#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩১||
৫১.
ইমনের সামনেই মাওশিয়াতের হাত ধরে কম্পিউটার ক্লাস থেকে বের হলো ইভান। ইমন চুপচাপ তাদের যাওয়া দেখছে। তার এই মুহূর্তে কিছুই ভালো লাগছে না। সায়ন্তনীর সাথে সম্পর্কে গিয়েও সে মাওশিয়াতকে ভুলতে পারছে না।
ইমন কাজ শেষ করে কম্পিউটার ল্যাব থেকে বের হলো। বাইরে আসতেই দেখলো ইভান মাওশিয়াতের চুলগুলোতে আঙ্গুল চালাচ্ছে। ইমন তাদের সামনে দিয়ে বেরুতেই মাওশিয়াত ইমনকে দেখিয়ে দেখিয়ে ইভানের শার্ট ঠিক করে দিতে লাগলো। ইমন তাদের দিকে এক নজর তাকিয়ে চলে গেলো। ইমন চলে যাওয়ার পর মাওশিয়াত বলল,
“ইভান, এগুলো কিন্তু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে! কতোদিন ধরে আমরা অভিনয় করছি! কিন্তু ইমন কিছুই বলছে না।”
ইভান বলল,
“আমি ইমনকে অনেক ভালো করেই চিনি। ও এতো ধৈর্যশীল ছেলে না। ও খুব শীঘ্রই আমাদের কাছে আসবে। তারপর আমাকে প্রশ্ন করবে। এরপর তোমাকে আবার ফেরত চাইবে। তারপর…”
মাওশিয়াত ইভানকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“যদি আসে তাহলে বুঝবো, ও আমাকে এখনো ভালোবাসে। এরপর আমি ওকে সব জানিয়ে দেবো। তখন সব ঠিক হয়ে যাবে।”
এদিকে ইমন সায়ন্তনীর দোকানে আসতেই সায়ন্তনী তার দিকে চা এগিয়ে দিলো। ইমন সায়ন্তনীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে তার হাত ধরে তাকে পাশে বসালো। সায়ন্তনী বলল,
“কি হয়েছে, ইমন?”
“আমার সাথে কম্পিউটার ক্লাসে জয়েন করবে?”
“কম্পিউটার ক্লাস! কি করবো কম্পিউটার শিখে? কলেজেই তো ভর্তি হতে পারছি না। কম্পিউটার ক্লাসের টাকা কিভাবে দেবো?”
ইমন কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“আচ্ছা, ঠিক আছে। তুমি ওখানে বসেই চা বিক্রি করতে পারো। ওখানে অনেক ভীড় হয়। দেখবে তোমার ভালোই ব্যবসা হবে।”
“তাই নাকি! আচ্ছা, যাবো।”
সায়ন্তনী কথাটি বলেই মুগ্ধ দৃষ্টিতে ইমনের দিকে তাকিয়ে রইলো। ইমনের চোখেমুখে অস্থিরতা। সায়ন্তনী সেই অস্থিরতা দেখে তার হাত ধরে বলল,
“ভালোবাসি, ইমন!”
সায়ন্তনীর কথাটি শুনেই ইমন চমকে উঠলো। তারপর সায়ন্তনীর চোখের দিকে তাকালো৷ তখনই আরাফ দোকানে এলো। ইমন আর সায়ন্তনীকে কাছাকাছি দেখে গলা খাঁকারি দিলো। শব্দ শুনে তারা দু’জনেই দূরত্ব রেখে বসলো। সায়ন্তনী আরাফকে দেখে অস্থির কন্ঠে বললো,
“আরাফ, আমি তোমার জন্য চা বানিয়ে দিচ্ছি। বসো।”
সায়ন্তনী চা বানিয়ে আরাফের হাতে দিলো। আরাফ আঁড়চোখে সায়ন্তনীর দিকে তাকালো। তার চোখে মুখে উজ্জ্বলতা ফুটে উঠেছে। প্রেমে পড়লে মানুষের চেহারার মধ্যে আলাদা মাধুর্যতা ফুটে উঠে। এই কথাটির সত্যতা সায়ন্তনীকে দেখলেই বোঝা যাবে। আরাফ সায়ন্তনীকে দেখে অনেক কিছুই বুঝতে পারে। তার চোখের গভীরতা, মিষ্টি হাসি আরাফকে ভাষা ছাড়াই অনেক কিছুই জানিয়ে দেয়। শুধু সে-ই আরাফকে বুঝে না। সায়ন্তনী হয়তো কখনোই মনোযোগ দিয়ে আরাফকে দেখে নি। দেখলে হয়তো তার চোখের গভীরে জমে থাকা আক্ষেপগুলো দৃষ্টি এড়াতো না।
কেটে গেলো কয়েক সপ্তাহ। সায়ন্তনী এখন ইমনের কথায় কোচিং সেন্টারের সামনে চায়ের ফ্লাক্স নিয়ে বসে থাকে। ইমন সেখানে বসেই সায়ন্তনীর সাথে সময় কাটায়। যদিও তার মূল উদ্দেশ্য এসব মাওশিয়াতকে দেখানো।
ইমন কখনো পার্ক, কখনো খোলা রাস্তায় সায়ন্তনীর হাত ধরে নিজের গল্পের মেতে থাকে। কখনোই সে সায়ন্তনীর কাছে তার স্বপ্ন, তার ইচ্ছে, ভালোলাগা এসব নিয়ে প্রশ্ন করে নি। তবে সায়ন্তনী নিজ থেকেই ইমন সম্পর্কে সব জেনে নিয়েছে।
সায়ন্তনীর মনে ভালোবাসার ঢেউ এতো তীব্র ভাবে ফুলে উঠছিল যে সে বুঝতেই পারছিলো না, ইমনের এসব ভালোবাসার প্রকাশ শুধুই লোক দেখানো। তবে সায়ন্তনী চোখ বন্ধ করেই ইমনকে বিশ্বাস করতো। তার কোনো কিছুতেই সে বাঁধা দিতো না। সে তার মাকেও ইমনের কথা বলে ফেলেছে। তিনি ইমনকে দেখতে চাইলেন। তারপর সায়ন্তনী একদিন তাকে বাসায় যাওয়ার জন্য দাওয়াত করলো। তবে ইমন একা যায় নি। অরুণিকা, আরাফ আর আহনাফকেও সাথে নিয়ে গিয়েছিল। তাহমিদকে দেখার জন্য বাসায় কাউকে থাকতে হবে, তাই তূর্য তাদের সাথে যায় নি। এদিকে ইভানও মাওশিয়াতকে নিয়ে আরাফের পিছু পিছু বিনা নিমন্ত্রণে সুড়সুড় করে চলে এলো।
সায়ন্তনীদের বাসাটা অনেক ভেতরে। কলোনির পর কলোনি, তারপর ময়লা রাস্তা পার করে তারা একটা বস্তি এলাকায় চলে এলো। আশেপাশে নর্দমার পানি উপচে হাঁটার রাস্তায় চলে এসেছে। সেখানের পাশেই মানুষ বসে আছে।
সায়ন্তনীর মনে মনে খারাপ লাগছিল। কারণ সে এমন একটা পরিবেশে শুধু ইমনকেই আনলে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো৷ এখন বাকিরাও এসেছে, তাই সে ইতস্ততবোধ করছিলো। এদিকে ইমন, আরাফ, ইভান আর আহনাফের এই রাস্তায় চলতে তেমন অসুবিধা হচ্ছে না। কারণ এর চেয়ে জটিল পথ তারা আগেও পার করেছে। কিন্তু মাওশিয়াত আর অরুণিকার জন্য এই রাস্তাটা মোটেও সুবিধার ছিল না। বস্তিতে ঢুকতেই একটা কুকুর দেখে অরুণিকা লাফাতে লাগল। সে আরাফের শার্ট খামচে ধরে বলল,
“আমি বাসায় চলে যাবো। দেখো সামনে ভয়ংকর একটা কুকুর!”
আরাফ অরুণিকাকে কোলে নিয়ে নিলো। মাওশিয়াত তা দেখে বলল,
“ইশ, অরুণিকার মতো ছোট হলে, আজ আমাকেও কেউ কোলে নিতো।”
ইভান ভ্রূ কুঁচকে মাওশিয়াতের দিকে তাকালো। ইমন মাওশিয়াতের দিকে একনজর তাকিয়ে মাথা নিচু করে হাঁটতে লাগলো।
তারা সায়ন্তনীদের বাসায় আসতেই সায়ন্তনীর মা তাদের উঠানে বসার জন্য চাটাই বিছিয়ে দিলেন৷ আহনাফ পা ভাঁজ করে চাটাইয়ের উপর বসে পড়লো। অরুণিকা সবার দিকে একবার একবার তাকিয়ে আহনাফের কোলে বসে পড়লো। আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“এতো জায়গা থাকতে কোলে বসছো কেন?”
অরুণিকা চাটাইয়ের একপাশ দেখিয়ে বলল,
“আমি এটাতে বসবো না।”
সায়ন্তনী বিষয়টা বুঝতে পেরে বলল,
“অরুণিকা, এটা গরম ভাপ লেগে একটু পুড়ে গেছে৷ ময়লা নেই। তোমরা আসবে তাই আমি সকালেই চাটাইটা ধুয়ে রোদে দিয়েছিলাম।”
আরাফ অরুণিকাকে টেনে আহনাফের কোল থেকে উঠিয়ে তার পাশে বসালো। তারপর বলল,
“সব জায়গায় নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়। তুমি তাহমিদের কাছ থেকে বাছাবাছি করার মতো বাজে স্বভাবটিই পেয়েছো।”
অরুণিকা আরাফের কথায় মন খারাপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। আহনাফ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“এখানে আমাদের মতো চুপচাপ বসে থাকবে। আমরা যা করবো, তাই করবে। তারপর তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দেবো।”
অরুণিকা আনন্দিত কন্ঠে বলল,
“কি সারপ্রাইজ!”
“পরে বলবো।”
অরুণিকা আহনাফের কথা অক্ষরে-অক্ষরে পালন করছে। প্রথমে সে আহনাফের মতো পা গুঁটিয়ে বসলো। আহনাফের অভ্যাস খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে কাঁচা মরিচ খাওয়া। অরুণিকাও তাকে অনুসরণ করতে গিয়ে কট করে মরিচে কামড় বসিয়ে দিলো। সেকেন্ড খানিক পর অরুণিকা ঝাল ঝাল করেই লাফিয়ে উঠল। সায়ন্তনী ঠান্ডা লাচ্ছি নিয়ে এলো। তা খেয়েই অরুণিকার ঝাল কমলো। তবে এতোক্ষণে তার নাকের পানি চোখের পানি এক হয়ে গেছে। আর তার এই অবস্থা দেখে সবার খাওয়া বন্ধ।
অরুণিকা শান্ত হয়ে বসার পর ইভান বলল,
“তুমি মরিচটা খেতে গেলে কেন?”
অরুণিকা অভিমানী দৃষ্টিতে আহনাফের দিকে তাকিয়ে তাকে একটা চিমটে দিলো। আহনাফ হাঁ করে অরুণিকার কান্ড দেখছে। আরাফ বলল,
“তুমি আহনাফকে চিমটে দিলে কেন?”
অরুণিকা বলল,
“ও বলেছে চুপচাপ বসে থাকতে, আর সবাই যা করে তাই করতে, তারপর আমাকে সারপ্রাইজ দেবে।”
তারপর সে আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এটাই তোমার সারপ্রাইজ ছিল, তাই না? আর কথা বলবো না তোমার সাথে।”
আহনাফ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“তুমি যদি সহজ কথা বাঁকা ভাবে বুঝো, ওটাতে আমার দোষ কোথায়? আমি তোমাকে মরিচ গিলতে বলি নি। বলেছি আমাদের মতো চুপচাপ বসে থাকতে। আমি তো সবজিও নিয়েছিলাম, ওটাতো খাচ্ছিলে না!”
“আমি এই সবজি খাই না, তুমি জানো না?”
“মরিচ তো খুব খাও! তাই না?”
অরুণিকা মুখ বাঁকিয়ে বলল, “আড়ি। হুহ।”
সায়ন্তনী দু’জনকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“হয়েছে, আর কতো ঝগড়া করবে তোমরা? এবার তো শান্ত হও।”
আজ পুরো সময়টা ইভান আর মাওশিয়াত নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত ছিল। আর এসব ইমনের একদমই সহ্য হচ্ছিলো না। হঠাৎ তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো। সে হুট করেই কথার মাঝখানে সায়ন্তনীর কাছাকাছি এসে তার অধরে চুম্বন করলো। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই হতভম্ব। মাওশিয়াত বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। ইভান আর আহনাফ বিস্মিত। আরাফের চোখ দুটি স্থির হয়ে গেছে। অরুণিকাও সবার দেখাদেখি তাদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। আহনাফ অরুণিকার তাকানো দেখে তার সামনে এসে দাঁড়ালো। অরুণিকা আহনাফকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“তুমি সামনে কেন দাঁড়িয়েছো। এখানে এতো জায়গা দেখছ না?”
অরুণিকার কন্ঠ নীরবতা কাটিয়ে দিয়েছে। ইমন শব্দ শুনেই সায়ন্তনীর কাছ থেকে দূরত্ব রেখে বসলো। এদিকে সায়ন্তনী লজ্জায় লাল হয়ে গেছে, আর মাওশিয়াতের মনটা একেবারেই ভেঙে গেছে। সে একা একাই সামনে হাঁটতে লাগলো। ইভান ইমনের হাত ধরে তাকে বসা থেকে দাঁড় করালো। রাগী কন্ঠে বললো,
“মাথা ঠিক আছে তোর!”
ইমন ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“তোমার মাথা ঠিক আছে? তোমার যেহেতু মাথা ঠিক নেই, আমার মাথাও ঠিক নেই।”
“কি করলি এটা! তাও সবার সামনে!”
সায়ন্তনী মাথা নিচু করে একপাশে সরে দাঁড়ালো। ইভানের রাগ দেখে তার আরো বেশি লজ্জা লাগছিলো। সে কারো চোখের দিকে তাকাতে পারছে না। লজ্জায় হয়তো সে এবার কেঁদেই দেবে।
আহনাফ বলল,
“আমি অরুকে নিয়ে বাসায় চলে যাচ্ছি। তোরা তোদের সমস্যাগুলো সমাধান করে ফেল।”
আহনাফ এই কথা বলে অরুণিকাকে নিয়ে চলে গেলো। যাওয়ার পথে মাওশিয়াতকে একপাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,
“সব তোমার জেদের জন্য হয়েছে। শুরুতেই যদি সবটা বুঝতে, তাহলে এতোকিছু হতো না।”
মাওশিয়াত কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
“অন্তত তোমার বন্ধুর রুচি সম্পর্কে এখন জানতে পারলাম। ইমনের মন-মানসিকতা কতো নোংরা তা আজ জেনেছি। ও লোক দেখানো সম্পর্কেও আজ দাগ লাগিয়ে দিয়েছে। এখন ও ফিরে আসলেও আমি কখনো আজকের দিনটা ভুলতে পারবো না।”
আহনাফ কোনো উত্তর দিলো না। সে অরুণিকাকে নিয়ে চলে গেল।
এদিকে ইভান ইমনকে একপাশে টেনে এনে বলল,
“আমাদের সব অভিনয় ছিল। আমরা কোনো সম্পর্কে যাই নি। ভেবেছি, তুই রাগ করে আমার কাছে আসবি, অন্তত ঝগড়া করার বাহানায় আমার সাথে কথা বলবি। তুই ভাবছিস আমি মাওশিয়াতকে ভালোবাসি, তোর জন্য ওর কাছ থেকে দূরত্ব রাখছি, কিন্তু এটা একদমই সত্য না। ও উল্টো তোকে ভালোবাসে। তোকে পাওয়ার জন্য, তোকে জ্বালানোর জন্য এতোকিছু করলো। আমরা ভেবেছিলাম, আগের মতো তুই ওর কাছে আসবি। ওকে ফেরত চাইবি।”
ইমন রাগী কন্ঠে বলল,
“বার-বার আমি কেন যাবো? ও তো আসতে পারতো।”
আরাফ বলল,
“ইমন, তুই ওকে সুযোগটাই তো দিলি না। ও তোকে বলার আগেই তুই সায়ন্তনীর সাথে সম্পর্কে চলে গিয়েছিলি!”
ইমন কথাটি শুনে আরাফকে জিজ্ঞেস করল,
“আমি কাউকে বিশ্বাস করি না। একমাত্র তোকেই করি, তুই বল, মাওশিয়াত কি এখন আমাকে সত্যিই ভালোবাসে?”
আরাফ মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ।”
ইমন আর কোনো দিকে না তাকিয়ে মাওশিয়াতের পিছু নিলো। আরাফ ইমনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে পেছন ফিরে সায়ন্তনীর দিকে তাকালো। সায়ন্তনী আসামীর মতো একপাশে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরাফের সায়ন্তনীর অসহায় মুখটা দেখেই কষ্ট লাগলো। সে মনে মনে ভাবছে,
“সায়ন্তনী যদি জানতে পারে, ইমন জেদের বশে এতোদিন তাকে পুতুলের মতো ব্যবহার করেছে, তাহলে হয়তো অনেক কষ্ট পাবে।”
সায়ন্তনীর চোখগুলো ভিজে গেলো। সে ইমনের যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে। মনে মনে ভাবছে,
“ও এভাবে বিদায় না নিয়ে চলে গেল কেন! কি কথা হচ্ছিলো ওদের মধ্যে?”
(আগামী পর্বে ইমনের প্রেমের অংশ শেষ হবে। এখন কি তার প্রণয়ে পরিণয় থাকবে, নাকি বিচ্ছেদ তা আগামী পর্বেই জানা যাবে। )
চলবে-#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩২||
৫২.
“দাঁড়াও, মাওশিয়াত। প্লিজ আমার কথাটা তো শুনো।”
“ইমন প্লিজ। আমাকে আর বিরক্ত করো না।”
“আমি ভুল করে ফেলেছি। রাগের মাথায়..”
মাওশিয়াত ইমনকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“নাটক করা বন্ধ করো। তোমার কাছে মানুষের অনুভূতির কোনো মূল্য নেই। সায়ন্তনী তোমাকে ভালোবাসে। তারপরও তুমি ওর সাথে অভিনয় করেছো। আমি শুরুতেই তোমাকে বারণ করেছিলাম। আর আজকে তুমি কি করলে?”
ইমন হাতজোড় করে মাওশিয়াতকে বলল,
“সরি, সরি৷ আর এমন হবে না। প্লিজ, আমার সাথে এমন করো না। আমি তোমাকেই ভালোবাসি। সায়ন্তনীকে না।”
মাওশিয়াত তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“আমিও তোমাকে ভালোবাসতাম। কিন্তু এই ইমনকে নয়, আগের ইমনকে। যে মানুষকে সম্মান করতো, যে অভিমানী ছিল ঠিক, কিন্তু জেদি ছিলো না। তুমি আমাকে পরিবর্তন করে এখন নিজেকেই পরিবর্তন করে ফেলেছ? আই এম সরি, ইমন। এখন আমাদের পথ ভিন্ন হয়ে গেছে।”
ইমন মাওশিয়াতের হাত ধরে বলল,
“তুমিও আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছিলে! স্কুলে সবার সামনে আমাকে অপমান করতে। আমি তো সব সহ্য করেছি, শুধু এই আশায় যে তুমি একদিন সব ভুলে আমাকেই ভালোবাসবে। আমার ছোট বয়সের আবেগটা এখন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। এই কারণে আমি বুঝতে পারছিলাম না তোমাকে কিভাবে ফিরিয়ে আনবো। আমি ভেবেছি আমাকে সায়ন্তনীর সাথে দেখলে তুমি রিয়েলাইজ করবে যে তুমিও আমাকে ভালোবাসো।”
মাওশিয়াত ইমন থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“প্রতিদিন আর এই তামাশাগুলো সহ্য করতে পারছি না। আমি মানসিক অশান্তিতে আছি। ইভান আর তোমার মধ্যে ঝামেলাটা শুধু আমার কারণে হয়েছে। তাই একটা কথায় বলবো, ইভান তোমাকে অনেক ভালোবাসে। নিজের ভাইকে তুমি এতোদিন অবহেলা করেছো। কিন্তু ও রাত-দিন তোমার কথা ভেবেছে। তোমরা তো সব হারিয়ে ফেলেছে। এখন তুমি কি ভাইকেও হারাতে চাইছ? মানুষ নিজের জীবনটাই ভাইয়ের জন্য ত্যাগ করে দেয়। আর তুমি ভালোবাসা ত্যাগ করতে পারলে না? অন্তত সেই মানসিকতা নিয়ে যদি থাকতে, তাহলে আমি সত্যিই তোমার কাছে ফিরে আসতাম। কারণ ইভান আমাকে ভালোবাসে না। আর আমিও ধীরে ধীরে তোমার গুরুত্ব বুঝতে পারলাম। কিন্তু ইমন, তুমি এখন স্বার্থপর হয়ে গেছ।”
“প্লিজ আমাকে আরেকটা সুযোগ দাও।”
মাওশিয়াত কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“তাহলে সায়ন্তনী?”
ইমন আর কিছুই বললো না। মাওশিয়াত মলিন হেসে সামনের রাস্তায় পা বাড়ালো।
দুই সপ্তাহ দেখতে দেখতেই কেটে গেছে। সবার বাড়িতেই এখব নীরবতা বিরাজ করছে। শতাব্দী সারাদিন বাসায় বসে বসে তাহমিদকে নিয়েই ভাবতে থাকে। বাবা-মাকে সে খুব ভালোবাসে। তাদের কষ্ট দিয়ে তাহমিদকে পাওয়া তার পক্ষে সম্ভব না৷ আর তারা তাহমিদ আর তার সম্পর্ক কখনোই মেনে নেবে না। আর তাহমিদও তাকে ভালোবাসে কিনা এই ব্যাপারে শতাব্দী কিছুই জানে না। এদিকে মাওশিয়াত সারাদিন রুমে একা একা বসে থাকে। ইমন প্রতি ঘন্টায় তিন-চারবার করে কল দেয়। কিন্তু মাওশিয়াত একবারো কল রিসিভ করে না। অন্যদিকে ইমন আর ইভানের মধ্যে সব ঝামেলা মিটে গেছে। কিন্তু তাহমিদের অসুস্থতার জন্য সবার মধ্যেই বিষন্নতা বিরাজ করছে। নতুন করে এক্স-রে করার পর তার আরো সমস্যা দেখা গিয়েছে। এখন পায়ের হাড্ডি মজবুত করার জন্য থেরাপি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ইভান আর আহনাফ সারাদিন তাহমিদের পেছনেই পড়ে থাকে। আর তাই অরুণিকার সম্পূর্ণ দায়িত্ব ইমনের উপরেই পড়েছে।
এদিকে সায়ন্তনী দোকান খুলে ইমনের অপেক্ষায় বসে থাকে। দোকানে আগের মতো সবাই আসে, শুধু ইমন আসে না। সে ইমনকে অনেকবার ফোন দিয়েছিল, কিন্তু সে কল রিসিভ করে নি। তবে আরাফ মাঝে মাঝে দোকানে এসে চা খেয়ে যায়। কিন্তু সেদিনের ঘটনার পর সায়ন্তনী আরাফের চোখের দিকে তাকানোর মতো সাহস পাচ্ছে না। তার আরাফের সাথে কথা বলতে খুব লজ্জা লাগছে। আরাফও সেটা বুঝতে পেরে দোকানে যাওয়ায় বন্ধ করে দিয়েছে।
কিছুদিন পর মাওশিয়াত স্বাভাবিক হলো। সে বাসা থেকে বের হলো। অনেকদিন পরই সে কলেজে গেলো। মনে মনে আশা করছিলো যাতে তাকে আর ইভান বা ইমন কারো মুখোমুখিই হতে না হয়। সামনে তার অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা। ঘরে বসে থাকলে পরীক্ষায় ভালো করতে পারবে না। তার উপর অনেকগুলো ল্যাব করা বাকি।
মাওশিয়াত ক্লাসে ঢুকতেই ইভানের মুখোমুখি হলো। কিন্তু সে ইভানের সাথে কোনো কথা না বলে, ক্লাসে ঢুকে পড়লো। এদিকে ইভান ক্লাস থেকে বের হয়েই ইমনকে ফোন করে মাওশিয়াতের কথা জানালো। ইমনও দেরী না করে ইভানদের কলেজে পৌঁছে গেলো। ক্লাস শেষে মাওশিয়াত কলেজ থেকে বের হওয়ার সময় ইমন তার সামনে এসে দাঁড়ালো। ইমনকে দেখেই মাওশিয়াত চমকে উঠলো। ইমন তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“আমাকে কি আরেকটা সুযোগ দেওয়া যায় না? একেবারেই শেষ সুযোগ। আই প্রমিজ, আমি আর এমন ভুল করবো না। আমি তোমাকে ভালোবাসি, মাওশিয়াত। আমি যা করেছি, সেটা আমার ভুল ছিল না, অপরাধ ছিল। প্লিজ আমাকে শেষ সুযোগ দাও। আমি আর কোনো মেয়ের সাথেই কথা বলবো না৷ তুমি ছাড়া কারো দিকেই তাকাবো না।”
ইভান ইমনের কথা শুনে অবাক হয়ে গেলো। মনে মনে বলল,
“বাহ, কোনো মেয়ের দিকেই তাকাবে না! দেখা যাক।”
ইমন পাশে ইভানকে দেখে ভ্রূ কুঁচকালো। ইভান হাতের ইশারায় ইমনের কথাগুলো শুনে শব্দহীন তালি দিতে লাগলো। মাওশিয়াত ইমনের চোখ অনুসরণ করে পেছন ফিরতেই ইমন চোখ বড় বড় করে ইভানের দিকে তাকালো। ইভানও মুহূর্তেই স্বাভাবিক হয়ে মুখটা মলিন করে দাঁড়িয়ে রইলো৷ মাওশিয়াত এবার ইমনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সায়ন্তনীর কি হবে?”
ইমন বলল,
“আমি আজ ওকে সব জানিয়ে দেবো।”
“এরপর ও যদি এই সত্যটা মেনে নিতে না পারে?”
ইভান সামনে এসে বলল,
“আমি বোঝাব ওকে।”
মাওশিয়াত ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“অভিনয় তো তোমার ভাই করেছে, তাহলে তুমি কেন বোঝাবে?”
ইমন দাঁড়িয়ে বলল,
“আমিই বোঝাব৷ আজই বলবো। প্লিজ, আমাকে একটা সুযোগ দাও।”
“কেন সুযোগ দেবো, বলো?”
“জানি না। সুযোগ দিতে হবে, তাই দেবে।”
মাওশিয়াত ভেংচি কেটে বলল,
“কাল থেকে রোজা শুরু। আমি চাই, আজই সায়ন্তনী সব জানুক। আগামীকাল যাতে সবার জীবনে নতুন সূর্য উঠে এই আশা রাখছি।”
“তুমি কি আমাকে সুযোগ দিচ্ছ?”
মাওশিয়াত মুচকি হেসে বললো,
“ইদে আমার বাসায় তোমাদের দাওয়াত রইলো। অরুণিকা, তোমার বন্ধুদের আর…”
ইভানকে দেখিয়ে বলল,
“তোমার এই ভ্রাতাকেও নিয়ে আসবে। সেদিনই সব উত্তর পাবে।”
ইমন মনে মনে খুশি হলো। কিন্তু মুখে বলল,
“দেখো, মাও!”
মাওশিয়াত ‘মাও’ সম্বোধন শুনে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। ইভান হেসে চলে গেলো। ইমন বলল,
“সরি, মাওশিয়াত!”
মাওশিয়াত বুকে হাত গুঁজে বলল,
“ইটস ওকে। মাও নামটা খারাপ না। মিষ্টি একটা নাম।”
ইমন কথাটি শুনে মুচকি হেসে বলল,
“মাও, বলছি কি! ইদ তো আনন্দের দিন। সেদিন এই অবুঝ যুবকটাকে কষ্ট দিও না। ঠিক আছে?”
মাওশিয়াত হাসলো। ইমন বলল,
“আমি কি তোমাকে বাসায় পৌঁছে দেব?”
“না, আমি মামার বাসায় যাবো। পাশেই বাসা। মা আজ ওখানেই আছে। বাসায় কেউ নেই। তুমি সাথে না গেলেই ভালো হবে। নিচে মামার স্টোর আছে একটা। মাঝে মাঝে ওখানে বসেন। উনি দেখলে অনেক প্রশ্ন করবেন। আমি আপতত এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে চাচ্ছি না। তবে সময় হলে উত্তর দিতে আপত্তি নেই।”
মাওশিয়াতের শেষ কথাটি শুনে ইমন খুশি হলো। মাওশিয়াতের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে বাসায় চলে এলো। বাসায় এসে ভাবতে লাগলো, কিভাবে সে সায়ন্তনীকে সত্যটা বলবে!
৫৩.
বিকেলে সায়ন্তনীর দোকানে চায়ের আসর বসলো। তূর্য তাহমিদ আর অরুণিকাকে নিয়ে দোকানে এলো। অনেকদিন পর তাহমিদ ঘোরার জন্য বাসা থেকে বের হয়েছে। সাধারণত ডাক্তার দেখানোর জন্যই সে বাসা থেকে বের হয়৷ এদিকে তূর্য দোকানে এসেই সবাইকে ফোন করে সায়ন্তনীর দোকানে আসতে বলল। অনেকদিন নিজেদের ব্যস্ততার জন্য বাসায় একসাথে থেকেও আড্ডা দেওয়া হয় না।
এদিকে ইমনও সুযোগ পেয়ে গেলো। সে দেরী না করে দশমিনিটের মধ্যেই দোকানে চলে এলো। সায়ন্তনী ইমনকে দেখে যেন দেহে প্রাণ ফিরে পেলো। চায়ের কেটলি একপাশে রেখে দৌঁড়ে ইমনের সামনে এসে দাঁড়ালো। কাঁপা কন্ঠে বললো,
“এতোদিন কোথায় ছিলে?”
তূর্য আর তাহমিদ একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। অরুণিকা হঠাৎ বলে উঠলো,
“জানো, রকস্টার, ওইদিন ইমন সায়ন্তনী আপুকে..”
এতোটুকু বলেই অরুণিকা মুখে হাত দিয়ে হাসলো। ইমন রাগী দৃষ্টিতে অরুণিকার দিকে তাকালে, তূর্য অরুণিকাকে ইশারায় চুপ থাকতে বলল। তবে তূর্য আর তাহমিদ বাকিদের কাছে এসব শুনেছিল। তখনই দোকানে আহনাফ আর ইভান চলে এলো। তাদের দেখে ইমন আর কিছু বললো না। সে বেঞ্চের উপর গিয়ে বসলো। সায়ন্তনীও কিছু না বলে দোকানে ঢুকে চায়ের কাপ সাজাতে লাগলো। সবাই চুপচাপ বসে একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। অরুণিকাও সবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো৷ এরপর বিড়বিড় করে বলল,
“সবাই এমন স্ট্যাচু হয়ে গেছে কেন?”
সে এবার ইমনের দুই হাঁটুতে হাত রেখে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “মুভ।”
অরুণিকার এমন কান্ডে ইমন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। অরুণিকা বুকে হাত গুঁজে বলল,
“তোমরা সবাই স্ট্যাচু হয়ে গেলে কেন? তোমাদের মাথায় কি বিজলি পড়েছে।”
ইমন বলল, “বিজলি!”
“হ্যাঁ, বিজলি। আমাদের ক্লাসে একটা বিজলি আছে। ও কি বলে জানো? ওর সেদিন জন্ম হয়েছিল, সেদিন বাইরে বিজলি পড়ছিল। তাই ওর নাম বিজলি রাখা হয়েছে। আর বিজলি পড়লে মানুষ নাকি স্ট্যাচু হয়ে যায়।”
অরুণিকা “স্ট্যাচু অব লিবার্টি’র” ভঙ্গিতে দাঁড়ালো। ইভান তার হাত নামিয়ে দিয়ে বলল,
“এখন তুমি কথা কম বলো। আর চুপচাপ বসে থাকো।”
অরুণিকা ইভানের উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে ইভানকে ভেংচি কাটলো। তূর্য আর তাহমিদ তার মুখোমুখি থাকায়, তারা অরুণিকার মুখের ভঙ্গিমা দেখে হাসতে লাগলো। আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তোরা হাসছিস কেন?”
অরুণিকা পেছন ফিরে আহনাফের দিকে তাকিয়ে আবার সামনে তূর্য আর তাহমিদের দিকে তাকালো। তারপর ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে ইশারায় তাদের চুপ থাকতে বলল। তারপর তূর্যের কানের কাছে গিয়ে বলল,
“ওদের কিছু বলবে না। ঠিক আছে? ব্লা ব্লা ব্লা ব্লা ব্লা ব্লা।”
তূর্য মুখ চেপে হেসে বলল,
“কি বলছো এগুলো?”
“এখন ওরা ভাববে ওদের নিয়ে কথা বলছি।”
অরুণিকা কথাটি বলেই মুখে হাত দিয়ে হাসলো।
তারপর তাহমিদের কানের কাছে এসে বলল,
“ব্লা ব্লা ব্লা ব্লা ব্লা!”
তাহমিদ কানে হাত দিয়ে অরুণিকাকে সরিয়ে দিয়ে বলল, “কি!”
অরুণিকা আবার ফিসফিস করে বলল,
“আরেহ, আমি তো ওদের জ্বালানোর জন্য বলছি। ওরা ভাববে ওদের নিয়ে কথা বলছি। কিন্তু আমি তো ব্লা ব্লা করছি। বুঝেছো?”
তাহমিদ মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, বুঝলাম।”
অরুণিকা আবার বলল,
“ওরা তিনটাই দুষ্টু ছেলে। ইমনও এখন দুষ্টু হয়ে গেছে। ও এখন ইভানের মতোই আমাকে বকা দেয়।”
ইমন ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“এই ও কি বলছে তোদের কানে কানে?”
অরুণিকা বেঞ্চে পা ঝুলিয়ে বসে বলল,
“বলবো না। এটা আমাদের সিক্রেট।”
আহনাফ অরুণিকার দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলল,
“আমরাও তোমার ক্লু লেস কথা শুনতে আমরা আগ্রহী নই।”
তখনই আরাফ এলো। আরাফ এসেই অরুণিকার পাশে বসে পড়লো। তারা অনেকক্ষণ টুকটাক কথা বললো৷ তাদের ক্লাসে ঘটা হাস্যকর কথাগুলো ভাগাভাগি করলো। চা-নাস্তাও করলো। এবার ইমন সিদ্ধান্ত নিলো, যাওয়ার আগে সায়ন্তনীকে সব জানিয়েই যাবে। তাই সে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো।
সায়ন্তনীর সামনে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলো। সায়ন্তনী বলল,
“ইমন, কিছু বলবে?”
এদিকে ইভান ছাড়া বাকিরা উৎসুক দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। ইমন বলল,
“আই এম সরি, সায়ন্তনী। আমি তোমাকে ভালোবাসি না।”
ইমনের মুখে এমন কথা শুনে সায়ন্তনীর বুকটা খালি হয়ে গেলো। সে কাঁপা কন্ঠে বললো,
“কি বলছো, ইমন?”
ইমন বাকি কথাগুলোও সায়ন্তনীকে বলল। সায়ন্তনী সব শুনে বলল,
“আমি তো তোমার সাথে অভিনয় করি নি। আমার ভালোবাসা মিথ্যা ছিল না।”
“আমি জানি। আমাকে ক্ষমা করে দাও, প্লিজ।”
“তুমি কি সত্যিই মাওশিয়াতের সাথে নতুনভাবে সব শুরু করছো?”
ইমন মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। সায়ন্তনী ধপ করে বেঞ্চে বসে মুখটা হাত দিয়ে ঢেকে রাখলো। সে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছিলো। সে এতোগুলো মানুষের সামনে কাঁদতে চায় না। তবুও পারছিলো না। তার মনে হচ্ছিলো শরীরে আবরণ না থাকলে, সব ছিঁটকে বেরিয়ে পড়তো। তার গলাটা ভারী ভারী লাগছিল। ভালোভাবে নিঃশ্বাসও ফেলতে পারছিলো না। অরুণিকা ধীর পায়ে সায়ন্তনীর সামনে এসে দাঁড়ালো। তারপর ইমনের দিকে তাকিয়ে জোর গলায় বলল,
“তুমি একদম ভালো না। তুমি আপুকে কাঁদালে কেন? তুমি জানো, আপু কত ভালো?”
ইমন হাঁটু গেড়ে সায়ন্তনীর সামনে বসে পড়লো। বলল,
“আমি অনেক বড় অপরাধ করেছি হয়তো…”
সায়ন্তনী মাথা তুলে ছলছল চোখে ইমনের দিকে তাকাতেই ইমন কথা থামিয়ে দিলো। সায়ন্তনী বলল,
“অপরাধ করো নি। পাপ করেছো। আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করবে না। আমার মা আর ভাই ছাড়া কেউ নেই। আমার মা মুসলিম, বাবা হিন্দু ছিলো। তারা সবার বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করেছিল। তারপর বাবা একদিন আমাদের রেখে চলে যায়। সবার বিরুদ্ধে গিয়ে তারা বিয়ে করেছিলো, তাই দাদা-নানার পরিবারের কেউই আমাদের মেনে নেয় নি। তারপর থেকে আমাদের জায়গা বস্তিতে হয়েছিল। আমি কোনো ধর্মই পালন করতাম না। আমি কখনোই ভাবি নি আমার জীবনে ভালোবাসা আসবে। ভালোবাসার জন্যই তো আজ এতো কষ্ট হচ্ছে আমাদের। এরপর তোমাকে ভালো লাগার পর মাকে বললাম, আমি মুসলিম হবো। মাও তা-ই চাইতো। এরপর ধর্মান্তর হওয়ার পর আল্লাহর কাছে তোমাকে চাইতাম। পেলামও। কিন্তু এভাবে তো পেতে চাই নি।”
“সরি, সায়ন্তনী!”
“সরি? এই দোকানে বসেছি। আজ পর্যন্ত কেউ স্পর্শ করতে পারে নি আমাকে। তুমি তো আমার শরীরে দাগ লাগিয়ে দিয়েছ, ইমন।”
ইভান বলল,
“কি বলছো এসব সায়ন্তনী? এগুলো এখন খুব স্বাভাবিক!”
আরাফ ইভানকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“তুই চুপ কর।”
সায়ন্তনী ইভানের সামনে এসে বলল,
“তোমাদের মতো পুরুষের কাছে স্বাভাবিক। আমাদের মতো মেয়েদের কাছে অনেক বেশি কিছু। ভালোবাসার অর্থই প্রেমিকাকে স্পর্শ করা না। আমি এটাই শিখেছি। কিন্তু দোষ তো আমার। আমিই বাঁধা দেই নি। কারণ আমি তো ভাবতাম, অন্তত ইমন প্রতারণা করার মতো ছেলে না। কিন্তু সব প্রতারকই তো ভালো সেজেই প্রতারণা করে।”
ইমন বলল,
“প্লিজ, আমাকে ক্ষমা করে দাও, সায়ন্তনী।”
“না, ইমন। আমি তোমাকে আটকাবো না। তুমি চলে যাও। আমার সামনেও আর এসো না। কিন্তু আমি তোমাকে ক্ষমা করতে পারবো না। কারণ আমি অভিনয় করি নি। ভালোবেসেও অভিনেত্রীর খেতাব পেয়েছি, শুধু তোমার জন্য। এখন যাও এখান থেকে। আর এই দোকানের আশেপাশে আসবে না।”
অরুণিকা সায়ন্তনীর হাত ধরে বলল,
“আপু, তুমি রাগ করো না।”
সায়ন্তনী হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“যাও, তুমিও। আমি চাই না আমার কষ্টগুলো তোমার উপর আসুক। কিন্তু সত্য তো এটাই, মেয়েরাই এই সমাজে বেশি প্রতারিত হয়। তোমার সাথে এমন…”
ইমন সায়ন্তনীকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“প্লিজ, সায়ন্তনী। তুমি খারাপ কথা বলো না।”
ইভান রাগী কন্ঠে বললো,
“তুমি এসবের মধ্যে অরুণিকাকে কেন টেনে আনছো?”
সায়ন্তনী বলল,
“আমি শুধুই উদাহরণ দিলাম। এতেই এতো খারাপ লাগছে? তাহলে ভাবো, সত্যটা তো আমার সাথে ঘটেছে। আমার কেমন লাগছে?”
তূর্য অরুণিকার হাত ধরে ইমনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোর তামাশাগুলো তুই একাই শেষ কর।”
আরাফ আর ইমন ছাড়া সবাই চলে গেলো। সায়ন্তনী বলল,
“তোমরাও যাও।”
ইমন চলে যেতেই আরাফ সায়ন্তনীর কাছে এসে বলল, “সায়ন্তনী!”
“কিছু কি বলার বাকি আছে?”
“জীবনকে কি আরেকবার সুযোগ দেওয়া যায় না? আমি….”
“প্লিজ, আরাফ। যাও। আমি আর নিতে পারছি না।”
আরাফ মাথা নেড়ে চলে গেলো। আরাফ চলে যাওয়ার পর সায়ন্তনী দোকান বন্ধ করে ভেতরে ঢুকে ডুঁকরে কেঁদে উঠলো। দুই হাত তুলে বলল,
“আমি তোমার কাছে ইমনকে চেয়েছিলাম, এখনো সেই চাওয়া থেমে থাকবে না। আমি আমার ভালোবাসা ভিক্ষা চাই। আমি জোর করবো না। কাউকে জোর করবো না। কিন্তু এমন কি হওয়া সম্ভব না, ও নিজেই আমার কাছে ফিরে আসবে?”
সায়ন্তনী কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমি ওকে কিভাবে ভুলে থাকবো? কিভাবে মেনে নিবো যে এসব অভিনয় ছিল? আমি তো অভিনয় করি নি। ভালোবেসেছিলাম। খুব ভালোবেসেছিলাম।”
চলবে-#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩৩||
৫৪.
তূর্য আর আহনাফ ইভানের উপর খুবই ক্ষুব্ধ৷ তূর্য রাগী কন্ঠে বললো,
“তুই ইমনের পক্ষ নিচ্ছিস? তুই কি পাগল হয়ে গেছিস?”
ইভান বলল,
“আমার যা ভালো মনে হয়েছে, আমি তাই করেছি। ইমন মাওশিয়াতকে ভালোবাসে। তাহলে আমি কেন ওকে সায়ন্তনীর ব্যাপারে ভাবতে বলবো?”
আহনাফ বলল,
“অবশ্যই ভাবতে বলবি। সম্পর্কে গিয়েছিল কেন ও?”
তূর্য ইমনের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“ভাই, সায়ন্তনীর জন্য তোর একটুও খারাপ লাগছে না? আরেকবার ভেবে দেখ। মেয়েটা তোকে সত্যিই ভালোবাসে৷ মাওশিয়াত আর সায়ন্তনী দু’জনের মধ্যে সায়ন্তনীই তোর জন্য বেশি উপযুক্ত।”
ইভান তূর্যকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“তুই আবার এসব শুরু করেছিস? তুই কি প্রেম গুরু নাকি কোনো মনিষী? সবসময় তুই ওর জন্য ও ভালো হবে, এ ভালো হবে, এই জ্ঞানই দিতে থাকিস। তুই নিজের মাথায় তেল দে। ইমনের ব্যাপারে নাক গলাবি না। আমি ইমনের বড় ভাই, আমি জানি ওর জন্য কি ভালো, কি খারাপ!”
এবার তাহমিদ বলল,
“ইভান, তুই তূর্যের সাথে এভাবে কথা বলছিস কেন? ও তো ভুল কিছু বলে নি। আমরা জানি তুই ইমনের বড় ভাই। কিন্তু আমরা কি ওর খারাপ চাইবো?”
আহনাফ বলল,
“তোরা এসব তামাশাগুলো কখন বন্ধ করবি? মাওশিয়াত, সায়ন্তনী এই দুইটা মেয়েকে নিয়ে তোরা যেভাবে মিটিং করছিস, মনে হচ্ছে তোরা এদের উপরই পি.এইচ.ডি করবি। এই বাসায় কি আর কোনো বিষয়ে কথা হবে না?”
ইভান বলল,
“তুই চুপ কর, আহনাফ। তোর যতি এসে আমাদের জীবনে কম ঝামেলা বাঁধায় নি।”
আহনাফ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“অন্তত আমি ওর বিষয়ে এভাবে সালিস বসাই নি। আমি ওই মেয়েটাকে চুপচাপ সহ্য করে যাচ্ছিলাম। কাউকে বলি নি যে আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।”
এবার ইমন বলল,
“এটাই আহনাফ। আমিও এটাই বলতে চাইছি। সায়ন্তনী ভালো। কিন্তু আমার জন্য উপযুক্ত না। ওর সাথে আমি মানসিক শান্তি পাই না৷ কেন পাইনা আমি নিজেও জানি না। হয়তো মাওশিয়াতকে ভালোবাসি তাই।”
আহনাফ এবার চুপ করে রইলো। মনে মনে বলল,
“ঠিকই তো। আমিও তো যতির সাথে মানসিক শান্তি পাই নি। হয়তো ও একটু বেশি পজিজিভ ছিল। কিন্তু আমিও তো ওকে ভালোবাসতে পারি নি। কারণ আমি তো…..”
আহনাফ এবার অরুণিকার দিকে তাকালো। অরুণিকা তাহমিদের পাশে বসে বসে তাদের ঝগড়া দেখছে আর ক্যান্ডি খাচ্ছে। ইভানের কথা শুনে আহনাফের মনোযোগ আবার আগের জায়গায় ফিরে গেলো। ইভান বলল,
“তোরা সবাই আহনাফকে জোর করে ওই মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব করিয়েছিলি। ওকে প্রেম করতে বাধ্য করেছিস। কিন্তু আহনাফ তো ওর সাথে ভালো ছিল না। তাহলে সময় নষ্ট তো আহনাফেরই হয়েছিল। আরাফ ছাড়া আমরা কেউই এটা দেখি নি যে আহনাফ যতিকে ভালোই বাসে না। এটা দেখেছি যতি আহনাফের ব্যাপারে কতোটা ডেডিকেটেড। ভাই, এক পক্ষের ডেডিকেশন দিয়ে সম্পর্ক চালানো যায় না। আর জোর করে কারো মনোযোগও পাওয়া যায় না। তাই আমাদের উচিত মন যেটা বলে সেটাই করা। আজ নিজের মনের কথা শুনলে, ভবিষ্যতে কারো উপর দোষ দেওয়ারও সুযোগ থাকবে না, কাউকে ভালো কিছুর ক্রেডিটও দিতে হবে না। আমি ভালো আছি, এটাই আমার জন্য যথেষ্ট।”
ইভানের কথায় সবাই নিরব হয়ে গেলো। হঠাৎ তূর্য বলল,
“অন্তত এটা মিথ্যা না যে, তুই নিজেই চাস না সায়ন্তনী আর ইমনের কোনো সম্পর্ক থাকুক।”
ইভান তূর্যের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। তূর্য আবার বলল,
“যদি ইমন সায়ন্তনীকেই ভালোবাসতো, তবুও তুই এই সম্পর্কটা মেনে নিতি না।”
ইমনসহ সবাই তূর্যের দিকে তাকালো। ইভান বিনা দ্বিধায় বলল,
“হ্যাঁ নিতাম না। কারণ ও আমাদের স্ট্যাটাসের না।”
তূর্য হেসে বলল,
“এটাই আমি শুনতে চেয়েছিলাম।”
এই কথা বলে তূর্য চলে যেতে নিবে তখনই ইভান বলল,
“বাবা-মা বেঁচে থাকলে কখনোই এমন সম্পর্ক মেনে নিতো না। আর ওদের অবর্তমানে ইমনের অভিভাবক আমি।”
তূর্য পেছন ফিরে বলল,
“সমস্যাটা এই জায়গায় ইভান। বাংলাদেশ ফিরলে ইমনের স্ত্রী মৈত্রী গ্রুপ এন্ড ইন্ডাস্ট্রির ৩০% অংশ পাবে। একটা বস্তির মেয়ে এই দায়িত্ব কিভাবে নেবে? মাওশিয়াত শিক্ষিত, স্মার্ট। এই দায়িত্ব মাওশিয়াত সহজেই নিতে পারবে।”
ইভান তাহমিদের দিকে তাকালো। তূর্য বলল,
“তাহমিদ আমাকে কিছুই বলে নি, ইভান। ওইদিন তোদের কথাগুলো আমি সব শুনেছি। সুরের জগতে থাকলেও আমি আশেপাশের খেয়াল রাখি।”
ইভান বলল, “হ্যাঁ, এটাই বাস্তবতা।”
“তোর কথায় এখন আমাদের ভালোবাসতে হলে স্ট্যাটাস দেখেই ভালোবাসতে হবে। ইভান, আমি আজ বুঝেছি, আমাদের গ্রুপের এতো শত্রু কেন ছিল? আজ বুঝেছি একটা পরিবারকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার কারণ কি!”
ইভান রাগী কন্ঠে বলল,
“কি বলতে চাইছিস তুই?”
“এসব নিয়ম। আর এসব স্ট্যাটাসই আমাদের প্রধান শত্রু। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আরুপা ফুফির কারণেই সেই রাতটি মৈত্রী গ্রুপের জন্য কাল রাত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আরুপা ফুফি আত্নহত্যা করার পর থেকেই এই ঘটনাগুলো ঘটছিল। কেন ফুফি আত্মহত্যা করেছিল? কারণ কেউই তার ওই ছেলের সাথে সম্পর্কটা মেনে নেয় নি। ওই ছেলেকে যাচ্ছেতাই শুনিয়ে প্রহরীদের ডাকিয়ে সভাঘর থেকে সেদিন ধাক্কা দিয়ে বিদায় করেছিল। কারণ ফুফির নামে থাকা সম্পত্তির অংশগুলো যাতে ওই ছেলে বা ওর বংশের নামে না হয়৷”
আহনাফ বলল,
“তোকে এসব কে বলেছে?”
“গিটারে সুর তুলতে ব্যস্ত থাকলেও আমি সেই রাত এখনো ভুলি নি। শুধু তোরাই ভুলে যাচ্ছিস।”
৫৫.
রোজা শুরু হয়ে গেছে। রোজা নিয়ে অরুণিকার অনেক আগ্রহ। সে এক সপ্তাহ আগে থেকেই ট্যা ট্যা করছিলো যে, সে রোজা রাখবেই রাখবে। তাই আরাফ সেহেরীর সময় তাকে ডেকে তুললো। ঘুম ঘুম চোখে খুব উৎসাহের সাথে সে ভাত খেলো। তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়লো। আজ রোজা রেখেছে, তাই স্কুলে যাবে না, তাহমিদের সাথেই বাসায় থাকবে। বাকিরা যার যার কাজে বেরিয়ে পড়লো৷ কিন্তু সারাদিন সে তাহমিদের সাথে এতো বকবক করলো যে তার গলাটাই এখন শুকিয়ে গেছে। তাহমিদ বলল,
“থাক, তুমি ছোট মানুষ। তোমার রোজা রাখতে হবে না। পানি খেয়ে ফেলো, যাও।”
অরুণিকা মলিন মুখে বললো,
“আমার এগারো হয়ে গেছে। আর এগারো হলে রোজা রাখতে হয়।”
“তো তুমি বার-বার পানি খাবে কেন বলছ!”
“আর বলবো না।”
তাহমিদ অরুণিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“তুমি ঘুমিয়ে পড়ো, যাও।”
“তুমি আমাকে কোরা’আন শেখাবে না? তুমিই তো বললে শেখাবে।”
“তোমাকে আগে অক্ষর শেখাতে হবে।”
“আমি আলিফ, বা, তা, সা সব পারি। যবর, যের, পেশ দিয়েও বলতে পারি। ওই বাড়িতে শিখেছিলাম, মনে নেই?”
“আচ্ছা, দুপুরে শেখাবো। ঠিক আছে?”
“আচ্ছা। চলো এখন আমরা খেলি।”
তাহমিদ অরুণিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“অরুণিকা, আমার ঘুম আসছে। প্লিজ বোন, তুমিও ঘুমাও। আমাকেও একটু ঘুমাতে দাও।”
এরপর দুপুরে বাকিরাও বাসায় ফিরলো। তারপর একটু বিশ্রাম করে, নামাজ-দোয়া সেরে, ইফতারি তৈরীতে লেগে পড়লো। ওদিকে অরুণিকা হাত-পা মেলে বিছানায় শুয়ে রইলো। আরাফ তার হাত ধরে তাকে টেনে তুলে বলল,
“আগে তো নামাজ শিখতে হবে। রোজা তো আরেকটু বড় হলেও রাখতে পারতে। এখন উঠো। তুমি আসরের নামাজ পড়েছ?”
অরুণিকা ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“আমি তো পারি না।”
“কাল শিখিয়েছিলাম, মনে নেই?”
“অনেক কঠিন। আমি সব ভুলে গেছি।”
তাহমিদ হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে অরুণিকার রুমে এসে বলল,
“যাও আমি শিখিয়ে দেবো এখন। ওজু করে আসো।”
অরুণিকা উৎসাহ নিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ওজু করে এলো৷ তারপর টেবিল থেকে কোর’আন এনে বলল,
“এখন শুরু করব?”
“অরুণিকা, আগে নামাজটা তো শিখতে হবে। কোর’আন পরে শিখিও।”
“না, আমি এটাই পড়বো।”
“নামাজ শিখবে না?”
“পরে শিখবো, বললাম তো।”
তাহমিদ বিড়বিড় করে বলল,
“নিজে যা বুঝে তাই করবে।”
অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“কি বললে তুমি?”
“কিছু না।”
তাহমিদ নামাজে দরকার হবে সেই সূরাগুলোই বার-বার অরুণিকাকে শেখাতে লাগলো। অরুণিকা একটু পর থেমে গিয়ে বলল,
“তুমি শেষে চলে গেলে কেন? এইগুলো পড়বো না?”
“আগে এই সূরাগুলো শিখে মুখস্থ করতে হবে। তারপর বাকিগুলো পড়তে পারবে।”
“যদি ভুলে যাই?”
“তাই তো বার-বার পড়াচ্ছি।”
অরুণিকা পা ধাপিয়ে বলল,
“অনেক কঠিন এগুলো।”
ইভান ড্রয়িংরুম থেকে চেঁচিয়ে বললো,
“এই মেয়ে এতো কথা বলে কেন?”
অরুণিকা ইভানের কথা শুনে এবার জোরে জোরে পড়তে লাগলো। আহনাফ রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ইভানকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“এক ধমকে সোজা হয়ে গেছে। তুই গিয়েই ওকে পড়া! তাহমিদ রেস্ট নিক।”
ইভান বলল,
“আমি পড়াতে গেলে, পড়া কম কান্না করে চোখের পানি ফেলবে বেশি৷ তাহমিদের ধৈর্য আছে। ও-ই পড়াক।”
ইফতারির সময় সবাই গোল হয়ে বসলো। অরুণিকা খাবারের প্লেট ভর্তি করে ফেলেছে। ইমন বলল,
“তুমি সব খেতে পারবে তো?”
অরুণিকা মুচকি হেসে বললো,
“হ্যাঁ। আমার অনেক ক্ষুধা লেগেছে। আমি সব খাবো।”
“দেখবো তো! পুরো প্লেট যাতে খালি দেখি।”
আজান দেওয়ার পর সবাই ইফতারি শুরু করল। অরুণিকা অল্প একটু ছোলা আর পিঁয়াজু খেয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলো। তারপর আস্তে করে এক চামচ ছোলা আরাফের প্লেটে তুলে দিলো। আরাফ ভ্রূ কুঁচকে অরুণিকার দিকে তাকালো। অরুণিকা অন্য দিকে তাকিয়ে পিঁয়াজু খাওয়ার ভান ধরল। ইভান রান্নাঘরে যেতেই সে কিছু পিঁয়াজু আর বেগুনি তার প্লেটে দিয়ে সবাইকে ইশারায় চুপ থাকতে বলল। ইমন বলল,
“কেউ একজন বলেছিল, আমি সব খাবো।”
অরুণিকা মুখ ছোট করে বলল,
“না, আমি তো খেতামই। কিন্তু পরে ভাবলাম, আমি এখনো ছোট। আমার তো এতো শক্তি লাগবে না। তোমরা তো মোটা মোটা বই পড়ো, অনেক কাজ করো, তাই তোমাদের খাওয়াচ্ছি।”
“আচ্ছা, পন্ডিতমশাই। এবার যা খেতে পারেন, তা তো অন্তত খান!”
অরুণিকা পেটের উপর হাত রেখে বলল,
“আরেকটু খেলে আমি ঠুস করে ফেঁটে যাবে।”
ইভান রান্নাঘর থেকে আসতেই অরুণিকার মুখটা চুপসে গেলো। সে আবার চামচ হাতে নিয়ে ছোলাগুলোকে প্লেটের মধ্যেই ঘুরাতে লাগলো। আরাফ অরুণিকার জন্য আলাদা প্লেটে হালিম তুলে রেখে, তার হাত থেকে চামচ নিয়ে বলল,
“থাক, জোর করে খেতে হবে না। পরে খেও। আমি তোমার জন্য তুলে রেখেছি। যাও এখন রেস্ট করো।”
রোজা শুরু হওয়ার পর থেকেই ইফতারির পর প্রতিদিন শতাব্দী বাসায় চলে আসে। আর ছ’জনই অরুণিকাকে শতাব্দীর কাছে রেখে তারাবিহ পড়তে চলে যায়। রোজা রেখে সকালে ক্লাস, বিকেলে কাজ, রাতে তারাবিহ পড়ার পর কারো শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি অবশিষ্ট থাকে না।
এদিকে সায়ন্তনী দোকান বন্ধ রাখে নি। কারণ এটাই তার জীবিকার পথ। আর আরাফও প্রতিদিন দূর থেকে এসে সায়ন্তনীকে দেখে চলে যায়। দিন দিন সায়ন্তনী শুকিয়ে যাচ্ছে। আরাফের খুব ইচ্ছে করে তার পাশে বসে দু’দন্ড কথা বলতে। কিন্তু কোনোভাবেই সাহস পায় না।
কয়েকদিন পর তারাবিহ পড়ে বাসায় আসার পর সবাই বসার ঘরে এক এক জায়গায় বসে পড়ল। শতাব্দী চুল ঠিক করতে করতে বলল,
“আমি যাচ্ছি তাহলে।”
তূর্য বলল,
“একটু বসো। আজ এতো তাড়াহুড়ো করছো কেন?”
“মা ফোন করেছে। বলেছে বাসায় পিসিমা আসবেন।”
“আসলে আসবে।”
“না, বাবা। তুমি বুঝো না এসব। এতো রাতে বাইরে থেকে ফিরলে অনেক বকাবকি করবেন।”
“এখানে এসেছো বলবে।”
শতাব্দী মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“পিসিমা মা-বাবার মতো এসব মানবে না গো। উলটো মায়ের কান ভরবে। এমনতেই স্কুল পাশ করার পর থেকে বিয়ে বিয়ে করে মাথা খেয়ে ফেলছে। আমার তো ছোট বোন আছে। আমার বিয়ে দিলেই তো তার বিয়ে দেবে। আর পিসিমার কাছে জগতের সব পুরুষের খোঁজ পাওয়া যাবে। ডাক্তারবাবু, ইঞ্জিনিয়ারমশাই, দারোগা বাবু, তুমি যেই পাত্র চাইবে একেবারে চুটকির মধ্যে খুঁজে এনে দেবে। তাও বাবা তোমাদের খুব ভালোবাসে, আর ছোট সখী তার চোখের মণি, তাই আমাকে এখানে আসতে দেয়। মাকেও তো বাবাই রাজি করিয়েছিল।”
তাহমিদ বলল,
“তোমার বিয়ে দিয়ে দেবে নাকি!”
“দিয়ে দেবে বললে তো দেওয়া যায় না। আমি মানলেই তো হবে। কিন্তু সোজাসাপ্টা চলাফেরা করলেই তো আমার কথার মান থাকবে, নাকি! দেরী করে বাসায় ফিরলে তাড়াতাড়ি ভাগিয়ে দেবে।”
তূর্য হেসে বলল,
“মিষ্টিমশাই তুমি একটু শক্ত হয়ে বসো। আমি শতাব্দীকে তাড়াতাড়ি বাসায় দিয়ে আসি। নয়তো তুমি হুইলচেয়ার ছাড়ার আগেই সে শ্বশুড়বাড়ি চলে যাবে।”
তাহমিদ রাগী দৃষ্টিতে তূর্যের দিকে তাকালো। তূর্য চোখ মেরে বলল,
“আরেহ, বসে বসে কি বিয়ের আনন্দ পাবে? তাই বলছি। তুমিও না উল্টোটাই বুঝো।”
শতাব্দী লাজুক হেসে তাহমিদের দিকে তাকালো। তাহমিদ হুইলচেয়ারটি উল্টোদিকে ঘুরিয়ে নিলো।
পরেরদিন সেহেরী করে ঘুম থেকে উঠতে উঠতে সবার দুপুর হয়ে গেছে। আরাফ বিছানা থেকে মাথা তুলে অরুণিকার রুমের দিকে তাকালো। দেখলো বিছানায় অরুণিকা নেই৷
আরাফের বেড থেকে সরাসরি অরুণিকার বিছানাটা দেখা যায়৷ রাতে অরুণিকাকে ঘুম পাড়িয়ে সে ড্রয়িংরুমে চলে আসে৷ তারপর করিডরের বাতিটা জ্বালিয়ে দেয়, যাতে মাঝ রাতে ঘুম ভাঙলে অরুণিকা ভয় না পায়। তবে যদি অরুণিকার ঘুম ভাঙে, সে সুড় সুড় করে ড্রয়িংরুমে এসে বসে থাকবে। কখনো কখনো আরাফ আর ইভানের বেডের মাঝখানে যেই খালি জায়গা থাকে, সেখানেই শুয়ে পড়বে। আর আরাফ ও ইভান মেঝেতেই আলাদা বিছানা করে ঘুমায়।
এদিকে আরাফ বিছানা ছেড়ে উঠে সোজা অরুণিকার রুমে চলে এলো৷ এসে দেখলো অরুণিকা চেয়ারে দুই পা তুলে হাঁটুতে মুখ গুঁজে চুপচাপ বসে আছে। আরাফ তার কাছে এসে বলল,
“অরু, তুমি কখন উঠেছ?”
অরুণিকা ছলছল চোখে আরাফের দিকে তাকালো। আরাফ ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“তুমি কাঁদছো কেন? কি হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে?”
আরাফের কন্ঠ শুনে ইমন রুমে ঢুকলো। সে অরুণিকার পাশে বসে বলল,
“অরুণিকা, কাঁদছো কেন তুমি?”
তারপর আরাফকে জিজ্ঞেস করলো,
“কেউ বকা দিয়েছে নাকি!”
আরাফ বলল,
“না, ইভান তো এখনো শুয়েই আছে। আর কেউ তো রুমে আসে নি।”
আরাফ আহনাফকে ডাকলো। আহনাফের পিছু পিছু তূর্য আর তাহমিদও চলে এলো। তূর্য অরুণিকার চোখে পানি দেখে ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
“টুইংকেল, তুমি কাঁদছো কেন? কি হয়েছে আমাকে বলবে?”
অরুণিকা মুখে হাত দিয়ে ঢুঁকরে কেঁদে উঠলো। আহনাফ বলল,
“আচ্ছা, শুনো, অরু। কি হয়েছে না বললে আমরা কিভাবে বুঝবো, বলো? তুমি কি খারাপ স্বপ্ন দেখেছ?”
অরুণিকা চোখের পানি মুছে বিছানার দিকে ইশারা করল। সবাই সেদিকেই তাকালো। ইমন বলল,
“পোকা দেখে কাঁদছো? দাঁড়াও, আমি দেখছি।”
ইমন বিছানার আশেপাশে ভালোভাবে ঘাঁটাঘাঁটি করলো। তারপর কিছু না দেখে বলল,
“কিছুই তো নেই।”
হঠাৎ তাহমিদের চোখ পড়লো, ওয়াশরুমের পাশে পড়ে থাকা জামা-প্যান্টের দিকে। সে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে দেখলো সে কালকের পরণের জামাটা পরিবর্তন করে ফেলেছে। সে এবার হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে জামাটা উঠালো। সে যা ধারণা করেছিল, তাই হয়েছে। জামাটা হাতে নিতেই সবার নজর সেদিকেই পড়লো। ইমনেরও এবার বিছানায় ভালোভাবে চোখ পড়ল। আরাফ অরুণিকার হাত ধরে বলল,
“অরু, ভয় পাচ্ছো কেন বলোতো? এটা তো সাধারণ ব্যাপার।”
আরাফ আহনাফের দিকে তাকাতেই সে শতাব্দীকে কল করল। শতাব্দী কল ধরতেই আহনাফ তাকে সব বললো। শতাব্দী বলল,
“সখীকে দাও তো। আমি কথা বলছি।”
“আচ্ছা, তুমি বাসায় আসলে ভালো হয়। ওকে একটু বুঝিয়ে বলবে আর কি। ও ভয় পেয়ে কান্না করছে।”
“আচ্ছা, আমি এখনি বের হচ্ছি।”
আহনাফ অরুণিকাকে ফোনটা দিলো। অরুণিকা ফোন কানের কাছে আনতেই শতাব্দী বলল,
“সখী, তুমি কান্না করছো কেন বলো তো? তুমি একদম কাঁদবে না৷ আমি আসছি, দাঁড়াও।”
অরুণিকা কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমি কি মারা যাবো?”
অরুণিকার কথা শুনে সবাই রাগী দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। শতাব্দী বলল,
“ধুর বোকা। এটা তো মেয়েদের জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার। তুমি মরে যাওয়ার কথা বলো না, সখী। তোমার কিছু হলে তোমার ছ’ পুরুষের কি হবে বলো তো দেখি?”
অরুণিকা সবার দিকে একবার একবার তাকালো। ফোন রেখে দেওয়ার পর তাহমিদ বলল,
“যাও ভালোমতো ফ্রেশ হয়ে আসো। কান্নাকাটি বন্ধ করো।”
এদিকে ইভান সব শুনে দোকানে গিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে নিয়ে এলো। বিশ মিনিটের মধ্যেই শতাব্দী বাসায় চলে এলো। বাসায় এসে অরুণিকাকে সব বুঝিয়ে বলল। নিজে বসেই অরুণিকার সব কাপড়, আর বেডশিট ধুয়ে দিলো। শতাব্দীর এমন কাজে আরাফ বলল,
“তুমি এসব করতে গেলে কেন?”
শতাব্দী বলল,
“ও আমার বোনের মতো। তাই আমিই ধুয়ে দিয়েছি। আর তোমরা রোজা রেখেছ। অরুণিকা তো এখনো ছোট। ভাবছি, আমাদের বাড়িতে কাজ করে, উনাকে এখানে পাঠিয়ে দেব। রোজা রেখে তোমরা এতো কাজ কীভাবে করবে, বলো?”
“কাজের বুয়া রাখার মতো টাকা এখন আমাদের হাতে নেই। আমরাই পারবো। বাড়তি খরচ করতে চাচ্ছি না।”
“আচ্ছা, আর আমি অরুণিকাকে সব বুঝিয়ে বলেছি। তোমরা চিন্তা করো না।”
“থ্যাংক ইউ, শতাব্দী৷ তুমি অনেক ভালো একটা মেয়ে। কলকাতায় এসে তোমার মতো একটা মেয়ের সাথে আমাদের দেখা হয়েছে, এটা আমাদের সৌভাগ্য। তুমি না থাকলে কি হতো জানি না! তুমি আমাদের অনেক উপকার করেছো। সবসময় পাশে থেকেছো।”
“বিপদে বন্ধুই তো কাজে আসে। আর আমি কি আমার সখী আর সখাদের জন্য এতোটুকু করতে পারবো না?”
চলবে-