ল্যাম্পপোস্ট পর্ব -০৭

#ল্যাম্পপোস্ট( ৭ )

কানাডার মাটি তে ফ্লাইট ল্যান্ড করতেই শীতের প্রকোপ যেন কয়েক গুন বেড়ে যায়। সাধারন একটা সোয়েটার গায়ে ছিল বিভার। শীতের কারনে দাঁতে দাঁত লেগে যাওয়ার মতো অবস্থা। অ্যাড নানা রকমের কথায় ব্যস্ত। চারদিকে কঠিন নজরদারি করা এর মাঝে ককপিট এ করে বিভা কে নিয়ে আসা মানে অসাধ্য সাধন করা। বিভার দিকে এক পলক তাকায় ছেলেটা। চোখে পড়ে নেতিয়ে যাওয়া বিভা কে। গোলাপি রঙের কোমল ঠোঁট টা আপাতত রুক্ষ একটা রূপ ধারন করেছে। যত্ন না নিলে অতি শীঘ্রই ঠোঁট ফেটে র ক্ত ঝরবে। সাথে কোনো জামা কাপড় নিয়ে আসা হয় নি। অ্যাড দ্রুত কাজ সম্পূর্ন করে বিভার হাতের তালু তে স্পর্শ করতেই কেঁপে উঠে তার শরীর। বরফ ঠান্ডা হয়ে গেছে হাত। দ্রুত গতিতে গাড়ির দিকে চলে আসে। গাড়িতে এসে হিটার ওপেন করে দেয়। যার ফলে স্বস্তি মিলে বিভার। কাঁপা ঠোঁট দুটো নাড়িয়ে বলে
“ধন্যবাদ। কানাডায় এত শীত পড়ে,জানা ছিল না।”

“আমি ও ভুলে গিয়েছিলাম। তুমি এই ঠান্ডা তে অভ্যস্ত নও। সামনের শপ থেকেই শীতের পোশাক কিনে নিব। এখন এই কফি টা নাও তো।”

অ্যাডের হাতে থাকা কফি দেখে চমকায় বিভা। বিগলিত হাসে অ্যাড। কেটলি থেকে ওয়ান টাইম গ্লাসে গরম পানি ঢেলে তাঁর মাঝে কফি পাউডার মিক্স করে। প্রচন্ড অবাকের সাথে বিভা বলে,
“ওয়াও এটা খুব ভালো আইডিয়া।”

“এটা এখানের রীতি বলতে পারো। প্রায় সবাই কেটলি সাথে ঘুরে।”

“ওহহ। অস্ট্রিয়া যেতে অনেক সময় লাগবে কি?”

“আমি চেষ্টা করব যথা সম্ভব কাজ সম্পূর্ন করার। তুমি সত্যি সিউর তোমার বয়ফ্রেন্ড বেঁচে আছে?”

“একটা নিউজ চ্যানেল থেকেই খবর টা সম্প্রচার হয়েছে। আর তারপর তেমন কোনো আপডেট ছিলো না। আরাজ খুব ভালো গান করে। ওর নাম ডাক রয়েছে প্রচুর। তাহলে এভাবে কি করে সম্ভব? আমার মনে হয় ওকে কেউ বিপদে ফেলেছে।”

বিভার প্রতিটা কথা মনোযোগ সহকারে শুনে অ্যাড। নিজের কর্মজীবনে ছয় বছরে এমন কেস আসে নি। স্বপ্ন গুলো পূরণ হয়েছে নিজ বুদ্ধির জোরে। তবে আজ বিভা কে সেফ রাখা আর সাহায্য করা যেন নিশ্বাস হয়ে গেছে। এ নিশ্বাসের ভরসা নেই, তবে বেঁচে থাকতেই হবে।

“অ্যাড! কি ভাবছ তুমি?”

“না তেমন কিছু না। তোমাকে বাসায় নিয়ে যাব ভাবছিলাম। কানাডায় একা রাখতে চাচ্ছি না।”

“ওহ”

গাড়ি ড্রাইভ করছে অ্যাড। বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে বিভা। চারপাশে ম্যাপল গাছের সারি। এ দেশে নাকি প্রথম এসেছিল ফরাসিরা। তাদের উদ্দেশ্য করে আদিবাসীরা আঞ্চলিক ভাষায় বলত ‘কানাডা’, যার অর্থ ‘আমাদের গ্রামে এসো’ সেখান থেকেই এ দেশের নাম হয়েছে কানাডা। কানাডিয়ানদের এই অভ্যর্থনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি অনাগত কাল থেকে তাদের সংস্কৃতিরই একটা অংশ। কানাডা উত্তর আমেরিকার উত্তরাঞ্চলের বেশির ভাগ এলাকা জুড়ে থাকা এক দেশ। আয়তনের দিক থেকে এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। তবে জনসংখ্যায় এর অবস্থান ৩৮তম। দেশটির বিভিন্ন শহরে প্রতি বছর হাজার হাজার দর্শনার্থী বেড়াতে আসেন।

কানাডার দক্ষিণ-পূর্ব অংশে অবস্থিত অন্টারিও প্রদেশের রাজধানী শহর ‘টরন্টো’। অর্থনৈতিক ভাবে কানাডার সবচেয়ে সমৃদ্ধ প্রদেশ অন্টারিও-র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর বলে এটি দেশটির অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়িক প্রাণকেন্দ্র। নিরাপত্তা, জীবনযাত্রার ব্যয়, বসবাসযোগ্যতা, ইত্যাদি বিবেচনায় বিশ্বের সেরা শহর টরন্টো। টরন্টো শহরটি অন্টারিও হ্রদের উত্তর-পশ্চিম তীরে অবস্থিত। শহরেও সবুজ উদ্যানের অভাব নেই। বেশিরভাগ বাড়ির সামনে ম্যাপল গাছ চোখে পড়ে। ম্যাপলের পাতা নাকি কানাডার প্রতীক। জাতীয় পতাকা থেকে শুরু করে প্রায় সব জায়গায় লাল ম্যাপল পাতার ছবি।

কানাডার সুন্দর দৃশ্য দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ে বিভা। ডুপ্লেক্স বাসার সামনে এসে গাড়ি পার্ক করে অ্যাড। পাশে তাকিয়ে দেখে ঘুমিয়ে আছে বিভা। প্রচন্ড মায়া লাগে তার। মেয়েটার চোখ মুখ কোটরে চলে গিয়েছে। বিভার দিক থেকে চোখ সরতেই জানালা দিয়ে দেখতে পায় এক কাপল কে। বিষাক্ততায় ছেয়ে যায় অ্যাডের মন। কানাডার কিছু রীতি নীতি একদম ই পছন্দ নয়। এখানে বিয়ের প্রয়োজন হয় না। এদের প্রথম কার্যক্রম লিভ টুগেদার করা। যার বেশি ভাগ ই বিয়ে অবধি গড়ায় না। আর একটা বিষয় একদম ই সহ্য হয় না সেটা হলো সকলের সামনে যাকে তাকে লিপ কিস করা। সামান্য প্রাইভেসির প্রয়োজন হয় না এদের!তাছাড়া প র কী য়া র মতো বাজে বিষয় কে ও এদেশ গুরুত্ব দেয় না। তারা শান্তি প্রিয় দেশ, তাদের কাছে রীতি মত এটাকে লিখিত ভাবেই সংবিধান দেওয়া হয়। নিজ দেশের প্রতি বিরক্তি এসে যায়। এক মুহুর্ত দেড়ি করে না ছেলটা। বিভা কে কোলে তুলে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে।

.

থিওডোরের মুখোমুখি হতেই দাঁড়িয়ে যায় অ্যাড। ভাই কে চোখের ইশারায় সব ম্যানেজ করতে বলে। অন্য দিকে মিস্টার হাডসন প্রচন্ড রেগে আছেন। ভিনদেশীর জায়গায় কোনো কানাডিয়ান থাকলে একটু ও রাগ করতেন না তিনি। মিসেস হাডসনের ভাব মূর্তি বোঝা যাচ্ছে না। সে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে ভিনদেশীর দিকে। থিওডোর চোখের ইশারায় ভেতরে যেতে বলে, অ্যাড চলে যায়। মিসেস হাডসন কিছু বলবে তার আগেই মিস্টার হাডসন ফরাসি ভাষায় বলেন
“অ্যাড এটা কি করেছে! কে এই মেয়েটা। এভাবে কোলে তুলে নেওয়ার কি প্রয়োজন ছিল।”

“ড্যাড তুমি শান্ত হও। আমরা সবাই অ্যাড এর কাজ সম্পর্কে অবগত। এটা নিয়ে অনেক ঝামেলা হয়েছে আজ আর ঝামেলা নয়।”

“থামো থিওডোর। তোমার ভাই আমাদের বিষয়ে একটু ও ভাবে না। সব কিছু তেই তার অন্য রকম ভাব। নিজের জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই।”

“মম তুমি তো জানো অ্যাড কেমন।”

মিসেস হাডসন কিছু বলবেন তার আগেই সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে অ্যাড। সবাই তার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে তাকায়। সে কোনো প্রকার ঝামেলা না করেই ম্যাপল ফল তুলে নেয়। হাতের মাঝে ম্যাপল ফল নাড়াচাড়া করতে করতে বলে,
“সী ইজ মাই রেসপন্সিবিলিটি। আমি চাই না ওর সামনে কেউ এমন আচরণ করো যাতে ওহ কষ্ট পায়।”

“অ্যাড!”

“কামন ড্যাড । তুমি জানো এই সব রীতি নীতি তে আমি অভ্যস্ত নই। সো প্লিজ , ওর ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়ে কেউ কথা বলবে না।”

“ওহ মুজলিম অ্যাড, তুমি কি করে…।”

“স্টপ মম। ওর জন্য খাবারের ব্যবস্থা করো। আর হালাল ফুড এর লিস্ট দিয়ে দিচ্ছি আমি।”

কথা টা বলে এক সেকেন্ড অপেক্ষা করে না অ্যাড। গট গট শব্দ তুলে উপরে উঠে যায়।

বিভার ঘুম ভেঙেছে কিছুক্ষণ পূর্বে। কম্বল জড়িয়ে উঠে বসে মেয়েটা। বোঝার চেষ্টা করে কোথায় আছে। হঠাৎ ভয় পেয়ে যায়। অ্যাড সম্পর্কে বাজে ধারনার সৃষ্টি হয়। দরজার কাছে হন্তদন্ত হয় ছুটে আসে। তখনি অ্যাড খিচে ধরে তার হাত। পেছন ফিরে ঝটকা মে রে সরিয়ে নেয়। র ক্ত লাল চোখে তাকায়। অ্যাডের গায়ে কোনো প্রীতিকর পোশাক নেই। পরনে তোয়ালে , উন্মুক্ত বুক পিঠে বিন্দু পানি বিন্দু জমে আছে। দৃষ্টি ফেরায় বিভা, চোখে মুখে হাত বুলিয়ে বলে
“তুমি আমার কোনো ক্ষতি করো নি তো?”

“বিইভা! তুমি আবার , উফফ আমি তোমাকে বাঁচিয়ে ছি বিইভা।”

চক্ষু লজ্জায় পড়ে বিভা। পেছন ফিরে বলে
“তোমার গায়ের শার্ট কোথায়?”

“আমি শাওয়ার নিচ্ছিলাম। তখনি দরজা খোলার শব্দ পাই। তুমি তো ভয় পেয়েই গিয়েছিলে। তাই এভাবে চলে আসি।”

“কিন্তু আমি এখানে কি করে? এটা কোথায়?”

“এটা আমার রুম। আমি তোমাকে নিয়ে এসেছি। তোমার জন্য রুম সেট করা হচ্ছে।”

চুপ হয়ে যায় বিভা। আবারও ভুলে বুঝেছিল সে। তার উষ্ণ শ্বাসে ভরে উঠেছে চারপাশ। কিছু সময় পর ব্যলকনিতে চলে আসে। হালকা শিরশিরে বাতাসে গা ঝম ঝম করছে। চেরি গাছের কয়েক সারি দেখা যাচ্ছে। লাল লাল চেরি দেখে মন ভালো হয়ে যায় হুট করে। চোখ বন্ধ করে আরাজের কথা ভাবে। কি হয়েছে আরাজে?
সে কি সত্যি কোনো বিপদে আছে? নাকি অন্য কিছু। কল্পনা করতে পারে না বিভা। চোখের কার্নিশ বেয়ে অশ্রু নেমে যায়। আঁধার ঘনিয়ে আসে। চারপাশে জ্বলে উঠে কৃত্রিম আলো। যে আলো তে অশ্রু বিসর্জন দেওয়া খুব ই সহজ কাজ।

চলবে….
কলমে ~ ফাতেমা তুজ নৌশি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here