#অন্তর_দহন
#লেখনিতে_আরুহি_অহি
পর্ব __২
__স্পন্দন?
মায়ের কন্ঠ শুনে থেমে গেলো স্পন্দন। পেছনে না ফিরে বরং নিরব হয়েই রইলো।
__ঘরে চল স্পন্দন।নিচে চন্দ্র অপেক্ষা করছে তোর জন্য।
__স্পন্দনের জন্য কেউ অপেক্ষা করে না মা।
__এভাবে বলিস না বাবা। বাচ্চা মেয়ে এসব নিতে পারবে না। অন্ততঃ তোর বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে হলেও চন্দ্রকে মেনে নে বাবা।
__তোমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখতে গিয়ে স্পন্দন আজ শূণ্য মা। চন্দ্রকে দেওয়ার মতো আমার কাছে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই মা।
__স্পন্দন?
__কাঁদছো কেনো মা? আমার জন্য কারো চোখে পানি পড়ে না। তোমার চোখে কেনো পড়ছে তবে?
__আমি তোর মা স্পন্দন। আমার চোখে ছেলের জন্য পানি পড়বেই বাবা।নিচে চল তুই।
__এমনটা কেনো করলে মা?
__তোর ভালোর জন্য করেছি বাবা।
গগন কাঁপিয়ে হেসে উঠলো স্পন্দন। একসময় হাঁটু গেড়ে বসে মায়ের পা দুটো জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
__আমি যে ঝড়ে উপড়ে পরা একটা বৃক্ষ মা। আমার দেহে শ্বাস চলছে তবে আমি অন্তর দহনে মৃতপ্রায়।এই বৃক্ষের বুকে কেনো ফুল ফোটাতে চাইছো তোমরা? আমাকে মুক্তি দাও মা। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।
__আমরা তোর ভালো চেয়েছি বাবা।
__তাই বলে নিজের ছেলের ভালো চাইতে গিয়ে ঐ বাচ্চা মেয়েটার জীবন কেনো নরক বানিয়ে দিলে মা?
__কিচ্ছু শেষ হয়নি বাবা। নতুন করে আবার শুরু কর।দেখবি সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে।
__তুমিও মা? শেষ পর্যন্ত নিজের স্বার্থে আরেকটা জীবন নষ্ট করে বলছো সব ঠিক হয়ে যাবে। কিভাবে হতে পারলে এতটা স্বার্থপর?
__আজ তোর আমাদের স্বার্থপর মনে হচ্ছে স্পন্দন। কিন্তু একদিন দেখবি তোর বাবা_মায়ের এই স্বার্থপরতার জন্য তুই শুকরিয়া আদায় করবি।
__আমি চাইনা এমন কাজের জন্য কারো শুকরিয়া আদায় করতে।তোমরা ভুল করেছো মা। আমার নষ্ট জীবনের সাথে চন্দ্রের জীবন মিলিয়ে দিয়ে অনেক বড় ভুল করেছো মা। তোমাদের চোখের সামনে আগে একটা জীবন ধুঁকে ধুঁকে ম’রে যাচ্ছিলো। এবার দু’টো জীবন ম’রে যেতে দেখবা।
__বড় মামানি?
মিতুর গলা শুনে স্পন্দন চোখ মুছে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো।
__কি হয়েছে মিতু মা?
__মামু ডাকছে তোমায়। ভাইয়া তোমাকে ও ডাকছে।
স্পন্দন বড় বড় পা ফেলে নিচে নেমে গেলো। পেছনে চোখ মুছতে মুছতে ওর মা ও নেমে গেলো।মিতু সেদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিচে নামার জন্য পা বাড়ালো।
__আমাকে ডেকেছেন?
__ভেতরে এসো স্পন্দন। আমি জানি তোমার এই বিয়েতে কোনো মত ছিল না। আমি তোমাকে বাধ্য করেছি বিয়ে করতে। এখন আমিই চাইছি তুমি চন্দ্রকে মেনে নিয়ে সুখী হও।
__আপনার কথা শেষ হয়েছে?
__আমার সাথে এভাবে কথা বলবে না স্পন্দন।আসতে পারো তুমি এখন।
মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে কান্না নিয়ে এলোমেলো বিধ্বস্ত পায়ে বেড়িয়ে এলো স্পন্দন।
ঘরের দরজায় আসতেই দেখে ভাই-বোন গুলো সব কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে।স্পন্দনকে দেখে ভয়ে জড়সড় হয়ে আছে।কেউ কিছু বলার সাহস করতে পারছেনা। এরমধ্যে থেকে সবার বড় রেহানকে সবাই চিমটি কেটে কিছু বলতে বলছে।রেহান ভয় কাটিয়ে বললো,
__ভাইয়া তোমার ভেতরে যাওয়া নিষেধ।
__কে হুকুম জারি করেছে রেহান?
__না মানে ইয়ে মানে ভাইয়া দিপ্ত আর রাতুল বলেছে।
দিপ্ত আর রাতুল নিজেদের নাম শুনেই চেঁচিয়ে উঠলো।বললো,
__রেহান ভাইয়া? তুমি একা আমাদের উপর দোষ দিয়ে দিতে পারো না। আমাদের সাথে তুমি ও ছিলে। সেকথা বলো স্পন্দন ভাইয়াকে।
__কিরে রেহান? খুব সাহস বেড়ে গেছে মনে হয়।কানের নিচে একটা পড়লে সব সাহস জানালা দিয়ে পালিয়ে যাবে।
__দেখো ভাইয়া তুমি ভয় দেখিয়ে আমাদের এভাবে বলতে পারো না।কিরে মিতু নিরা সিঁথি তোরা এমন হাবার মতো দাঁড়িয়ে না থেকে কিছু বল।
__ভাইয়া ঐ তো রেহান ভাইয়া দিপ্ত ভাইয়া আর রাতুল ভাইয়া আমাদের জোর করে এখানে আসতে বাধ্য করেছে।আমরা আসলেই কিছু জানিনা।
__অনেক হয়েছে তোদের একজনের আরেকজনের উপর দোষ দিয়ে পাশ কাটিয়ে যাওয়া। এখন আমার সামনে থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য কি তোদের হাতে কলমে দেখাতে হবে নাকি মুখে বললেই সরে যাবি এখান থেকে।
__আরে ভাইয়া রেগে যাচ্ছো কেনো? তোমার ঘর তোমার বউ।আমরা তো শুধু এখন পাড়া প্রতিবেশী।তাইনা রাতুল।
__ঠিক ঠিক না মানে ঠিকই বলেছিস রেহান ভাই।
__দেখ এমনিতেই মাথা গরম হয়ে আছে।আর তার মধ্যে তোরা এমন করলে কি করতে কি করে বসবো তার ঠিক নেই। ভালো মতো বলছি পথ ছেড়ে দাঁড়া। আমাকে রুমে যেতে দে।
__এতো তাড়া কিসের ভাইয়া। চন্দ্র না মানে ভাবির সাথে তো সারা রাত ধরে কথা বলতে পারবা।তার আগে আমাদের পাওনা মিটিয়ে দেও। আমরাও গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। সারাদিন এতো ধকল কাটিয়ে এসে আবার তোমার বাসর সাজিয়ে দিলাম। আমাদের তো আর কম কষ্ট করতে হয়নি, তাইনা?
__কিসের পাওনা তোদের? আমার ঘরে আমি যাবো তাতে তোদের টাকা দিয়ে আমাকে যেতে হবে কেনো?
__আরে আমরা কষ্ট করে সাজিয়ে দিলাম। আমাদের পরিশ্রম হয়েছে না?কি যে বলো না তুমি ভাইয়া?
__আমি করতে বলেছি? আমার তো মনে পড়ে না এমন কোনো কথা তোদের বলেছি বলে।
__তুমি বলবে কেনো? নিজের বাসর সাজিয়ে দিতে বলবা একটু লজ্জা করবে না?তাইতো আমরাই সাজিয়ে দিলাম।
__নিজে থেকে সাজিয়ে দিয়েছিস। এখন নিজের থেকে বিদায় হ।না হলে স্পন্দন কি করতে পারে তা তোদের থেকে ভালো কেউ জানে না।
__তুমি আমাদের মতো নিরীহ বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের সাথে এমন ব্যবহার করতে পারবা ভাইয়া?
__কে নিরীহ?
__এই যে আমরা!
__তোরা নিরীহ? তোদের মতো একেকটা যদি একটা বাড়িতে থাকে তাহলে সেই বাড়ি আর বাড়ি থাকবে না পাগলা গারদ হয়ে যাবে।আর সেখানে তোরা নিজেদের নিরীহ বলিস? লজ্জা হওয়া দরকার তোদের।
__দেখো ভাইয়া তুমি কিন্তু আমাদের অপমান করছো।
__মান অপমান বোধ আদৌ আছে তোদের?থাকলে এতো সময় নষ্ট না করে আরো আগেই সরে যেতি এখান থেকে।
__তার মানে তুমি টাকা দিবা না?
__না।
__এই চল সবাই বাসর ঘরটা আমরা এমনি এমনি সাজিয়ে দিয়েছি ভাইয়াকে। ভাইয়া এতো গরিব মানুষ জানা ছিলো না।জানলে আরো কিছু টাকা খরচা করে ভাইয়াকে গিফট ও কিনে দিতাম।
__এই দাঁড়া?
সবাই খুশিতে আত্মহারা হয়ে ফিরে দাঁড়াতেই স্পন্দন বললো,
__কোথায় যাচ্ছিস?
__তুমিই তো বললা চলে যেতে।
__হ্যাঁ বলেছি।তবে এখনো নয়। আগে আমার ঘর যেমন ছিল তেমনি করে দিবি তারপর যাবি।
__মানে?
__মানে হলো আমার ঘরে যা যা আছে সব বাইরে রেখে তবেই যাবি।
সবাই অসহায় চোখে একে অপরের দিকে তাকিয়ে দেখে এক পা দু’পা করে দৌড়ে পালিয়ে গেলঝ।স্পন্দন পেছনে পেছনে ডাকলেও কেউ ফিরলো না।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো স্পন্দন।দেখে বিছানায় গুটিসুটি মেরে বসে আছে চন্দ্র।এক পলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো স্পন্দন।ড্রয়ারের ওপর থেকে সিগারেট আর দেয়াশলাই নিয়ে বড় বড় পা ফেলে বেলকনিতে চলে গেলো। চন্দ্র এতো সময় দম আটকে বসে ছিলো ভয়ে।স্পন্দন যেতেই ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে আড়চোখে বেলকনিতে তাকালো। এরপর আবার আগের মতো করে বসে রইল। এদিকে সারাদিন এতো ধকল গেছে যে ও আর বসে থাকতে পারছে না। ঘুম ঘুম চোখে ঝিমাচ্ছে। হঠাৎ করেই একটা বিকট শব্দে তড়িঘড়ি করে উঠে বসে সামনে তাকিয়ে দেখে স্পন্দন রাগী চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।কিছু বুঝে উঠার আগেই স্পন্দন এগিয়ে এসে ওকে বিছানা থেকে নামিয়ে দিলো। এরপর সব ফুল টেনেটুনে ছিঁড়ে ফেলতে লাগলো। চন্দ্র ভয়ে থরথর করে কাঁপছে।গলা শুকিয়ে আসছে ওর।কান্না পাচ্ছে খুব। এমন একটা মানুষের সাথে জেনেশুনে আব্বু আমার বিয়ে কিভাবে দিতে পারলো। আব্বু আমাকে ভালোবাসে না।মনে মনে বলেই চোখ দিয়ে পানি ছেড়ে দিলো চন্দ্র।ফুল সব ছিঁড়ে বিছানার বেডশিট সহ ডাস্টবিন বক্সে ফেলে দিয়ে সোফায় গিয়ে বসলো।মাথার চুল গুলো টেনে পেছনে নিয়ে বললো,
__চন্দ্র?
চন্দ্র কথা বলার অবস্থায় নেই।ভয়ে জড়সড় হয়ে এখনো চোখের পানি ফেলে চলেছে।
__আমি তোকে বউ বলে মানিনা চন্দ্র।তোকে বাবা মা এই বাড়িতে এনেছেন। তাদের কাছে গিয়ে থাকবি । আর ভুলেও আমার আসেপাশে আসার চেষ্টা করবি না তুই।
চন্দ্র এখনো চুপ।এতো সময় যে ঘুম ঘুম পাচ্ছিল তা উবে গেছে অনেক আগেই। এখন শুধু বুকটা ভেঙে কাঁদতে ইচ্ছে করছে চন্দ্রের।
__একদম চোখের পানি ফেলবি না চন্দ্র। আমি মেয়েদের চোখের পানি সহ্য করতে পারিনা তা তুই ভালো করেই জানিস। এখন যা এই ঘর থেকে। আমার চোখের সামনে আর আসবি না।
__কো কোথায় যাবো?
__জাহান্নামে যাবি। কিন্তু আমার চোখের সামনে একটুও নয়। বেড়িয়ে যা চন্দ্র।
__আ আমি যাবো না কোথাও।
স্পন্দন এবার চন্দ্রের দিকে তাকিয়ে বললো,
__তুই বড় বেশি ভুল করেছিস চন্দ্র।এই বিয়েটা করে তুই অনেক বড় ভুল করেছিস।
চন্দ্র ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে ফ্লোরে। ভুল তো ও করেনি।ওকে বাধ্য করা হয়েছে করতে।সেটা কি স্পন্দন জানে না?
#চলবে,,,,,,,
ভুল ত্রুটি মার্জনীয়। লেখিকার লেখা ভালো লাগলে পাশে থাকবেন। লাইক কমেন্ট করবেন।#অন্তর_দহন
#লেখনিতে_আরুহি_অহি
পর্ব_৩
__তোকে এখান থেকে চলে যেতে বলেছি চন্দ্র।চলে যা এখান থেকে। আমার সিমানার বাইরে, দু’চোখের আড়ালে কোথাও চলে যা চন্দ্র।
__আমি কোথাও যেতে পারবোনা। আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই আর।
__আমি এতো সব কথা শুনতে চাই না চন্দ্র। তুই আমার চোখের সামনে থাকলে আমি তা সহ্য করতে পারবোনা। বারবার মনে হবে আমি হৃদির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। আমাকে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দে চন্দ্র।প্লিজ চলে যা তুই কোথাও।
নিজের বরের মুখে অন্যমেয়ের নাম শুনে চন্দ্র চমকে উঠলো। খুব করে ভেঙে গেলো ভেতরে ভেতরে। এতো দিন জানতো স্পন্দন বদরাগী,নেশা করে। আজকে আবার ওদের বাসর রাতে বউকে বলছে অন্য মেয়ের কথা।কোনো কিছু না ভেবেই চন্দ্র বললো,
__হৃদি কে?
__খবরদার চন্দ্র।তোর ঐ মুখে তুই হৃদির নাম ও নিবি না।
স্পন্দনের তীব্র আক্রোশের সুরে চন্দ্র কিছুটা নিশ্চুপ হয়ে গেলো। তবুও বললো,
__আপনি তাকে ভালোবাসেন?
__তোকে এসব বিষয়ে কথা বলতে না করেছি চন্দ্র। তুই কি থামবি?
__আমার ঘুম পেয়েছে। আমি ঘুমাবো।
__ঘুমাবি তো ঘুমা গিয়ে কোথাও। সৈয়দ মির্জার বিশাল বড় অট্টালিকা আছে। সেখানে তোকে রাজরাণী করে রাখবে। কিন্তু এই স্পন্দনের ঘরে এক চুল জায়াগাও নেই চন্দ্রের জন্য।তাই এখানে থেকে সময় নষ্ট না করে বেড়িয়ে যা চন্দ্র।
__আমি এখন বাইরে যেতে পারবোনা।
__কি বললি তুই?তোর এতো বড় সাহস স্পন্দনকে চোখ রাঙানি দিস। তুই জানিস না আমি তোর সাথে কি কি করতে পারি।
__দেখেন। আমি এখানে নিজে হেঁটে হেঁটে আসিনি।স্পন্দন মির্জার বউ হিসাবে পূর্ণ মর্যাদা নিয়ে এসেছি। আপনার বরং ভাগ্য ভালো যে আমি আপনাকে বিয়ে করেছি।না হলে,,,,
__না হলে কি চন্দ্র?
__কিছু না।
__শুরু যখন করেছিস। শেষ ও তোকেই করতে হবে।বল না হলে কি?
চন্দ্রের এমনিতেই বুক কাঁপছে স্পন্দনের সাথে কথা বলতে।তার উপর আবার মুখ ফসকে স্পন্দনকে কি বলতে কি বলে ফেলেছে।ভয়ে এবার ওর গলা শুকিয়ে আসছে।তার মধ্যে স্পন্দন সোফা থেকে উঠে একটু একটু করে এগিয়ে আসছে চন্দ্রের দিকে। চন্দ্র পেছাতে শুরু করলো এবার।এক সময় দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে থেমে গেলো চন্দ্র।স্পন্দনের গরম নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে চন্দ্রের চোখে মুখে। চন্দ্র হাঁসফাঁস করছে।স্পন্দন ভাবলেশহীন ভাবে চন্দ্রের দুপাশে হাত দিয়ে চন্দ্রকে বললো,
__কি বলতে চেয়েছিলি চন্দ্র? কথা শেষ কর।
__আ আপনার মতো ,,,,
__হ্যাঁ আমার মতো কি বল?
__আ আপনার মতো বদরাগী, একগুঁয়ে আর,,,
__আর?
__না মানে,,
__বলতে বলেছি চন্দ্র।
__নেশাখোর মানুষকে কে বিয়ে করবে?
স্পন্দন এক মিনিট চন্দ্রের দিকে তাকিয়ে হু হা করে হাসতে লাগলো। চন্দ্র নিজের বুকে একটা ফুঁ দিয়ে একটা ফাঁকা ঢোক গিলে বিস্মিত হয়ে তাকালো স্পন্দনের দিকে।চোখ দুটো লাল হয়ে আছে স্পন্দনের।দেখেই আৎকে উঠলো চন্দ্র।স্পন্দন বললো,
__আমাকে দেখেছিস নেশা করতে?
__নাহ্।
__তাহলে শুধু শুনেছিস?
__হ্যাঁ শুনেছি।সবাই বলে আপনি আপনার বাবার টাকায় খেয়ে দেয়ে ঘুরে বেড়ান আর নেশায় ডুবে থাকেন।
__আমাকে নেশা করতে না দেখেই সার্টিফিকেট দিয়ে দিলি নেশাখোরের। আবার কি বললি বাবার টাকায় খাই? গিয়ে জিজ্ঞেস করে দেখ সৈয়দ মির্জার কাছে।তার একটা টাকা স্পন্দন হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখে কিনা?
__তাহলে কি করেন আপনি?
__সে কৈফিয়ত কি তোকে দিতে হবে নাকি চন্দ্র?
__নাহ্ ।তবে আমার জানার অধিকার আছে। আমি আপনার বউ।
__বউ? খুব সখ হয়েছে না স্পন্দন মির্জার বউ হবার? আমি স্পন্দন মির্জা বলছি, আমার বউ হবার কোনো যোগ্যতাই নেই তোর চন্দ্র।
__তো কার আছে?ঐ শাকচুন্নী হৃদি না ফিদি ওর?
চন্দ্রের বলতে দেরি হলেও মুখে থাপ্পড় পড়তে সময় লাগলো না। চন্দ্র মুখে হাত দিয়ে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে স্পন্দনের দিকে।স্পন্দন বললো,
__বেড়িয়ে যা চন্দ্র।না হলে এর থেকেও খারাপ হয়ে যাবে তোর সাথে।ভালোয় ভালোয় চলে যা চন্দ্র।
__চন্দ্র ও এই মির্জা বাড়ির মেয়ে।তার ও রাগ জেদ দুইটাই আছে।শুনে রাখুন মিস্টার স্পন্দন মির্জা, চন্দ্র এখান থেকে এক পাও নড়বে না। আপনি কি করতে পারেন করেন।
স্পন্দন কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে চন্দ্রের দিকে তাকিয়ে বেড়িয়ে গেলো ঘর থেকে। চন্দ্র যেনো এবার হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।লাগেস থেকে একটা ড্রেস নিয়ে চেঞ্জ করতে ওয়াশরুমে চলে গেলো।ফিরে এসে বিছানার একপাশে শুয়ে পড়লো।ক্লান্তির চোখে ঘুম ধরে গেলো সহসাই।স্পন্দন ছাদে বসে নেশা করছে।কত সময় পার হয়ে গেছে স্পন্দনের হিসাব নেই। এরপর ঢুলতে ঢুলতে বিছানায় গিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। সকাল হতেই চন্দ্রের ঘুম ভেঙ্গে গেলো।রাতে বেঘোরে ঘুমিয়েছে চন্দ্র আজকে।আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসতেই দেখে স্পন্দন পাশেই বিধ্বস্ত অবস্থায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে।গা থেকে নেশার বিগঘুটে গন্ধ আসছে। চন্দ্রের গা গুলিয়ে উঠলো। দ্রুত ওয়াশরুম থেকে এসে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো চন্দ্র। ভোরের আকাশে সূর্য উঁকি দিয়ে উঠছে মাত্র। চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে তার কিরণ। মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। বেলকনিতে চোখ বুলিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল চন্দ্র।একপাশে একটা দোলনা রাখা আছে।আরেকপাশে গোলাপের গাছ লাগানো দুইটা।একটা দুধ সাদা আর একটা টকটকে লাল।দুইটা দুইটা করে মোট চারটা ফুল ফুটেছে। চন্দ্র খুশি হয়ে গেলো এমন মন ভোলানো ফুলের সৌন্দর্য দেখে। মুগ্ধ নয়নে এটা ওটা দেখতেছে চন্দ্র। এমন সময়ে ভাবনার সুতায় টান ফেলে রুমের দরজায় নকের আওয়াজ এলো। দরজা খুলতেই দেখে মিতু আর নিরা দাঁড়িয়ে। চন্দ্র বললো,
__কি হয়েছে আপু?
__নিচে চল।মামানি ডাকছে।দাদিমা এসেছেন সকালে।
__দাদিমা?
__তুই চেঞ্জ করে নিচে আয়।আমরা যাচ্ছি।
চন্দ্র তাড়াতাড়ি করে চেঞ্জ করে নিচে নামলো । সিঁড়ি থেকে দাদিকে দেখেই ছুট লাগালো। জাপটে ধরলো দাদিকে।স্পন্দনের মা শাড়ির আঁচলটা দিয়ে নিজের চোখের পানি মুছে নিলো।মনে মনে ভাবলো,
__আমি জানি রাতে স্পন্দন তোর সাথে ভালো ব্যবহার করে নি।অন্তত ও বাড়ির লোকজন কে দেখে তোর মন ভালো হয়ে যাবে ভেবেই আম্মাকে আনতে পাঠিয়েছিলাম।এর চেয়ে বেশি আর তোর জন্য কিইবা করতে পারবে তোর বড় আম্মু।বাপ ছেলের মাঝখানে পড়ে আমি আজকে চোখের পানি সম্বল করেই বেঁচে আছি রে চন্দ্র।পাড়লে আমাকে ক্ষমা করে দিস।
__চন্দ্র দি ভাই?
__জ্বী দাদি।
__আমার স্পন্দন দাদুভাই কোথায়?
__ঘুমাচ্ছে দাদি।
__সারা রাত ধরে জাগিয়ে রেখেছিস বুঝি দি ভাই?হয় হয় নতুন পেলে পুরাতনকে সবাই ভুলে যায়। এখন আমাকেও আর দাদুভাই মনে করবে না।
__ঐ খবিশ বদরাগী নিজেকে ছাড়া আর কাকেই বা মনে রাখে?
__কি বললি দি ভাই?
__কিছু না দাদিমা। তুমি বলো ও বাড়িতে সবাই কেমন আছে?
দাদিমার মুখটা একটু ফেকাসে হয়ে গেছে কথাটা শুনে।বিয়েটা যে কারো মনের মতো হয়নি সেটা চন্দ্র ও জানে।সবাই চিন্তিত চন্দ্রের ভাগ্য নিয়ে। তবুও স্পন্দনের জন্য এই বিয়েটা দরকার ছিলো। ভীষণ দরকার ছিলো।মুখে কিছুটা শুকনো হাসি ঝুলিয়ে দাদিমা বললো,
__সবাই ভালো আছে দিভাই।এসব নিয়ে তুই কখনো চিন্তা করিস না।সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।আর তুই তো কাল যাচ্ছিস ই ও বাড়িতে।গেলেই বুঝতে পারবি সব কিছু।
__আমি যাবো না দাদিমা।
__কি বলছিস দিভাই?
__আমি যা বলেছি ঠিক বলেছি।যাবো না আমি ও বাড়িতে।আর কখনো চন্দ্র ও বাড়ির চৌকাঠে পা রাখবে না দাদিমা।
__ও কি কথা চন্দ্র? আম্মাকে এসব কথা বলছিস কেনো?বড় ভাবী দেখো তোমার বউমা বাড়িতে আসতে না আসতেই কি সব কথা শুরু করে দিয়েছে।
__তুই চুপ কর আফরা।সব কথায় তোর ফোড়ন না কাটলেই নয়।দিভাই বাচ্চা মেয়ে। অভিমান করে বলেছে যা বলেছে।তাই বলে তুই বড় হয়ে এভাবে বলতে কে? সৈয়দ বাড়ির কোনো গুন ই পাস নাই তুই।
__আপনি আমাকে এভাবে বললেন আম্মা?থাকবো না আমি।বড় ভাবী আপনার সামনে এভাবে কথা শুনতে হলো এই আফরাকে?আর আপনি চুপ করে থাকলেন?
চিৎকার চেঁচামেচি শুনে সবাই বেরিয়ে এলো বসার ঘরে।স্পন্দন ও নেমে এলো। সৈয়দ মির্জা বললেন,
__কি হয়েছে আফরা?এতো শোরগোল কিসের?
__ভাইজান আম্মা আমারে শুধু শুধু কথা শুনিয়েছে। আমি থাকবো না এখানে।মিতু চল এখান থেকে।
দাদিমা বললেন,
__তোর ইচ্ছে করছে তুই চলে যা আফরা। আমার মিতু দিভাই কোথাও যাবে না। মির্জা?ওকে বাঁধা দিস না।
__আম্মা বাদ দেন না।বিয়ে বাড়িতে এগুলো হয়ে থাকে।আফরা তুই ভেতরে যা।
আফরাকে ভেতরে নিয়ে যেতে সৈয়দ মির্জা স্পন্দনের মা’কে ইশারা করলো।উনি কিছু বলতে যাবেন তার আগেই আফরা মুখ ঘুরিয়ে ভেতরে চলে গেলো।
__কেমন আছো দাদিমা?
__আরে আমার দাদুভাই ও উঠে এসেছে দেখছি।তা রাতে বউ ঘুমাতে দেয়নি বলেই বুঝি এতো বেলা
করে ঘুম ভাঙলো?
স্পন্দন বিরক্তিকর চাহনিতে তাকালো চন্দ্রের দিকে।স্পন্দনের বাবা মা দুজনেই ভেতরে চলে গেলেন।ভাই বোন গুলো এসে ঘিরে ধরে বসলো।স্পন্দন শুকনো হাসি দিয়ে বললো,
__স্পন্দন নিজের মর্জিতে চলে দাদিমা।কে কি বললো বা করলো তাতে তার কিছুই আসে যায় না।
__ভাইয়া তা ঠিকই বলেছে দাদিমা।কাল ওতো সুন্দর করে আমরা বাসর সাজিয়ে দিলাম আর ভাইয়া?
__কি করেছে আমার দাদুভাই?
__ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে আমাদের সবাইকে।
__রেহান বেশি বকবক করবি না এই সকাল সকাল। না হলে রাতে যেটা করিনি সেটাই করবো এবার।
__সেকি ভাইয়া?রাতে তুমি বাসর করো নাই?
__রেহান?
সবাই খিলখিল করে হাসতে লাগলো।আর স্পন্দন রেহানকে থাপ্পড় দেওয়ার জন্য তাড়া করতে লাগলো। সেদিকে তাকিয়ে চন্দ্র মনে মনে বললো,
__কাল রাতে বাসর করবে কি গোমড়া মুখো। আমার মতো একটা ভোলাভালা মেয়েকে ধমকে থাপ্পড় মেরে তবেই নিজে শান্তিতে ঘুমিয়েছে।বেডা খাটাশ একটা।
#চলবে,,,,,
গল্পে কোনো ভুল ত্রুটি হলে মার্জনা করবেন।আর কিছুটা ভিন্নতা আছে ভেতরে।এখনি অধৈর্য্য হবেন না।সাথে থাকুন।লাইক কমেন্ট করবেন। সবাইকে ভালোবাসা।