরে গেলে মাকে জানিয়ে যেত সে ছেলে কি করে একদিন একরাত বাইরে পার করলো মাকে না জানিয়ে। সরাসরি মাকে ফোন করে মিথ্যে জবাব দিতে পারবে না বলেই কাল শুধু কাকাকে ফোন করে বলেছে কাজে যাচ্ছে। কাকা বুঝদার মানুষ তিনি জোরাজোরি করা পছন্দ করেন না আর শরতকে ভরসাও করেন খুব৷ কিন্তু মায়ের মন শুধু ভরসাতে মানতে চায় না৷ শুধু যে জয়তুন সন্দেহ করছে তা না শিফারও একটু অন্য ভাবনা আছে মনে শুধু শিউলিই আর ভাইকে ঘাটায়নি। মায়ের কথা এড়িয়ে গিয়ে সে গোসল সেরে আবার চলে গেল দোকানে। জয়তুনের মনের খচখচানি আর সারাদিনে একটুও কমেনি। এরপর আরও কিছুদিন জয়তুন পেছনে পড়ে রইলেন ছেলের কিন্তু কোন মনঃপুত জবাব তিনি পাননি। দিন দিন শরত আগের চেয়েও বেশি অন্তর্মুখী হয়ে উঠছে তা বাড়ির সকলেই টের পাচ্ছিলো। এদিকে শিউলির মেয়েরও এক মাস পূর্তি হতেই জামিল আর তার পরিবার তাড়া দিচ্ছে তাদের মেয়ে বউ তারা বাড়ি নিতে চায়। আহসানুল্লাহও শরতকে ডেকে বললেন, একটা ছোটো খাটো আয়োজন ছাড়া তো তাদের মেয়ে দেওয়া যায় না শরত।

শরত শুনে বলল, ” হ্যাঁ কাকা মাও বলছে কিছু আয়োজন করা লাগবে আপনি বলেন কেমনে কি করব?”

ভর দুপুর; মাথার ওপর রোদ যেমন চড়াও তেমনি বাতাসেরও কমতি নেই। সেই বাতাসে আবার ভেসে আসছে মুকুলের ঘ্রাণ। এই রোদ্দুরে বাতাসে হাঁটতে হাঁটতেই দোকান থেকে ফিরছিল তারা। আহসান আর শরতের কথার মাঝেই আহসানুল্লাহর ফোনটা বেজে উঠলো সশব্দে। পাঞ্জাবীর পকেট থেকে ফোন বের করে দেখলেন শিশির কল দিচ্ছে । আহসানুল্লাহ ফোনকল পেয়ে কপাল কুঁচকে কিছু ভাবলেন কয়েক মুহূর্ত। শরত তা খেয়াল করে বলল, কে কল দিলো কাকা?

“শিশির কল দিলো এই সময়!” চিন্তিত শোনালো আহসানের কণ্ঠস্বর। শিশির সবসময় তার মায়ের ফোনেই কল দেয় তাও আবার সকালে কিংবা বিকেল বা রাতে। ভর দুপুরে সে কখনোই দেয়নি বলে কিছুটা বিচলিত হলো আহসান। শরতও বুঝলো কাকার ভাবনা তবুও বলল, কলটা ধরে দেখেন কাকা জরুরি কিছু হতে পারে।

শরতের কথাতেই যেন হুঁশ হলো আহসানের সে কল রিসিভ করতে গেলেই কেটে গেল। এবার নিজেই ব্যাক করতে নিলে পুনরায় বাজলো ফোনটা।

“হ্যালো।”

“আসসালামু আলাইকুম আব্বা।”
শিশির প্রথমেই সালাম দিল তার বাবাকে। আহসান সালামের জবাব দিতেই শিশির জিজ্ঞেস করলো তিনি এখন বাড়িতে কিনা! আহসান জানালো সে আর শরত একন বাড়িই ফিরছে। কিন্তু শিশিরের তো এদিকে আর তর সইছে না কিছুতেই। সে তাই আর অপেক্ষা না করে বলেই ফেলল, “আব্বা আমি যে বিদেশে পড়ার জন্য এপ্লাই করেছি তার রেজাল্ট পেয়ে গেছি। লন্ডনে হয়ে গেছে আর ফান্ডের ব্যাপারটাও আমার জন্য সুবিধার মধ্যেই হচ্ছে।”

শিশিরের কথা শুনতেই আহসানুল্লাহ ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে শরতকে জানালো। ওপাশে শিশিরও বাবাকে একটুখানি সময় দিয়ে পরে বলল, ” আব্বা আরও কিছু ব্যাপার আছে টাকা পয়সার কিন্তু সেটা আমাদের পক্ষে সম্ভব না। কিন্তু”

শিশির থেমে দম নিলো। সে জানে না তার বাবা রাজী হবে কিনা কারণ তিনি বরারই সাধারণ মানুষ সাধারণ জীবনযাপনে বিশ্বাসী। টাকাপয়সার জন্য কখনো কারো কাছে চাইতে পছন্দ করতেন না আর সাধ্যের বাইরে কিছু পেতেও চাইতেন না। সে বাবার অনুমতি ছাড়াই যে প্রভোস্ট স্যারের হেল্প নিতে রাজী হয়ে গেছে এখন সেটা বলতেই ভয় লাগছে৷ সে জানে বাবা তার এই পড়াশোনার উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য জায়গা-জমি বিক্রি করতে দু’বার ভাববেন না। কিন্তু গ্রামে যে দর জমির তাতে সবটা সম্ভব নয় সেকারণেই সে মুখের সামনে পাওয়া প্রস্তাবটা ঠেলতে পারেনি। শিশির জানে না প্রভোস্ট স্যার বা উনার স্ত্রী এতো কেন সদয় তার প্রতি! তবুও সে ভাবে সে কৃতজ্ঞ থাকবে তাদের প্রতি তবে ঋণ রাখবে না। ছেলের নীরবতাতে কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে উঠলো আহসান। তারা বাড়ির গেইটে চলে এসেছে । শিশিরকে জিজ্ঞেস করলেন ‘কিন্তু কি!’

“ব্যাংক, টাকা পয়সার কিছু ব্যাপার আছে যেগুলো হয়ত আমাদের পক্ষে সম্ভব না জোগাড় করাটা আর প্রভোস্ট স্যার নিজ দ্বায়িত্বে সেগুলোতে হেল্প করবেন বলেছেন। স্যারের ওয়াইফও সে আশ্বাস দিয়েছেন। আব্বা আপনি চিন্তা করবেন না এ নিয়ে আমি সব শোধ করে দিব।”

ছেলের কথা শুনে বিষ্ময়ে খেই হারিয়ে ফেললেন আহসান। তিনি এখনও ঠিকঠাক বুঝতে পারছেন না শিশিরের কথা। কিন্তু এখন এ নিয়ে কিছু বলতে চাইলেন না। রাতে কথা হবে বলে কল কাটলেন তা দেখে শরত জানতে চাইলো কি হয়েছে।

“রাতে ধীরেসুস্থে সবটা জেনে তোকে বলছি।”

নিঃসঙ্গতায় ঘেরা গুলশানের ডুপ্লেক্স বাড়িটিকে আজ অনুর কাছে এক অচিনপুরের রাক্ষস বলে মনে হচ্ছে। দিনের এক তৃতীয়াংশ বাড়ির বাইরে কাটিয়ে কিছু আনন্দঘন মুহূর্তে দুই বেস্টফ্রেন্ডের সাথে কাটিয়ে তাকে ফিরতেই হলো একলা নীড়ে। গাড়িটা গ্যারেজে রেখে কিছুসময় সে বিমর্ষতায় বসে রইলো বাড়ির ডান দিকের একট টুকরো বাগানটায়। তাদের বাড়ির সবচেয়ে সুন্দর জায়গা শুধু এই টুকরো বাগানটাই। এখানে থরে থরে সাজানো নানা জাতের দেশী-বিদেশী ফুল, পাতাবাহার এর গাছ সাথে আছে একাংশ জুড়ে খাচাবন্দী বিদেশী কিছু পাখি। পাখিগুলো সারাটা দিন কিচিরমিচির করে বাগানটাকে একদম গ্রাম্য সেই অনুভূতি ফিরিয়ে দেয় যেমনটা তারা উপভোগ করেছিল শিশিরদের বাড়িতে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত এই কিচিরমিচির ভীষণ বিরক্ত লাগতো অনুর কিন্তু এবার শিশিরদের গ্রামে গিয়ে গাছ-গাছালিতে পাখির কলরব, খোলা আকাশ, বন-বাদাড়, কাশফুলের ক্ষেত, নদীর জল এসবের মাঝে চারটা দিন স্বপ্নের মত কেটেছে। তার ওই চারদিনেই মনে হয়েছে এ জনম তার বৃথা যেত যদি না প্রকৃতির ওই রূপটা দেখে আসত। এ বাগানে কাঠের একটি দোলনা আছে তার মায়ের সৌখিনতার পরিচয় বহন করতে। বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বসল সেই দোলনায়। এই তার জীবন! আজকে তার জন্য কত বড় একটা দিন, তার উশৃংখল জীবনের শৃংখল এক ফলাফল আজ সে হাতে পেয়েছে অথচ আজ তার সাথে এই দিনটাকে বিশেষ করার জন্য পাশে নেই মা আর বাবা। কত কত বাবা মা সন্তানের জীবনে এমন কোন দিন দেখার জন্য তীর্থের কাকের মত অপেক্ষায় বসে থাকে আর সে সৌভাগ্যের চরম পেয়েও আজ পাশে কেউ নেই। না ছিলো তো শিশির আর সোহা। এ দুজনের কথা ভাবতেই বুকের চাপ চাপ দুঃখরা উধাও হওয়ার পায়তারা করছিল কি ঠিক সে সময়েই একটা গাড়ি এসে ঢুকলো বাড়িতে। ঘাড় বাঁকিয়ে দেখার সুযোগটাও হলো না অনুর তার আগেই গাড়ির ভেতরের মানুষটা বেরিয়ে এলো ঝড়ের গতিতে। তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে এক সেকেন্ডও অপেক্ষা না করে দু বাহু খামচে ধরে দাঁড় করালো অনুকে। সে কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগেই মানুষটা তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই জোর করে চুমু খেয়ে নিলো। অনু তাকে ঠেলে সরাতে চাইলে মানুষটা তাকে আরো জাপটে ধরলো। তার চুমুর বর্ষণ বাড়তে থাকলে অনু আর সামলাতে পারলো না নিজেকে তাই বাধ্য হয়েই লোকটার পেটের ডান দিকে ঘুষি মেরে বসল।

চলবে
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন )#শিশিরে_ভেজা_আলতা
(২য় খন্ড)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
২৫.

“এত জোরে কেউ ঘুষি মারে!”

দু হাতে পেট চেপে ধরে দোলনায় বসে বলল তাওহীদ। অনুর হাতে মা-র সে আগেও দু একবার খেয়েছে কিন্তু আজকের ব্যাপারটা বেগতিক ছিল। তাওহীদের আর্তনাদ দেখে একটুও ভাবান্তর হচ্ছে না অনুর বরং এই মুহুর্তে এই লোকের চেহারা দেখতেই মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে।

“এখানে কেন এসেছো?”

“মিষ্টি খেতে কিন্তু মিষ্টির সাথে এমন দুর্দান্ত ব্যথাও যে খেতে হবে বুঝতে পারিনি।”

“তোমার কি লজ্জা করে না এভাবে প্রায়ই চলে আসতে! কেন বুঝতে পারছো না এই বিয়ে হবে না আর কত অপেক্ষা করবে তুমি?”

“যতদিন না তোমার মাথা থেকে ওই ছেলের ভূত নামছে।”

তাওহীদের মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই আরেকটা ঘুষি পড়লো তার মুখে। ডান গালের পাশটাতে এত জোরেই লেগেছে ঘুষিটা যা ভেতরের চোয়াল এমনকি দাঁতও হয়ত নড়িয়ে দিয়েছে। এবার যেন সহ্যসীমা অতিক্রম হয়েছে তার। সে বসা থেকে উঠেই দু গাল চেপে ধরল অনুর। দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “বাড়াবাড়ি করা ভালো নয় অনু। আমার ধৈর্য্য ফুরিয়ে আসছে এবার। আমার বউ তোমাকে হতেই হবে এটা যেমন ঠিক আমায় ছেড়ে ওই ছেলের সাথে চিপকে থাকলে ওই ছেলেকে খুন করব আমি সেটাও ঠিক কথাটা গেঁথে নাও মস্তিষ্কে।”

অনুকে ছেড়ে আর এক সেকেন্ডও না দাঁড়িয়ে চলে গেল তাওহীদ। আজ দুইটা বছর চলছে অনুকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে৷ আংটি বদল করেছে পরিবারের বড়রা অথচ বিয়ের জন্য এখন কেউ মুখ খুলছে না। অনুর উশৃংখল পরিবার কোনদিন মেয়ের ব্যাপারে সিরিয়াস ছিলো না যেদিন থেকে তাওহীদ বুঝতে পারল সেদিন থেকে সে নিজেই তৎপর হলো বিয়ের ব্যাপারে আগাতে৷ কিন্তু অনু বড় জেদী আর বেয়াদব স্বভাবের হওয়ায় তাওহীদের কথায় পাত্তা দিচ্ছে না। তাওহীদ খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছে অনু একটি ছেলেকে ভালোবাসে৷ সেই ছেলের খোঁজও জানা তাওহীদের তবুও সে বুঝিয়ে সুঝিয়ে অনুকে নিজের করতে চাইছে৷ কিন্তু সে প্রতিবারই ব্যর্থ তাই এবার অধৈর্য্য হয়েই জোর খাটাতে চাইছিলো। তাওহীদের গাড়িটা বাড়ির বাইরে যেতেই অনু বাড়ির ভেতরে ঢুকলো৷ নিচতলায় গ্যারেজ দোতলায় বিশাল আকারে ড্রয়িং স্পেস, রান্নাঘর আর একটা মিউজিক রুম। তিনতলায় নিজেদের শোবার ঘর, গেস্ট রুম একটা লাইব্রেরী কাম এক্সারসাইজ রুমও আছে। অনু একবার মায়ের রুম, বাবার রুমের দরজায় তাকালো। দুটো রুমই লকড কারণ একজন নিজের এসিস্ট্যান্টকে নিয়ে হলিডে কাটাতে এক সপ্তাহের জন্য নেপাল গেছে অন্যজন নিজের ভার্সিটি লাইফের ফ্রেন্ডদের সাথে রিইউনিয়ন এর নাম করে কক্সবাজার আছে৷ অনু জানে সেখানে তার মম প্রাক্তনের সাথে সময় কাটাতে গেছে। কি অশ্লীল এক জীবন হলো তার! এমনও হয় কারও বাবা মা! কই শিশিরদের বাড়ি গিয়েছিল তার বাবা মায়ের মধ্যে তো এমন কিছু নেই। বরং আঙ্কেলের চোখে আন্টি ছাড়া অন্য কোন নারীর ছায়া আছে বলে মনেই হয়নি৷ শরতের মা বিধবা মহিলা তার কি যৌবণ কাটেনি দ্বিতীয় পুরুষ ছাড়া? শিশিরের মুখেই শুনেছে তার জেঠু তারা ছোট থাকতেই মারা গেছেন এরপরও জেঠি কখনো দ্বিতীয় বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়নি৷ আর আয়শার মা! নকশি সে একা এক সন্তান নিয়ে অল্প বয়সেই জীবনযুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছেন৷ আয়শা বড় হয়ে তার মাকে বাধ্য করেছে বিয়ে করতে নইলে হয়ত তিনিও শরতের মায়ের মত জীবনটা একা কাটিয়ে দিত। তবে তার আধুনিক বাবা মা কেন এমন হলো না! একে অন্যের প্রতি লয়ালটি দেখানোর কেন আগ্রহ পায় না তারা! টাকার নেশা, যৌ*নতার নেশা এসবই কি সব জীবনে? টলমলে পায়ে নিজের ঘরে ঢুকে ধড়াম করে দরজাটা লক করে দিল অনু। এ বাড়িতে কাজের লোকগুলোও ঠিক তাদের মনিবের মত। কাজের মেয়েটা বিবাহিত ড্রাইভারের সাথে আজকাল একটু বেশিই সময় কাটায়। মনিবের নেশায়ই হয়ত পেয়ে বসেছে তাকে। আর কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছে না এই বিষাদিত মন নিয়ে। বিছানায় গা এলিয়ে চোখ বুজতেই নিদ্রা ভর করলো চোখের পাতায়। এরপর এক ঘুমেই তার রাতটাই কভার হয়ে গেল। এরই মাঝে তার মাতৃদেবী বুঝি একবার মনে করেছিলেন একমাত্র সন্তানকে তাই ফোনের ওয়ালে চারটা মিসড কল শো হচ্ছে। সকালে বিছানা ছেড়ে ফোনের মিসড কল দেখেও সে কলব্যাক করলো না তার মমকে। কাজের মেয়েটিকে ডেকে কফি আর ডিমের ওমলেট দিতে বলে সে ঢুকলো বাথরুমে। প্রতিদিনকার মত আজকের রুটিন সেই একই। দু ঘন্টা লাইব্রেরিতে তারপর ক্লাস আছে কিনা চেক করে যদি ভাগ্যে থাকে তো ক্লাস করবে অন্যথা ক্যাম্পাসেই এদিক ওদিক ঘোরা কিংবা শিশির সোহার সাথে সময় কাটানো৷ এই একটা ব্যাপার অনুর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ আর তা হলো সর্বাবস্থায় তার পড়াশোনা ঠিক রাখা। শুধু ঘুমের কারণে প্রায়ই সকালের ক্লাসগুলো বাদ যায়। তাতেও নসীব সুপ্রসন্ন শিশিরের কারণে। জীবনে তার এক আনাই সুখ আছে আর সেটা এই পড়াশোনা। নইলে জীবনের সেরা দুটো বন্ধু বান্ধবীই কি করে আসত! বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা শুধু শিশির না অনুরও করার সুযোগ হয়েছে। কাল থেকেই শিশির সেই সুখবরকে ঈদ উৎসবের মত উপভোগ করছে উদযাপন করছে শিশিরের পরিবার। আর সে! তার এই সুখবরটা, তার স্বপ্নের কথাটা শেয়ার করার মত একটা আপন মানুষ নেই। মা-বাবা থাকতেও তার কেউ নেই। থাকার মধ্যে আছে শুধু তাদের দেওয়া কার্ডস, ব্যাংক ফাইল আর খুব দামী একটা গাড়ী যা অনুর পছন্দের। আচ্ছা এই যে তার বিদেশে পড়তে যাওয়ার সুযোগ হলো নিজ যোগ্যতায় সেই আনন্দটা কি এই ব্যাংক, ব্যালেন্স আর গাড়ির সাথে ভাগ করা যাবে!

কিছুদিন পরের ঘটনা; শিশিরে যাওয়া নিয়ে শুধু টাকা পয়সার একটা সমস্যা ছিল আজ সেটা দূর হয়ে গেল। শিশির এখনো যথেষ্ট বুঝদার হয়নি তার প্রমাণই ছিলো প্রভোস্ট স্যারের কাছে থেকে লক্ষ লক্ষ টাকার সহায়তা নেওয়ার সিদ্ধান্তটা। আহসানুল্লাহ ছেলের বিদেশে নিজ যোগ্যতায় পড়াশোনা করার সুযোগ পাওয়ায় ঠিক যতোটা আনন্দ হয়েছিল ঠিক ততোটাই চিন্তিত আর কষ্ট পেয়েছিল শিশিরের সিদ্ধান্তে। প্রভোস্ট রাশেদ আর তার স্ত্রীর সাথে আহসানুল্লাহর পড়াশোনাকালীন একটা সেরা সম্পর্ক ছিল এ কথা যেমন সত্যি সময়ের পরতে সেই বন্ধুত্ব ছাপিয়ে রাশেদর স্ত্রী আহসানের প্রতি ভীষণরকম দূর্বল হয়েছিল এ কথাও তেমন সত্যি। কিন্তু আহসানের পক্ষ থেকে বন্ধুত্বের বাইরে কখনোই কিছু ছিলো না। সে কারণেই পরবর্তীকালে রাশেদের সাথে যোগাযোগ থাকলেও তার স্ত্রীকে সম্পূর্ণ ভুলে যাওয়ার মতই ব্যাপার এখন। আহসান ভেবেছিল জমি বিক্রি করবে কিন্তু সেই টাকায় আর যাইহোক লন্ডনের মত জায়গায় গিয়ে পড়াশোনা চালানো মুশকিল৷ তারওপর সেখানে স্টুডেন্ট জব পাবে কি পাবে না সে বিষয়ে আন্দাজ নেই তাদের৷ বাধ্য হয়েই ঋণ করার চিন্তা করলো আহসান। কিন্তু সকল চিন্তার অবসান ঘটিয়ে দিলো শিফা। বাপের বাড়ির অর্থবিত্তের প্রতি এই প্রথম সে নিজ স্বার্থে নজর দিলো। আহসান চুপচাপ মেনে নিলেন স্ত্রীর পরামর্শ ছেলের কথা ভেবে। শিফা বড় রকমের ধার চাইতেই একদিন বাপের বাড়ি গিয়ে হাজির হলো। বিয়ের প্রায় পঁচিশ বছর পার হলো সে কোনদিন দশটা টাকার সাহায্য নেয়নি বাপের বাড়ির আর এত বছর পর তার হঠাৎ ধারের কথা শুনে ভাই বোন সকলে কষ্ট পেলেন। বড় আদরের ছোট বোন শিফা তাদের। বড় ভাইয়ের কত সাধ ছিল তাকে খুব বড়লোক বাড়িতে বিয়ে দেওয়ার কিন্তু বাবার সিদ্ধান্তের ওপর তখন ভাইয়েরা কিছুই বলতে পারেনি। এতবছর পর বোনের অসহায়তার কথা ভেবে প্রথমে প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলেন বড় ভাই। পরে অবশ্য বড় বোন আর ছোট ভাইয়ের কথা শুনে রাগ মাটিচাপা দিয়ে আহসানকে ডাকলেন। আজ সময় করে আহসান আর শিফা পৌঁছুতেই দেখলো বাড়িতে বড় বোন আর ভাইয়েরা সবাই উপস্থিত। এমনকি বোন সাথে করে লাখ দুই টাকা এনেছেন। বাকি তিন ভাইও তাদের অবস্থানুযায়ী কয়েক লক্ষ টাকার একটা হিসেব দিলেন যা শিশিরের নামে একাউন্টে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।এতসব কান্ড দেখে আহসানের আজ আবারও মনে হলো তার শিফাকে বিয়ে করা উচিত হয়নি। আজ আবারও পুরনো ক্ষত রগরগে হয়ে উঠলো যা শিফার বড় ভাইয়ের কাছ থেকে পেয়েছিল তবে আজ একটু আনন্দও হলো ছেলের স্বপ্ন পূরণের পেছনের বাঁধা সরে যাওয়ায়। শিফা লক্ষ্য করেছিলেন স্বামীর মুখের মেকি হাসির আড়ালে লুকানো কষ্টটা। সে ভাই বোনদের সাথে টাকা পয়সার আলোচনা শেষ হতেই মিথ্যে বলে আহসানকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো৷ দুপুরের আগেই গিয়েছিল তারা কারণ বড় ভাই বলেছে দুপুরে একসাথে খাবে আজ। বড় ভাইয়ের ঘরে ভালো মন্দ আয়োজনও হয়েছে আজ সব ভাইবোনের উদ্দেশ্যে। কিন্তু আহসানের এই বিমর্ষ মুখটা দেখার পর শিফার গলা দিয়ে নামবে না এ খাবার। তাই দ্রুত ফিরে আসা৷ বাড়ি ফিরে প্রথমেই শিফা চুলায় ভাত চড়ালো। তা দেখে জয়তুন আশ্চর্য হলেও কিছু না বলে দু বাটিতে দু পদের তরকারি এনে রাখলো শিফার সামনে।

“কি হইছে শিফা।”

“কিছু না ভাবী।”

“আমার লগে কতক্ষণ মিছা কইতে পারবি!”

জয়তুন বললেন জোর দিয়েই। শিফা জানে সত্যিই সে লুকাতে পারবে না। ছলছলে চোখে ভাবীর দিকে তাকিয়ে বলল, “আজকে কয়েক লাখ টাকার ঋণ হওয়ার কথা ছিল ভাবী। কিন্তু ঋণ হয় নাই কারণ আমার ভাইবোন এমনিতেই দিয়ে দিছে কয়েক লাখ টাকা। আপনার দেবর এই জিনিসটাই সইতে পারতেছে না। তিনি আমার ভাই বোনের এভাবে টাকা দেওয়াটা সহজভাবে নিচ্ছে না হয়ত ভাবছে তারা দান খয়রাত করছে।”

শিফা ঠিকঠাক গুছিয়ে বলতে পারছে না কথাগুলো। তার মনটা খারাপ হয়ে আছে মানুষটার উদাসীনতা দেখে৷ জয়তুনের পছন্দ হলো না শিফার কথা সে মুখ বাঁকিয়েই বলল, “এরা ভাইরা খালি এইসবই জানে। ক্ষমতার বাইরে কিছু করতে এমন আত্মীয়স্বজনের সাহায্য লওয়া লাগে এই নিয়ে এত কষ্ট পাওয়ার কি আছে! বড়লোক শ্বশুরবাড়ি আছে কোন দিনের জন্য?”

দোকান বন্ধ করে মাত্রই বাড়ি এসেছে শরত। মায়ের মুখে এমন কথা শুনে বিরক্ত হলো সে। মুখ খুলছিলো কিছু একটা বলার জন্য কিন্তু ঘর থেকে কাকাকে বের হতে দেখে আর বলল না। এগিয়ে এসে জানতে চাইল ব্যবস্থা কতটুকু হলো? আহসান জানালো হয়ে গেছে সমস্যার সমাধান এখন যা বাকি সেটা শিশিরের দিককার কাজকর্ম। শরত সেটা শুনে আমতা আমতা করে বলল, “কাকা আমি বলেছিলাম আমি কিছু ব্যবস্থা করব। আমি লাখ দেড়েক এর মত ব্যবস্থা করে ফেলেছি আসলে দুই লাখই করতে পারতাম যদি পুকুরের কাজটা আগেই না হাতে নিতাম।”

জয়তুন, শিফা, আহসান তিনজনই যেন চমকে গেল শরতের কথা শুনে। কেমন ভড়কে যাওয়া চোখে সবাই তাকিয়ে রইল তার দিকে। এতে করে অস্বস্তিতে পড়ে শরত বলল, “আমি গোসল করি গিয়ে আম্মা ভাত বাড়েন।”

পরিস্থিতি যতোই প্রতিকূল হোক না কেন সহযোগিতার হাত পেলে সবটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব যেকোন উপায়ে। শিশিরের আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন হুট করেই হাতের মুঠোয় ধরা দিতে লাগল। নিজেকে তার দুনিয়ার সবচেয়ে সৌভাগ্যবান সন্তান বলে মনে হয়। সামান্য স্কুল মাস্টার, মুদি দোকানীর ছেলে হয়ে ইউরোপের কোন খন্ডে পাড়ি জমানোর স্বপ্নটা বড় বেশিই দামী মনে হয়েছিল তার আর আজ সেই স্বপ্ন বড় সস্তায় পূরণ হতে যাচ্ছে মনে হলো। তার জীবনে নির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য আছে, আছে কিছু স্বপ্ন আছে একটা প্রতিজ্ঞা। স্বপ্ন পূরণের জন্য হাতে গুণে দুইটা বছরের মত সময় তাকে পরদেশে ব্যয় করতে হবে ততদিনে সে দূর থেকেই চেষ্টা করবে প্রতিজ্ঞাটা পূরণ করতে। সেই প্রতিজ্ঞা আলতাকে সরব করে তোলার, আত্মবিশ্বাসী আর স্বাবলম্বী করার। আর বাকি রইলো লক্ষ্য সেটা তার গ্রামের জন্য কিছু করতে হবে, বাবা মায়ের জন্য করতে হবে প্রতিটা কাছে দূরের সকলের জন্য কিছু করতে। শিশিরদের গ্রাজুয়েশন এব্রোডে হবে ভাবতেই সোহার কান্না পায়। তার প্রিয়রা চলে যাবে দূর দেশে আর সে একা পরে রইবে চেনা শহরে। এদিকে ভালোবাসার মানুষটার প্রত্যাখান সব দিকেই ভেতর থেকে গুমরে উঠছে সোহা। বাড়িতে আজকাল কারও সাথে কথাও বলা হয় না ঠিকঠাক। মা বাবা চিন্তিত তাকে নিয়ে আর খালা বুদ্ধি দিচ্ছে তাকে বিয়ে দেওয়ার। তাদের ধারণা বিয়ে দিলেই সোহা স্বাভাবিক হয়ে যাবে, আগের মত আবার প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠবে। কিন্তু আদৌ কি এমনটা সম্ভব! যে মন মস্তিষ্কে শরত গেঁথে আছে বেত কাঁটার মত তা উপরে ফেললেও ভেতরে ঘা ঠিকই হয়ে থাকবে। কিশোরী বয়সে সোহা কারো প্রেমে প্রত্ততায় ভোগেনি অথচ কৈশোর পেরিয়ে এতদিনে কারো প্রতি এসেছে সেই প্রমত্ত, উত্তাল আবেগমাখা প্রেম। তার মন বলে এটাই তার জীবনের প্রথম প্রেম যে প্রেম সে কখনো ভুলতে পারবে না সেই সাথে পারবে না ভুলতে মানুষটার প্রত্যাখ্যান৷ মন পবনে তুফান বইতে বইতে তাকে বিধ্বস্ত করে দিচ্ছে এখন। খুব করে মন চাইছে সব ছেড়ে ছুড়ে জোর করে শরতের বুকে গিয়ে পড়ুক। সেই মানুষটা কতদিন তাকে দূরে ঠেলবে! কতদিন উপেক্ষা করবে তাকে? এই প্রশ্নের উত্তর সোহা নিজেই নিজেকে দিয়ে দিল, “যতদিন ওই মানুষ তার প্রাক্তনকে ভুলতে পারবে না ততদিন অন্য কাউকেও আপন করতে পারবে না আর তাকে তো নয়ই।”
মনে পড়ে গেল সেদিনের ঢাকায় ফিরে আসার দিনটার কথা। শরত ড্রাইভ করতে করতে একদম কলেজের লেকচারারের মত করে বলেছিল, “তোমার সাথে কোনভাবেি লোন সম্পর্কে যাওয়া সম্ভব নয় আমার পক্ষে।”

“কেন সম্ভব নয়?” প্রশ্ন ছিলো সোহার। তখন সরু কপালটায় কেমন চিন্তিত ভঙ্গিতে দুটো ভাজ ফেলে, চোখ দুটো সামান্য ছোট করে পথের দৃষ্টি ফেলে চমৎকার ভাবে বলে গেল, “অসম সম্পর্ক আমি কখনোই পছন্দ করি না সোহা। তোমার আমার মধ্যে আর্থিক, পরিবেশগত এবং শিক্ষাগত পার্থক্য কি তা নিশ্চয়ই ভেঙে বোঝানোর দরকার নেই? তোমাকে আমি আগেও একবার বলেছিলাম মনে করে দেখো।”

সত্যিই শরত আরও একবার আরও ভালো করে তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল তাদের মধ্যে কোন সম্পর্ক তৈরি হওয়া অসম্ভব। আজ আবারও সেসব কথা মনে করে দরজা চাপিয়ে কান্না করতে লাগল সোহা। কখন যে তার ঘরে তার প্রিয় দুজন মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে সেদিকেও খেয়াল নেই। যখন টের পেল রুমের মধ্যে সে ছাড়া আরও কেউ আছে তখন ধড়ফড়িয়ে চোখ মেলে সোজা হয়ে বসল বিছানায়।

আলতা ফোনটা একবার টেবিলে রাখছে তো একবার হাতে নিচ্ছে। আজ সারাটা দিন শিশির ভাই তাকে একটা কল কিংবা মেসেজ কিছুই দেয়নি। আজকাল এমনটা বিশেষ হয়না তাই আজকের অনিয়ম মন খারাপ করে দিলো আলতার। এমনিতেই তো আর নাকি কয়েকটা মাস আছে সে তারওপর দু দুটো বছর নাকি আর দেশের মাটিতে পা রাখবে না৷ আচ্ছা এই দু বছরের মাঝেই যদি আলতার কিছু হয়ে যায় শিশির ভাই কি কষ্ট পাবে! তার জন্য শিশির ভাই ছটফট করবে, তাকে পাওয়ার তৃষ্ণায় ধুঁকবে সারাটাক্ষণ এমন স্বার্থপর কিছু চাওয়া আলতার মনে ঘুরপাক খায়৷ আদৌও কি এমন কিছু হবে কখনো! মনে তো হয় না নইলে আজও কেন শিশির ভাই তাকে কেন বলেনি সেসব কথা যেসব কথা একজন প্রেমিক তার প্রেমিকাকে বলে! কই সেদিন তো সে নাহার আর তার প্রেমিকের স্পষ্ট কথপোকথন শুনেছিল৷ ছেলেটা নাহারকে প্রায় সব কথাতেই ভালোবাসি বলেছে, তাকে কাছে পাওয়ার জন্য আকুল আবেদন জানিয়েছে। তাহলে শিশির ভাই কেন তাকে এমনটা বলে না! নাহার তো বলল শিশির ভাই আমাকে ভালোবাসে নইলে অত যত্ন কেন করে আবার শাষণেও কমতি রাখে না। নাহার যখন তার ভাইয়ের হয়ে ফোন নম্বর নিতে চেষ্টা করলো সে কথা শিশির ভাইয়ের কানে যেতেই কত শাষণ করল। আবার সেই বৃষ্টির বিকেলে আমার কাছে ছাতা নেই শুনে নিজে টিউশনি বাদ দিয়ে ছাতা নিয়ে তাকে আনতে গেল। এছাড়াও তো সেই রাতের আঁধারে যত্নে তাকে জড়িয়ে রাখা, সেই কাশফুলের মাঝে তার পা ভর্তি আলতা রাঙানো সেসব কি! বয়স বাড়ছে কিন্তু তার ম্যাচিউরিটি ঠিক কতোটা বাড়ছে কে জানে! এখনও কিনা অন্যের বুঝিয়ে দেওয়া কথাটাকেই সে মাথায় গেঁথে নেয়। শিশির ভাই তাকে ভালেবাসে কিনা তা জানতে হচ্ছে বান্ধবীর অনুমান থেকে। এমনও বুঝি হয় মেয়েরা! আলতা নিজেই নিজের মাথায় ঠোকা মেরে হাতে রাখা বইটাতে মনযোগ দিতে যাচ্ছিল। তখনই কানে এলো মেসেজের টোন৷ ফোন হাতে নিতেই দেখলো শিশিরের মেসেজ, “তোর কি এখানে কোন শাড়ি আছে?”

চলবে
(লেখাটা কেমন যেন এদিকে এসে খাপছাড়া হয়ে যাচ্ছে৷ আচ্ছা তথ্যাদি কিছু ভুল লিখলে ক্ষমা করবেন এবং সম্ভব হলে জানিয়ে শুধরানোর সুযোগ করে দিবেন। প্রত্যেকের মন্তব্য কামনা করছি)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here