❝মোহ মেঘের আলাপন ❞
লেখিকা: “নূরজাহান আক্তার আলো”
[২৪]
-”অহেতুক এক কাজ বার বার করে সময় নষ্ট না করলেই কী নয়? অপেক্ষা করছি, জলদি রুমে এসো।”
-”হাতের কাজটা সেরে যাচ্ছি।”
-”না। এখন আসতে বলেছি মানে এখনই আসবা।”
-”কী আশ্চর্য, বলছি তো কাজটা সেরে যাচ্ছি।”
-” আজ পালাতে চাচ্ছো ঠিক আছে, কাল অথবা পরশু কী করবে? ফের আমার কাছেই ধরা তো দিতেই হবে, তখন?”
একথা শুনে মেধা হাতের কাজ সেরে রুমে চলে গেল। সময় নিয়ে ফ্রেশ হয়ে এলো। তার পরণে গোলাপী রঙের রাতের পোশাক। দেখতে বেশ আদুরে লাগছে। যেনো একটা পুতুল।
মেধা তোয়ালেতে মুখ মুছতে মুছতে ড্রেসিংটেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর আড়চোখে আদিত্যকে পরখ করে
চুল বাঁধলো। আদিত্য বুকে দুই হাত গুঁজে এদিকেই তাকিয়ে আছে। চোখাচোখি হওয়াতে সে দৃষ্টি সরিয়ে কী করবে ভেবে পেলো না। মিনিট দু’য়েক দাঁড়িয়ে থেকে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। তখন আদিত্য বলল,”
-”ঢং করা শেষ নাকি বাকি আছে?”
উক্ত কথার জবাব দিলো না মেধা। পাশ ফিরে কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে কাঠ হয়ে শুয়ে রইলো। এতে আদিত্য প্রচন্ড বিরক্ত হলো। সে কন্ঠে বিরক্ত এনে বলেই ফেললো,
-” আমি কী এখন নানী দাদীর চরিত্র ভাড়া করে আনবো?”
-”মানে?”
-”মানে বোঝো না? নানী দাদী থাকলে নিশ্চয়ই তোমাকে এটা বলে দিতো, ফাস্ট নাইটে তোমার কোনটা করা উচিত আর কোনটা অনুচিত।”
-”এমন করছেন কেন তুমি?”
-”কেমন করছি? ”
-”কিছু না, আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।”
-”রাগ উঠাবে না মেধা, আমার কাছে এসো।”
মেধা এবার বিরক্ত হয়ে বিরবির করে উচ্চারণ করলো,
-”বা*।”
-”কি বললে? জোরে বলো।”
মেধা এবার করুণ দৃষ্টিতে আদিত্যের দিকে তাকালো। সেটা দেখে আদিত্য ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। অতঃপর সোজা হয়ে শুয়ে মেধাকে পুনরায় কাছে আসার কথা বললো। মেধা ভদ্রমেয়ের ন্যায় আদিত্যের কাছে এসে চট করে আদিত্যের বুকে মুখ লুকালো। বেশ কিছুক্ষণ সেভাবে থেকেই হাত দিয়ে ইশারা করলো ক্যালেন্ডারের দিকে। তারপর তারিখের দিকে তাকিয়ে ক্রস চিহ্ন আঁকালো। ক্রস অর্থাৎ নিষিদ্ধ। তারিখের দিকে ক্রস মানে নিষিদ্ধ তারিখ। ধূর্ত আদিত্যের ব্যাপারখানা বুঝতে সময় লাগল না।ততক্ষণে মেধা এটা বুঝিয়ে ওর বুকে মুখ লুকিয়েছে। এজন্য আদিত্যের কাছে আসতে সে ভীষণ লজ্জা পাচ্ছিলো। কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে আদিত্য মুখ খুললো,
-”মেয়ে মানুষ একটু বেশি বোঝে এর জলজ্যান্ত প্রমাণ তুমি।
আমার কাছে আসতে বলেছি এর কারণ আমার মাথা ব্যথা করছিলো, ম্যাসাজ করে দেওয়ার জন্য। আর আমি বুঝেছি তোমার….! ”
-”কীভাবে বুঝলে?”
মুখ ফসকে একথা বলে মেধা জিহ্বায় কামড় বসালো। সেটা দেখে আদিত্য হাসতে গিয়েও চেপে গেল।তবে ঠোঁটের কোণে
লেগে রইল তার মৃদু হাসি। ফ্ল্যাটে আসার ঘন্টা দু’য়েক পরেই তারা পুনরায় বাইরে বের হয়েছিলো। বেশ কিছু প্রয়েজনীয় জিনিস কেনাকাটা করতে। শপিংমলে গিয়ে আদিত্যকে ব্যস্ত রেখে সে চট করে গিয়েছিলো পাশের ফার্মেসিতে। ওকে বের হতে দেখে আদিত্যও বের হয়েছিলো। তবে তাকে ফার্মেসিতে ঢুকতে দেখে সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়েছিলো। দূর থেকে নজর রাখছিলো তার প্রতি। যখন দেখলো মেধা আসছে তখন সে মলে ঢুকে এটা ওটা দেখার ভাণ ধরে। এতে মেধাও ভাবে সে কিছুই টের পায় নি। তবে আদিত্য এ ব্যাপারে কথা বাড়ালো না। মেধার হাত টেনে নিজের মাথায় রাখলো। মেধা চট করে উঠে আদিত্যের পাশে বসে মাথা ম্যাসাজ করতে লাগলো, চুল টেনে দিতে থাকলো। আধা ঘন্টা পর, মেধা আদিত্যকে
জিজ্ঞাসা করলো,
-”ঘুমিয়ে গেছো?”
-”উহুম, না।”
-”ব্যথা একটু কমেছে?”
-”হুম।”
-”কফি খাবে, এনে দিবো?”
-”উহুম।”
তারপর পুনরায় নীরবতা। একটু পর, মেধা আদিত্যর কানের
কাছে ফিসফিস করে গিয়ে বললো,
-”ভীষণ ভালোবাসি, ভালোবাসার মানুষ। ”
একথা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই আদিত্যের ঠোঁটে হাসি ফুটলো। মেধা নয়ন জুড়িয়ে তা দেখলো। তখন আদিত্য তাকে শুইয়ে দিয়ে ওর বাহুডোর বন্ধী করে চট করে মেধার কপালে, নাকে
, গালে, চুমু এঁকে বললো, ‘ঘুমাও।”
মেধা আর কথা বাড়ালো না।প্রিয় মানুষটার বুকে মাথা দিয়ে প্রশান্তিতে চোখ বুজে নিলো। এই মানুষটাকে ভালো রাখার দায়িত্ব তার, একান্তই তার।
___________________________________
মেয়েটির নাম মিষ্টি। নামের মতোই দেখতে সে। তার হাসি দেখলে মনে সুখ অনুভব হতো। মনে হতো, হাসি-খুশি তার জন্যই। তার মন খারাপ দেখলে বুক ঝড় উঠতো। পাগলের ন্যায় ছটফট করতো হৃদয়পাড়। দূর থেকে আগলেও রাখত সবসময়। তখনকার দিনগুলোও ভালো ছিলো। আর যখনই ছুঁতে গেলে, নিজের করে পেতে মরিয়া হয়ে উঠলো তখনই মরিচিকার ন্যায় হারিয়ে গেল। সেই সঙ্গে বুঝিয়ে দিলো, না পাওয়ার বিষাক্ত ব্যথা।
অন্ধকার বেলকণিতে বসে নিজের কথায় ভাবছিল আমান।
মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি। মিষ্টি নামের মেয়েটি তার অতীত। যে অতীতকে অতি গোপনে বয়ে বেড়াচ্ছে দীর্ঘ আট বছর। তার প্রতি রাগ করে মিষ্টি নিজের প্রাণ ত্যাগ করেছিলো। চুপিচুপি বিয়ে করেছিলো তারা। আমান তখন অনার্সের ছাত্র। মূলত,
একে অপরের প্রতি ভালোবাসার প্রমাণ দিতেই বিয়ে অবধি এগিয়েছিলো। তবে আমান তাকে কখনো খারাপভাবে ছুঁয়ে দেখে নি। মাঝে হাত ধরতো, কপালে চুমু আঁকতো, আর ওর মন খারাপ থাকলে মিষ্টিকে শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে
ধরে বসে থাকতো। চুপিচুপি প্রেম তাদের ভালোই চলছিলো। একদিন মিষ্টি কল করে জানায় সেদিন তাকে পাত্রপক্ষ নাকি দেখতে আসবে। ব্যাপারটা সেদিন সাধারণভাবে নিয়েছিলো।
মাইগ্রেনের অসহ্য ব্যথার কারণে কথা বলতে পারছিলো না, মিষ্টিকে চিন্তা করতে নিষেধ করে ওর ফোনটা সাইলেন্ট করে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছিলো। যখন তার ঘুম ভাঙ্গে, তখন রাত দশটা। অর্থাৎ সে টানা আটঘন্টা ঘুমিয়েছে। তখন তার মনে পড়ে মিষ্টির কথা।ফোন হাতে নিতেই দেখে অনেক কল, মেসেজ। সে কল ব্যাক করলে মিষ্টি ধরে না। পরে রাগ ভাঙাবে বলে ফ্রেশ হয়ে আসতেই দেখে তার বন্ধু রতন কল করেছে। সে ফোন কানে ধরতেই যা শুনে তাতে তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। তার কানে রতনের বলা কম্পিত কন্ঠে বলা কথাটা এখনো তার কানে বাজে, “মিষ্টি আর নেই ভাই।”
দেখতে এসে পাত্রপক্ষ কাবিন করা সিদ্ধান্ত জানায়। বেচারা মিষ্টি কোনোভাবে আঁটকাতে পারছিলো না। পরে ওয়াশরুমে
যাওয়ার নাম করে তার রুমের সিলিংয়ের সাথে গলায় দড়ি দেয়। সেই সঙ্গে হারিয়ে যায় তার পবিত্র ভালোবাসা। এই কষ্ট ভুলতে পা বাড়ায় নেশার জগতে। ধীরে ধীরে বাড়তেও থাকে তার চাহিদা। বাবা-মা, ভাই কারো সন্মানের পরোয়া করে না।
নিজে যা ভালো বুঝে তাই করে। পুরনো অতীত স্মৃতিচারণ করে আমান হাসলো। ঠিক তখনি তার মস্তিষ্কে খেলে গেলে আদিত্যের বলা কথাগুলো,
-‘পৃথিবীতে কোনো ভাই এই অভিশাপ হয়তো কোনো ভাইকে দেয় নি। তবে আজ আমি তোকে দিচ্ছি। তোর জীবনে প্রেম আসুক। কাউকে যেনো ভীষণ ভালোবাসতে পারিস। বুঝতে পারিস প্রেমের মর্ম, গভীরতা। নিগূঢ়ভাবে উপলব্ধি করতেও সক্ষম হোস প্রিয়’র স্থানটা বুকের ঠিক কোন পাশটায়। সেই সঙ্গে বিশুদ্ধ ভালোবাসা মিশে যাক তোর রন্ধে রন্ধে। বুকের পা পাশটায় গেঁথে যাক অতি প্রিয় একটি নাম। যার সামান্য ব্যথাতে তুই কাঁতরাতে পারিস, ছটফট করতে পারিস। যার চোখের পানি দেখে তোর নিজেকে পাগল পাগল মনে হয়। মনে হয়, যে কোনো কিছুর বিনিময়ে তার আবদারটা পূরণ করি। তবুও সে হাসুক, ভালো থাকুক। তার হাসিতেই তোর সর্বসুখ। ঠিক সেদিনই বুঝবি আমার ঠিক কোথাও আঘাত করেছিস তুই। কতটা কষ্ট, যন্ত্রণায়, মুহূর্ত গুলো কাটিয়েছি আমি। আজকে যেমন এই কষ্টে আমি তরপাচ্ছি, একদিন তুই’ও তরপাবি।’
আদিত্যের হয়তো জানা ছিল না তার ভাই এই অনলে দগ্ধ হচ্ছে অনেক আগে থেকেই। তবে সেটা সে না কাউকে বুঝতে দিয়েছে, আর নিজে নিজে ভুলতে পেরেছে। সে আজও খুব ভালোবাসে মিষ্টি কে, ভীষণ ভালোবাসে। দু’চোখ বন্ধ করলে
মিষ্টির অশ্রুসিদ্ধ চোখজোড়া দেখতে পায়। যে চোখে নীরব অভিমান ঠাসা। তার জীবনে প্রতিটা ধাপে ধাপে ভুল করেছে সে। আর ভুলের মাশুলও দিচ্ছে। এসব ভেবে সে বেলকনির
মেঝেতে পা ছড়িয়ে দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে বসলো। আজ
আকাশে চাঁদ উঠেছে। পূর্নিমার চাঁদ। আমান চাঁদটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বিরবির বললো,
-”চাঁদ, আমার ভাইয়াকে বলে দিস তার দেওয়া অভিশাপে আমি অনেক আগে থেকেই অভিশপ্ত। এবার যেনো আমার সঙ্গে কথা বলে।”
To be continue………..!!