ল্যাম্পপোস্ট পর্ব -০৬

#ল্যাম্পপোস্ট ( ৬ )

আজ রাতে কানাডার উদ্দেশ্যে রওনা হবে অ্যাড আর বিভা। এমিলি আর এলার মন খারাপ। এই কয়েক দিনে যেন খুব আপন হয়ে গেছে। বিভার মনে ও দাগ কেঁটে গেছে। এমিলি আর এলা কে জড়িয়ে ধরে। এমিলি বলে উঠে।
“বিদায় বেলা মন খারাপ করতে নেই। সম্ভব হলে আবার এসো আমার শহরে।”

“অবশ্যই আসব এমিলি। তোমাদের ভোলা যায় বলো?”

“ব্রিভা তোমাকে আমি খুব পছন্দ করি।”

“ওহ এলা আমি ও তোমাকে পছন্দ করি প্রিয়। আবার দেখা হবে আমাদের।”

এলার চোখে পানি চিক চিক করে। এলার বয়স বছর একুশ আর বিভার বয়স বাইশ। দুজনে সমবয়সী ই বটে। অন্য রকম সম্পর্ক দুজনের। বিভার চোখ ফেটে জল গড়ায়। একটু করে হেসে বিদায় জানায় সকল কে।

আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ডাবলিনের কাছেই বেলফাস্ট শহর। এখান থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টার রাস্তা লিমরিক, আয়ারল্যান্ডের ছোট্ট একটা শহর। লিমরিকে বিনা নোটিশে সারা বেলা বৃষ্টি হয়, অবশ্য মন চাইলে রোদও উঠে মাঝে মধ্যে। ঠান্ডা বাতাস বেরসিকের মতো শরীরে কাঁপুনি দেয়। লিমরিকের এক অংশে রয়েছে আবার আটলান্টিকের বিশালতা, আরেক অংশে দিগন্তবিস্তৃত পাহাড়। ভেড়ার খামার আর সরিষার খেত প্রকৃতিজুড়ে। সবুজের যেন শেষ নেই এই লিমরিক শহরে। রাস্তার পাশে টিউলিপের বাগান আইরিশ শহরের অন্যতম আকর্ষণ। বিভা অ্যাড কে প্রশ্ন করল।
“আমার জন্য অনেক টাকা খরচ হচ্ছে তাই না? আমি তোমাকে সব টাকা ফেরত দিয়ে দিব।”

“সত্যি ফেরত দিয়ে দিবে?”

কথাটা রসিকতার স্বরেই বলে অ্যাড। বিভা লম্বা করে শ্বাস নিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলে
“হ্যাঁ।”

“শোধ দিবে তাই না?”

“তেমন টা নয় অ্যাড। আমি তো শুধু বলছিলাম।”

বিভা কথা টা পূর্ণ করতে পারে না। তার আগেই সজোরে ব্রেক কষে অ্যাড। বিভার দিকে তাকিয়ে বলে
“প্লিজ বিইভা এই বিষয় নিয়ে আর কোনো কথা বলবে না। আমি রেগে যাব।”

“কিন্তু অ্যাড।”

“স্টপ ইট বিইভা।”

ধমক খেয়ে দমে যায় বিভা। অ্যাডের চোখে মুখে হতাশা। গাড়ি থেকে নেমে আসে সে।
“স্যরি অ্যাড। এখানে নেমে গেলে কেন?”

“ক্লিফ অব মোহের দেখার জন্য।”

“সেটা কি?”

“দেখলেই বুঝবে,আসো।”

গাড়ি থেকে নেমে যায় বিভা। অ্যাড আশে পাশে চোখ বুলিয়ে নেয়। সন্তপর্নে বিভার হাত টা নিজের হাতের মাঝে আবদ্ধ করে। বাদামি রঙা চুল গুলো উল্টে নেয়। তারপরই জ্যাকেট এর টুপি টা মাথায় দিয়ে নিল। অ্যাডের কান্ডে প্রশ্ন করে বিভা।
“কি হয়েছে অ্যাড?”

“আমাকে আড়ালে থাকতে হয় বিইভা। আয়াল্যান্ড এর কিছু সাংঘা তিক লোকজন আমাকে মা রা র জন্য সর্বদা অপেক্ষা করে আছে।”

“কি বলছ অ্যাড! এখান থেকে চলে যাচ্ছি না কেন আমরা?”

“লুকিয়ে বাঁচার জন্য আমাদের জন্ম নয়। ভালো কাজ করে লুকিয়ে থাকব কেন?”

“তোমার প্রা ণ সংশয়ে অ্যাড।”

উত্তর করে না অ্যাড। বিভার হাত ধরে সামনের দিকে আগায়।

বিশাল সাদা পাহাড়ের অংশ বুক উঁচিয়ে আটলান্টিকের উপর দাঁড়িয়ে আছে। নিচে অসংখ্য সাদা শঙ্খচিল উড়ে বেড়াচ্ছে। সে যে পাহাড়ের উপর, আর পাখি যে নিচে উড়ছে, এটা ভেবেই আ ত্ম হারা বিভা। শুধু কি ক্লিফ অব মোহের? আয়ারল্যান্ডের অন্যতম আকর্ষণ রিং অব কেরি। এটা একটা পাহাড়ি রাস্তা। যার একপাশে আটলান্টিক, অন্যদিকে মালভূমি। রিং অব কেরি মূলত শুরু হয় গ্যাপ অব ডানলোর পর থেকে। গ্যাপ অব ডানলো হলো দুই পাহাড়ের মাঝখানে বিরাট এক হ্রদ। এর পরের যে আঁকাবাঁকা পথ, সেটা পাহাড় ঘুরে ঘুরে উঠে গেছে। প্যাঁচানো এই পথের নামই ‘রিং অব কেরি।’ রিং অব কেরির পথ যখন ওদের কে পাহাড়ের উপরের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন মনে হচ্ছিল পৃথিবীর বুকে ও এত সুন্দর জায়গা আছে! ঝিরিঝিরি ঠান্ডা বাতাস আর হলুদ বুনো ফুলের গন্ধে পাহাড়েই থেকে যাওয়ার এক প্রবল ইচ্ছা জাগল বিভার। পথের পাশে কোথাও দেখা যায় ঝর্ণা, আবার কোথাও নীল জলের হ্রদ। পাশে কালো আর লাল পাহাড়। সেই ঝর্ণার পাশে কিছু পরিবার তাঁবু গেড়ে বার-বি-কিউ করছে। উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় উঠলে দেখা যায় গোটা রিং অব কেরির এক অংশ। পাহাড়ের চূড়া থেকে ওরা যখন নিচে নামা শুরু করল তখন ওর দৃষ্টি পাত ঘটে আইরিশ ঐতিহ্যবাহী বাড়ি, পেছনে পাহাড়, সামনে ঝর্ণা। এরপর শুরু হয় বন। আর বনের বুক চিরেই রাস্তা। হঠাৎ দেখতে পেল একঝাঁক হরিণ রাস্তা পার হচ্ছে। যা দেখে লাফিয়ে উঠে বিভা। অ্যাড বলে,
“পড়ে যাবে বিভা। হিল পরেছো তুমি।”

“কিছু হবে না অ্যাড। আমার তো পাখির মতো ডানা মেলে উড়ে যেতে ইচ্ছে করছে।”

“তুমি পাঁচ বছরের বাচ্চা দের মতো করছো বিইভা।”

“অ্যাড আমি আকাশে মেঘের মতো ভেসে যাচ্ছি। পাহাড় টা এত সুন্দর কেন বলো তো?”

বিভার কথায় হাসে অ্যাড। নিজের সমস্ত দুঃখ ভুলে ছন্নছাড়া হয় বিভা। এক মুহূর্তের জন্য চোখ আটকে যায় অ্যাডের। নীল চোখের মনি তে শুধুই হাস্য উজ্জ্বল বিভার মুখখানি ভাসে। মায়াবী মুখের দিকে বেশিক্ষণ তাকাতে পারে না অ্যাড। চোখ নামিয়ে আশে পাশে দৃষ্টি পাত করে। কিছুক্ষণ পর বিভা বলে
“এই পথ দিয়ে গেলেই কি হরিণের দেখা পাওয়া যায়?”

“হ্যাঁ। চলো সামনে আগানো যাক।”

“ওকে।”

অ্যাডের পাশাপাশি হাঁটে বিভা। বিভা এত টাই আবেগে আপ্লুত যে ছবি তুলতেই ভুলে যায়। রাস্তার শেষ দিকে এসে মুখ গোমড়া করে বলে
“ভাগ্য খারাপ বলেই হরিনের ছবি তুলতে পারিনি।”

“বিইভা তুমি বার বার একি কথা বলো। এটা একদম ই উচিত নয়।”

“আচ্ছা স্যরি।”

যাত্রা এখানেই শেষ হয় না। কারণ রিং অব কেরির বাকি অংশ পড়েছে আটলান্টিকের পাশে। সবুজ গ্রাম, মাঠে সাদা ভেড়ার পাল ওদের কে রিং অব কেরির আরেকটা সৌন্দর্যে নিয়ে গেল। পাহাড়ের সরু আঁকাবাঁকা পথ, পাশে বিশাল খাদ, নিচে তাকালেই নীল সাগর। জল গুলো যেন বিশালতার প্রতিক হয়ে ছলছল করছে। কিছুদূর যেতে চোখে পড়ে সবুজ পাহাড়ের ওপর সাদা রঙের বাড়ি, আর সেই বাড়ির মুখ সাগরের দিকে। বারান্দায় বসে এক কাপ চা হাতে জীবনের অর্ধেক সময়ই যেন পার করা যাবে। এমনি ভাবনায় মত্ত হয় বিভা।

তখনি গায়ে সজোরে ধাক্কা প ড়ে বিভার। ছিটকে প ড়ে যায় সে। অ্যাড টেনে মাথা নিচু করে নেয়। মাথার উপর দিয়ে কয়েক ফালি বু লে ট ছুঁড়ে যায়। অ্যাডের হৃদপিন্ড কাঁপছে। বিভার মাথা টা একদম বুক বরাবর হওয়াতে সে শব্দ স্পষ্ট শুনতে পেল বিভা। অবাক দৃষ্টি তে অ্যাডের দিকে তাকায় মেয়েটা। অ্যাডের চোখে মুখে ভয়ের ছাপ! বিভার দৃষ্টি যায় অ্যাডের নীল মনি তে। স্বচ্ছ নীল মনি তে যেন এক সমুদ্র লুকিয়ে আছে। বেশ কিছুক্ষণ এভাবেই কেঁটে যায়। অ্যাড দেখতে পায় পুলিশ ছুটছে এই রাস্তা দিয়ে। বোধহয় কোনো চোর কে ধরতে বেরিয়েছে। আত্মায় পানি ফিরে পায় সে। বিভার দিকে তাকিয়ে বলে
“তুমি ঠিক আছ?”

“হ্যাঁ।”

“উঠ , জামা টা পরিষ্কার করো ময়লা লেগে গেছে।”

অ্যাডের কথা মতো জামা পরিষ্কার করে নেয় বিভা। লন্ডন থেকে বেলফাস্ট বেশি দূরের না। দেড় ঘণ্টার ফ্লাইটে খুব অল্প টাকায় বেলফাস্ট চলে যাওয়া যায় বাজেট এয়ারে। বেলফাস্ট থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টার গাড়ি চালিয়ে আয়ারল্যান্ডের শহর লিমরিক যাওয়া যাবে। ডাবলিনে বিশ্রাম নেওয়া যেতে পারে খাবার আর শহর ঘোরার জন্য। সেখানে সুবিধা থাকে বেশি তাই বিভা কে সেখানে রেখেছিল অ্যাড। তবে এখন সমস্যা হচ্ছে বিভা কে পার্সোনালি ট্রিট করছে সে। তাই সমস্ত সুবিধা থেকে এক প্রকার বঞ্চিত করতে হচ্ছে। যদি ও বিষয় টা ইন্টারন্যাশনাল ভাবে ট্রিট করা যেত। তবে বিভার বিষয় টা সম্পূর্ন অন্য রকম। মেয়েটা সম্পর্কে এখনো সঠিক অবগত নয় অ্যাড। তাই পাসপোর্ট করা হয় নি। তাছাড়া অনেক রকমের ভেজাল হতো তাতে। সময় ও লাগবে অনেক। যার ফলে ডাবলিন থেকে বিভা কে নিয়ে কানাডা যাওয়া যাবে না। এতে করে নানান ঝামেলা হবে। ভাইরাল হয়ে যাবে বিষয় টা। আর আয়ারল্যান্ডের এক দল হায়না অ্যাড কে আ ক্র মণ করার জন্য সুযোগ খুঁজে চলেছে। তাদের ব্রোথেলের ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে অ্যাড। যার ফলে অ্যাডের শত্রুর অভাব নেই। তাই তাঁরা লিমরিক এর পথে রওনা হলো। সেখান থেকেই বিভা কে নিয়ে কানাডায় পারি জমাবে।

চলবে….
কলমে ~ ফাতেমা তুজ নৌশি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here