মোহ মেঘের আলাপন পর্ব – ২২

❝মোহ মেঘের আলাপন ❞
লেখিকা: “নূরজাহান আক্তার আলো”
[২২]

-”যদি এই মুহূর্তে আমার সঙ্গে না যাও তবে চিরতরে হারাবে আমায়। এবার সিদ্ধান্ত তোমার।”

-”আ আদিত্য..।”

-”আমি বাড়তি কথা শুনতে ইচ্ছুক নয়।”

-”তাই বলে বাসা থেকে চলে যাবেন?”

-”থাকো তবে।”

একথা শুনে মেধা ছলছল দৃষ্টিতে মামনির দিকে তাকালো।
সে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে। একদিকে মামনি অন্যদিকে অতি প্রিয় মানুষটা। কী করবে বোধগম্য হচ্ছে না। যার জন্য এত লড়াই তাকে ছাড়া থাকবে কীভাবে? দিনই বা কাটবে কী করে? সে যে ভীষণ ভালোবাসে মানুষটাকে। আদিত্য মেধার দিকে না তাকিয়ে হাঁটা ধরতেই শার্টে টান খেলো। মেধা ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে তার পানে। আদিত্য ওর হাতের মুঠোয় থেকে শার্ট ছুটাতেই মেধা শব্দ করে কেঁদে দিলো। ঘাড় ঘুরিয়ে সীমা বেগমকে বিচার দিলো,

-”মামনি কিছু বলো প্লিজ।”

একথা শুনে সীমা বেগম হাসলেন। কিঞ্চিৎ অবাক হোন নি তিনি। এমন কিছুই ঘটবে উনি যেনো আগে থেকে জানতেন।
আদিত্য মেধার হাত থেকে হাত ছুটাতেই তখন সীমা বেগম বললেন,

-”যাচ্ছো যাও, তবে কষ্ট করে আর একটা ঘন্টা থেমে যাও।”

-”কেন?”

-”কিছু কাজ বাকি আছে। আশা করি এক ঘন্টায় খুব একটা ক্ষতি হবে না তোমার।”

আদিত্য মায়ের কথায় কোনো জবাব না দিয়ে সোফায় গিয়ে বসলো। অর্থাৎ থেমে যাবে। ওকে বসতে দেখে মেধার মুখে হাসি ফুটলো। সে কিছু বলতে গেলে আদিত্য মুখটা ঘুরিয়ে
নিলো। তখন সীমা বেগম জলদি আদিত্যের বাবাকে ডেকে কিছু বলে বাইরে পাঠালেন। তারপর মেধাকে ডেকে নিজের রুমে নিয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে আদিত্যকে বলে গেলেন, একটা পাঞ্জাবি পরে আসতে। কিন্তু আদিত্য গেল না সেখানে সেভাবেই বসে রইল। ঠিক পনেরো মিনিটের মধ্যে আদিত্যের বাবা একজন কাজি ডেকে আনলেন। সীমা বেগমও মেধাকে লাল শাড়ি পরিয়ে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে আনলেন। তাকে বসালেন আদিত্যের পাশে। বড় মামা আসছেন রাস্তায় উনি।
আদিত্য মায়ের উদ্দেশ্য বুঝে এবারও কিছু বললো না। বরং কাজি যখন যা যা বললেন সেসব করলো সে। এর খানিক্ষন পরেই বড় মামা-মামী উপস্থিত হলেন। নিকট আত্মীয়ও চলে এলেন জরুরি তলবে। তারপর সকলের উপস্থিতিতে তাদের শুভ পরিণয় সম্পূর্ণ হলো। বৈধভাবে তারা জুড়ে গেলো একে অন্যের সাথে। মেধা নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে ওর চিরসখা হিসেবে গ্রহণ করলো প্রিয় মানুষটাকে। এসব করতে করতে প্রায় এক ঘন্টা ঘনিয়ে এলো। এক ঘন্টা হতে যখন আর দশ মিনিট বাকি তখন আদিত্য সীমা বেগমের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো,

-”আমার ফ্ল্যাটে উঠছি আপাতত। আগামীকাল এসে নতুন সংসার গুছিয়ে দিয়ে যেও। বাসা আলাদা হচ্ছে তবে আমি
কিংবা মেধা কেউ পর হয়ে যাচ্ছি না। সর্বদা সর্বক্ষণ আমি রইবো তোমাদের পাশে। আর কেন চলে যাচ্ছি, অজানা নেই তোমার। তাই মন খারাপের কিছু নেই। খুব ভালো থেকো তোমরা, সাবধানে থেকো, চলো মেধা।”

একথা বলে আদিত্য এক কাপড়ে মেধার হাত ধরে বেরিয়ে গেল। মেধা ঘাড় ঘুরিয়ে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে সীমা বেগমের দিকে। উনিও স্থির হয়ে ওদের চলে যাওয়া দেখছে।
আদিত্য মেধাকে তার গাড়িতে বসিয়ে নিজে বসলো ড্রাইভিং সিটে। মেধা বিনাবাক্য গাড়িতে বসে জানালায় মাথা ঠেকিয়ে অঝরে কাঁদতে লাগলো। এমন তো হওয়ার কথা ছিলো না!
বাবা মাকে হারিয়ে আরেকটা পরিবার পেয়েছিলো। সকলের
সঙ্গে থাকতে চেয়েছিলো মিলেমিশে। সেই সঙ্গে চেয়েছিলো খুব সাধারণ একটি জীবন। যেখানে চাওয়া পাওয়ার হিসাব নেই। একা হওয়ার ভয় নেই। থাকবে এক টুকরো সুখ। অথচ হচ্ছে তার বিপরীত। বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী ওর জীবন এতটা জটিল হয়ে গেছে যেটার সমাধান হাতের বাইরে। এই যেমন, সেদিন আমানের সঙ্গে গিয়ে যেই বিপদে পড়েছিলো সে, ভেবেছিলো আর কখনো আদিত্যের দেখা পাবে না। সে আর বলতেও পারবে না, ‘ভালোবাসি আদিত্য, আমি ভীষণ ভালোবাসি তোমায়।’ কাঁদতে কাঁদতে তার হঠাৎ’ই সেদিনের কথা মনে পড়ে গেল। সে ভাবতে লাগলো সেই ঘটনার কথা।
মেধা যখন চোখ খুলে তাকায় তখন দুপুর। জানালার পর্দা মেলে দেওয়ায় আবহাওয়াটা বোঝা যাচ্ছে না। এসি চলছে।
এজন্য শীত লাগছে বোধহয়। সে আশেপাশে দৃষ্টি ঘুরাতেই নজর পড়ে উদয়ের ফটোফ্রেমের দিকে। তার মনে পড়ে যায় ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। হারানোর কষ্টে ভারি হয়ে থাকে বক্ষপাশ। চোখ ফেটে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু। বুকেও শুরু হয় নিষ্ঠুর তোলপাড়। অতি প্রিয় মানুষটার মুখটা ভেসে ওঠে চোখের পাতায়। সেই সঙ্গে মুখ থেকে বেরিয়ে আসে একটা অতি প্রিয় শব্দ ‘আ আ আদি ত্য।’
তখন সুসজ্জিত রুমের দরজা ঠেলে কেউ প্রবেশ করে। শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখে উদয়। ওর পরনে কালো টি শার্টের সঙ্গে কালো টাউজার। কানে ইয়ারফোন গুঁজে রাখা। হাতে আধ খাওয়া আপেল। মুখে মিটিমিটি হাসি। উদয় জানালার পর্দা
সরিয়ে মেধাকে বললো,

-”আমার রাজ্যে তোমাকে সু-স্বাগতম মাই লাভ।”

এই কথাটা বলতে বলতেই উদয় এগিয়ে মেধাকে একটানে দাঁড় করিয়ে জানালার পাশে চলে গেল। থাই গ্লাস ভেদ করে দৃষ্টি গেল বাইরের দিকে। মেঘলা আকাশ। তখন উদয় থাই
গ্লাস সরাতেই চোখ পড়লো অনেক বড় বড় বিল্ডিং। দেশের
আকাশে বাতাসে কেমন অচেনা টান অনুভব করলো মেধা।
অদ্ভুত ঠেকলো তার কাছে। মস্তিষ্কেও খেলে গেল কিছু প্রশ্ন।
তখন তার চঞ্চল দৃষ্টি দেখে উদয় ঝাপটে ধরলো বাহুডোরে।
অতঃপর হাতের বাঁধন শক্ত করে ফিসফিস করে বলল,

-”আমরা আছি তোমার আদিত্যের ধরা ছোঁয়ারও বাইরে। এই সেই সুদূর আমেরিকা।”

-”আদিত্যের ভয়ে এখানে এসেছেন বুঝি?”

-”হা হা হা, আদিত্যকে ভয়? তাও আবার আমি? জোক্সটা কিন্তু দারুণ।”

ওর হাসি মেধার সহ্য হলো না। আচমকা উদয়ের কলার ধরে
ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো,

-”কেন করলেন এমন? কি অপরাধ আমার? কোন অপরাধে
আমাকে এত বড় শাস্তি দিলেন? বলুন, বলুন, বলছি।”

-”বেশ করেছি।”

একথা শুনে মেধার রাগ তুঙ্গে। সে আর ভাবনা চিন্তা না করে থাপ্পড় দিতে হাত তুললেই উদয় তা ধরে ফেললো। মুখের ভাবভঙ্গি মুহূর্তেই পাল্টে গেছে তার। মুখে ফুটে উঠেছে চাপা ক্রোধ। হটাৎ সে মেধার হাত পেছনে মুচড়ে ধরে বাঁ গালে ওষ্ঠ ছুঁয়ে বললো,

-”জান, তুমি যত দুঃসাহস দেখাবে আমি আমার আদরের মাত্রা তত বাড়বো। বাকিটা তোমার ইচ্ছে। ”

-”আপনাকে আমি ঘৃণা করি, ছাড়ুন আমায়। আপনার স্পর্শে আমার শরীর গুলিয়ে যাচ্ছে, বমি পাচ্ছে আমার।”

-”মজার ব্যাপার কি জানো? নিষিদ্ধ কাজে আমি আকৃষ্ট হই বেশি। কেউ কিছু বারণ করলে আমি সেটাই না করা অবধি শান্তি পাই না। সরি বউ তোমার এই কথাও রাখতে পারলাম না।”

উদয়ের কথা শুনে মেধা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে। সে বুঝে গেছে জোর খাটিয়ে কিছু করা যাবে না। এখানে বুদ্ধির খেল দেখাতে হবে। ওকে নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে
উদয় ভাবে মেধা তার সব কথায় বিশ্বাস করেছে। তাই হিরো সাজতে আরো অনেক কথা বলে মেধাকে। তবে মেধা কিন্তু
তখনো জানতো না উদয়ের পরিচয়ে তুষার। তখন তুষারের ফোনে কল আসে। তুষার মুখ ফসকে বলে ফেলে, হ্যাঁ তুষার
বলছি বলুন।’ একথা শুনতেই মেধার সন্দেহ প্রবল হয়। তাও সে কিছু বলে না।মনমরা হয়ে বসে থাকে রুমের এক কোণে।
পরে তুষারের সেই ভাড়া করা ফ্ল্যাটে তারই এক বন্ধু মেধাকে দেখতে আসে। মেধা তখন ঘুমের ভাণ ধরে শুয়ে ছিলো। ওর বন্ধু তুষারকে বলে,

-”আমানের বোনটা কিন্তু দেখতে জোস। তবে আমান শা’লা’ আসলেই গাধা। নয়তো এত সুন্দর মেয়েকে এভাবে রেখে যায়? আমরা তো মাল খেয়ে টাল হয়ে পড়ে থাকি। কখন কী ঘটিয়ে ফেলি বলা যায়?”

-”ঘটনা ঘটাবো বলেই তো আমানের চোখ ফাঁকি দিয়ে অন্য জায়গায় এনেছি মাম্মা। ইউটিউব দেখে হিরোদের মতো কত্তগুলো বুলি আওড়ে শুনিয়েছি।”

-”চুপ চুপ এসব কথা বলিস না। শুনে নিলে ঝামেলা করবে।”

-“তা ঠিক। আচ্ছা শোন ওদিকের খবর শুনেছিস?”

-”হুম আমানের ভাই আদিত্য..! ”

ওদের বাকি কথা শুনতে পারে নি। তারা কথা বলতে বলতে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আর তখনই সে জানতে পারে এরা কে, এবং এদের উদ্দেশ্য কী।পরে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটানোর
পর, সে এক শীতল হাতের স্পর্শ পায়। কেঁদে ফুলে ওঠা নেত্র তুলে তাকাতেই দেখে আদিত্য। আদিত্যকে দেখেই সে হামলে পড়ে তার বুকে। গলা জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ লুকিয়ে ভাসিয়ে দেয় আদিত্যের বুক। আদিত্যও খুব শক্ত করে জড়িয়ে রাখে তাকে। অনেক কষ্টে সে মেধার খোঁজ পেয়েছে। তারপর তারা রুম থেকে বের হতেই দেখে আমান বেধড়ক মারছে তাদের বন্ধুদের। সেটা দেখেও আদিত্য কথা বলে নি দাঁড়াও নি আর একমুহূর্ত। মেধাকে নিয়ে সোজা চলে আসে বাসায়। মেধার এসব ভাবনার ছেদ ঘটলো গাড়ির হর্ণ শুনে।সে মুখ তুলতেই
আদিত্য বললো,

-”কান্নাকাটির কী হলো বুঝলাম না। সব মেয়েরা চায় বরকে নিয়ে আলাদা থাকতে। দু’জনার টোনাটুনির সংসার পাততে। শশুড়-শাশুড়ি, দেবর-ননদের, ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে। তুমি এসব চাওয়ার আগেই পেয়ে গেলে। তাহলে বোকার মতো কাঁদছো কেন হুম? এখন তোমার উচিত, বরকে নিয়ে চুটিয়ে প্রেম করা। রোমান্সের রসে তলিয়ে যাওয়া। ”

মেধা জবাব দিলো না। বরং সিটে হেলান দিয়ে বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। ওকে মনমরা দেখে আদিত্যই বললো,

-”রজনীগন্ধা, গোলাপ, আর কোন কোন ফুল আনবো?”

-”ফুল? ফুল কি করবেন?”

-”বলে কি মেয়ে, রুম সাজাতে লাগবে না?”

-”কি আশ্চর্য! রুম সাজাবেন কোন দুঃখে?”

-”দুঃখে না রে পাগলি সুখে।”

-”এই পরিস্থিতিতেও সুখ কিলবিল করছে আপনার মনে?”

-”সুখী মানুষের মনে সুখ কিলবিল করা স্বাভাবিক।”

-”শুনি কোন সুখের ঠেলায় ফুল কিনবেন।”

-”আজ আমাদের ফাস্ট নাইট। রুমে না সাজালে কীভাবে হবে হুম? বিয়ে যখন করেছি বাসর তো ক…।”

আদিত্য তার কথা শেষ না করতেই দেখে মেধা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। তাকে আরেকদফা অবাক করতে সে সত্যি সত্যিই গাড়ি থামিয়ে অনেকগুলো ফুল কিনে আনলো।
সব ফুল এনে রাখল মেধার কোলে।

To be continue…….!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here