হৃদয়জুড়ে বিষন্নতা পর্ব -০৫

#হৃদয়জুড়ে_বিষন্নতা
#পর্বসংখ্যা_০৫
#আনিশা_নিঝুম

পলাশী আপু এসেই আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,’ভালো আছিস,স্নিগ্ধ?’

‘তোমাকে ছাড়া ভালো থাকতে পারি আমি পলাশী আপু?’

আমার কথায় পলাশী আপু মলিন হেসে বললেন,’বিয়ের পর মেয়েদের স্বামী বাড়িই সব! এখন থেকে স্বামীর সাথে থাকার অভ্যাস করে নে। দশদিন তোর সাথে তো আমি আছিই, টুকিটাকি সংসারের কাজ বুঝিয়ে দিবো।’

পলাশী আপুর হাত চেপে আমি বললাম,’এসেই জ্ঞান দেওয়া শুরু করে দিলে! সংসারের কাজ পরে বুঝিও আগে আমার সাথে জম্পেশ গল্প করো।’

পলাশী আপু মৃদু হেসে বললেন,’হ্যাঁ চল।’

পলাশী আপুকে ঘরে নিয়ে যেতে যেতে পলাশী আপু বলল,’ত্রিধার বেরিয়েছে কখন?’

‘দশটার দিকে।’

‘ফ্ল্যাটটা ভীষণ সুন্দর। আমাকে ঘুরে ঘুরে দেখাস কিন্তু।’

আমি জবাবে মৃদু হাসলাম। পলাশী আপুকে বিছানায় বসিয়ে বললাম,’আপু রাফাত কি বাড়ি এসেছে?’

রাফাতের নাম শুনতেই পলাশী আপুর মুখটা চুপসে গেলো, মলিন মুখে বলল,’না এখনো ফিরেনি।’

আপুর কথা শুনে আমার বুক ধক করে উঠলো। থমথমে মুখে তাকালাম আপুর দিকে। আপু আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন,’তোর এখন একটা সংসার হয়েছে স্নিগ্ধ। কারো জন্য পিছুটান রাখিস না। ত্রিধার তোকে বিশ্বাস করে, তার বিশ্বাস ভাঙ্গিস না। একবার বিশ্বাস ভেঙ্গে গেলে তা আবার অর্জন করা ভীষণ কঠিন! এরচেয়ে কঠিন কাজ পৃথিবীতে দুটো নেই।’

‘হুম।’ ছোট করে জবাব দিলাম আমি। আপু স্মিত হাসলেন, বললেন,’রাফাত এতো বছরে তোর জন্য যা করেনি ত্রিধার তা দুইদিনে করেছে। তাকে দুঃখ দিয়েছিস তো দুঃখ এসে তোকে দুঃখ দিবে।’

‘প্রথম ভালোবাসা ভুলা এতো সহজ পলাশী আপু?’

‘তোর বিয়ে হয়েছে এরমানে তোর স্বামীই এখন তোর প্রথম আর শেষ ভালোবাসা। পরপুরুষকে নিজের প্রথম ভালোবাসা বললে সৃষ্টিকর্তা পাপ দিবে! এই পাপ নিয়ে জনমভর থাকতে পারবি তো?’

পলাশী আপুর কথায় চুপ হয়ে গেলাম আমি! আসলেই তো! রাফাত বর্তমানে আমার কেউ না! ত্রিধারই আমার সব! এখন তার মধ্যেই আমার নিজের সব সুখ খুঁজে নিতে হবে!

‘ত্রিধার সেনাবাহিনীতে আছে আপু! আমার আর্মি মানুষ পছন্দ না।’

‘তোর পছন্দ না হওয়ার কারণ হয়তোবা আমার বাবা কিন্তু সব আর্মি পার্সনই কিন্তু খারাপ হয় না। খালি আমার বাবার মতী কিছু অপদার্থই খারাপ। নয়নও তো আর্মি ছিলো! সে কি খারাপ কাজ করেছে? আমার থেকে ওই দূর আকাশে থেকেও সে আমার মনের মধ্যে প্রতিনিয়ত সুখ দিয়ে যাচ্ছে। স্বামী থাকতে তার কদর বুঝতে শিখ! হারিয়ে গেলে, সেই ভালোবাসা পাবি না। প্রতিনিয়ত অগ্নি শিখায় দগ্ধ হতে হবে।’

পলাশী আপুর কথায় আমার বুক কেঁপে উঠলো! ত্রিধারও যদি এইভাবে আমার কাছ থেকে হারিয়ে যায় তবে আমার কি হবে? আমাকে কে সামলাবে?পলাশী আপুর মতোই কি আমার উজ্জ্বল চেহেরা নিমিষেই সাদা বর্ণ ধারণ করবে? আমিও কি সমাজ থেকে নিজেকে একেবারের জন্য গুটিয়ে নিবো? ভেবেও রূহ কেঁপে উঠলো আমার৷ পলাশী আপু ওষ্ঠ্য বাকিয়ে হাসলেন, বললেন,’জানিস, আমার স্বামীকে ষড়যন্ত্র করে মারা হয়েছিলো। মানুষ টা আমার কল্পনার চেয়েও বেশি সৎ ছিলো তারজন্যই হয়তো শত্রু পক্ষ তাকে মেরে ফেলেছে। আমার চোখের সামনে এখনো সেই দিনটি ভাসে। যেদিন রাতে ফ্ল্যাটে দুটো কালো পোশাকধারী লোক ঢুকে যায় দরজা ভেঙ্গে। তখন আমি আর নয়ন ঘরে একসাথে ছিলাম।

আমাদের ঘরের দরজা ভেঙ্গে দুজন ঢুকে পরে। নয়ন আর আমি চমকে ছিটকে দূরে সরে গেলাম। নয়ন সেদিন সকাল মাত্রই ট্রেনিং থেকে ফিরেছিলো৷ স্বামীকে এতোদিন পর কাছে পেয়েও হারিয়ে দিলাম আমি৷ আমারই সামনে তাকে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়৷ আমার হাত পা তখন বাঁধা ছিলো মোটা দড়ি দিয়ে। চোখ খুলে রাখা হয়েছিলো হয়তো স্বামীর মৃত্যু স্বচোখে দেখার জন্য। আমি দেখছিলাম তারা নয়নকে বেঁধে তার দুই হাতের দশটা আঙ্গুল এক এক করে কেটে নেয়! নয়ন যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে তারচেয়েও বেশি যন্ত্রণা হচ্ছিলো আমার। নয়ন পায়ের তালুর চামড়া ছুড়ি দিয়ে আলাদা করা হয়। পা দিয়ে যেনো রক্ত ঝরছিলো! আমি যন্ত্রণা সইতে পারলাম না, মুখ দিয়ে চিৎকার করে উঠলাম কিন্তু আমার যন্ত্রণাদায়ক চিৎকার শোনার মতো ওইদিন কেউ ছিলো না। হুট করে ওই লোক দুজন বেরিয়ে গেলো। নয়ন আমাকে বলে উঠলো,’পলাশী,আমি যদি মরে যাই তারা তোমাকে কিচ্ছু করবে না। কারণটা বলতে গেলে সময় লাগবে, এখন তোমার দায়িত্ব তোমার স্বামীকে যারা হত্যা করছে তাদের খুঁজে বের করা। আমার জন্য হলেও তোমার বাঁচতে হবে। আলমারীর দিত্বীয়তাকে একটা ডায়েরী আছে ওখানে আমার সবচাইতে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ত্রিধার ফোন নাম্বার আছে। তার সাথে যোগাযোগ করলেই তুমি আমার হত্যাকারীকে শাস্তি দিতে পারবে!’

নয়ন আরো কিছু বলতে চেয়েছিলো কিন্তু তার আগেই দুজন লোক ফিরে এলো। হাতে তাদের বোয়াম ভর্তি লবণ। আমি আতকে উঠলাম, ভয়ার্ত চোখে নয়নের দিকে তাকালাম। তার চোখে পানি জমেছে। ইচ্ছা করল সেই পানি মুছে দিতে আমি পারলাম না। পারলাম না স্বামীর মৃত্যু দেখতে চোখ বন্ধ করে নিলাম মূহুর্তেই। কর্ণপাত হলো নয়নের চিৎকার! আমার রূহ কেঁপে উঠলো সেই মূহুর্তে। ধীরে ধীরে তাকিয়ে দেখলাম নয়নের জিহ্ব ছুড়ি দিয়ে কেটে ফেলা হয়েছে। মুখভর্তি লবণ আর পায়ের তালুও লবণে আবৃত। ভয়ে কেঁপে উঠলাম। নয়ন তখনো একটু নড়াচড়া করছিলো কিন্তু তাও করতে দিলো না তাকে। ছুড়ি ঢুকিয়ে দিলো নয়নের বুকের ভিতর। নয়ন রক্তবমি করে উঠলো৷ আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম। চোখ থেকে অঝরধারায় জল গড়াচ্ছিলো। কোনো শব্দ না পেয়ে তাকালাম আবারো। নয়নকে দেখতে পেলাম না আর। হয়তো তার লাশ টেনে দুজন লোক নিয়ে গিয়েছে। আশেপাশে তাকালাম, তখনই পুলিশ এলো বাড়িতে। তারা বন্দুক তাক করে ধীরে ধীরে সেই রুমে এলো যেই রুমে নয়নকে হত্যা করা হয়েছে। তারা আমাকে এইভাবে দেখতে পেরে আমার দড়ি খুললো নানা প্রশ্ন করলো কিন্তু তার একটা উত্তরও দিতে পারি নি আমি, মানসিক ভাবে এতোটাই খারাপ অবস্থায় ছিলাম আমি। মাথায় যেনো বজ্রপাত হয়েছে আমার। বলার মতো অনেক কিছুই ছিলো খালি মুখটাই তারা বন্ধ করে রেখে দিয়েছে। পুলিশরা ঘর খুব ভালো করে দেখলো, শত্রুপক্ষের রেখে যাওয়া প্রমাণের আশায়। তাদের কাজের মধ্যেই আমার মনে পড়লো নয়নের বলা শেষ কথা গুলো ত্রিধারের ফোন নম্বর বের করতে হবে! আমি চুপিচুপি আলমারী থেকে ডায়েরীটা নিয়ে নিজের ওড়নার ভাজে লুকিয়ে নিলাম। আলমারী ঘাটাতে যেয়ে চোখে পড়লো প্রেগন্যান্সি রিপোর্টটা তা দেখে চোখে জল চলে এলো আমার। কাঁদলাম না, নিজের পেটে আস্তে করে হাত দিয়ে বেরিয়ে এলাম ফ্ল্যাট থেকে৷ এরকিছুদিন পর জানতে পারলাম আমার মিসক্যারেজ হয়েছে। তখন থেকেই ঠিক করেছি স্বামী আর সন্তানের মৃত্যুর পিছে যারা দায়ী থাকবে তাদের আমি নৃশংস ভাবে হত্যা করবো! আমার নয়ন যতটা না যন্ত্রণায় মরেছে তারচেয়েও বেশি যন্ত্রণা দেবো আমি।’

পলাশী আপুর কথায় স্তব্ধ হয়ে হেলাম আমি৷ পলাশী আপু কাঁদছে! স্বাভাবিক! তাকে দেখে এতোটা অসহায় কখনো মনে হয়নি আমার। মানুষটা কতোটা কষ্ট সহ্য করেছে তা আজ বুঝলাম। উপলব্ধি করলাম আমার শরীর প্রচণ্ড রকমের কাঁপছে। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছি আমি। বুক চেপে ধরলাম আমি! বুকে হাত বুলালাম, চোখ থেকে আমার পানি গড়াচ্ছে! চারদিকে আবছা আবছা দেখছি সব! পলাশী আপুর চেহেরাটা ঝাপসা লাগছে। দেখলাম পলাশী আপু অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, ঠোঁটের কোণে তার সেই শুকনো হাসি!

#চলবে?

| গল্পটা বেশি বড় হবে না। সর্বোচ্চ পনেরো পর্বের হতে পারে। এইটাকে উপন্যাস বানাতে গেলে জগাখিচুড়ি হয়ে যাবে আবার! আর গল্পটা আপনাদের কেমন লাগছে জানাবেন। হ্যাপি রিডিং |

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here