#শিশিরে_ভেজা_আলতা
(২য় খন্ড)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
২৬.
সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে মন ছুটছে আলতার। শিশিরের সময়গুলো ফুরিয়ে আসছে দেশের মাটিতে পা রাখার সেই সাথে অনুরও। টাকা পয়সার চিন্তাটা শেষ হয়ে এসেছে আহসানুল্লাহর। এখন কাঁধে শুধু আছে স্ত্রীর ঋণ। সেবার যখন শিফার বাবার বাড়ি গিয়ে টাকার জোগাড় হলো তখন আহসানের কষ্ট হচ্ছিলো এতজনের কাছ থেকে পাওয়া সাহায্য নিতে। তারা হয়ত নিজেদের অঢেল থাকায় বোনের ছেলেকে বিনা হিসেবে অনেকগুলো করে টাকা দিতে যেচে এগিয়ে এসেছিল। কিন্তু এই দরদামের চড়া বাজারে আহসানের কাছে ব্যপারটা সুখকর ছিলো না। যত দিন গড়াচ্ছিলো ততোই আহসানুল্লাহ মানসিক অশান্তিতে দূর্বল হয়ে পড়ছিলেন। একঘর এক বিছানার সঙ্গী হয়ে শিফার চোখে কিছুই এড়ায়নি বরং দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনে সে এই মানুষটার সকল নীতিজ্ঞানের সাথে পরিচিত। তাই না পারতেই একদিন স্বামীর দু হাত জড়িয়ে ধরে অনুরোধ করলো সে যা সিদ্ধান্ত নিবে সেটা যেন মেনে নেয়। আহসান যখন কৌতূহলী হলো সিদ্ধান্ত জানতে তখনই শিফা বলল, বড় ভাই বাবার সম্পত্তি ভাগবন্টন করতে চেয়েছেন। মেজো ভাইয়ের ছেলে দুটো বড় পাজী তারা সম্পত্তির ভাগাভাগি করতে চায় সে হিসেবে বড় ভাই ভাগ করবেন। তাই শিফা নিজের ভাগটুকু নিয়ে শিশিরের জন্য খরচ করলে কেমন হয়! আহসান জবাব দেয়নি প্রথম দফায় তা দেখে শিফা আবারও বলল, “আমার ভাগটুকু আমার হক সেটা আমি আমার সন্তানের জন্য খরচ করতে পারি না! আর আমার ভাগটুকু যদি নিয়ে নেই তাতে অনেক আছে তাই দিয়েই শিশিরের হয়ে যাবে তখন ভাই বোনদের থেকে যা এমনিতে নিয়েছি সেগুলো ফেরত দিতে পারব।”
শিফার কথা শুনে সে ভারমুক্ত হতে পারেনি তবে একটু হলেও দায় মুক্ত হতে পারবে বলে মনে হয়েছে। অন্যের কাছ থেকে সাহায্য নেওয়ার চেয়ে স্ত্রীর সাহায্যটাই বেশি শোভনীয় মনে হয়েছে তার। শেষ পর্যন্ত তাই হলো বাপের বাড়ির ভাগ হাসিমুখেই নিয়ে এলো শিফা আর ভাই বোনের তরফ থেকে পাওয়া অর্থগুলো আবার তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হলো। এতে অবশ্য শিফার বড় বোন আর বড় ভাইটা তার প্রতি অপ্রসন্ন হলো। বড় ভাই এমনিতেই আহসানকে গরীব বলে খুব একটা পছন্দ করতেন না। তারওপর ক্ষোভ ছিলো তার পাঠানো দামী চাকরির অফারগুলোও এককালে পায়ে ঠেলেছে সে এখন আবার তার জন্য শিফা ভাইয়ের টাকা ফেরত দিল! সব মিলিয়ে নতুন করে একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হলো শিফার বড় ভাইয়ের । আর আহসানের দিন কাটছে ভাবনায় কি করে স্ত্রীর ভাগের লাখ লাখ টাকা শোধ করা যায়! শিশির অবশ্য মা -বাবাকে রোজ আশ্বস্ত করছে সে সেখানে ফার্স্ট টার্মের রেজাল্ট দিয়েই নিজের ভালো একটা ব্যবস্থা করে নিবে এদিকে যে ইউনিভার্সিটিতে সে যাচ্ছে সেখানকার প্রফেসরের সাথে তার অনলাইনেই চমৎকার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে সেই সুবাদে সে সাধ্যমত মদদ পাবে। লোকটা তাকে এখন থেকেই বিভিন্ন ব্যাপারে পরিষ্কার ধারণা দিচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে অনুর চেয়ে তার ভাগ্য সুপ্রসন্ন আর সেজন্য শিশির প্রতি ওয়াক্তে উপরওয়ালার শুকরিয়া আদায় করে। অনুর এখনও সেখানে স্টে করার ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোন ব্যবস্থা জানা যায়নি অথচ শিশিরের সে ব্যবস্থাও হয়ে গেছে৷ এখন শুধু তার ফাইনাল একটা ডেটের অপেক্ষা। এদিকে আলতার মনের অবস্থাও তার বোধগম্য হয়ে গেছে ঠিকঠাক। তাইতো যাওয়ার আগেই আলতাকে সরাসরি নিজের মনের কথা জানিয়ে যেতে চায় শিশির সেই সাথে আলতাকে নিজের নামে আজীবনের জন্য বন্দী করতে চায়। মাস কয়েক আগের ঘটনা শিশির আলতাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলো, “তোর কি এখানে কোন শাড়ি আছে?”
আলতা সেদিন প্রশ্ন শুনে অবাক হয়েছিল ভীষণ কিন্তু সাথে উত্তেজনাও ছিল এক ভিন্নরকম। তার কাছে কোন শাড়ি নেই কথাটা বলতে ইচ্ছে করছিলো না তাই সে পাল্টা প্রশ্ন করেছিল, “শাড়ি দিয়ে কি হবে শিশির ভাই?”
শিশির তার উত্তর বুঝি সেই প্রশ্নেই পেয়ে গিয়েছিল। আর কোন প্রশ্ন না করে ফোন কেটে দেয়। সন্ধ্যের মুখে আলতা যখন কোচিং থেকে ফিরছে শিশির এলো সেখানে। হাতে তার একটা শপিং ব্যাগ সেটা আলতাকে দিয়ে বলেছিল, এটা নিয়ে যা।
“এটা কি?”
“একটা শাড়ি; আপাতত তোর কাছে রাখ একদিন পরিস।”
আলতা জানতে চাইলো শাড়ি কেন পরবে! শিশির হেয়ালি করে বলল, “আমার গার্লফ্রেন্ড কে দেখতে নিয়ে যাব তোকে।”
আলতা এরপর আর কোন প্রশ্ন করেনি। সেই শাড়ির পয়াকেট খুলে সে দেখতে পেয়েছিল একটা চমৎকার হাফসিল্ক শাড়ির। শাড়ির রঙটা কি রঙ অনেক চেষ্টা করেও সে যখন বুঝতে পারল না তখন মনে পড়লো নিজেদের গ্রামে দেখা জারুল ফুলের কথা। হ্যসঁ এটা সেই জারুল ফুলের রঙ আর এই রঙটা আলতা বড় পছন্দের। এর একটা ইংলিশ নাম আছে যা আলতার জানা নেই৷ সাথে পেটিকোট আর সাদা ব্লাউজও ছিল৷ কিন্তু ব্লাউজটা একদমই আলতার মাপের নয়। তবুও সে মনে মনে খুব খুশি হয়েছে। প্রিয় মানুষ থেকে পাওয়া সকল জিনিস দুনিয়ার সবচেয়ে মূল্যবান বলেই মনে হয়। আলতারও তেমন মনে হলো শাড়িটাকে অনেকটা সময় এলোমেলোভাবে গায়ে পেঁচিয়ে বসে রইল। মনের ভেতর ভালোলাগার শুয়োপোকারা কুট কুট করে কেটে যাচ্ছিলো তাকে। সেই কামড় সুখের শিরশিরানি দিচ্ছিলো হৃদয় জুড়ে। আলতা নিজেই একদিন কলেজের সেই বান্ধবী নাহারকে নিয়ে নিউমার্কেটে গেল। শিশির জানতে পারেনি সে কথা। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বের হওয়া সেই ছিল আলতার প্রথমবার। সে নাহারের সাহায্যে ব্লাউজ কিনলো, শাড়ির সাথে মিলিয়ে চুড়িও কিনেছিলো কয়েক মুঠো। নাহার তাকে আনন্দ, উৎসাহ নিয়ে চুড়ি আর ব্লাউজ কেনা দেখা প্রশ্ন করে বসলো, “তোমার কি কোন প্রেমিক আছে আলতা?”
“নাতো!”
“মিথ্যে বলছো কেন? এসব তুমি প্রেমিকের জন্যই কিনছো নিশ্চয়ই তার কাছে যাবে।”
নাহারের কথাগুলো খুব বেশিই ঠোঁটকাটা বলে মনে হলেও মন বলল কথা মিথ্যে নয়। শিশির ভাই কি তার প্রেমিক নয়! নাকি তাদের ভেতর কাজিন সম্পর্কের বাইরে ভিন্ন কিছু নেই! যদি নাইবা থাকবে তবে এত পরিবর্তন কেন? ছোট্ট আলতার সাথে যেমনটা আচরণ ছিল এখন আর তেমনটা তো নেই। কিশোরী আলতার সাথে যুবক শিশির ভাইয়ের আচরণে শুধু কাজিন রূপ অধিকার নয় এখন সে প্রেমিকগত অধিকারও ফলায়। রাত বিরাতে কতশত শাষণের নামে কত কি যে বোঝায় আজকাল মানুষটা। পড়াশোনার কথা বলতে বলতেই নিজের মনের চাওয়া পাওয়ার কথাও কি না বলেছে! বলে তো আজকাল কত কথা। এইতো সেদিন চুল কাটিয়ে সোজা এলো আলতার হোস্টেলের সামনে। সোজাসুজি কথা বলা শিশির ভাই সেদিন ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে জানতে চাইলো তাকে চুল কাটায় কেমন লাগছে! এবার নাকি একটু ভিন্ন কাট-এ তাকে আজব লাগছে তাই জানতে চায় আলতার কেমন লাগে? শার্ট কিনতেও এখন আলতাকে পাশে চাই তার। সেদিন একটা ঘড়ি কিনবে বলে আলতাকে নিয়ে গেল। ঘড়ির কিছু বুঝতে না পারা আলতাকে জিজ্ঞেস করলো, “কোনটা বেশি মানায় বলতো!”
আলতা জানে না তার ভাবনা ঠিক কি না তবে শিশির ভাই তার ওপর যেভাবে অধিকার খাটায় তা আর এখন শুধু কাজিন বলেই মনে হয় না৷ তার মন বলে বদলে গেছে তাদের সম্পর্ক, মন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে খুব শিগগিরই শিশির ভাই তাকে বলবে মনের কথাগুলো। নাহারের কথার প্রেক্ষিতে সে এবার নিজের দ্বিধা বলে ফেলল। জানিয়ে দিলো শিশির ভাইয়ের সাথে তার সম্পর্ক কেমন সেই সাথে বলল এখনো সরাসরি কিছুই বলেনি তাকে। নাহার সব শুনে হাসলো মলিন মুখে। বুঝে নিলো তার ভাই আর আগাতে পারবে না এই মেয়েটির দিকে। আলতা অপেক্ষার প্রহর গুণছে কবে শিশির ভাই বলবে তাকে এই শাড়িটা তার পরে আসতে! আর তো মাত্র মাসখানেক সময় এরপর তো চলে যাবে সে৷ এত দেরি কেন করছে বলে দিতে কথাটা? আলতা যখন শিশিরের ভাবনায় বিভোর তখন তার ফোনটা বাজল সশব্দে। ফোনের স্ক্রীণে চোখ পড়তেই মুখে ফুটে উঠলো এক চিলতে উজ্জ্বল হাসি। মা ফোন করেছে তাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে ফোন তুলল। অনেকটা সময় নিয়ে মা মেয়ে কথা বলল। আলতার তো এখন আরও একটা জিনিসের অপেক্ষা। নকশির এখন নয় মাস চলছে৷ শরীরের অবস্থাও বেশ ভার তবে কিছু জটিলতা দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে আবার ভয়ও হচ্ছে খুব তবুও জহির কাকা সেদিন ফোন করে অভয় দিলেন দ্রুতই সিজারিয়ান অপারেশন করিয়ে নিবে। কিন্তু আফসোস সে তার মাকে ফোলা শরীরে কাছ থেকে দেখতে চেয়েছিল, ধরতে চেয়েছিল কিন্তু কিছুই তার পূরণ হলো না। এই পাথুরে শহরে এসে পড়াশোনায় অন্য এক জগত তৈরি হয়ে গেছে। এখন চাইলেই মায়ের কোলে মাথা পেতে দেওয়ার সুযোগ নেই। শিশির ভাই আজ দু দিন হয় বাড়ি চলে গেছে। আলতার এই শেষ সময়ের পরীক্ষাগুলো না থাকলেও সেও চলে যেত কিছুদিনের জন্য কিন্তু এখন তা সম্ভব নয়৷ সেই যে শীত গেল গ্রামে তারপরের কতগুলো মাস পেরুলো মাকে কাছ থেকে দেখেনা। মায়ের শরীরের যা অবস্থা তাতে মা’ও আসতে পারেনি এতদূর। দেখার মধ্যে আব্বা আসে প্রতি মাসে একবার করে আর শিশির ভাইয়ের দরকারে মামা এসেছিল একদিন৷ মাঝেমধ্যে মনে হয় গ্রামে থাকলেই বুঝি ভালো হত! আবার মনে পড়ে সে গ্রামেই থেকে গেলে হয় জহির কাকার বাড়ি অথবা তার সৎমায়ের সংসারে থাকতে হত। কিন্তু এখন অন্যের ঘরে না থেকেও তার বাবা মা দুজনকেই তার নিজের মনে হচ্ছে । শিশির ভাই তাকে শহরে পড়ার জন্য এমনি এমনি উস্কায়নি আজ তা আলতা ভালো করে বুঝতে পারে।
“আর কতদিন এসব চলবে সোহা?”
সোহার ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কথাটা বলল তার মা। কবে থেকে ভালো ভালো বিয়ের প্রস্তাবগুলো ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে শুধু মেয়েটা রাজী হয়না বলে৷ আজও সোহার ফুপু এক পাত্রপক্ষ পাঠাচ্ছেন ঢাকার স্থানীয় পরিবারের। ছেলে ব্যবসায়ী, বংশ ভালো, ছেলে শিক্ষিত। সোহারা ঢাকায় জন্ম নিলেও তাদের আদি ভিটা ময়মনসিংহের এক গ্রামে। বাবা মা চাইছে মেয়েটাকে শহরেই স্থানীয় কোন পরিবারে স্যাটেল করতে যেন সে তার জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা আবহাওয়াতেই জনম কাটাতে পারে৷ কিন্তু হায়, মেয়ের যে কি হলো আজ বছর দুই হবে বিয়েশাদীর নামই নিচ্ছে না। অনার্সও শেষ হতে বেশিদিন নেই এদিকে তার দুই বেস্টফ্রেন্ড উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছে। মেয়ে তো তেমন কিছুতেও নেই তবুও কেন ঘর সংসার করতে চায় না বুঝে পাননা তিনি। তবে মাস খানেক আগে নিজের বোনের মুখে মেয়ের প্রেম সম্পর্কে কিছু শুনেছিলেন। সোহা জিজ্ঞেসও করেছিলেন কিন্তু মেয়ের পক্ষ থেকে সদুত্তর না পেয়ে তিনি পাত্র দেখায় মন দিয়েছেন। আত্মীয়স্বজনও খুঁজে খুঁজে ভালো ভালো পাত্রের সন্ধান দিয়ে চলছে। অথচ মেয়েটার কি হলো কে জানে! সোহার মা ব্যতিব্যস্ত হয়ে আরো কিছুক্ষণ ডেকে চলে গেলেন। পাত্রপক্ষ আসবে সন্ধ্যায় এখন বাজে বেলা তিনটে। তিনি কিছু বুঝে উঠতে না পেরে অনুকে ফোন দিলেন আসার জন্য৷ অনু আজ শেষবারের মত তাওহীদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল৷ যে করেই হোক আজই নাম কা ওয়াস্তে হওয়া এনগেজমেন্ট এর ব্যপারটার সমাপ্তি টানতে। কিন্তু সোহার আম্মু কল দিয়ে সমস্যা বলতেই সে উঠে গেল তাওহীদের সামনে থেকে।
“তোমার সাথে অন্য একদিন ফাইনাল কথা বলব এবং তোমার আংটিটাও নিয়ে আসব। ” কথাটা বলেই সে তাওহীদের সামনে থেকে চলে গেল আর পেছনে ফেলে গেল ব্যথাতুর দৃষ্টির মানুষটাকে। একটা মানুষ কাউকে ভালবেসে তার অবহেলা কতদিন সহ্য করতে পারে! তাওহীদ জানে না সে কথা শুধু বুঝতে পারছে তাকে আরও অবহেলা সহ্য করে যেতে হবে। চাইলেই সে জোর খাটাতে পারে এই মেয়েটার ওপর কিন্তু তার মনটা সায় দেয় না বলেই সহ্য করছে।
দিনের তৃতীয় প্রহর চলছে। শিশির একটু ঘুমাবে ঘুমাবে করেও ঘুম এলো না চোখে৷ আজ কতগুলো দিন হয়ে গেছে বাড়ি এসেছে। হলের সিট সে এখনো ছাড়েনি এখান থেকে আবারও যাবে সেখানে। শেষ মুহূর্তে হল থেকেই এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বের হবে বলে সেটাই সুবিধা। এমনিতেও আরও কিছু কাজ আছে ঢাকায় আর তাতে সবচেয়ে বড় কাজ আলতার ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে যেন কোন সমস্যা না হয় সেদিকটার একটা ব্যবস্থা করে যাওয়া। শিশির চায় আলতা যে করেই হোক ঢাবিতে চান্স পাক তবে সেটা না হলেও যেন ভালো কোথাও পায়। পরিচিত এবং খুব কাছের বন্ধু, বান্ধবীদের সাথে আলতাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে যাবে যেন প্রয়োজনে তাদের সহযোগিতা নিতে পারে। শিশির নিজের ঘরে শুয়ে এসবই ভাবছিলো তখনি কানে এলো অপুর কণ্ঠ৷ শিশির ভাবছিল তার বন্ধু নিশ্চয়ই তাকেই ডাকতে এসেছে কিন্তু খেয়াল করে শুনলো, “কাকী নকশি ফুপু অসুস্থ হয়ে পড়ছে৷ নকশির ফুপু ননদে আপনাদের ডাকতেছে।”
শিফা কথাটা শুনে চিন্তিত হলো৷ বাড়িতে বড় ভাবী নেই তিনি শরতকে সাথে নিয়ে শিউলির শ্বশুর বাড়ি গেছে। নকশির ননদ বলতে তো জহির ভাইয়ের চাচাতো বোনদের কেউ একজন হবে তারমানে নকশির কাছে মুরিব্বি গোছের কেউ নেই। শিফা একটু ঘাবড়ে গেল তৎক্ষনাৎ কিন্তু শিশির ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। সে জিজ্ঞেস করলো কি সমস্যা শিফা তা বলতেই শিশির বলল, “আম্মা তুমি বোরকা পরে আসো আমি আগে গিয়া গাড়ির ব্যবস্থা করি।”
জহির বাড়ি নেই সে নিজ কাজে শহরে গেছে। বাড়িতে রেখে গেছে তার বিধবা চাচাতো বোন জাহানারাকে। সে নকশিরই বয়সী কিন্তু তার একার পক্ষে সম্ভব নয় নকশিকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার। নকশি যখন আচমকা পেটে ব্যথা বলে ছটফট করছিল তা দেখে জাহানারা ভয়ে তার মা মানে জহিরের চাচীকে ডাকলো। বৃদ্ধা নকশির অবস্থা যাচাই করে বললেন, “অর তো সময় অইয়া গেছে দাঈ ডাকতে হইবো।”
নকশির গর্ভাবস্থায় কিছুটা জটিলতা আছে সে কথা জাহানারা শুনেছিলো জহির ভাইয়ের মুখে তাই সে তার মাকে থামিয়ে জহিরকে ফোন দিলো। জহির যথেষ্ট দূরে আছে বলে সে বলল, “আহসানদের বাড়িতে খবর দে। শিশির, শরত কাউকে বল হাসপাতালে নিয়ে যেতে তুই বা নকশির ভাবীদের কাউকে বল তারাই যাবে আমি সোজা হাসপাতালে আসি।”
জাহানারা কথাগুলো শুনে নিজেই বের হচ্ছিলো মাস্টার বাড়িতে যাওয়ার জন্য। বাড়ির গেইটে অপুকে দেখে বলল ও বাড়ি একটা খবর দে। ছেলেটাও দেরি না করে এসে খবরটা জানালো। শিশির বাড়ি থেকে কিছুটা এগোতেই পরিচিত একজনের অটো দেখতে পেলো। শিফাও একদম প্রস্তুত হয়ে নকশির কাছে গিয়ে দেখলো শিশির অটো নিয়ে হাজির। তারা আর কাল বিলম্ব না করে নকশিকে নিয়ে ছুটলো সদর হাসপাতালে। তারপর কাটলো আরও ঘন্টা তিনেক এর মধ্যে এক ব্যাগ রক্ত লাগলে শিশিরের বন্ধু অপুর সাথে গ্রুপ মিলে যাওয়ায় সেই দিলো। জহির তখনও এসে পৌঁছায়নি হাসপাতালে। নকশির যা অবস্থা তাতে সিজারের বিকল্প ছিলো না। কিন্তু তার আগে যে বন্ড সাইন করতে হবে সেটা নিয়ে কিছুটা সমস্যা দেখা দিলো। লিগ্যাল অভিভাবক ছাড়া সই কে করবে! ডাক্তার যখন মানতে নারাজ তখন বাধ্য হয়ে জহিরের সাথে ফোনে কথা বলে শিশিরকেই দেওয়া হলো অভিভাবকের নাম৷ শিশির কাগজটাতে সই করতেই শুরু হলো অপারেশন। এর মধ্যে শরত আর জয়তুনও বাড়ি ফিরে ঘটনা জানতে পেরে তারাও চলে এলো হাসপাতালে। আরো দীর্ঘ সময় কাটলো সবার চিন্তিত মনে। অপারেশন থিয়েটার থেকে একসময় বের হলো ডাক্তার, নার্সরা। সবার কৌতূহলী দৃষ্টি দেখে ডক্টর মুচকি হেসে শিশিরকে বলল, “পেশেন্ট আপনার কি হয়?”
“ফুপুআম্মা।”
” ভাই হয়েছে আপনার।মিষ্টি নিয়ে আসেন বড় ভাই।” কথাটা হাসতে হাসতে মজা করে বলল ডাক্তার। শিফা, জয়তুন, শরত উপস্থিত সবার মুখেই আনন্দের হাসি৷ সকলেই আলহামদুলিল্লাহ বলে জহিরকে ফোন করতে বলল। শরত জহির কাকাকে সুসংবাদ জানাচ্ছে এদিকে শিশির একটু সরে গিয়ে আলতাকে ফোন দিচ্ছিলো৷ হুট করে তার পেছন থেকে অপু এসে কাঁধে হাত রেখে ফিসফিস করে বলল, “মিষ্টি খাওয়ান শালার বোনজামাই৷ শালা হইছে আপনার সেই খুশিতে জলদি করে মিষ্টি নিয়ে আসেন দুলাভাই।”
বন্ধুর মশকরা শুনে শিশির শব্দ করে হেসে উঠলো। একটু দূর থেকে সকলে তার হাসি দেখে বিষ্ময়ে তাকাতেই হাসি বন্ধ করে মুখটাকে স্বাভাবিক করে নিলো ঝটপট। ওপাশে আলতা কলটা আগেই রিসিভ করে হ্যালো হ্যালো করছে।
চলবে#শিশিরে_ভেজা_আলতা
(২য় খন্ড)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
২৭.
“দুলাভাইয়ের কাছে মিষ্টি চাচ্ছে অপু।” ফোনটা কানে রেখে ফিসফিস স্বরে বলল শিশির।
“কি?” আলতা বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করলো শিশিরকে। শিশির মিটিমিটি হাসতে হাসতে ফোন কানে ধরেই হাসপাতাল থেকে বের হলো। আলতার সাথে কি মজাটা ঠিকঠাক করেই ফেলবে! উহুম থাক আজ নয় যাওয়ার আগেই তাকে প্রপোজ করে তবেই এমন মজা করবে। সে কথা ঘুরিয়ে বলল, ” ভাই হয়েছে তোর সেজন্য ফোন করলাম। মিষ্টি খাওয়াবি না!”
“সত্যি! সত্যি শিশির ভাই আমার ভাই হয়েছে? আম্মা কই আমি দেখব তাদের।” আনন্দে, উচ্ছ্বাসে চেঁচিয়ে উঠলো আলতা। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের শুরু এ সময়টা আলতা বইয়ে মুখ গুঁজে অপেক্ষা করে শিশিরের ফোনকল আর মেসেজের। আজও সেই অপেক্ষা নিয়ে পড়তে বসেছিল। কিন্তু আজকের কলটা তাকে অন্যান্য দিনের চেয়েও দ্বিগুণ আনন্দিত করল যেন। শিশিরের এখন মনে হচ্ছে এই কথাটা যদি ভিডিও কলে বলত তাহলে নিশ্চয়ই এই মুহুর্তে সে তার চঞ্চলপাখির উচ্ছ্বাসটুকু স্বচক্ষে দেখে অন্তর জুড়িয়ে নিতে পারত। ইশ, কেন আগে এই কথাটা মাথায় এলো না এখন আফসোস হচ্ছে। আলতার সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা বলে শিশির ফোন করে অনু আর সোহাকেও জানালো কথাটা। বাচ্চার ছবি তুলে একে একে আলতা, সোহা আর অনুকেও দিল। গ্রুপ কলে মজা করে সোহাও বলে ফেলল হবু শালার মিষ্টি খাওয়াতে৷ কথাটা শুনতেই অনু ফট করে কল থেকে বেরিয়ে গেল। শিশির ভাবল হয়ত নেটওয়ার্ক প্রবলেম কিন্তু সোহা বুঝলো এখন এভাবে কথাটা বলা উচিত হয়নি। নকশির শারিরীক অবস্থা মোটামুটি ভালো দেখে শিফা, শিশির বাড়ি ফিরে গেল। নকশির সাথে রাতে জাহানারা আর জয়তুন থেকে গেলে জহিরকেও রাতে বাড়ি পাঠিয়ে দিল তারা। ছেলে হয়েছে, প্রথম সন্তান হয়েছে জহিরের এ কথা ভাবতেই বুকের ভেতর কেমন টালমাটাল এক অনুভতিতে ভেসে যাচ্ছে সে। বয়স কত হলো তার! চল্লিশ তো কবেই পেরিয়ে গেছে তার বন্ধুরা মেয়ে বিয়ে দিয়ে ফেলেছে যাদের ছেলে আছে তারা ছেলে বিয়ে করাবে করাবে ভাবছে। এইযে বন্ধু আহসানুল্লাহর ছেলেই তো কত বড় হয়ে গেল শহরে পড়াশোনা করছে ক’দিন বাদে বিদেশ চলে যাবে। গ্রামের অশিক্ষিত পরিবারের হলে এতদিনে হয়ত শিশিরও বিয়ে করে নিতো তার নিজেরই সন্তান থাকত আর এতদিনে কিনা জহির সন্তানের বাপ হলো! বন্ধুরা নাতিপুতি কোলে নিয়ে ঘুরবে আর সে এতদিনে বাবা হয়ে ছেলে নিয়ে ঘুরবে ভাবতেই হাসি পাচ্ছে চোখে জল চলে আসছে৷ তবুও খোদার দ্বারে মোনাজাত তুলে সে শুকরিয়া আদায় করল তার একজন বংশধর, তার নিজের একটা সন্তান তো হলো! বছর খানেক আগেও কি ভেবেছিল তার জীবনে তার নাম জিইয়ে রাখার মত কেউ থাকবে! খোদার শুকরিয়ার পর সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চাইলো তার স্ত্রীর। একমাত্র নকশির জন্যই তো সে অপেক্ষা করেছে টানা পনেরো বছর নকশি যদি এখনো রাজি না হতো তবে এই সুখ সে কোথায় পেত! নকশির পরই তার মন থেকে দোয়া আসে আলতার জন্য। জহির জানে, সে বোঝে আলতা নিজের মাঝে কতখানি কষ্ট চাপা দিয়ে তার মাকে জহিরের করে দিয়েছে। আলতা না চাইলে কোনদিনও সে নকশিকে পেতো না নিজের করে। আলতাই চেয়েছিল তার মায়ের জীবনটা গুছিয়ে দিতে এতে যে সে নিজেই কত কষ্টকে বুকে লালন করছে তা এখনকার আলতাকে দেখলেই বোঝা যায়। চঞ্চল হরিণীর মত ছুটে বেড়ানো বাচ্চা মেয়েটা এমনি এমনিই নিরিহ শাবক হয়ে যায়নি৷ মা ছাড়া যার দুনিয়ায় কেউ ছিল না সে এখন মায়ের কাছ থেকে কতদূরে চলে গেছে ভেবেই জহিরের মন গলে গেল। আবেগরা তরল হয়ে উঠলো চোখের ভেতর তবে সেই তরল জল গড়িয়ে পড়ার আগেই সে আলতাকে ফোন দিল। ফোন বাজল বার কয়েক কিন্তু ওপাশ থেকে রিসিভ না হওয়ায় একটু চিন্তিত হলো জহির। ফোনটা রেখে ঘুরে ঘুরে নিজের পুরো ঘরটা দেখলো৷ ঘরে এখন কিছু জিনিস কিনতে হবে তার সন্তানের জন্য আর সেগুলো কি কি আর কোথায় রাখবে সব ভেবে নিচ্ছে একমনে৷ তারপরই মনে হলো কাল সকালে মিষ্টি কিনতে হবে কিন্তু কত কেজি কিনবে কাকে কাকে পাঠাবে! পুরো পাড়ায় মিষ্টি বিলানোর জন্য কত কেজি লাগবে সেগুলোও ভাবতে বাদ নেই তার। এমনই বুঝি হয় প্রত্যেকটা পুরুষের জীবনে! প্রথম সন্তান, ঘরের প্রথম অংশীদারের জন্ম বড় আনন্দের হয়। জহিরের সকল আনন্দের মাঝেই একরাশ দুঃখ এসে জড়ো হলো মনের খাঁচায়। বড় সাধ ছিল তার মায়ের তার একটা সংসার দেখার, নিজের একজন উত্তরসুরী দেখার। ছেলে তার মায়ের ইচ্ছে, তার শখগুলো পূরণ তো করেছে কিন্তু সেসব দেখার জন্য আর তার মা বেঁচে নেই। আজ যেন সকল আনন্দ, সকল দুঃখ একসাথেই এসে মনের ভেতর হানা দিতে লাগল জহিরের। কথায় আছে পুরুষ মানুষদের কাঁদতে নেই৷ জহির সে কথা আজ ভুলে গিয়ে নিজের ঘরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। বুকের ভেতরকার সকল ভার বাষ্প হয়ে মিলিয়ে গেল তার গালজুড়ে। কান্নার দমক তার যখন একটু কমে এলো ঠিক তখনি ফোনটা বাজল৷ কান্না থামিয়ে চোখ মুছে গলার স্বর যথাসম্ভব স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল সে।
আলতা সালাম দিতে দিতেই জহির প্রশ্ন করলো,
“কিরে মা তখন ফোন তুললি না যে?”
“আমি ফোন সাইলেন্ট করে খাইতে গেছিলাম কাকা। কেমন আছেন আপনি?”
“আমি ভালো আছি। তুই কেমন আছিস? তোরে কি কেউ ফোন দিয়ে বলছিলো তোর ভাই হইছে?”
“আলহামদুলিল্লাহ কাকা আমিও ভালো। হ্যাঁ শিশির ভাই সন্ধ্যায়ই ফোন দিছে।”
” তুই আসবি না তোর ভাইরে দেখতে? আমি আসব তোরে নিতে নাকি শরতকে পাঠাইয়া দিব?”
“কাকা আমার তো ক্লাস পরীক্ষা চলতেছে। আর তো কয়েকটা মাস বোর্ড পরীক্ষার তাই এখন কলেজে না গেলে জরিমানা হবে। আমি ভিডিও কলে দেখব তাদের।”
আলতা কথাটা বলতে বলতে খেয়াল করল জহির কাকার কণ্ঠস্বর ঠিকঠাক নেই৷ এদিকে জহির ভেবে নিল আলতার বুঝি মন ভালো নেই৷ সে সত্যিই তার মাকে বিয়ে দিয়ে বড় কষ্টে আছে৷ আর এ কারণেই জহিরের বুক ভার হয়ে উঠলো আবার। তার মনে হলো আলতাকে বলা উচিত, “আমি তোর থেকে তোর মাকে ছিনিয়ে নেইনি। নকশি তোর মা তোর আজীবন কাছের মানুষ । তুই চলে আয় এখানে আমি অযত্ন করব না কোনদিন তোর। মাথায় আগলে রাখব তোকে আমার প্রথম সন্তান হিসেবে।” কিন্তু না এসব কথা সে মুখে আনতে পারল না৷ কেন জানি মনে হলো তার দেওয়া সান্ত্বনা আলতা মেকি মনে করবে। আলতার নিজের বাবা আছে সে জহিরের বাবাসুলভ আচরণ সবসময়ই নকল ভাববে৷ তবে ফোন রাখার আগে আরও একবার বলল, “তোর সুযোগ হলেই জানাবি আমি তোকে আনার ব্যবস্থা করব৷ তোর আম্মা তোর জন্য মন খারাপ করে থাকবে। জানিসই তো কত ভালোবাসে তোর আম্মা তোরে।”
“জহির কাকা! ভাই হয়েছে আপনি খুশি হননি?”
জহির এভার ভীষণ অবাক হলো আলতার কথায়। তার মনে হচ্ছিলো আলতা খুশি হয়নি এদিকে আলতা ভাবছে জহির কাকা খুশি হয়নি!
“আমি অনেক খুশি হইছি তো। তোর আম্মার কাছে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব রে তোর মত একটা মেয়ে দিলো, এখন একটা ছেলে দিলো। আমার সংসারটা পূর্ণ হয়ে গেছে রে মা শুধু তোর মায়ের কারণেই তো।”
“আমিও অনেক খুশি কাকা। আমি সুযোগ হলেই বাড়ি আসব আমার ভাইকে দেখতে।”
আলতার কথায় এবার বুকের ভার কমে এলো জহিরের৷ ফোন রেখে সে আবারও ভাবতে লাগল তার ঘর আবার নতুন করে সাজাবে। শুধু ছেলে নয় মেয়ের জন্যও একটা ঘর সাজাবে৷ নকশির মেয়ে তারও মেয়ে৷ আলতা এখন থেকে গ্রামে আসবে এ বাড়িতে থাকবে৷ আহসান মামার বাড়ি সে শুধু বেড়াতে যাবে। নিজের নতুন সংসার এবার আরও সুন্দর করে সাজিয়ে তুলবে জহির নকশিকে নিয়ে৷ সারারাত সত্যিই আর ঘুম হয়নি জহিরের। সকাল হতেই সে তৈরি হয়ে হাসপাতাল গেল নাশতা কিনে৷ জয়তুন আর জাহানারা দুজনেই নাশতা খেয়ে একটু বের হলো ছোট্ট কেবিনটা থেকে। জহির কেবিনেই বসে রইলো নকশির বিছানায়। কোলে তার ছেলেকে নিয়ে অপলক চেয়ে আছে। বারংবার বলছে, “বাবু তো দেখি একদম তোমার মত হয়েছে নকশি শুধু গায়ের রঙটা পাইছে তার বোনের।”
নকশি চুপচাপ জহিরের কথা শুনে যাচ্ছে আর নিরবে দেখছে জহিরকে। এই মানুষটা তার আজীবনের সঙ্গী হয়েছে। জীবনের অর্ধেকটা পেরিয়ে এতদিনে এসে তার আসল রঙ খুঁজে পেল। এ বয়সে এসে তারা দুজন এক সুতোয় জুড়ে গিয়ে নতুন এক অস্তিত্বকে জন্ম দিলো। মেয়েটা কত বড় হয়ে গেছে এইতো কদিন পর কলেজের গন্ডি পার করবে। আর এখন কিনা সে এইটুকুনি একটা বাচ্চা পালবে! আর কয়টা বছর তারপরই তো মেয়ের বিয়ে দিবে বাড়িতে জামাই আসবে তখন তার বাবুটা কতটুকু হবে! ভাবতেই এখন লজ্জায় মুখ লুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে আবার অন্যরকম অপার্থিব এক সুখও অনুভূত হচ্ছে। জীবনের কত ধারা সে পরখ করে নিচ্ছে একসাথেই। জীবন সুন্দর যদি পাশে থাকার মানুষগুলোর মন সুন্দর হয়। নকশি অনেক ভেবে দেখেছে তার পাশে যখন অসুন্দর মনের আলেয়া ছিল আওলাদের ভাবীর মত মানুষ ছিল তখন নকশির জীবন হয়েছিল বিষাক্ত। তারপর সবুজের সহযোগিতায় সে গ্রাম ছেড়ে আহসানের ভাইয়ের বাড়ি আসতেই তার জীবন হয়ে উঠলো রঙিন ফুলের মত। তাতে কাঁটা বিছিয়ে গেল একটা সময় সুবাস আর রঙে চারপাশ তার ছেয়ে গেল। এখন শুধু বিষমুক্ত বনানীতে তার বসবাস। জহিরের দিকে তাকিয়েই সে ভাবতে লাগলো তার গোটা জীবনটাকে নিয়ে৷
সময়ের নিপুণ ধারাবাহিকতায় শিশিরের জীবনের মাতৃভূমির অধ্যায় শেষ হয়ে এলো। ব্যাগপত্র, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সবকিছুই তার গোছানো হয়ে গেছে। টিকিট, ফ্লাইট টাইম এমনকি লন্ডনের মাটিতে তার অবস্থানের সময়টাও ঘড়ির কাটা মেপে ঠিক হয়ে আছে। এখন শুধু হাতে আছে একটা দিন বাকি প্লেনে চড়ার। গ্রাম থেকে সবাইকে একসাথেই বিদায় দিয়ে এসেছে আজ দিন দুই হলো। শিফার কান্নাকাটি থেমে নেই সেই থেকে তবে আহসানুল্লাহ নিজেকে শক্ত রাখতে পারছেন। জয়তুনও থেকে থেকে বকে চলছে আহসানকে৷ তার এক কথা বহুত পড়ছে পোলায় আর কি পড়ব এবার মা’র বুকে ফিরা আসুক। বিদেশ যাওনের কোন দরকার নেই।”
শরতও মাকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে ক্লান্ত, “পড়াশোনা ছাড়ার জিনিস নয়৷ যত পড়বে তত জানবে তত জীবনটাকে সুন্দর করতে পারবে।” কিন্তু সে কথায় কে কান দেয়! শিশিরের ফ্লাইট পড়েছে শনিবার সকাল এগারোটায়। ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত ব্যাপারের জন্য সে দশটার আগেই এয়ারপোর্টে থাকবে বলে জানিয়েছে অনুকে। অনু আর তার ফ্লাইট একসাথে হলেও লন্ডনে পৌছে তাদের যেতে হবে ভিন্ন দু জায়গায়। অনু উঠবে তার বাবার এক পরিচিতার বাড়িতে আর শিশির যাবে তার প্রফেসরের দেওয়া ঠিকানায়। হাতে সময় শুধু আর দেড় দিন আছে শিশিরের তাই সে সোহা আর অনুকে গ্রুপ কল করলো। রাতের তখন সময় আটটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট। প্রথমে কল সোহাই ধরলো৷ সে জানতে চাইলো কি হয়েছে শিশির বলল আগে অনু আসুক একসাথে বলব দুজনকে৷ মিনিট কয়েক অপেক্ষার পরই যখন অনু জয়েন করলো শিশির তখন বলল, “আমি কাল একটা কাজ করতে চাই তোরা কি আমাকে একটু হেল্প করবি?”
কথাটা বলার সময় শিশিরের কণ্ঠ যেন কিছুটা লজ্জিত ছিল। অনু তো ভারী অবাক হয়ে বলল, “ব্লাশ করছিস নাকি! তোর কণ্ঠ এমন কেন শোনাচ্ছে?”
“ব্লাশ করব কেন আমি কি মেয়ে? ওসব ন্যাকামি মেয়েরা করে আচ্ছা আমার কথা শোন তোরা কি কাল একটু দেখা করতে পারবি বিকেলে?”
“ব্যাপার কি শিশির খুলে বলো।” সোহা বলল কথাটা।
” আমি কাল আলতাকে প্রপোজ করতে চাই৷ যাওয়ার আগেই তাকে নিজের নামের একটা সিলমোহর তো লাগাতেই হবে তাইনা!”
“তার মানে তোমার বাড়িতে সবাই জানে তুমি যে আয়শাকে ভালোবাসো!” অবাক কণ্ঠে জানতে চাইলো সোহা। শিশির এবার হাসতে হাসতে বলল, “আরেহ নাহ। ভাইয়ের আগে আমি কি করে নিজের বিয়েটিয়ে নিয়ে কথা তুলব বলো! আমি শুধু আলতার কাছে নিজের মনটাকে আমানত রেখে যাব। বড় ভয় হয় আমি দূরে চলে গেলে যদি আমার ওই চঞ্চল পাখিটা আমাকে দূরই করে দেয়! মরেই যাব আমি আমার ওই ছোট্ট পাখিটাকে হারিয়ে ফেললে। আমার নিঃশ্বাসটাই যে থেমে যাবে সোহা। যদি সত্যি হয়, ‘কায়া দেখলে মায়া বাড়ে’ তবে আমি দূরে গেলে তার মায়া যদি কমে যায় আমার প্রতি? অনুভূতি লুকিয়ে রেখে পরে পস্তানোর চেয়ে আগেই জানিয়ে দেওয়া ভালো নয়কি! আমি জানি সে আমার ভেতরটা অনেক আগেই পড়ে নিয়েছে তবুও নিজেকে সান্ত্বনা দিতেই বলে যাব এবার সরাসরি। মাত্র তো দুটো বছর তারপর ফিরেই ফুপুআম্মাকে বলব, দিয়ে দিন শিশিরের আলতাকে। ততদিনে আমার পাখিটা আরও একটু বড় হবে, সমাজ, সংসার আর আমাকেও তখন পুরোপুরি বুঝতে পারবে। আর ভাইও তখন সংসারী থাকবে মানে বাড়িতে আর কেউ থাকবে না আমার বিয়ের সামনে।” শেষের কথাটা বলতে গিয়ে শব্দ করেই হাসলো শিশির। সোহা অবাক হয়ে সবটা শুনলো, খুশিও হলো আবার পরক্ষণেই মনে হলো তার কষ্ট লাগছে। অনু যে কষ্ট পাচ্ছে কথাগুলো শুনে তা মনে পড়তেই ফোনের স্ক্রীণে তাকালো। কই অনু নেই লাইনে। তারমানে শিশিরের কথা শুনেই সে কল থেকে বেরিয়ে গেছে। খারাপ লাগছে সোহার খুব কি করবে সে! ভালোভাসার মানুষকে আপন করতে না পারার যন্ত্রণা যে কি তাতো সোহা জেনেই গেছে আর অনুও জানে, জানবে। তাওহীদ ভাইও নিশ্চয়ই একই কষ্ট পাচ্ছে! সোহা নিজ ভাবনায় ডুবে চুপ হয়ে আছে। শিশির বিপরীতে কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে ডাকলো সোহাকে, এ্যাই সোহা চুপ করে গেলে কেন? বললে না তোমরা আসবে কিনা আর অনু তুই কিন্তু তোর ক্যামেরাটা আনবি। আমি সেই মুহূর্তটাকে বন্দী রাখতে চাই রে! যাওয়ার সময় স্মৃতি তো ওইটুকুই নিয়ে যাব। দুটো বছর পার করতে সেটা আমার জন্য খুব জরুরি।”
শিশির অনুকে ডেকে কত কথা বলে দিল অথচ সে খেয়ালই করলো না অনু কলে এখনও আছে কিনা! সোহা ডাকলো, “শিশির!”
“হু”
“অনু নেই অনলাইনে। আমি ফটো তুলে দেব তোমার আর আলতার। তা কোথায় প্রপোজ করবে বলে ঠিক করলে?”
“আমার প্রিয় জায়গায়।”
সোহা প্রথমে কপাল কুঁচকে ভাবতে গিয়েই উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, “ক্যাম্পাসে! সত্যি!”
সোৎসাহে চেঁচিয়ে উঠলো সোহা যেন তার বিশ্বাসই হচ্ছে না কথাটা। ক্যাম্পাস জুড়ে হাজারো মানুষের ভীড়ে এক প্রেমিক তার ভালোবাসার মানুষটিকে প্রপোজ করবে! বুকের ভেতর তিরতিরিয়ে এক আবেগের ঢেউ উঠলো সোহার হিংসাও হলো আলতার নসীবের ওপর।
রাতে সোহা অনুকে কল দিয়ে লাইনে পেলো না। বাধ্য হয়েই সে অনুর মায়ের নম্বরে কল দিলো। অনুর মা বাড়িতে ছিলেন না। রাত বিরাতেও তিনি বন্ধুবান্ধব নিয়ে কিটি পার্টিতে ব্যস্ত। সোহা মনে মনে কয়েক প্রস্থ গালি দিলো অনুর মাকে। যার মেয়ে সকাল হতেই ফ্লাইট ধরবে বিদেশে পাড়ি জমাতে সেই মা কি করে বাড়ির বাইরে পড়ে থাকে আগের রাতে! যেখানে মেয়ের যোগ্যতা নিয়ে আনন্দে আত্মহারা হবে, মেয়ের হাতে হাতে তার নতুন পথটার জন্য দু হাত ভরে দোয়া করবে সেখানে কিনা মহিলা জানেই না তার মেয়ে এখন কি করছে। সোহার মেজাজ খারাপ হলেও সে তা প্রকাশ না করে বলল, “আন্টি আমার ইমিডিয়েট একটু কথা বলা প্রয়োজন অনুর সাথে।কাইন্ডলি একটু বাড়ির কারো নম্বর দিতে পারবেন?”
যতোটা সম্ভব নিজেকে সংযত রেখে কথাটা বলল সোহা৷ অনুর মা বুঝলেন আর্জেন্ট কোন কাজ হবে হয়ত তাই বাড়ির টেলিফোন নম্বরটা দিলেন সোহাকে যদিও আশিভাগ সম্ভাবনা এ ফোনটা কেউ তুলবে না। সোহা কল সেই নম্বরে কল দিলো আবার। পরপর অনেকবার বাজতে অনু নিজেই তুলল কলটা।
“হ্যালো”
“ফোন ধরছিস না কেন?”
“চার্জ নেই।”
“মিথ্যা বলছিস কেন অনু? দ্যাখ এখনো সময় আছে তুই তোর মনের কথা বলে দে শিশিরকে৷ বন্ধু সে আমাদের নিশ্চয়ই বুঝবে তোকে৷ তোর ভালোবা….”
“কি বালের কথা বলছিস সোহা। কি ভালোবাসা! আমার ওসব কোন ফিলিংস নাই তুই ভুল বুঝছিস।”
“আমার সাথে কেন মিথ্যে বলছিস বল তো! আজ তিন বছরেরও বেশি হয়েছে তুই শিশিরকে ভালোবাসিস। কেন লুকিয়ে গেলি বলতো এখন ওই আলতা!”
সোহাকে আবারও থামিয়ে দিলো অনু। সে এবার চেঁচিয়েই বলল, “আমি তারে তিন বছর ধরে ভালোবাসি আর ও আয়শাকে তার জন্মের পর থেকে ভালোবাসে। কিসের সাথে কি বাল মিলিয়ে কথা বলিস সোহা! তোর কি একটুও কমনসেন্স নেই বলতো! আর আমি তাওহীদের ফিয়ন্সি সেকথা ভুলে যাস কেন? তুই বল শিশিরের পরের প্ল্যান কি৷ আয়শাকে কিভাবে প্রপোজ করবে আমরা কি হেল্প করব?”
একদম অনড়, অটল, শক্ত কণ্ঠে একনাগাড়ে কথা বলছে। শরতের জীবনে কেউ আসবে ভাবলেই যেখানে সোহার কষ্টে মরে যেতে ইচ্ছে করে সেখানে অনু এত স্বাভাবিক কি করে! নিজের বিষ্ময়ে খেই হারানো সোহা অনুর ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলো। একে একে শিশিরের সাজানো পরিকল্পনার কথা জানিয়ে ফোন কাটল।
রাত বাড়ছে সেই সাথে কমছে শিশিরের দেশে থাকার সময়। মন উচাটন প্রিয় মানুগুলোকে ছেড়ে যাওয়ার যন্ত্রণায়। আবার যুক্ত হয়েছে আলতার জবাবের ভয়টাও। আলতা যদি কাল তার প্রস্তাবে সম্মতি না দেয়! যদি ফিরিয়ে দেয় তাকে ভরা মজলিশে শূণ্য করে! মন বড় অস্থিরতায় কাঁপিয়ে দিচ্ছে শিশিরের ভেতর বাহির সবটা। অথচ এসএসসি পরীক্ষা কিংবা ঢাবিতে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল নিয়েও সে এতোটা উতলা হয়নি৷ নিজের মনকে শান্ত করতে সে আজ পরপর তিন চারটে সিগারেট শেষ করেও শান্ত করতে পারলো না। অবশেষে মনে হলো তার সকল স্বস্তি তার আলতার মাঝেই লুকিয়ে আছে। হাত ঘড়িটাতে সময় দেখলো রাত বারোটা ছুঁই ছুঁই। আলতা এখনো ঘুমায়নি হয়ত তার তো রাত জেগে পড়ার অভ্যাস হয়ে গেছে। অস্থির মনটাকে শান্ত করতেই সে ডায়াল করলো আলতার নম্বরে। ফোন বাজার কয়েক সেকেন্ডেই সেটা রিসিভ হলো। আলতা কিছু বলার আগেই শিশির বলে উঠলো, মেসেজটা পেয়েছিস?
“হু”
“ওই শাড়িটাই পরে আসিস কাল। তুই ঠিক চারটা বাজেই ওই রেস্টুরেন্টে আসবি বুঝলি পরে আমি তোদের নিয়ে ক্যাম্পাসে যাব।”
“আমাদের!”
“ও হ্যাঁ তোকে বলা হয়নি, সোহা অনুও তো থাকবে।”
“ওহ!” একটু যেন নিভল আলতা অনু, সোহা থাকবে শুনে। মেসেজে তো বলেছিল একটা সারপ্রাইজ আছে কাল তুই রেস্টুরেন্টে আসবি। মেসেজেই রেস্টুরেন্টের লেকেশন দেওয়া ছিল। সেটা তার হোস্টেল থেকে কাছেই৷ তার ধারণা ছিল শেষ মুহূর্তে নিশ্চিয়ই শিশির ভাই তাকে ভালেবাসি কথাটা বলেই দিবে। কিন্তু তাদের ভালোবাসার মাঝে ওদেরও কেন থাকতে হবে! আলতা চুপ করে কথাটা ভাবছিলো ওপাশ থেকে শিশির বলল, চুপ করে গেলি কেন?
“এমনি!”
“ওহ আমি কিন্তু এখনো মিষ্টি পাইনি।”
এবার আলতা অবাক হলো ভীষণ৷ সে কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলো কিসের মিষ্টি। শিশিরের মুখে চওড়া হাসি ফুটলো এবার। সে শব্দ করে হাসতে হাসতেই বলল, “ভাই হয়েছে তোর মিষ্টি খাওয়াবি না?”
“ওহ, আচ্ছা খাওয়াবো।”
“কোন মিষ্টি খাওয়াবি?” বলতে বলতেই মিটমিটিয়ে হাসছে শিশির। আলতা ভেবে পেলো না মিষ্টি আবার কোন মিষ্টি! পরে মনে হলো ঢাকায় এসে সে অনেক পদের মিষ্টি খেয়েছে বোধহয় শিশির ভাই ভিন্নরকম কোন মিষ্টি খাবে। সে ভাবতে লাগলো তার কাছে এখন কত টাকা আছে! চারশ নাকি পাঁচশ আছে ঠিক মনে নেই গুণতে হবে। সে এবার বলল, “কোন মিষ্টি খাবে বলো সেটাই খাওয়াবো।”
“যে মিষ্টি বলবো তাই খাওয়াবি তো! পরে আবার না বলতে পারবি না কিন্তু।”
এবার আলতার একটু সন্দেহ হলো। সে ভয়ে ভয়ে বলল, “কি এমন মিষ্টি খাবে যার জন্য এত ভণিতা করছো শিশির ভাই?”
“অপেক্ষা কর কালই বলব এবং কালই আমি সেই মিষ্টি খাব। চলে যাওয়ার আগে একটিবার তা না খেলে যে আমি দূরে গিয়েও শান্তি পাব না।”
শিশির হাসছে, বলছে আর ভাবছে আলতার আগামীকালকের অবস্থা।
চলবে
(