#ল্যাম্পপোস্ট ( ৫ )
আয়ারল্যান্ড হলো উত্তর-পশ্চিম ইউরোপে অবস্থিত একটি দ্বীপ রাষ্ট্র। রাজধানী ডাবলিন যা আয়ারল্যান্ড দ্বীপের সর্ববৃহৎ শহর বলে পরিচিত। ডাবলিন নগরী বেশ ছিমছাম, রাস্তাঘাটে মানুষের ভীড়ও তেমন নেই বললেই চলে। লন্ডনকে যেমন ব্যস্ত নগরী মনে হয়, ডাবলিন সে তুলনায় একেবারে শান্ত-সৌম্য। মানচিত্রে দেখতে লাগে লম্বাটে। উত্তর-দক্ষিণের দৈর্ঘ্য মাত্র ৪৬৫ কিলোমিটার এবং পাশে ২৮৫ কিলোমিটার, বলা যায় বাংলাদেশের অর্ধেকের মতো!বড়ো শহর বলতে ডাবলিন, যেখানে জনসংখ্যা মাত্র ছয় লাখের মতো। ইউরোপের তৃতীয় বৃহত্তম দ্বীপ এবং পৃথিবীর বিশতম বৃহত্তম দ্বীপ এটি। আইরিশ মানুষ কথোপকথন ভালোবাসে এবং অন্যান্য মানুষের প্রতি তাদের প্রকৃত আগ্রহ আছে। যার দরুন বিভা কে ফ্যাল ফ্যাল করে দেখছে সবাই। জিন্স এর সাথে শার্ট পরিহিত ভিনদেশী কে অন্য রকম দেখতে লাগছে। হালকা শীতে গলায় মাফলার রাখা , সাথে রয়েছে হ্যাট। ভিনদেশীর অন্যন্য রূপে পুরো ডাবলিন শহর যেন তাকিয়ে আছে বিস্মিত নয়নে।
ডাবলিনের সিটি সেন্টারে মানুষের সমাগম তুলনা মূলক বেশি। এতো দিন নিঠাল পরিবেশের সাথে থেকে কেমন আড়ষ্টতা কাজ করছে। তার উপর সকলেই ভিনদেশী। বিভা অ্যাডের গায়ের সাথে চেপে গেল খানিক বাদে।
“ভয় পেও না। এটা সিটি সেন্টার , একটু মানুষ বেশি। বাট এরা কেউ কারো শত্রু নয়।”
“আমার কেমন যেন লাগছে অ্যাড। চলো ফিরে যাই।”
“রিলাক্স বিইভা। আমরা ও সবার মতো ঘুরতে এসেছি। টেক ইট ইজি।”
কথা টা বলেই বিভার হাত ধরে অ্যাড। বিভা আশে পাশে তাকিয়ে হাঁটতে থাকে। কেমন কেমন লাগছে তার। চোখ দুটি তে ভয়। অচেনা শহরে নিজেকে ভিনদেশী নয় বরং ভীন গ্রহের প্রানী মনে হচ্ছে।
গ্রোসারি শপে চলে এসেছে অ্যাড। বিভা থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে দেখে গলা উঁচিয়ে ডাকল,
“বিইভা হোয়াট হ্যাপেন? ভেতরে আসো।”
শপের ভেতরে আসে বিভা। চারিদিকে চোখ বুলায় অ্যাড। খাবারের বিষয়ে তেমন আইডিয়া নেই ওর। তাই বিভার দিকে তাকিয়ে বলল, “কোনটা তোমার জন্য হালাল আমি জানি না। তুমি তোমার মতো করে তুলে নাও।”
“তুমি জানলে কি করে?”
“এমিলি বলেছে আমায়। তুমি মুজলিম, আর মুজলিম রা সব ধরনের ফুড খায় না। তাই তুমি এক সপ্তাহ তেমন কিছুই খেতে পারো নি।”
“ধন্যবাদ অ্যাপ। আমার ভিনদেশে ল্যাম্পপোস্ট হয়ে আলো ছড়ানোর জন্য। আই উইস সেই আলো পৃথিবীর সবার জীবনে ছড়িয়ে যাক আর আমি ও এমন ভাবেই আলোকিত হই।”
ঝরঝরে হাসে অ্যাড। বিভা কে চোখের ইশারায় ফুড কালেক্ট করতে বলে। সাধারন কিছু সবজি আর মাছ নিয়ে নেয় বিভা। এখানে থাকা মাং স তার জন্য হালাল নয়। তাই সেগুলোর দিকে ফিরে ও তাকায় না।
আয়ারল্যান্ড একটি ছোট্ট দেশ আয়তন মাত্র ৭০ হাজার বর্গকিলোমিটার। চার পাশে পানি উথাল-পাথাল করে। রয়েছে অসংখ্য পাহড়-পর্বত, বেশ কয়েকটি নদী এবং অনেক হ্রদ। দক্ষিণে ও পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর, আড়াই হাজার কিলোমিটার অতিক্রম করলেই দেখা মিলে আমেরিকার। আইরিশরা প্রধানত ক্যাথলিক ক্রিশ্চিয়ান। এরা খুবই ভদ্র, নম্র ও অতিথিপরায়ণ। আয়ারল্যান্ডের মোট জনসংখ্যা মাত্র ৫০ লাখের কাছাকাছি। আয়ারল্যান্ডের প্রধান ক্রীড়া-সকার এবং রাগবি।
গ্রোসারি কমপ্লিট করে অ্যাডের কাছে চলে আসে বিভা। অ্যাড ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত। একপলক তাকিয়ে বলে,
“কাউন্টারে সাবমিট করো আমি বিল পে করে দিব।”
“ওকে।”
কাউন্টারে বসে থাকা মেয়েটি নিঃসেন্দহে অসাধারন সুন্দরী। পর পর চোখের পলক ফেলে বিভা। সুন্দরী মেয়েটি আইরিশ ভাষায় কিছু একটা বলছে। বিভা বলল
“আমি তোমার ভাষা বুঝতে পারছি না। ইংরেজি তে বলবে প্লিজ।”
মেয়েটি হাসে। হাত বাড়িয়ে বলে
“আম লিয়া। আমি তোমাকে আইরিশ ভাষাতে সেটাই বলেছি।”
“ওহ আচ্ছা। আমি তানমীর বিভা।”
“ওহ নাইস নেম। তো বিভা তুমি কোন দেশ থেকে এসেছ?”
লিয়ার কথাতে হালকা ভালো লাগা কাজ করে। এক মাত্র লিয়া ই তার নাম টি সুন্দর ভাবে উচ্চারন করতে পেরেছে। বিভা গ্রোসারি গুলো রেখে বলল
“বাংলাদেশ।”
“ওহ আচ্ছা। তুমি আলু নাও নি?”
“আলু আমার পছন্দ নয়।”
“কি বলো এটা তো আমাদের প্রিয় খাবার।”
মৃদু হাসল বিভা। লিয়া প্রতিটা জিনিসের উপর ইলেকট্রনিক যন্ত্র দিয়ে দাম কালেক্ট করছে। এত সময় পর ভালো লাগছে তার। একটা মিষ্টি অনুভূতি হচ্ছে।
আলু আইরিশদের প্রধান খাদ্য। কত শত প্রকারের খাবার যে আলু দিয়ে তৈরি হয় তার সীমা নেই। আয়ারল্যান্ডের মাটি চাষবাসের জন্য খুব একটা উপযোগী নয়। পাথর আর কঙ্কর মিশ্রিত থাকায় ফসল ফলানো কঠিন। ১৮৪০-এর দশকে আয়ারল্যান্ডে ঘটে যায় এক মর্মান্তিক ঘটনা। কয়েক বছর আলু ও অন্যান্য উৎপাদন মারাত্মক মা র খায়। এক ধরনের রোগে আলু পচে যায়। খাদ্যাভাবে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এতে প্রায় ১০ লাখ লোক মা রা যায়।
আয়ারল্যান্ড বাংলাদেশের মতোই ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল দীর্ঘদিন। ১৯২১ সালে দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে। এদের রাষ্ট্রভাষা দুটো ইংলিশ ও আইরিশ গ্যালিক। আইরিশদের জাতীয় পতাকার তিনটি রঙ এর মধ্যে দুটো রঙ দুটো ধর্মকে প্রতিনিধিত্ব করে। সবুজ রঙ রোমান ক্যাথলিক এবং কমলা রঙটি প্রোটেস্ট্যান্টদের। সাদা রঙটি ঐক্যের প্রতীক। জলবায়ু নাতিশীতোষ্ণ, মৃদু শীত, ঠান্ডা গ্রীষ্ম, নিয়মিত আদ্রতা, অর্ধেক সময় থাকে মেঘাচ্ছন্ন।
আয়ারল্যান্ডের উচ্চতর শিক্ষা ব্যবস্থা সুযোগ অনেক বিস্তৃত এবং চতুর্দিকে বিশ্ববিদ্যালয় সেক্টর, প্রযুক্তিগত ক্ষেত্র,শিক্ষার জন্য প্রাইভেট কলেজ ও স্বতন্ত্র কলেজ। প্রতিষ্ঠানগুলো যা প্রথম তিনটি গ্রুপের মধ্যে পড়ে, স্বায়ত্তশাসিত এবং স্ব নিয়ন্ত্রক, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রই তহবিল প্রদান করে। জ্ঞান বা বিদ্যা, নব্য ধ্রুপদী এবং নব্য গোথিক শৈলীতে ১৭, ১৮ এবং ১৯ শতকে নির্মিত মহিমান্বিত বাসগৃহ যেমন-কাসল ওয়ার্ড, কাসলটাউন হাউস, বেনট্রি হাউস ও পর্যটকদের আগ্রহের কারন।
আয়ারল্যান্ডের নারীদের ৩৬ শতাংশ প র কী য়া য় জড়িত। এখানে ব্রোথেল এর জন্য আলাদা করে রুলস রয়েছে। মুক্ত ভাবেই অনেক ব্যবসায়ী ব্রোথেল চালায়। যার বিরুদ্ধে রয়েছে কিছু সংস্থা। তার ই একটি হলো ল্যাম্পপোস্ট। খ্রিস্টান হলে ও এই সব বিষয়ে বেশ কঠোর অ্যাড। তাই তো দীর্ঘ ছয় বছর ধরে এই সংস্থা পরিচালনা করে চলেছে। অ্যাডের ইচ্ছে বিভিন্ন দেশের কল্যান সাধনা করা। ছাব্বিশ বছর বয়সী এই তরুন সাফাল্য ও পেয়েছে। তবে তার কাজের বিপক্ষে রয়েছে তার নিজের ফ্যামিলি!
রাতের আলোতে ডাবলিন শহরকে দিনের চেয়েও সুন্দর মনে হয়। আলো ঝলমল রাতের আঁধারে শত শত পর্যটক ক্যামেরা কাঁধে ঝুলিয়ে ছবি তুলতে ব্যস্ত সময় পার করেন।
সাহিত্যের জন্য ডাবলিন একেবারে অন্যরকম। খানকার সাহিত্য আসরগুলো শুড়িখানার মতো। সাহিত্য আর সুরায় এক অনবদ্য মিল যেখানে উপভোগ করার মতো। ‘ডাবলিন লিটারেরি পাব ক্রলে’ যে কেউ ঢুকে যেতে পারে। পানশালা আর সাহিত্য এখানে একাকার। একেবারে আনন্দের মধ্য দিয়ে সাহিত্য। এই ডাবলিন শহরেই আসতেন জেমস জয়েসের মতো বিখ্যাত আইরিশ ঔপন্যাসিক ও কবি সাহিত্যিকরা।
ম্যাগাজিন পড়ে এই সব ই জানতে পারল বিভা। বাসায় ফিরে এসে ক্লান্ত হয়ে পড়ল মেয়েটি। মনের অবস্থা ও ভালো নয়। এদিকে কোনো ফোন ও নেই তার কাছে। বার বার এমিলির ফোন চাইতে ও লজ্জা করে। থম থমে মুখ করে বসে আছে মেয়েটি। চোখের কার্নিশে পানি জমেছে। সারাক্ষন কেঁদেই সময় যায়। হন্ত দন্ত হয়ে আসে অ্যাড। বিভা শুধায়,
“কি হয়েছে অ্যাড?”
“তোমার খাবার টা রান্না করতে পারছে না এমিলি। যে যে জিনিস এনোছ তাতে কোনো রেসেপি ওদের জানা নেই। তুমি তো সেদ্ধ খাবার খেতে পারো না।”
“আমি ও রান্না করতে পারি না। বাসায় নুডলস আছে?”
“ইয়েস। বাট তুমি কি এটাই খাবে?”
কাউচ থেকে উঠে দাঁড়ায় বিভা। বলবে কি বলবে না দ্বিধায় পড়ে। অ্যাডের সামনে এসে কাঁচুমাচু করতে থাকে। লম্বাটে দেহের অধিকারী অ্যাডের দিকে তাকাতে মাথা উঁচু করতে হয়। সে বলল,
“আমি কি তোমার ফোন টা পেতে পারি? সেখানে বাঙালি খাবারের রেসিপি দেখে নিব।”
“ওহ দ্যাটস গ্রেট। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম তোমার ফোন নেই। কাল এনে দিব। এখন আমার ফোন থেকেই রেসেপি দেখে নাও।”
“ধন্যবাদ অ্যাড , তুমি না থাকলে আমি আজ কিছু পৈশাচিক মানুষের খাদ্য হয়ে যেতাম।”
“বিইভা এমন টা বলতে নেই। গড তোমাকে দেখার জন্য আমাকে এনজেল হিসেবে পাঠিয়েছেন। ডোন্ট ওরি আমি তোমার ক্ষতি হতে দিব না। ল্যাম্পপোস্ট হয়ে তোমার পাশে থাকব। সর্বদা আলোয় ঝলমলে কোরো তুমি।”
চলবে…..
কলমে ~ ফাতেমা তুজ নৌশি