#এ_মন_মেলুক_পাখনা 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০২
“অভ্র স্যার, আপনি এখানে কী করেছেন? কিছুক্ষণ পূর্বে না আপনাকে অফিসে দেখলাম। এর ভেতরে এখানে চলে এসেছেন?” বলতে বলতে রাস্তা পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম অভ্র স্যারের কাছে। ফুলের দোকানের সামনে উদিতাকে নিয়ে ফুল কিনছেন।
অভ্র স্যার আমাকে দেখে না দেখার ভান করলেন। উদিতার দিকে তাকিয়ে ফুলের টাকা দিল ফুল ওয়ালীকে। ‘আমাকে ইগো দেখাচ্ছে’ ভেবে উল্টো পথে ধরলাম। অতঃপর থেমে গিয়ে নিজেকে শান্ত করলাম, ‘মোম, চাকুরিটা তোর অনেক প্রয়োজন। এতদিন মামার জমিতে থেকে যত শরিষা দিয়ে তেল বানিয়েছিস, সবগুলো অভ্র স্যারকে দে।’
পৌঁছে গেলাম সামনে। উদিতার গাল টেনে দিয়ে বললাম, “কিউট উদিতা কেমন আছে?”
উদিতা জবাব দিচ্ছে না। বাবা আর মেয়ে একই ধাঁচে তৈরি। কুল মোম! কুল! অভ্র স্যার ভ্রু কুঁচকে বললেন, “আপনি কে? স্যরি, ঠিকঠাক চিনলাম।”
“এমা! আমি মোম। একটু আগে ইন্টারভিউ দিয়ে এলাম, ভুলে গেছেন। আপনার জন্য দুদিন থা/নায় ছিলাম, এটাও ভুলে গেছেন?” বলেই মাথায় হাত দিলাম। অভ্র স্যার মাথা চুলকে প্রত্যুত্তর দিলেন, “আচ্ছা, কেন থা/নাতে পাঠিয়ে ছিলাম?”
“আমার মামি প্রচুর সিরিয়াল দেখে। রাঙা বউ নামের একটা প্রোমো দেখেছি, নায়কের ভুলে যাওয়ার রোগ আছে। আপনারও কি তেমন রোগ আছে?” আমার কথাতে অভ্র স্যার হাসলেন। অপূর্ব সুন্দর হাসি তার। গালে টোল পড়েছে। চুলগুলো কোঁড়কানো, উদিতা যেন স্যারের পরিচয় বহন করছে। হঠাৎ করেই উদিতাকে দেখতে পেলাম না। আশেপাশে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম দুজনে। অভ্র স্যার বললেন, “উদিতা কোথায় গেল? উদিতার কিছু হয়ে গেলে, ভাইয়া আমাকে মে/রেই ফেলবে।”
“ভাইয়া? উদিতা আপনার মেয়ে না?”
“না!”
ব্যস্ত রাস্তার মাঝখানে ছুটে চলেছে উদিতা। ওপর পাশ থেকে চলন্ত ট্রাক এগিয়ে আসছে। অভ্র স্যারকে রেখেই ছুটে গেলাম সেদিকে। উদিতার হাত টেনে লাফ দিলাম। মুখ থুবড়ে পড়লাম রাস্তায়। উদিতা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে আমাকে আঁকড়ে ধরে আছে। দৃঢ় করে আঁকড়ে ধরে রাস্তায় বসে রইলাম। অভ্র স্যার ততক্ষণে এসেছেন এপাড়। উদিতাকে কেড়ে নিয়ে দিলেন এক ধমক, “এক চ/ড় মা/র/ব। এভাবে রাস্তার মাঝে ছোটাছুটি করছিস, কিছু হয়ে যেতে পারতো।”
উদিতা কেঁদে দিল। অভ্র স্যার সামলাতে লাগলেন। পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, “না! না! উদিতা, তোমাকে কেন মা/র/ব? নিজেকে মা/র/ব। প্লীজ কেঁদো না। তোমাকে আমি অনেক চকলেট কিনে দিবো।”
পরক্ষণেই উদিতার কান্না থেমে গেল। অভ্র স্যারের কাঁধে মাথা রেখে আছে। বাম হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “ধন্যবাদ মিস্ মোম। উঠে আসুন।”
কাঁপা কাঁপা হাত তার করতলে রেখে ভর দিয়ে উঠলাম। টান লাগল পায়ে। পায়ের দিকে তাকাতেই দেখলাম সালোয়ার অনেকটা ছিলে গেছে। নির্ঘাত পা-ও ছিলে গেছে। রাস্তার ধারে পরে আছে আমার জামা কাপড়ের ব্যাগ। ব্যাগটা তুলে কাঁধে নিলাম। ড্রাইভার চলে এসেছে। অভ্র স্যার উদিতাকে ড্রাইভারের কাছে দিলেন। আগ বাড়িয়ে বললেন, “আপনার হাঁটু ছিলে গেছে মিস্। হাঁটতে পারছেন না। চলুন আপনাকে বাড়িতে পৌঁছে দেই।”
“বললাম না সকালে, আমি এই শহরে নতুন। এখনো বাড়ি ভাড়া নেই নি। এখন নিবো।”
“এই অবস্থায় বাড়ি ভাড়া খুঁজতে যাওয়া অসম্ভব মিস্! চলুন ফার্মেসীতে যাই। (ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে) আপনি উদিতাকে কয়েকটা চকলেট কিনে গাড়িতে বসুন। আমি একটু ফার্মেসী থেকে আসছি। ঊষার স্কুলে যেতে হবে।”
অভ্র স্যারের সাহায্যে একটা ফার্মেসীতে এলাম। ডাক্তার ইনজেকশন দিয়েছেন। ব্যান্ডেজ করে দিয়েছেন। বাড়ি ভাড়া নিতে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। আমি রাজি হলাম না। বলা যায় না, রাতে ডা/কা/তি করতে পারে। বিল পরিশোধ করে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলেন তিনি। আমি চরম কিপ্টা মানুষ, তাই একবারও বিল সাধলাম না। ফার্মেসীতে আরও আধ ঘণ্টা বসে রইলাম।
বারান্দায় বসে আছি। ঘরে আলো নেই, কারণ বাতি নেই। আমি যা কিপ্টা মানুষ, মনে হয় না এত তাড়াতাড়ি বাতি কিনবো। দুটো কামরার ফ্লাট, একটা ওয়াশরুম, একটা রান্নাঘর, একটা ড্রয়িং রুম, এক রুমে বারান্দা। প্রচুর গরম লাগছে। এই নিয়ে তিনবার গোসল করেছি। একটা ফ্যান কিনতে হবে। নতুন এসেছি বলে বাড়ি ওয়ালী রাতে খাবার দিয়ে গেছেন। জামা কাপড়ের ব্যাগটা মাথায় দিয়ে শুয়ে পড়লাম বিছানায়। লাল রঙের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে একটা কথাই ভাবলাম, “থা/নাতে থাকতে পারলে ঘর ভাড়া দিতে হতো না।”
__
সকাল আটটা আটান্ন মিনিট। সূর্য তার আলোতে আলোকিত করেছে পৃথিবী। হাই তুলে উঠে বসলাম আমি। ব্যস্ত নগরীতে সবাই ছুটছে কর্মস্থলে। হাই তুলে উঠে বসলাম আমি। বাটন ফোনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই হতভম্ব হলাম আমি। তড়িগড়ি করে উঠে বসলাম। ব্যাগ থেকে থ্রি পিস বের করে পড়ে নিলাম। চুলগুলো দুহাতে বেনুনি করলাম। হালকা লিপস্টিক দিয়ে তৈরি হলাম। পার্স ব্যাগ হাতে নিয়ে বের হলাম বাড়ি থেকে দরজায় তালা ঝুলিয়ে পা ফেলতেই মনে হলো ব্রাশ করা হয়নি। তালা খুলে ব্রাশ নিলাম। পুনরায় তালা ঝুলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ব্রাশ করতে লাগলাম।
নয়টা পনেরোতে অফিসে এসে পৌঁছালাম। ফ্যাশন হাউসে পা রাখতেই চিৎকার চ্যাঁচামেচির শব্দ শুনতে পেলাম। কর্মীরা ভিড় করে আছে অভ্র স্যারের চেম্বারের বাইরে। ভেতরে কাউকে মা/র/ছে। কৌতুহল নিয়ে একটা মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে আপু? এত ভিড় কীসের?”
“আর বলো না, আমাদের নিউ কালেকশন ডিজাইন লঞ্চ করা হয়েছে। কালকে মডেলকে দিয়ে নিউ কালেকশন স্যুট করাও হয়েছে। সেই ফটো স্যারের চেম্বারে জমা দেওয়া হয়েছে। সেই ছবি চেক করতে গিয়ে একটা মেয়ের আপত্তিকর ছবি স্যারের হাতে পড়েছে। একদম বাজে। যে মেয়েটার ছবি স্যু/ট করা হয়েছে সে আমাদের মডেল নয়। একজন ফ্যাশন ডিজাইনার। তার অনুমতি ব্যাতিত তোলা হয়েছে। এজন্য আধঘণ্টা ধরে স্যার তাকে মা/র/ছে।” বলতে বলতে মেয়েটা আড়চোখে চেম্বারের দিকে তাকাচ্ছে। আমি দরজাটা মৃদু ফাঁক করলাম। আচমকা ফটোগ্রাফার আমার সামনে এসে পড়ল। আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে পা জড়িয়ে ধরল। চমকে উঠলাম আমি। সরাতে সরাতে বললাম, “একি করছেন? পা ছাড়ুন বলছি।”
“ছাড়ব না। আমাকে আগে ক্ষমা করুন। আপনি ক্ষমা না করলে স্যার আজকে আমাকে আস্তো রাখবে না।”
“ঠিক আছে, ঠিক আছে। পা ছাড়ুন।”
ফটোগ্রাফার উঠে অভ্রর সামনে গিয়ে বলল, “ম্যাম আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছে স্যার। আমি এবার যাই।”
অভ্র স্যারের মা/রে ফটোগ্রাফারের জিওগ্ৰাফি পাল্টে গেছে। জায়গায় জায়গায় কালো হয়ে গেছে। অভ্র স্যার আঙুল তুলে বলেন, “যা, তবে তোকে আর আমার আশেপাশে না দেখি। তোর বকেয়া বেতন পরিশোধ হবে না। বেরিয়ে যা।”
কপালের শিরা ফুটে উঠেছে। চোখজোড়া টলটলে। ঘেমে গেছেন। জিনিসপত্র ভেঙে পড়ে আছে। ফটোগ্রাফার ছুটে পালিয়ে গেল। দরজায় মৃদু শব্দ হলো। অভ্র ছুটে এলেন নিকটে। হাতের পার্স ছুড়ে ফেলে দিয়ে চ্যাঁচিয়ে বললেন, “আমাদের এখানে তিনটা ওয়াশরুম। আপনার শরীরে যখন পানি পড়েছিল, তখন একটাও খালি ছিল না? প্রকাশ্যে..
হতবাক হলাম। তিনি জানলেন কিভাবে, আমার শরীরে পানি পড়েছিল। দরজা মৃদু ফাঁক। সবাই সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অভ্র উঠে দরজার কাছে গেলেন। উচ্চ স্বরে বললেন, “এখানে সিনেমা চলছে? সবাই কাজ ছেড়ে এখানে কী করছেন? এখানে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য আমি স্যালারী দেই না। যে যার কাজে যান।”
অবিলম্বে ফাঁকা হলো পরিবেশ। কাজে ব্যস্ত হলো সবাই। উচ্চ শব্দে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বললেন, “আসতে দেরি হলো কেন?”
“আগেই এসেছি, ভয়ে ভেতরে আসি নি।”
“মিথ্যা বলছেন কেন? আমাদের এখানে সব জায়গাতে সিসি ক্যামেরা লাগানো। আপনি কখন এসেছেন আমি দেখেছি। পনেরো মিনিট লেটে এসেছেন। প্রথম দিনই অনিয়ম করেছেন, পরের দিন তো বাদ দিলাম। আমার অফিসে অনিয়ম হলে, আর কাজে আসবেন না।” অভ্র স্যারের ধমকে কেঁপে উঠলাম আমি। নতজানু হয়ে বললাম, “স্যরি স্যার। এই ভুল আর হবে না।”
“ফাস্ট এন্ড লাস্ট ওয়ার্নিং। এগুলো নিয়ে যান।” টেবিলের উপর রাখা ছবিগুলো আমার দিকে এগিয়ে দিল অভ্র স্যার বললেন। হাত বাড়িয়ে নিলাম। আড়চোখে নজর বন্দি হতেই হাত ফসকে গেল ছবিগুলো। ততক্ষণে অভ্র স্যার হাত আলগা করে দিয়েছেন। মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল ছবিগুলো। মাথা ভনভন করে উঠল। রীতিমত কাঁপছে শরীর। মাথা ঘুরছে। অতিরিক্ত টেনশন আমি নিতে পারি না। অতিরিক্ত টেনশন করলে চেতনা হারিয়ে ফেলি। সবাই বলে জন্মের সময় আমার ভুবন কাঁপানো চিৎকার শুনে নার্স হাত থেকে ফেলে দিয়েছিল আমাকে। কিন্তু আমার মনে হয়, নার্স হাত থেকে ফেলে দেওয়ার পর আমি ভুবন কাঁপানো চিৎকার করেছিলাম। সেই থেকেই স্বল্প টেনশনে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।
চেতনা হারিয়ে লুটিয়ে পড়তেই ধরে ফেললেন অভ্র স্যার। গালে মৃদু চপল দিয়ে বললেন, “মোম, এই মোম। অ্যানিথিং রঙ?”
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]