একমুঠো বসন্ত পর্ব -১৫+১৬

#একমুঠো_বসন্ত
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_১৫

চেরি ব্লসম!জাপানিরা অপেক্ষায় থাকেন এই বসন্তের জন্য। কারণ হাজারো চেরি ফুলের কুঁড়ির প্রস্ফুটনে আগমন ঘটে এ সময়ে। জাপানের বসন্তের প্রধান আকর্ষণ হলো চেরি ফুল।

সাধারণত গোলাপি, সাদা ও লাল রঙের ফুলের প্রাধান্য বেশি দৃষ্টিগোচর হয় চেরিতে। এক বিচিত্র গড়নের পাপড়ি দেখা যায় ফুলগুলোতে। সেই সঙ্গে গাছে গাছে আনন্দে মেতে ওঠে পাখপাখালি ও হরেক প্রজাতির রঙিন প্রজাপতি। এ সময়ে কেরিয়ার প্রতিটি প্রান্তে হয়ে ওঠে চেরি ফুলের স্বর্গরাজ্য। হাজার বছর ধরে এই ফুলকে নিয়ে কোরিয়ানরা রচনা করে চলেছে চিত্রকর্ম, সাহিত্যকর্ম, গানসহ অনেক কিছুই। চেরি যেমন বসন্তের আগমনী গান শোনায়, তেমনি চেরি ফুলের মাধুর্য কোরিয়ানদের চিন্তাচেতনা ও সৌন্দর্যবোধের জোগান দেয়।

নিহিলা গাড়ি থেকে নেমেই উৎফুল্ল হয়ে গেল। কী সুন্দর! এতদিন শুধু ভিডিও, ছবি এসবে দেখে মনের তৃষ্ণা মিটাতো আর আজ পুরোপুরি সামনে! চারদিকে মানুষে গিজগিজ করছে। এটি মূলত ব্লসম ফেস্টিভ্যাল হানামি নামে পরিচিত। যেটির অর্থ ফুল দেখা। এটি জাপানের একটি ঐতিহ্য এর মতো হয়ে গিয়েছে। প্রায় সব মানুষই তাদের পরিবার-পরিজন, বন্ধু বান্ধব নিয়ে নিয়ে ফুল ফোটানো উপভোগ করতে আসেন অথবা প্রিয়জনদের সাথে সময় কাটাতে আসেন। নিহিলা তাকিয়ে দেখলো পাশেই একটি সরু নদী বয়ে গেছে। নদীর পাশেই চেরি ফুলের গাছের বিশিষ্ট লাইন। আর সেই গাছে সাদা গোলাপী চেরির সমাহার। নিহিলা আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো। চারপাশে অনেক মানুষের দল। একেক দলে একেক আড্ডা। কোনো দল কথা বলতে বলতে উচ্চস্বরে হেসে সময়টা ভালোভাবেই উপভোগ করছে আবার কোনো দল চুপচাপ বসে থেকে সময় উপভোগ করছে। নিহিলা অদূরে তাকিয়ে দেখলো এক বৃদ্ধ আর বৃদ্ধা নদীর কিনারায় বসে সময়টা উপভোগ করছে। তার ভালো লাগলো ভীষণ। তাদেরকে ক্যামেরাবন্দী করে নিয়ে সে আবারো পরিবেশ দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। নিহিলা একটু অদূরে গিয়ে দাঁড়ালো। প্রায় অনেক মানুষ এখানে। সবাই এই স্থানটাকে বেছে নেয়ার কারণ সে খুঁজে পেল। এইতো এই স্থানটা হয়ত বেশিই মনকারা। কারণ পাশেই একটি নীরব নদী বয়ে গিয়েছে। এক পাশে নদী আর নদীর পাশে সালা গোলাপী মিশ্রনের চেরি ব্লসম গাছের বিশিষ্ট লম্বা লাইন। যেগুলোতে ফুলের সমাহারে ভরে গেছে। নিহিলা আশেপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলো সবাই এই সময়টাকেই হয়ত বেশি উপভোগ করে। তাই হয়ত রাহান ভাইও এই জায়গাটিতে নিয়ে এসেছে। রাহানের কথা মনে পড়তেই সে চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকালো। প্রতিটা জায়গায় গোল টেবিল ঘিরে ঘিরে মানুষ বসে আছে। নিহিলা সামনে তাকাতে নিতেই দেখলো তার একটু দূরেই রাহান পকেটে হাত গুটিয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। নিহিলা আর ঘাটলো না। সে এগিয়ে গিয়ে অরিন আর আহানের সাথে বসলো। অরিন আর আহান তাদের বাবা মায়ের ছবি তুলে দিচ্ছে। আহান একেক অঙ্গভঙ্গি শিখিয়ে দিচ্ছে আর রিনা আহমেদ লজ্জায় গুটিয়ে যাচ্ছে।

“আরে মা? এই ভঙ্গিমাটা করো।” বলেই আহান নিহিলার কাঁধের উপর হাত দিয়ে দেখিয়ে দিল।

“তোদের এমন ভঙ্গিমা আমি পারবো না।”
“আরে মা, একটু আধুনিক হও।”

“দেখছো না, বাবা কত আধুনিক হয়ে যাচ্ছে।” বলেই আহান বাবাকে চোখ মারলো।
ছেলের কথায় শফিক আহমেদ ভাব নেয়ার ভঙ্গিমা করে দাঁড়ালো। তা দেখে দূরে থাকা নিহিলা হেসে দিল।

“তোরা ছেলেমেয়েরা এতো বে’হা’য়া কবে থেকে হলি?বলেই রিনা আহমেদ স্বামীর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালেন,
“তুমিও এদেরকে আশকারা দিচ্ছ?”

স্ত্রীর কথায় শফিক আহমেদ আরেকটু ভাব নেয়ার ভঙ্গিমা করে দাঁড়ালেন,
“ওরা সত্যিটাই তো বলছে।” বলেই তিনি বুঁকের উপর দুহাত রাখলেন,
“দেখছো না? তোমার স্বামী দিন দিন কত সুন্দর হচ্ছে? তোমার তো গর্ব করা উচিত। তা না করে তুমি ছেলেমেয়েদের ধমকাচ্ছ! এটা কিন্তু ঠিক না রিনা।”

স্বামীর কথায় রিনা আহমেদ তোয়াক্কা না করে আহানের দিকে রাগী চোখে তাকালো,
“একটু হেঁসেছি তাই বলে মাথায় উঠে যাবি! এতো নি’র্ল’জ্জ কবে হলি?”

“মা, ভাইয়ার এসবে অভ্যাস আছে। আর তুমি এতো ছোট বিষয়ে এতো গুটিয়ে যাচ্ছ!” বলতেই অরিনের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন রিনা আহমেদ,
“অভ্যাস আছে মানে?”

অরিনের দিকে আহান র’ক্ত’চক্ষু নিয়ে তাকাতেই অরিন দমে গেল।

“আচ্ছা আচ্ছা অনেক বকেছো। চল আমরা একটু পরিবারের ছবি নিই।” বলেই আহান মা বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।

“রাহানকে ডাক।”

অরিন গিয়ে ভাইকে বলে আবার ফিরে আসলো।
“ভাই কোনোদিনও ছবি তুলবে?এমনিও অনেকবছর পরে নিজে থেকে এসেছে এই অনেক। এর চেয়ে বেশি আশা করলে হিতে বিপরীত হবে।”

রিনা আহমেদ অরিনকে চুপ করিয়ে ডাক দিতেই রাহান আসলো,
“তোমরা তুলো, আমি ছবি তুলে দিই।”

“না, তুই সহ আয়।” বলতেই রাহান এগিয়ে গেল।

রাহান গিয়ে দাঁড়াতেই নিহিলাকে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো।
“নিহিলা, তুমিও আসো।” রাহানের বলা কথা শুনে সবার নিহিলার কথা খেয়াল হলো।
“আরে হ্যাঁ, নিহিলা আসো।” বলেই রিনা আহমেদ ডাক দিতেই অরিন টেনে নিয়ে আসলো।

“আমার তুলতে ইচ্ছে করছে না। তোমরা তুলো।”

“এমন বললে তো চলবে না। ” বলেই আহান নিহিলাকে টেনে দাঁড় করিয়ে দিল।

ছবি তোলা শেষেই আহানের ফোন আসায় সে ফোন নিয়ে একটু দূরে সরে গেল। নিহিলা সবার মুখের দিকে তাকালো। এমন হাসিখুশি পরিবার! কারোর নজর না লাগুক কোনো।

নিহিলা একটু দূরে সরে নদীর পাশে এগিয়ে গেল। সে খেয়াল করলো তার জামাটার সাথে এই জায়গাটার বেশ মিল। মানে চেরি ব্লসম ফুলগুলো সাদা গোলাপী মিশ্রনের আর তার জামাটাও সাদা গোলাপী মিশ্রনের। মনে কিছু একটু ভাবনা আসতেই নিহিলা অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা রাহানের দিকে তাকালো। এটাও কী কাকতালীয়!

অদূরে অরিন আর তার বাবা একসাথে উৎফুল্ল হয়ে দাঁড়িয়েছে। অরিন আর শফিক আহমেদ একসাথে দাঁড়ালো আর রিনা আহমেদ ছবি তুলে দিচ্ছেন। পৃথিবীতে এর চেয়ে সুন্দর মুহূর্ত বোধহয় আর নেই কিন্তু সে নিজে এমন অভাগা যে মা বাবার এমন কোনো স্মৃতি সে দেখবে তো দূরের কথা একসাথে ছোঁয়াও পেল না। নিহিলা একটু দূরে সরে দাঁড়ালো। তার চোখে পানি টলমল করছে। মনে হচ্ছে যেন পলক ফেললেই টুপ্ করে ঝর্ণার মতো ঝরে পড়বে অশ্রুগুলো। তার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো।

“মুছে ফেলো।” পাশ থেকে রাহানের কণ্ঠস্বর পেতেই নিহিলা তাকালো।
রাহান নদীর দিকে দৃষ্টি রেখেই একটা সাদা হাল্কা নীলের সংমিশ্রনের রোমাল বাড়িয়ে দিলো।

নিহিলা দ্রুত পাশ ফিরে হাত দিয়ে চোখ মুছতে নিতেই রাহান সেদিকেই রুমালটা ধরলো।
নিহিলা চোখ মুছে নিল। সে তার হাতের মুঠোয় রোমালটা রেখেই নদীর দিকে তাকালো। সে এই গম্ভীর মানুষটাকে চিনে উঠতে পারছে না।

“রুমালটা?” নিহিলার এতো খারাপ সময়েও কোথ থেকে যেন হাসি পেয়ে যাচ্ছে। সে ভেবেছিল মানুষটা রুমালটা আর নিবে না কিন্তু পানি মুছার সাথে সাথেই রুমালটার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছে! নিহিলা আবারো ভাবলো, আসলেই এমন অদ্ভুত মানুষ এখনো পৃথিবীতে আছে!

#চলবে ইন শা আল্লাহ।
(আসসালামু আলাইকুম। রি চেক করা হয়নি। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ।)#একমুঠো_বসন্ত
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_১৬

নিহিলার আজ খুব ভোরেই ঘুম ভেঙেছে । এই বাড়িতে কেউ এতো তাড়াতাড়ি উঠে না। নিহিলা পাশ ফিরে আবারো ঘুমানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলো। এখন আর ঘুম আসবে না জানে তাই সে উড়নাটা নিয়ে খাট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। অনেকদিন মন প্রাণ খুলে বাতাস নেওয়া হয় না ভেবে সে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। সিঁড়ি দিয়ে নামতে যাবে তখনই মনে হলো রাহান ভাইয়ের রুমের দরজা খোলা। হাল্কা ভেড়ানো। নিহিলার ইচ্ছে করলো রাহান ভাইয়ের সাথে লাগোয়া বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতে কিন্তু সেই প্রথমের ঘটনার পরে আর যায়নি। যদিও এখন রাহান ভাই কোমল হয়েছেন তবুও নিহিলার আত্মসম্মানে বাধা দিল। মানুষটা হাজার কোমল হলেও গম্ভীর রয়ে গেছে। নিহিলা দরজা খুলে নিচের বিশাল বাগানে চলে এলো। পায়ের জুতা একদিকে রেখে সে খালি পায়ে সবুজ ঘাসের উপর হাঁটা ধরলো। এই বিশাল বাগানে কেউ সচরাচর আসে না। আসে না বলতে নিহিলা কাউকে দেখেইনি। হয়ত ফুপি আসে তবে নিহিলা ছিল না বলে দেখতে পায়নি। ঘাসের উপর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পানির কণাগুলো নিহিলার পায়ে লাগতেই অনুভূতিতে চোখ বন্ধ করে নিল। এই অনুভূতিটা অনেক সুখের। পায়ে ঘাসের শিশিরকণাগুলোর ফলে শিরশিরে অনুভূতি অনুভব হচ্ছে। কতগুলো দিন এমন করে খালি পায়ে হাঁটা হয়নি। নিহিলা হাল্কা নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে লাগলো। তার ভীষণ সুখ সুখ অনুভূতি হচ্ছে। ভোরের হাল্কা হাল্কা বাতাসও হচ্ছে। বাগানে অনেক ফুল ফুটে আছে। বাতাসের সাথে সেগুলোর মিষ্টি ঘ্রান ভেসে আসছে। নিহিলার ঠান্ডা অনুভূতি হলো। সে উড়নাটাকে দুইহাতে ভালোভাবে গায়ের সাথে জড়িয়ে নিল। এখন নিজেকে কেন জানি মুক্ত পাখির মতো মনে হচ্ছে। নিহিলা চারদিকে তাকিয়ে নিজের মতো করেই বাগান দেখবে ভেবে পা বাড়ালো।

“সামনে কাঁ’টা । সাবধানে পা বাড়াও।”
নিহিলা চোখ খুলে ফেলল। চমকে আশেপাশে তাকালো। রাহান ভাইয়ের কণ্ঠস্বর না! তবে কই! আশেপাশে তো দেখা যাচ্ছে না। নিজে ভুল শুনেছে ভেবে সামনে তাকাতেই দেখলো সত্যি সত্যিই একটা গোলাপের ডাল পড়ে আছে। যেটা অনেক পরিমান কাঁ’টাযুক্ত। সামনে পা বাড়ালে আসলেই অনেক ক্ষ’ত হতো।
নিহিলা ডালটি হাত দিয়ে তুলে নিল। কী মনে করে উপরে তাকাতেই দেখল রাহান ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। নিহিলা মনে মনে খুশি হলো। মানুষটা আসলে নিজেকে যেমন উপস্থাপন করে তেমনটা মোটেও না। নিহিলা হেসে ধন্যবাদ দিতে যাবে তখনই রাহান ব্যালকনি প্রস্তান করলো। প্রতিবারের মতো নিহিলা আবারো বিড়বিড় করে বলে উঠল,’মানুষটা এমন অদ্ভুত কেন!’

নিহিলা ঘাসের উপর বসে পড়লো। দেখতে দেখতে মাঝে অনেকগুলো মাস কাটিয়ে দিয়েছে সে। অদ্ভুত হলেও এটাই সত্যি যে এখন আর একটুও কষ্ট হয় না নিহিলার। একদম নিজের মতো করেই থাকছে। একটা উৎফুল্ল কাজ করে যে সাফাত ভাইয়ের প্রতি এখন আর সেই আগের অনুভূতিটা হয়ত নেই। মানুষটাকে মাঝে মাঝে মনে পড়লেও নিহিলা নিজেকে বেশ সংযত করে নিতে পারে। ইদানিং এখন আর মনে পড়ে না। অতো খারাপ লাগে না। উল্টো এখন এই মানুষগুলোই তার আপন মনে হয়। আর মাত্র কয়েকমাস আছে। এরপরই তার দেশে ফিরে যেতে হবে। একদিকে খুশি লাগছে এই ভেবে যে মা-বড়ো বাবা, রিহি এদের সাথে অনেকদিন পরে মিলবে কিন্তু আরেকদিকে এই পরিবারের জন্য খারাপ লাগছে। সে তো থাকতে পারবে না। মায়া জন্মে গেছে। ঘরের প্রতিটা মানুষ তাকে অনেক যত্ন করে। ছোট থেকে শুরু করে বড়ো পর্যন্ত সবাই তার ছোটোখাটো বিষয়েও খেয়াল রাখে। এইতো যেমন এই গম্ভীর মানুষটাও তাকে সামান্য কাঁ’টা’র আঁচ থেকে বাঁচিয়ে দিল। অথচ এমন কিছু সে অন্যদের থেকে আশা করলেও এই মানুষটার কাছ থেকে কোনোদিন করেনি। পরক্ষনেই কী যেন মনে হতেই নিহিলা ভাবনাটা সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো। এতে এতো ভাবার কী আছে! হয়ত মানুষটা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিল। কাঁ’টা দেখেছে বিধায় বলেছে। সেই একই জায়গায় নিহিলা নিজে থাকলেও বলতো কিন্তু তবুও বাঁচিয়েছে তো! সে এই পরিবারের সবার মায়া কীভাবে ছুঁটাবে ভাবতে পারছে না।

——-
আরো কয়েকটা দিন কেটে গেল। শফিক আহমেদ নাস্তা শেষ করেই অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।
রাহানও নাস্তা শেষ করে উঠে দাঁড়ালো। ট্রাওজার পরিহিত অবস্থায় রুমে না গিয়ে সদর দরজার দিকে অগ্রসর হতে দেখে রিনা আহমেদ ডাক দিলেন,

“রাহান বাবা, কই যাচ্ছিস?”

“বাগানে একটু হাটবো।” বলেই রাহান বেরিয়ে গেল।
বড়ো ভাইয়ের কথা শুনে অরিন আর আহান অবাক হয়ে একজন আরেকজনের দিকে তাকালো। তাদের ভাই হয়ত বদলে যাচ্ছে। কারণ আজ পর্যন্ত রাহান কোনোদিন বাগানে হাঁটাহাঁটি করেনি। রাহান অবসর সময়টা রুমেই কাটিয়ে দিতো কিন্তু ইদানিং বাগানে হাঁটাহাঁটি করে।
আহান ভ্রু কুঁচকালো,

“কী ব্যাপার মা? রাহান ব্রো এর ইদানিং কর্মকান্ড তোমাকে ভাবাচ্ছে না?”

ছেলের কথা শুনে রিনা আহমেদ তাকালেন। বোঝায় যাচ্ছে তিনিও রাহানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে এটাই ভাবছিলেন কিন্তু আহানকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। তিনি টেবিল থেকে নাস্তার প্লেটগুলো নিয়ে রান্নাঘরে যেতে যেতে বললেন,

“সবসময় একই থাকা লাগবে না-কি? সামনে বিয়েও দেওয়া লাগবে। তখনও কী এমন থাকতে পারবে না-কি?”

মায়ের কথা শুনে আহান অরিন নিহিলার দিকে তাকিয়ে হাসলো। নিহিলা নিজের মতো করেই নাস্তা খাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে খাবার ছাড়া বাইরের আর কোনো জিনিসের প্রতি তার আগ্রহ নেই।
অরিন আহান দুজনেই খুশি হলো। ভাই অন্তত একটু হলেও নিজের রুম ছেড়ে বের হতে শুরু করেছে। তার এই বদলে যাওয়া মানে গম্ভীর খোলস ছেড়ে আস্তে আস্তে বের হওয়া।

কিছুক্ষন পরেই রাহানকে ফিরে আসতে দেখে ওরা গল্প বন্ধ করলো। তাকে খালি পায়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে ঢুকতে দেখে অরিন আহান এগিয়ে গেল।
“কী হয়েছে ভাইয়া? খালি পায়ে কেন?”অরিন বিচলিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করতেই রাহান হাত উঁচিয়ে থামালো। সে নিজেকে শান্ত করে গম্ভীর কণ্ঠে “কিছু না” বলেই পাশ কাটিয়ে রুমে যেতে নিচ্ছিলো কিন্তু নিহিলা পথ আটকে দিল। সে বেশ বুঝতে পারছে যে মানুষটার কষ্ট হচ্ছে কিন্তু নিজের গম্ভীরালি ভাবের জন্য বলতে পারছে না।
নিহিলা রাহানের পায়ের কাছে বসে পড়তেই রাহান দুইকদম পিছিয়ে গেল। সে আরেকটু এগিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। সে পায়ে হাত দিতেই রাহান পা পিছিয়ে নিল।
“একটু দাঁড়ান।” বলেই নিহিলা গভীর চোখে পর্যবেক্ষণ করতে নিল। সে বেশ বুঝতে পারছে কোনো কাঁ’টা টাইপ কিছু পায়ের আঙুলে ঢুকেছে। এভাবে চলে গেলে ক্ষ’ত ভেতরে ভেতরে আরো বাড়বে। কাঁ’টা’টা ফেলা লাগবে নয়তো ক্ষ’ত স্থানে বাড়াবাড়ি রকমের কষ্ট হবে। ছোট বেলা থেকে সে অনেক জায়গায় দৌড়ঝাপ করতো বিধায় এসব সম্পর্কে অবগত।
“ছাড়ো। একটু পরিষ্কার করে নিলেই হবে।” বলেই রাহান যেতে নিলে নিহিলা আবারো আটকে দিল।
“পরিষ্কার করলে হবে না। এখানে কাঁ’টা আছে, ঐটা তুলতে হবে। নাহয় ব্যথা বাড়বে।” নিহিলার কথায় রাহান চুপ রইল।

“তুমি কাঁ’টাও তুলতে পারো?”আহান অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করতেই নিহিলা জবাব দিল,
“ছোটবেলায় কত লাফাতাম। প্রথম দিকে এমন কাঁ’টা ফুটলে কেঁদে কেঁদে মাকে বলতাম। মা প্রথমে ধমক দিতো কিন্তু পরে নিজেই তুলে নিতো। এরপর পরে কাঁ’টা ফুটলে মাকে আর এসে বলতাম না। নিজেই তুলে নিতাম কারণ ভাবতাম, যতদিন এরকম দৌড়ঝাঁপ করবো ততদিন এরকম আহত হবো তাই নিজে তুলে নেওয়া ভালো। এভাবে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। ”

“তুই কীভাবে বুঝেছিস যে এখানে কাঁ’টা আছে?”অরিনের কথা শুনে নিহিলা তাকালো।

“উনার হাঁটার ধরণ দেখে বুঝেছি যে প্রতি কদমে কদমে উনি এক জায়গায় সুচালো টাইপ ব্যথা অনুভব করছেন।” নিহিলার কথা শুনে আহান আর অরিন দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসলো। অরিন বলে উঠল,

“বাব্বা তুই ভাইকে এতো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিস?” অরিনের কথা শুনেই আহান ভাবুক কণ্ঠে বলে উঠল,
“আসলেই, কই আমি হাঁটলে তো অতো পর্যবেক্ষণ করো না।”

“আহান, অরিন।” রাহানের কণ্ঠস্বর পেতেই তারা চুপ হয়ে গেল। তারা তো ভুলেই বসেছিল যে এখানে তাদের ভাই দাঁড়িয়ে আছে।

নিহিলা খুব সন্তোপর্ণে কাঁ’টা’টা বেরিয়ে আনলো। কাঁ’টা বেরিয়ে আনতেই র’ক্ত চলে আসলো। নিহিলা অরিনকে টিস্যু আনতে পাঠালেই রাহান পকেট থেকে সেই সাদা নীল মিশ্রনের রুমালটা বের করে সেই জায়গা থেকে র’ক্ত মুছে নিলো। নিহিলা রুমালটির দিকে তাকালো। নিহিলার তাকানো রাহান বুঝতে পেরে রুমালটা আবারো পকেটে রেখে রুমের দিকে পা বাড়ালো।

নিহিলা উঠে দাঁড়ালো।
“দেখেছো তোমাদের ভাই একটু কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনও করলো না।”

“কী জানি হয়ত পরে এর চেয়ে বেশিকিছু করে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করবে।” বলেই আহান অরিন একজন আরেকজনের সাথে মিলিয়ে হাসতে লাগলো। নিহিলা ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই চুপ হয়ে গেল।

#চলবে ইন শা আল্লাহ।
(আসসালামু আলাইকুম। রিচেক দেওয়া হয়নি। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ। রেসপন্স করবেন প্লিজ 🙂)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here