মন দিতে চাই পর্ব -০৯

#মন_দিতে_চাই
#৯ম_পর্ব
#লেখনীতে_সুপ্রিয়া_চক্রবর্তী

বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম আমি। কোথায় যাব কি করব জানি না। শুধু এটুকু জানি আজ আমায় এই সিলেট শহর থেকে চলে যেতে হবে। মামির শর্ত মেনে আমি চলে এসেছি। তাই এখন আর ফেরা সম্ভব না। স্নিগ্ধা আপির বিয়েটা মনে হয় এতক্ষণে হয়ে গেছে। খুশি হোক স্নিগ্ধা আপি। তার খুশির জন্যই তো আমি এতকিছু ত্যাগ করলাম।

আমি উঠে পড়লাম ঢাকাগামী একটি বাসে। আসার সময় জমানো কিছু টাকা নিয়েছিলাম। সেই টাকাই সাথে নিয়ে এসেছি। আমার সামনের জীবন হয়তো অনেক কষ্টকর হবে। তবুও আমাকে ভয় করলে চলবে না। এখনো আমার অনেক কাজ আছে। আমি জানি আমি চাইলে এখনো বিদেশে যেতে পারব। বিদেশে গিয়ে মুক্তোর সাথে দেখা করব।

সারারাত বাসেই কে*টে গেল। অবশেষে ঢাকা নামক অচেনা শহরে পা রাখলাম। জীবনে যেখানে সিলেটের বাইরে কোথাও পা রাখিনি সেখানে আজ এতদূর ঢাকায় আসতে হলো।

শহরে নেমে আমি অবাক। কত ভিড় এই শহরে। আমার তো এখানে চেনা জানা কেউ নেই। তাহলে এখন আমি কোথায় যাব?

উদ্দ্যেশ্যহীন ভাবে রাস্তায় হাঁটতে লাগলাম। আমার খুব খিদে পেয়েছে। এটা অবশ্য স্বাভাবিক। কারণ কাল সন্ধ্যে থেকে কিছু খাই নি। আমি ব্যাগ থেকে টাকা বের করে গুনতে লাগলাম। এমন সময় একটা লোক এসে আমার হাত থেকে টাকা নিয়ে দৌড় দিল। হয়তো কোন চোর হবে। এই অচেনা শহরে এই টাকাগুলোই আমার শেষ সম্বল। তাই আমি দৌড় দিলাম লোকটার পেছনে। দৌড়াতে গিয়ে হঠাৎ একটি গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়ে দূরে ছিটকে পড়লাম। ব্যাস, তারপর আমার আর কিছু মনে নেই। ধীরে ধীরে চোখের সামনে অন্ধকার নেমে আসে।

❤️
ধীরে ধীরে চোখ খুললাম আমি। চোখ খুলতেই চোখের সামনে অনেক বেশি সুদর্শন একজন পুরুষকে দেখতে পেলাম। তিনি এগিয়ে এসে আমাকে বললেন, আপনি ঠিক আছেন তো? আমার গাড়ির সাথে আপনার এক্সিডেন্ট হয়েছিল। আজ টানা একমাস ধরে আপনার জ্ঞান ছিল না। অবশেষে আজ আপনি সুস্থ হলেন।

আমি মাথায় হাত দিয়ে ছিলাম। নিজের ব্যাপারে কিছুই মনে করতে পারছিলাম না। কে আমি? কি আমার পরিচয়? মনে করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম আমি।

সুদর্শন পুরুষ আমাকে বলল, কি হলো বলুন কিছু।

আমি কিছু জানিনা। কিছু মনে করতে পারছি না। আমার নিজের ব্যাপারে কিছু মনে পড়ছে না।

আমি দেখলাম সুদর্শন পুরুষ সহ কয়েকজন চিকিৎসক ও নার্স উৎসুক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

আমি মাথায় হাত দিয়ে আছি। কারণ নিজের ব্যাপারে কিছু মনে করতে না পেরে আমার মাথায় অতিরিক্ত চাপ পড়ছে। একজন চিকিৎসক বলল, আপনি জোর করে কিছু মনে করার চেষ্টা করবেন না। এতে আপনার মস্তিষ্কে চাপ লাগতে পারে। আপনি শান্ত হন।

চিকিৎসকের কথা শুনে আমি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। একজন নার্স এসে আমায় শুইয়ে দিল। একটি ইঞ্জেকশন পুশ করতেই আমি পুনরায় জ্ঞান হারালাম।

জ্ঞান ফেরার পর আবার নিজের চোখের সামনে সেই সুদর্শন পুরুষকে দেখতে পাই। আমাকে চোখ মেলে তাকাতে দেখে বললেন, ঠিক আছেন আপনি?

কি সুন্দর তার কন্ঠস্বর। মনে হয় মধু মেশানো। আমার কেন জানি মনে হতে থাকে এই কন্ঠস্বর আমি আগে কোথাও শুনেছি। আমার খুব চেনা এই গলার স্বর। আমি ভাবার চেষ্টা করলাম ভালো করে। কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ছে না।

আমাকে কিছু ভাবতে দেখে সুদর্শন পুরুষ বলল, ডাক্তার বলেছে আপনি যাতে কোন কিছু জোর করে মনে করার চেষ্টা না করেন। তাই আপনি এমনটা করবেন না। একদিন দেখবেন ঠিকই সবকিছু মনে করতে পারবেন। ততদিন আমি আপনার দায়িত্ব নেব।

আমি আপ্লুত হয়ে গেলাম সুদর্শন পুরুষের কথা শুনে। বললাম, আপনি কি চেনেন আমায়?

না চিনি না। তবে আপনার দায়িত্ব নিতে চাই। যেহেতু আমার কারণেই আজ আপনার এই অবস্থা। আপনি তৈরি হয়ে থাকবেন। আমি কাল এসে আপনাকে এই হাসপাতাল থেকে নিয়ে যাবো।

আচ্ছা।

আমি যেন সেই সুদর্শন পুরুষকে নিজের মনের মাঝে অজান্তেই অনেক বেশি স্থান দিয়ে দিচ্ছিলাম। জ্ঞান ফেরার পর যদিও আমি আগের কোন স্মৃতি মনে করতে ব্যর্থ হয়েছি। তবে এই পুরুষকে নিজের মনের মধ্যে বিশাল স্থান ঠিকই দিয়েছি।

যেমন দেখতে সুন্দর, তেমনই তার গলার স্বর। সবদিক দিয়ে অনেক বেশি উত্তম তিনি। আমি মুগ্ধতার সাথে দেখতে লাগলাম তাকে।

দেখতে দেখতে চোখের পলকে একটি দিন অতিবাহিত হয়ে গেল। আজ সেই সুদর্শন পুরুষের আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার কথা। আমি সকাল থেকে প্রহর গুনছি কখন সে আসবে আর আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাবে।

আমার অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো মধ্যাহ্নে। সুদর্শন পুরুষ আমাকে এসে বলল, আপনি তৈরি হয়ে নিন। আমি এখান থেকে নিয়ে যাবো আপনাকে।

আমি সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালাম। একজন নার্সের সহায়তায় সুন্দর করে তৈরি হয়ে নিলাম। আমার কোন পোশাক না থাকায় সুদর্শন পুরুষ নিজে আমার জন্য একটি কালো শাড়ি কিনে এনেছে। সেই কালো শাড়িতে নিজেকে আবৃত করে নিলাম আমি।

চলে আসলাম সুদর্শন পুরুষটির সামনে। সুদর্শন পুরুষ একপলক আমার দিকে তাকিয়ে তার চোখ সরিয়ে নিল। অজানা কারণে আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। আমি তো আয়নায় দেখলাম আমাকে অনেক সুন্দর লাগছে। তাহলে সুদর্শন পুরুষ কেন তাকালো না আমার দিকে? আমাকে কি তাহলে ভালো লাগছে না?

এরকম নানা ভাবনায় জর্জরিত রইলাম আমি। কিচ্ছু ভালো লাগছিল না৷ সুদর্শন পুরুষ আমাকে বলল, চলুন আমার সাথে। আপনাকে আমি আমার এক বান্ধবীর বাড়িতে রেখে আসবো।

তার মুখে এই কথাটা শুনে আমার মন আরো বেশি খারাপ হয়ে গেল৷ আমি তো আশা নিয়ে ছিলাম যে এই সুদর্শন পুরুষ আমাকে তার নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবে। কিন্তু এখন সে বলছে তার কোন এক বান্ধবীর বাড়িতে নিয়ে যাবে! আমি মন খারাপ করে বললাম, আপনার বান্ধবীকে তো আমি চিনি না। তাহলে আমি তার বাড়িতে কেন যাব?

সুদর্শন পুরুষ হাসল। কি মনোমুগ্ধকর সেই হাসি। যে কোন মেয়ে এই হাসি দেখলে তার মন দিতে চাইবে এই সুদর্শন পুরুষকে। আমিও নিজের মন দিতে চাই তাকে। কিন্তু একথা বোঝাতে পারছি না।

সুদর্শন পুরুষ হাসি থামিয়ে বলল, আমি আপনাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে পারব না। কারণ আমি নিজের বাড়িতে একা থাকি। আমার মা-বাবা দুজনেই বিদেশে থাকে। আমি একা দেশে থাকি। আর তাছাড়া আমিও তো আপনার কাছে অজানাই। আমার বান্ধবীকে ভরসা করতে পারেন ও একজন ডাক্তার। আপনাকে সাহায্য করতে পারবে।

আমি কিছু বললাম না। মনটাই খারাপ হয়ে গেছে। সুদর্শন পুরুষ আমাকে নিজের গাড়িতে করে নিয়ে যেতে লাগল। সুদর্শন পুরুষ গাড়ি চালাচ্ছে আর আমি তার পাশে বসে আছি। যেতে যেতে নিজের বান্ধবীর ব্যাপারে আমাকে অনেক কিছু বললেন। তার বান্ধবীর নাম সুবর্ণা রায়। সে নাকি ঢাকা শহরে একাই থাকে। তার পরিবারের আপন বলতে কেউ ছোট। অনেক ছোট থাকতেই মা-বাবাকে হারিয়েছে। মামা-মামীর কাছে মানুষ। সুবর্ণা আপির ঘটনাগুলো শুনে আমার মাথায় প্রচণ্ড ব্যাথা হতে লাগল। কেন জানি মনে হলো এমন কোন ঘটনা আমিও জানি।

আমার দিকে তাকিয়ে সুদর্শন পুরুষ বলল, আপনি ঠিক আছেন তো?

হুম।

চিন্তা করবেন না। আমি মাঝে মাঝে এসে আপনার সাথে দেখা করে যাব।

কথা বলতে বলতে নিজেদের গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম আমরা। সুদর্শন পুরুষ একটি বহুতল ভবনের সামনে গাড়ি থামিয়ে বললেন, এই ফ্ল্যাটের ৩য় তলায় থাকে সুবর্ণা। চলুন সেখানে।

আমি গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। সুদর্শন পুরুষ আমাকে নিয়ে বহুতল ভবনে প্রবেশ করলেন। লিফটে করে তৃতীয় তলায় পৌঁছালাম আমরা।

একটি রুমের দরজার সামনে এসে ডোরবেল বাজালেন সুদর্শন পুরুষ। সামান্য কিছু সময় পর এক সুদর্শনা রমনী এসে দরজা খুলে দিল। টানা টানা চোখ, শুভ্র গায়ের রং, আমার থেকেও অনেক বেশি সুন্দরী সে। যেন সাক্ষাৎ পরি।

দরজা খুলেই সেই সুদর্শনা রমনী সুদর্শন পুরুষের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, মুক্তো তুই এসে গেছিস!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here