কোন কাননে ফুটিবে ফুল পর্ব -১২

#কোন_কাননে_ফুটিবে_ফুল🌸
#Part_12
#Writer_NOVA

সন্ধ্যা নামার আগ মুহুর্তে আকাশে পাখির মিলনমেলা দেখা দেয়৷ বৃষ্টিময় আবহাওয়া থাকা সত্ত্বেও পেটের দায়ে নীড় ছেড়ে বেরিয়েছে বহু পাখি। সন্ধ্যার আগে নীড়ে ফেরার তাড়া তাদের। আকাশ মেঘলা। বৃষ্টি থেমে গেলেও মেঘের গুড়ুম গুড়ুম কমেনি। বিদ্যুৎ নেই দুদিন ধরে। বৃষ্টি দেখে তিল্পিতল্পা গুটিয়ে বিদ্যুৎ পালিয়েছে। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই চারিদিকে আধার নেমেছে।

হাতের কুপিটা উঁচু করে চৌকির নিচ থেকে হারিকেনটা বের করলো ঝুমুর। চিমনি উঠিয়ে সলতে তে আগুন ধরিয়ে দিলো। ফু দিয়ে কুপি নিভিয়ে বুক ভরে নিঃশাস নিয়ে কেরোসিনের গন্ধ টানলো। কেরোসিনের গন্ধ তার বেশ লাগে। কেমন নেশা নেশা লাগে।

‘কি করো ঝুমুর আপা?’

হঠাৎ ফুলের গলার স্বর পেয়ে চমকে উঠলো ঝুমুর। ইতস্ততা নিয়ে নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক করে উঠে দাঁড়ালো। বেআক্কল মার্কা হাসি দিয়ে নিজের বলদামি আড়াল করে বললো,

‘হারিকেনে আগুন ধরাইলাম।’

‘আমি দেখেছি তুমি কেরোসিনের ঘ্রাণ নিচ্ছিলো।’

বেকুবের মতো মাথা চুলকে হাসলো ঝুমুর। এতক্ষণ নিজেকে গম্ভীর করে রাখলেও হঠাৎ করে হেসে উঠলো ফুল।

‘লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। আমারো কেরোসিনের গন্ধ ভালো লাগে। যাও হারিকেনটা নাগ বারান্দার খুঁটির মধ্যে ঝুলিয়ে দিয়ে আসো। সেখানে আলো না দেখলে বুড়ি খিটমিট শুরু করবো।’

‘বুড়িটা ম’রে না কেন গো?’

‘আমি কি জানি? আল্লাহকে জিজ্ঞেস করো।’

‘জীবনডা ভাজা ভাজা কইরা ফালাইলো বুড়ি।’

ফুল ঠোঁট চেপে হাসি আটকানোর চেষ্টা করলো। তখুনি উপরের তলা থেকে হাঁক ডাক ছাড়লেন সুফিয়া বিবি।

‘ঐ ঝুমুর, কুপিতে আগুন ধরায় দিয়া যা৷ কই গেছোস? কালি সন্ধ্যা নামলো।’

ঝুমুর বিরক্তিতে গাল ফুলিয়ে বাতাস ছাড়লো। ঘাড় হেলিয়ে ফুলকে বললো,

‘কইতে না কইতে বুড়ির ডাক। হায়াত আছে৷ এতো তাড়াতাড়ি ম’রবো না। দেহো না নাম লইতেই চিল্লান দিয়া উঠলো।’

ফুল সাবধানী দৃষ্টি দিয়ে নিচু গলায় উত্তর দিলো।
‘জলদী যাও। নয়তো বুড়ির পিনিক উঠে যাবে।’

দুজনে একসাথে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। সোহেলী বেগম হাতে ধরে রাখা ক্ষীণ আলোর টর্চ লাইট নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছিলেন। হাসির শব্দ পেয়ে গর্জে উঠলো,

‘হারা সন্ধ্যা কি গল্প কইরা পার করবি তোরা? ইট্টু পর আজান দিবো। এহনো সব ঘরে বাতি দিতো পারলো না। হারাক্ষণ গল্প, গল্প। গল্প ছুটায় ফালামুনে।’

এক মিনিট দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিয়ে সোহেলী বেগম কলপাড়ে চলে গেলেন। ঝুমুর মুখ বাঁকিয়ে বললো,

‘এই হলো আরেকটা। জীবনডা অতিষ্ট কইরা হালাইলো। মাঝে মাঝে মন চায় না হেনে আর থাকি।’

ঝুমুরের কন্ঠে চাপা ক্ষোভ। ফুল কাঁধে হাত রেখে আশ্বাস্ত সুরে বললো,

‘মন খারাপ করো না। ভালো সময় নিশ্চয়ই আসবে।’

‘হো হের লিগা এহনও আশায় বাঁচি।’

ঝুমুর দাঁড়ালো না। হারিকেন উঁচু করে শব্দ করে পা ফেলে নাগ বারান্দার দিকে চলে গেলো। ফুল স্থির দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে ক্ষীণ শ্বাস ছাড়লো।

অনেকক্ষণ যাবত দরজায় কড়াঘাত করে বিরক্তি ফুটে উঠেলো তার চোখে। এক হাতে ছাতা, খাবারের প্যাকেট সামলে আরেক হাতে দরজা কষাঘাত করার কাজটা আসলেই বিরক্তিকর। সেই কখন খেয়া পার হয়ে এসেছে। গ্রামের বাজার থেকে ফলমূল, বিস্কুট, চানাচুর কিনতে গিয়ে দেরী হয়ে গেলো। এতোদিন পর বাড়ি এসেছে কিছু না নিয়ে ফিরলে কেমন দেখায়। মিনমিনিয়ে নিজে নিজে বললো,

‘সব গেলো কোথায়?’

একটু থেমে আবারো পরপর কতগুলো বারি দিলো সে। ধৈর্য্যের বাঁধ বোধহয় এবার ভেঙেই যাবে।

‘ঐ ফুল, ঝুমুর কই তোরা? ম’রছোতনি রে? কহন থিকা ডাকতাছি কেউ হুনে? একটা কাম ভালো মতো করে না।’

সোহেলী বেগম বিরক্ত গলায় বললো। ফুল নামাজের সালাম ফিরিয়ে দৌড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো।

‘কি হয়েছে চাচী?’

‘হাজার বছর পর নবাবজাদির হুশ ফিরছে। কহন থিকা ডাকতাছি হেই খেয়াল আছে?

‘কি দরকার তাই বলেন।’

‘সদর দরজা কে জানি বাইরাতাছে দেখতো কে।’

ফুল মুখ পানসে করে ফেললো। নিচে দাঁড়িয়ে থেকে ফুলকে হুকুম করছে কে এসেছে দেখার জন্য। অথচ পাঁচ কদম এগুলো সে নিজে দেখতে পারে। ফুলের রাগ হলো৷ আরো দুই রাকাআত নামাজ বাকি আছে তার। মনে মনে জেদ চেপে গেলো। না সে যাবে না।

‘যতক্ষণে ডাকছেন ততক্ষণে নিজে খুলেই দেখতে পারতেন। আমি নামাজ পরতেছি। আসতে পারবো না। নিজে একটু কষ্ট করে গিয়ে দেখুন।’

কথাগুলো বলে ফুল দাঁড়ালো না। দাঁড়ালে চাচীর তোপের মুখে পরতে হবে। কি প্রয়োজন ঝামেলা বাড়ানোর। সোহেলী বেগম ফুলের ঠাটবাট উত্তর শুনে রাগে গজগজ করে উঠলেন।ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও এগিয়ে গেলেন সদর দরজার দিকে।

কিন্তু দরজা খুলে ভুত দেখার মতো চমকে গেলেন সোহেলী বেগম। হাতে থাকা টর্চটা উঁচু করে অপর পাশে থাকা ব্যক্তিটার মুখের ওপর মা’রতেই সব রাগ হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। মুহূর্তের মধ্যে আবেগে আপ্লূত হয়ে পরলেন। চোখ দুটো টলমল করে উঠলো। কতদিন পর দেখা! ঝাপিয়ে পরলেন তার বুকে।

‘আমার অভি! কই আছিলি তুই বাপ? কত খুঁজছি তোরে। এমনে বাপ-মা রে পর কইরা দিলি।’

অভির চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। কতদিন পর মায়ের সন্নিধি পেলো। অভিমানের আস্তর গলে গলে পরতে লাগলো। এক হাতে মা কে জড়িয়ে ধরে অভিমানী গলায় বললো,

‘ভেতরে ঢুকতে দিবে না? তুমি এভাবে কাঁদলে কিন্তু আমি আবার নিরুদ্দেশ হবো।’

‘না না বাপ। ঐ কথা মুখেও আনিস না। লো ঘরে লো।’

প্রথম সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের টান থেকে আলাদা। সে যদি বছর দুই নিরুদ্দেশ থাকে তাহলে মায়ের মনের অবস্থা কেমন হয়? হঠাৎ সেই ছেলে ফিরে এলে যেনো খুশির বন্যা বয়ে যায়। সেই খুশির ছটা মনের উত্তাল সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে এসে বারি খাচ্ছে। কি থেকে কি করবে দিশেহারা অবস্থা সোহেলী বেগমের। গলা ছেড়ে চেচিয়ে উঠলো,

‘কই গো তোমরা? দেইখা যাও কেডায় আইছে।’

সারা বাড়িতে হৈহৈ রব। বাড়ির প্রথম ছেলে ফিরে এসেছে। এতে যেনো সবার আনন্দ ধরে না। আনোয়ার সর্দারকে খবর পাঠানো হয়েছে। ঝুমুরকে কিছু সময় পরপর তাগাদা দিচ্ছেন সোহেলী বেগম। এতোদিন পর ছেলে ফিরেছে ভালোমন্দ রান্না করতে হবে তো। সুফিয়া বিবির কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে অভি। দাদীর ভীষণ পছন্দের নাতী। হবেই তো! শুভর মতো নয় অভি। তার সব কথা শুনে, সম্মান করে, দাদী যেনো তার জানপ্রাণ। এমন নাতির জন্য অন্তর পুড়তো তারও। সেই যে বছর দুই আগে রাগারাগি করে বাড়ি ছেরেছিলো। আজ ফিরলো। লোকে তো বলেই দিয়েছিলো এই ছেলে আর ঘরে ফিরবে না। সবার কথা মিথ্যে প্রমাণ করে বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় অবশেষে অভির আগমন হলো।

‘কইছিলাম না বড় বউ আমার সোনার টুকরা নাতি ফিরা আইবো। দেখলা তো আমার কথা ঠিক ফললো।’

‘আমার মনও কইছিলো আমার অভি ফিরা আইবো। দেখছেন মা চেহারার কি সুরত করছে। হাড্ডিচারা বাইরায় গেছে। ঠিকমতো না খাইয়া শরীলের কি অবস্থা করছে।’

‘বছর পর আইছে। এবার আর ছাড়বি না। মাস খানিক বাড়িতে রাইখা ভালোমন্দ খাওয়াইয়া মোটা তাজা কইরা ভালো মাইয়া দেইখা বিয়া করায় দিমু। এরপর বউয়ের টানে প্রতি সপ্তাহে বাড়িত আইবোনে।’

খিকখিক করে হেসে উঠলেন সুফিয়া বিবি। অভি কোল থেকে মাথা তুলে এক চোখ মেরে বললো,

‘তুমি থাকতে অন্য কাউকে লাগে নাকি আমার?’

‘আমি তো পুরান হইয়া গেছি। এর লিগা আর ভালো লাগে না। বুড়িরে কি কারো ভালো লাগে? নতুন টশটশা জুয়ান মাইয়া আইনা দিমু। তহন তার আঁচলের তল থিকা বাইর হইতে চাইবি না।’

‘আমার অন্য কাউকে দরকার নেই। তুমি হলেই চলবে।’

সুফিয়া বিবি নাতির উত্তরে প্রসন্ন হয়ে পিঠের ওপর সাবাসীর চাপড় মা’রলেন। ছেলের বউকে তাড়া দিয়ে বললো,

‘তুই হেনো কি করোস? যা গিয়া দেখ রান্ধা কতদূর। যাগো কাম করতে দিছোস জানোসই তো কি ডিলা কোম্পানি। হেনে দাঁড়ায় থাকলে নাতিডা কহন খাইবো? আমি আর নাতি গল্প করি। তুই গিয়া ঐদিক সামলা। ঝুমুররে দিয়া আমগো লিগা দুই কাপ চা পাডায় দিস।’

অন্য দিন হলে সোহেলী বেগম শাশুড়ীকে ধোয়ানি দিয়ে দিতো। আজ ছেলে ফিরে আসার খুশিতে বাক-বাকুম মন। তাই খুশি মনে মাথা হেলিয়ে বললো,

‘আইচ্ছা আম্মা।’

সোহেলী বেগম বের হতেই সুফিয়া বিবি অভিকে ঠেলা দিয়ে বললো,

‘যা গিয়া হাত-পা ধুইয়া আয়। ভিজা কাপড়চোপড়ে এহনো হুইয়া রইছে। ঠান্ডা লাইগা যাইবোনে।’

অভি উঠলো না। নড়েচড়ে আগের ন্যায় উল্টো হয়ে দাদীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে রইলো। শরীর তার ভীষণ ক্লান্ত। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই চোখ দুটো ভার হয়ে আসছে। যেকোনো সময় হারিয়ে যাবে ঘুমের রাজ্যে। চেনা পরিচিত ঘ্রাণে নাকে এসে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। সাথে মনে কাজ করছে প্রশান্তি। আহ্ নিজের বাড়ি! এখানেই যেনো সব সুখ বিদ্যমান।

[একদিন পরপর গল্প দিবো। আমার মাথায় কুলোয় না]

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here