#বিচ্ছেদ -১৯
রিয়া ভিপি ম্যাডামের বাসার ড্রইং রুমে বসে আছে। সুন্দর ছিম্ ছাম করে সাজানো ড্রইংরুম। মহাখালী DOHS এ নিজের বাড়ী।
ম্যাডামের হাসবেন্ড রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার। এক ছেলে এক মেয়ে। দু’জনেই সুপ্রতিষ্ঠিত।
ছেলে আর্মি অফিসার,ক্যাপ্টেন। বর্তমানে রংপুর ক্যান্টনমেন্টে পোস্টিং। মেয়েটি ডাক্তার, মাত্র পাস করেছে। সামনেই মেয়ের বিয়ে। হব জামাইও ডাক্তার। কোন একটা হেলথ কমপ্লেক্সে পোস্টিং।
কত শান্তি একজন মায়ের, যখন সন্তানেরা যার যার জীবনে সঠিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। রিয়াও কি পারবে তার সন্তানকে সঠিক ভাবে মানুষ করতে ?
নিশ্চয় পারবে !
এখন তো আশিকও পাশে এসে দাড়াতে চাইছে।
রিয়া ঘরের চারপাশে চোখ বুলালো।
এক কোনে একটি কাঠের কর্ণার র্যাকে সুন্দর এবং মূল্যবান কয়েকটি শো-পিস সাজিয়ে রাখা। কোথাও একটুও ধুলো জমে নেই।
দেয়ালের সুন্দর পেইন্টিং এর উপর রিয়ার চোখ আটকে গেলো। সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ।
একটি গ্রামের বাড়ীর দৃশ্য।
সামনে বড় উঠোন। দূরে কুয়াশা ঢাকা মাঠ। মাঠের মাঝখানে একটা খেজুর গাছ বেয়ে গাছি উঠছে রসের হাড়ী নামাবার জন্য।
সকালের নরম রোদে মায়াবী এক উষ্ণতা ছড়িয়ে আছে সারা উঠোন জুড়ে !
রিয়া মুগ্ধ হয়ে ছবিটি দেখছিল।
ভিপি ম্যাডামের ডাকে চমকে তাকালো এবং উঠে দাড়িয়ে সালাম দিল।
রিয়ার বিধ্বস্ত চেহারা দেখে ভিপি ম্যাডাম বিচলিত হয়ে বললেন, কি হাল করেছো নিজের ?’
রিয়া ম্লান হাসলো।
কাজের মেয়েটা দু’কাপ চা দিয়ে গেল।
রিয়া চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে খুব ভাল বোধ করলো। ভেতরে ভেতরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
ভিপি ম্যাডাম সরাসরি প্রশ্ন করলেন,’কি নিয়ে তোমার এত অশান্তি হচ্ছে রিয়া ?’
রিয়া আস্তে করে বললো, ‘ম্যাডাম আপনার সাথে কথা বললে আমি ভরসা পাই,
শান্তি পাই, তাই এসেছি।’
ভিপি ম্যাডাম হাসলেন।
চায়ের কাপটা সেন্টার টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে রিয়ার হাতটা ধরলেন।
নরম গলায় বললেন, ‘আমি জানি তুমি খুব কষ্টো পাচ্ছো। তবে ভেঙ্গে পড়োনা রিয়া।
তুমি সেটাই করবে, যেটা তোমার বিবেক তোমাকে করতে বলবে।
মন অনেক কিছুই চায় কিন্তু বিবেক তোমাকে বিবেচনা করতে সাহায্য করবে।
তাই যা করবে, বিবেচকের মতই করবে।
জীবনের সব সিদ্ধান্ত সবসময় তোমার মনের
মত হবে না। না হোক,তাতে কি ?
তা বলে তো জীবনকে থামিয়ে রাখা যাবেনা।
সামনে এগোতেই হবে।’
রিয়ার মনে ভরসা জাগতে শুরু করলো।
ভিপি ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে আত্মবিস্বাসী কন্ঠে বললো, ‘আমি জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছি, কিন্তু নিজেকে অসম্মানিত হতে দিইনি কখনো।
আমার সন্তানকেও আমি যতটুকু পেরেছি, নিজের সামর্থ্যের মধ্যেই মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখিয়েছি।
রায়না অনেক বুঝদার মেয়ে।
সে তার অবস্হানটা বোঝে এবং সেভাবেই চলার চেষ্টা করে।
তবে ওর ছোট মনের কষ্টগুলো ইদানিং আমাকে খুব ভাবায়। আমাদের ভুলের জন্য আজ ওর এমন জীবন হয়েছে। এমনটা হওয়ার কথা ছিল না।
আমি ওকে ভাল থাকতে দেখতে চাই।
ওর ভাল থাকাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে ম্যাম।
ভিপি ম্যাডাম স্নেহের স্বরে বললেন,’শুধু রায়নার ভাল থাকার কথা ভাবছো ? নিজে কিছু চাও না ? তোমার ভাল থাকাটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ, রিয়া।তুমি ভাল থাকলে তবেই তো রায়নাকে ভাল রাখতে পারবে।’
রিয়া ভিপি ম্যাডামের কথায় মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানালো।
আরো কিছুক্ষণ কয়েকটা বিষয়ে কথা বলার পর চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাড়ালো রিয়া।
ম্যাডামের কাছে থেকে বিদায় নেয়ার আগে দেয়ালের ল্যান্ডস্কেপের দিকে আঙুল নির্দেশ করে বললো,’ছবিটা ভারী সুন্দর !’
রাস্তায় এসে রিয়া হাঁটতে লাগলো।
রিক্সা নিতে ইচ্ছে করছে না।
ছবিতে দেখা ঐ গ্রামে যেতে পারলে ভাল হত।
আচ্ছা, তার দাদার বাড়ীর গ্রামটাও কি অনেকটা এরকম নয় ?
নাকি বাংলাদেশের সব গ্রামের শীতের সকাল গুলো একই রকম হয় ?
রিয়া আজই বাবার ওখানে যাবে সিদ্ধান্ত নিলো। দূরে একটা খালি রিক্সা দেখা যাচ্ছে, রিয়া হাত নেড়ে রিক্সাটা ডাকলো।
বাসায় ফিরে এসে কি করবে কিছুই ভেবে পেলো না। রিয়ার মনে হলো তার আর কিছু করার নেই।
রায়নার জন্য মন ছট্ ফট্ করে উঠলো। মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে।
বিকেলেই বাবার বাসায় যাবে ঠিক করলো।
বারান্দায় চলে এলো।
টবের গাছগুলো নিজ হাতে পরিচর্যা করলো অনেকটা সময় নিয়ে।
কতদিন গাছগুলোর যত্ন নেয়নি নিজ হাতে !
ছোটবেলায় বাগান করতো রিয়া।
বাবা খুব উৎসাহ দিতেন এসব ব্যাপারে।
নার্সারী থেকে ফুলের চারা কিনে এনে দিতেন।বাবার এনে দেয়া গোলােপ,বেলীর চারা গুলো আনাড়ী হাতেই লাগাতো রিয়া।
তারপর, গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতো গাছের চারা গজানোর জন্য।
একটু একটু করে বেড়ে উঠা দেখার জন্য।
যেদিন প্রথম গোলাপের কুঁড়ি ফুটেছিল,সেদিন কি আনন্দই না হয়েছিল রিয়ার।
পুরো বাড়ী মাথায় করে ফেলেছিল।
বড় ভাইয়া বলেছিল,’বাহ্.. তুই তো গোলাপ ফুটিয়ে ফেলেছিস, রিয়া !’
কি সুন্দর ছিল সেইসব দিন !
বড় ভাইয়া কি ঠিক বলেছিল, সেদিন ?
রিয়া কি সত্যিই আরো একবার গোলাপ ফোটাতে পারবে ছোটবেলার মত ??
পুরো বাড়ীতে হুলস্থুল অবস্হা।
বড় আপা এসেছেন চিটাগং থেকে। দুলাভাইও এসেছেন। বাবা-মা জামাইকে পেয়ে অস্হির হয়ে পড়েছেন। দুলাভাই আজকাল আর সহজে আসতে পারেন না। প্রোমশনের সাথে সাথে গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্বও বেড়েছে অনেক। রায়না খুব আনন্দে আছে নেহাল ভাইয়া আর নেহা আপুকে পেয়ে।
আজ সন্ধ্যায় বড় ভাইয়াও দেশে এসেছেন।
রিয়া ভাইয়াকে দেখে অবাক হয়ে গেল !
ভাইয়া কোত্থেকে ? হট্যৎ ?
মা তাকে আগে থেকে বলেননি। ভাইয়া নাকি কাউকে বলতে না করেছিল, সবাইকে সারপ্রাইজ দিবে বলে।
ভাইয়া, রিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,কেমন আছিস রে বুড়ি ?
বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠলো রিয়ার।
সব কষ্ট গুলো বুক ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে চাইছে। রিয়াকে খুব আগলে রাখতো ভাইয়া।
বয়সের ব্যবধান অনেক বলেই হয়তো বেশী আদর করতো রিয়াকে।
রিয়ার জীবনের এই না পাওয়া দিকগুলো প্রথম প্রথম মানতে পারতো না ভাইয়া।
কিভাবে রিয়াকে ভাল রাখবে, সে চেষ্টায় করতো কেবল।
ভাল আছি ভাইয়া, তুমি কেমন আছো ?
বলো নি তো আসবে ?
ভাইয়া হাসতে হাসতে বললেন,
‘বললে বুঝি এত আনন্দ হত তোদের ?
আমার মামুটা এত অবাক হত ?’
রায়নাকে আদর করে ‘মামু’ ডাকে রিয়ার বড় ভাই রিয়াজ।
বাড়ীতে চাঁদের হাট বসেছে।
মা-বাবা কি যে খুশী, দেখে ভাল লাগছে।
রাতে মেঝো খালা,ছোট খালা আসলেন।
বড় ভাবী মায়ের সাথে রান্না করলেন।
মা কিছুতেই রান্না করতে দেবে না ভাবীকে।
তার এক কথা, ‘এত দূর থেকে কত জার্নি করে এসেছো। এখন তোমাকে রাঁধতে হবেনা।’
ভাবী মায়ের কথা শুনে হাসতে হাসতে বলেছিল,’কোন অসুবিধা নেই মা, আপনার সাথে রান্না করতে খুব ইচ্ছে করছে।’
খাবার টেবিলে খুব মজা হলো। এত সব মজার মজার খাবার দেখে রিয়ার ভাই, দুলাভাই, বড় আপু রিমা খুব খুশী হয়ে উঠলো। হৈ চৈ করে সবাই খাওয়া দাওয়া শেষ করলো। বড় জামাই এর প্লেটে রিয়ার মা রুই মাছের মাথাটা তুলে দিলেন।
দুলাভাই মুখে মুখে না না বললেও মাথাটা খেলেন তৃপ্তি করেই।
সবার মধ্য থেকেও রিয়ার নিজেকে খুব একা লাগছে।মনের ভেতরের অশান্তিকে আড়াল করে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে সে।
সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হলো যে, পরিবারের সবাই মনে মনে ধরেই নিয়েছে, তার আর আশিকের আবার মিল হয়ে যাচ্ছে।
রিয়া নতুন করে আবার সব কিছু ফিরে পাচ্ছে। প্রত্যেকের কথা বার্তায় সেটা ফুটে উঠছে। সবাইকে কেমন নির্ভার আনন্দিত মনে হচ্ছে ভিতরে ভিতরে !
রিয়ার কেমন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে ঐ বিষয় গুলো ভাবলে।
রিয়া ভাবতে চায় না।
রাতে মার ঘরে সবাই মিলে গল্প করছিল।
ভাবী,বড় আপু,মেঝো খালা,ছোট খালা, মা সবাই ছিল। রিয়া রুমে ঢুকতেই খালারা ওকে আদর করে কাছে বসালো।
বললো,কিরে তুই এমন একা একা থাকিস কেন সবসময় ? আয় বোস্ আমাদের কাছে।
রিয়া বসেছিল।
যথারীতি আশিকের কথা উঠলো।
মেঝো খালা বললেন, ‘নিয়ম-কানুন যা আছে সব মেনে আল্লাহ্ আল্লাহ্ করে আবার এক হয়ে যা তো ! আজকাল টাকা দিলে এরকম কত ছেলে পাওয়া যায়। কাগজে কলমে বিয়েটা হবে। সাতদিন পরে তালাকে সই করে দিবে। ব্যাস ঝামেলা শেষ।’
রিয়ার মাথা ঝিম্ ঝিম্ করে উঠলো।
আস্তে করে কেবল বললো, ‘খালা এরকম করাটা ঠিক না। এভাবে করার নিয়মও নেই।’
মেঝো খালা মৃদু ধমকে উঠলেন,’তোরা কি বেশী জানিস ? এরকম আকসার হচ্ছে। ”
ছোট খালাও মেঝো খালার সাথে তাল দিলেন।
মা কোন কথা বললেন না বটে।
তবে রিয়ার বুঝতে বাকী থাকলো না মা কি চায়। মা মৌনভাবে খালাদের সমর্থন করলেন।
রিয়া আর কথা বাড়ালো না।
মাথা নিচু করে বসে থাকলো।
ও শুনতে পাচ্ছে, সবাই আশিকের কত প্রশংসা করছে। আশিকের এটা ভাল ছিল.. ওটা খুব ভাল ছিল…
যাক বাবা.. খুব ভাল হয়েছে,ওদের মতি ফিরেছে। বাচ্চাটা এবার বাবা-মা দু’জনকেই পাবে… ইত্যাদি ইত্যাদি।
ট্রেন ছুটছে….
রিয়া ট্রেনের জানালার পাশে বসে অপলক তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে।
কুয়াশার পর্দা সরিয়ে উঁকি দিচ্ছে সূর্য্য।
নরম সোনা রোদে ঘাসের ডগায় শিশির গুলো চিক্ চিক্ করছে। নাম না জানা গাছগুলোকে পিছনে ফেলে ছুটে যাচ্ছে দূরন্ত ট্রেন।
রিয়া বসে আছে ইন্টারসিটি ট্রেনের ১ম শ্রেনীর একটি বেশ বড় কামরায়।
সামনা সামনি দুটো বড় বড় সোফার মত সিট।
সিট গুলো নরম রেক্সিনে ঢাকা। উপরেও দুটো সিট আছে। যেখানে ওদের সবার ল্যাগেজ গুলো রাখা হয়েছে। রাতের বেলা এই সিটটাই আবার একজনের বেড হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
দিনের বেলা আট সিটের কামরা।
আর রাতের বেলা চার জনের বেড।
তবে রিয়াদের কামরা টি বারো সিটের। আরো চার সিটের একটি বড় সোফা রয়েছে এই কামরায়। ইউ শেফে রয়েছে তিনটি সোফা।
প্রতিটি ট্রেনে আট সিটের কামরায় থাকে। তবে একটি বারো সিটের বড় কামরাও থাকে সব ট্রেনে। ওরা বারোজন সদস্য। তাই বড় কামরাটি নিয়েছে ওরা।
রায়না ট্রেনে রাতে ঘুমোন যায় শুনে খুব এক্সাইটেড। রাতের বেলা ট্রেনে করে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে জার্নি করা যায়, ভেবেই তো সে খুব অবাক !
মামুকে কানে কানে বলে ফেললো,’মামু শোন,আমার তো খুব ট্রেনে করে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কোথাও বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করছে।’
রিয়াজ হাহাহা করে হেসে উঠলো।
বললো, ঠিক আছে, মামু। রাতের বেলা একটা জার্নি করবো আমরা।
রায়না খুব আনন্দে আছে। নেহা আপু,নেহাল ভাইয়া এবং মামাত বোন রোশনী আপুর সাথে দারুণ সময় কাটছে তার। সবার ছোট হওয়ায় আদর একটু বেশীই তার।
রিয়ার দাদাবাড়ী যশোর সদর উপজেলার ভিতরে খোলাডাঙ্গা গ্রামে। যশোর পর্যন্ত ট্রেনে আসতে হয়। তারপর ট্রেন থেকে নেমে ভ্যান বা থেকে অটোরিক্সাতে যেতে হয়।
স্টেশনে নেমে ওরা মালপত্র নিয়ে দাড়িয়ে আছে। বাবা আর ভাইয়া ভ্যান ঠিক করার চেষ্টা করছে।
রায়না মহা আনন্দিত এবং খানিকটা উত্তেজিত ভ্যানে করে যাত্রা শুরু হবে বলে।
সে কোনদিন ভ্যানে চড়েনি তবে ঢাকা শহরে ভ্যান দেখেছে সে।
দু’টি ভ্যান ও একটি অটোরিকশা ঠিক করা হলো। রায়নার নানু,বড় খালামনি এবং রিয়া অটোরিকশায় উঠলো।
মালামাল এবং বাকীরা হৈ হৈ করে ভ্যান দু’টিতে চড়ে বসলো।
রায়না ভীষণ খুশী। এত আনন্দ করে আগে কোনদিন সে কোথাও বেড়াতে যায়নি।
তার কেবল মাঝে মাঝেই তার বাবাকে মনে পড়ছে, ইস্.. বাবা যদি সঙ্গে থাকতো, কত্তো মজা হতো ! সবার বাবাই তো তাদের সঙ্গে আছে !
রায়না নানাভাই এর পাশে পা ঝুলিয়ে বসে আছে।আরেক পাশে বড় মামু বসেছেন।ওরা বাদাম খেতে খেতে যাচ্ছে।
স্টেশন থেকে নেহাল ভাইয়া বাদাম কিনেছে।
নানাভাই বাদাম ছিঁলে ছিঁলে রায়নার মুখে দিচ্ছেন। ভ্যান এগিয়ে যাচ্ছে ইটের রাস্তা দিয়ে। জায়গায় জায়গায় রাস্তা ভাঙা।
বেশ ঝাঁকুনি লাগছে। রায়না শক্ত করে নানাভাইকে ধরে আছে।
সন্ধ্যার আগে আগে ওরা বাড়ী পৌঁছালো।
রিয়া এসেই গরম জলে গোসল করেছে, রায়নাকেও করিয়েছে।
ঝরঝরে লাগছে শরীরটা।
রাতের খাবার খেয়ে সবাই গল্প করছে বসার ঘরে। রিয়াদের বাড়ীটা অনেক পুরনো।
মূল বাড়ীটা ওর দাদা বানিয়েছিলেন।
পরে কিছু এক্সটেনশন করেছেন রিয়ার বাবা।
অনেক গুলো ঘর, বড় বারান্দা,বান্নাঘর সহ মোটামুটি বেশ বড়ই ওদের বাড়ী।
দো’তলার দুটো ঘর পরে বানানো হয়েছে।
রিয়ার ছোট চাচা এবাড়ীতেই থাকেন।
তিনিই সব দেখে শুনে রাখেন।
চাচী অনেক আয়োজন করে খাওয়ালেন রাতে। রান্না খুবই স্বাদের তবে ঝাল আর লবন বেশী। রিয়া ঠিকমত খেতে পারলো না।
তবে খুব খারাপও লাগেনি।
মাঝে মাঝে একঘেয়ে জীবনের একটু পরিবর্তন দরকার হয়।
রিয়া একটা বই নিয়ে বারান্দায় চলে এলো।
পাশাপাশি দু’টো বেতের চেয়ার পাতা আছে
বারান্দায়।
রিয়া একটা চেয়ারে বসলো।
রাত খুব গভীর হয়নি। কিন্তু মনে হচ্ছে কত রাত হয়ে গেছে। এমনিতেই শীতের রাত, তারউপর গ্রাম। তাই রাত ন’টাতেই নিশুতি রাত মনে হচ্ছে।
দূরের জঙ্গলে শেয়াল ডাকছে।
ছোটবেলায় বাবা বলতেন,শীতের রাতে শেয়াল কেন ডাকে জানিস ?
রিয়া খুব অবাক হয়ে বলতো, না তো ! কেন শেয়াল ডাকে বাবা ?
বাবা হাসতে হাসতে বলতেন,শীতে কাঁপছে শেয়ালগুলো, তাই হুক্কা হুয়া বলে কম্বল চাইছে।
একটু বড় হয়ে রিয়া বুঝতে পেরেছিল,বাবা মজা করে বলতেন শেয়ালের কম্বল চাওয়ার গল্পটা। এটা নাকি তার বাবা তার ছোটবেলায় তাকে বলতেন।
রিয়ার মনে হলো, সত্যিই কি শীত লাগছে শেয়ালগুলোর ? তাই এত ডাকাডাকি করছে ?
বই পড়ার জন্য যথেষ্ট আলো নেই বারান্দায়।
অল্প পাওয়ারের একটা লাইট জ্বলছে বারান্দায়। হলুদ আলোর চারপাশে কিছু পোকা উড়াউড়ি করছে।
শীতের সময় এই এক সমস্যা।
আলোর টানে সব পোকা ছুটে আসে।
আশিক খুব বিরক্ত হতো ঘরে পোকা ঢুকলেই।
বিশেষ করে, খাবার সময় যদি লাইটের চারপাশে পোকা উড়তো, তাহলে খুব বিরক্ত হতো। বলতো,পোকাদের সাথে নিয়ে খাওয়া যাবেনা। আগে ওদের বিদেয় করো, তারপর খাবো।
আশিকের মা বলতেন,শীতের সময় এরকম পোকা হয়। তাই সন্ধ্যার আগেই দরজা-জানালা বন্ধ করে দিতে বলতেন।
আজ কিন্তু এই একাকী বারান্দায় বসে পোকা গুলোকে রিয়ার খারাপ লাগলো না।
ওদেরকে আপন আপন লাগলো।
টুং করে একটা শব্দ হলো। মোবাইলের স্ক্রিন লাইটটা জ্বলে উঠলো।
রিয়া মোবাইল হাতে নিয়ে অবাক হলো।
আশিক টেক্স করেছে।
মৃদু হাসি ফুটে উঠলো রিয়ার ঠোঁটে…
(আগামী পর্বে সমাপ্ত)#ক্যানভাস_গল্পোৎসব_২০১৮_মার্চ
#বিচ্ছেদ ২০
রায়নার ডাকে রিয়ার ঘুম ভাঙ্গলো।
লেপের ভেতর থেকে মুখ বের করে বহু কষ্টে চোখ মেলে তাকালো রিয়া।
মা, প্লিজ উঠো ! আমরা এখন খেঁজুরের রস খাবো, উঠো না মা!
একটুও ইচ্ছে করছে না লেপের ভেতর থেকে উঠতে। কিন্তু মেয়ের মুখের এত মিষ্টি ডাক শুনে না উঠে পারলো না রিয়া।
প্রচন্ড ঠান্ডা !
রিয়া মোটা উলের সোয়েটার পরে নিল।
গলায় মাফলার জড়িয়ে রায়নার দিকে তাকালো। হাটু সমান মোটা জ্যাকেট, টুপি আর মোজাসহ কেডস পরে আছে মেয়েটা।
জ্যাকেটটা আশিক নিয়ে এসেছিল দেশে আসার সময়। রায়নাকে মানিয়েছে সুন্দর।
ঠিকঠাক মত শীতের পোষাক পরে আছে দেখে মনে মনে খুশী হলো রিয়া।
নিশ্চয় মা পরিয়ে দিয়েছেন।
মেয়ের হাত ধরে দো’তলা থেকে নিচে নেমে এলো। বাড়ীর ভিতরের দিকে চমৎকার উঠোন। সেখানে একপাশে মাটির চুলোয় গরম গরম ভাপা পিঠা তৈরী হচ্ছে।
উঠোনে কয়েকটা প্লাস্টিকের চেয়ার দেয়া হয়েছে। সেখানে বসে আছেন বাবা,দুলাভাই,ভাইয়া,আপু, ভাবী…
আশে-পাশের বাড়ীর জ্ঞাতী আত্মীয় স্বজনরা আসছেন মাঝে মাঝে।
এভাবে সবাই একসাথে বহুদিন পর বাড়ীতে এসেছে বলে গ্রামের আত্মীয়-স্বজন খুব খুশী।মা, চাচীর সাথে পিঠা বানাতে ব্যস্ত।
ছোট চাচা গ্লাসে গ্লাসে রস ঢেলে দিচ্ছেন,
বাবা বললেন, ‘খেয়ে দ্যাখ্…এমন সুস্বাদু খেজুরের রস গ্রাম ছাড়া কোথাও পাবিনা। ঢাকায় এসব পাওয়ার কথা ভাবাই যায়না।’
সবাই স্বাদ মিটিয়ে রস খেলো।
রায়না রসের গ্লাসে চুমুক দিয়ে অভিভূত হয়ে গেল। বললো, ma,I love this juice.
from now it’s my favr
রায়নার কথা শুনে সবাই হেসে উঠলো।
রসের গ্লাস হাতে নিয়ে আশিককে মনে পড়লো রিয়ার। আশিকও খেজুরের রস খুব ভালবাসতো। মেয়েটা একেবারেই ওর বাবার মত হয়েছে।
শীতের দিনে ছুটির সকালে রায়নার দাদী ভাপা পিঠা বানাতেন। যাতে আশিক গরম পিঠা খেতে পারে। আশিকের কত বাহানা ছিল। গুড় বেশী দিতে হবে, নারকেল দেয়া যাবেনা,আবার পিঠা খুব মজা হতে হবে…. মা সেরকম করেই বানিয়ে দিতেন।
সেই দিন গুলো অন্যরকম ছিল !
ফিরে পেলে মন্দ হতো না।
গরম ভাপা পিঠা থেকে নতুন গুড়ের একটা সুঘ্রাণ আসছে।
রিয়া রসের গ্লাসে চুমুক দিলো।
আজ কি একটু কষ্ট হচ্ছে আশিককে রেখে এসব খেতে ?
পিঠা খাওয়ার পরে ওরা সবাই গ্রাম দেখতে বেরিয়েছিল।
ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশির,হলুদ শরিষার ক্ষেত, ফুল কপি,বাঁধা কপি, টাটকা ধনিয়া পাতা, গাজর,মুলার ক্ষেত দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল সবাই। রায়না যেন প্রজাপতির মত উড়ছিল..
শীতের টাটকা শাক-সবজি আর নদীর তাজা মাছের ঝোল দিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে সবাই যার যার রুমে বিশ্রাম নিচ্ছিল।
রিয়া দো’তলার বারান্দায় পুরনো ইজিচেয়ারে আধা-শোয়া হয়ে বই পড়ছিল।
ঘুমিয়ে পড়েছিল বোধহয়।
কেউ তাকে ডাকছে বহুদূর থেকে। রিয়া দৌড়াচ্ছে সেই ডাক লক্ষ করে।
রায়নার হাত ধরে ঠিকমত দৌড়াতেও পারছেনা। রিয়া অবাক হয়ে খেয়াল করলো সে রায়নাকে নিয়ে রেল লাইনের উপর দিয়ে ছুটছে। অনেক দূরে আশিক হাত বাড়িয়ে দাড়িয়ে আছে..
রিয়ার খুব কষ্ট হচ্ছে.. খুব কষ্ট।
কিছুতেই এগোতে পারছে না।
রায়না বলছে,মা.. ঐ যে বাবা, আরো জোরে চলোনা মা ! প্লিজ মা !!
আর একটু এগোলেই আশিকের হাতটা ধরতে পারবে রিয়া। আর একটু…
‘এই রিয়া.. ওঠ ! মশা কামড়াবে তো !’
মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো রিয়ার।
ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
আশিক রেললাইনের উপরে দাড়িয়ে ওকে রিয়া রিয়া বলে ডাকছিল না ?
এতক্ষণ তবে সপ্ন দেখছিল রিয়া ?
রিয়া কিছুতেই মনে করতে পারছেনা, ও কি আশিকের হাতটা ধরতে পেরেছিল ?
একবার মনে হচ্ছে পেরেছিল। আবার মনে হচ্ছে, নাহ্ ধরতে পারেনি।
কোনটা সঠিক ?
সপ্নের কথা মনে থাকে না ঠিকমত।
খাবার ঘরে তুমুল আড্ডা চলছে…
রিয়া এক মগ গরম চা নিয়ে বসলো সবার সাথে। পারিবারিক আড্ডা।
সবার ছোটবেলা নিয়ে কথা হচ্ছে আর এই নিয়ে হাসাহাসিও হচ্ছে।
সবার মনে কত আনন্দ !
রিয়ার দেখেও ভাল লাগছে।
ছোট চাচী এরই মধ্য দু’বার চা বানিয়ে দিয়েছেন। সাথে ঝাল্ নিমকি।
মা চোখ গরম করে বলেছেন,আর কিন্তু চা হবেনা। শেষে রাতে আর কেউ ঠিকমত খেতে পারবেনা।
গতরাতে আশিকের মেসেজ দেখা মাত্র অদ্ভুত এক অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল রিয়া। সেই প্রথম জীবনের মত।
একটু ভাল লাগা…একটু অস্বস্তি..
মেসেজ পড়ে মন ভাল হয়ে গিয়েছিল রিয়ার।
রায়নার আমেরিকান নাগরিকত্বের কাজ বেশ খানিকটা এগিয়েছে।
আরো সময় লাগবে, তবে হয়ে যাবে।
এটা ভাল খবর।
রিয়া চায়,রায়নার ভবিষ্যৎ সুদৃঢ় হোক।
সে যেন তার বাবার কাছে যাওয়ার সুযোগ পায়। আমেরিকার মত দেশে গিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহন করতে পারে।
দশ মিনিট চ্যাট করেছিল ওরা।
এই প্রথম। এর আগে কখনো চ্যাট হয়নি আশিকের সাথে।
মেইলে যোগাযোগ হয়েছে।
আশিক কি আরো কিছু বলতে চাইছিল ?
হয়তো। রিয়া কথা বাড়ায়নি।
তবে আশিক কথা বললে হয়তো আরো কিছুক্ষন চ্যাট হতে পারতো।
ওরা কেমন আছে জানতে চাইছিল।
রিয়া জানিয়েছে, ওরা গ্রামে বেড়াতে এসেছে।
রায়না খুব আনন্দে আছে জেনে আশিক খুশী হয়েছে।
শুভরাত্রি বলার আগে আশিক লিখলো,
‘তোমরা দু’জন সাবধানে থেকো।
ঠান্ডা লাগিয়ে ফেলো না।’
রিয়ার মন কেমন করে উঠলো।
কত বছর পরে আশিক এভাবে বললো।
অথচ,আগে এভাবে বলা এবং শোনাটা অভ্যস ছিল।
বিয়ের পর যতদিন একসাথে সংসার করেছে, তার প্রতিটা দিনই অফিসে যাওয়ার সময় আশিক রিয়াকে বলতো, সাবধানে থেকো।
আর দু’জন যদি পরষ্পর থেকে দূরে থাকতো,তাহলে তো কথায় নেই।
বার বার ফোন করে রিয়ার খোঁজ নিত।
সাবধানে থাকতে বলতো।
সময়ের ব্যবধানে আজ এগুলো শুধুই স্মৃতি।
সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।
ট্রেন ছুটছে…
রিয়া জেগে বসে আছে জানালার পাশের সীটে। ট্রেনের জানালার গ্লাসের ভিতর দিয়ে রাতের অন্ধকারে তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবুও, রিয়া তাকিয়ে আছে বাইরে।
মাঝে মাঝে দূরের স্টেশনের আলো দেখা যাচ্ছে।
গত দশদিনে ওরা খুব আনন্দ করেছে।
নদীতে সাঁতার কেটেছে। এক বিকেলে নদীতে নৌকায় চড়েছে সবাই মিলে।
বিভিন্ন রকম পিঠা-পায়েস খাওয়া,আত্মীয় স্বজনের বাড়ীতে বেড়ানো,তাদের আন্তরিক আপ্যায়নে মুগ্ধ হয়েছে বার বার।
কিভাবে সবার সাথে আনন্দে কেটে গেল
দশটা দিন টের পেলো না কেউ।
রায়না খুব খুশী।
এই ক’দিনে মাঝে মধ্যে আশিকের সাথে চ্যাটিং হয়েছে রিয়ার। প্রয়োজনীয় কথা দিয়ে শুরু করতো আশিক। তারপর দু’চারটা সাধারণ কথা বলতো।
রিয়া খেয়াল করেছে, আশিক এবং সে একে অপরের সাথে কিছুটা সহজ হয়েছে।
এটা একদিক দিয়ে ভাল হয়েছে।
যেকোন ব্যাপারে সরাসরি কথা বলতে সুবিধা হয়। এই জীবনে বহুবার আশিকের সাথে তাকে কথা বলতে হবে।
রায়নার ব্যাপারে যেকোন সিদ্ধান্ত নিতে গেলে এখন তো আশিকের সাথেও কথা বলতে হবে।
কারণ, রায়না তাদের দু’জনেরই সন্তান।
যদিও,আশিক এমন দাবী জানায়নি, তবে রিয়া রায়নার প্রতি আশিকের অধিকারকে অস্বীকার করতে চায়না।
রিয়া শুনেছে কিছু কিছু পরিবারে সন্তানদের ব্যাপারে বাবা বা মা যেকোন একজন যা সিদ্ধান্ত নেয়, সেটাই শেষ কথা হয়।
কিন্তু রিয়া সেরকম কিছু করতে চায়না।
আশিক যখন ছিলনা,তখন রিয়া সব সিদ্ধান্ত একাই নিয়েছে মেয়ের ব্যাপারে।
আজ যখন আশিক তার মেয়ের পাশে এসে দাড়িয়েছে,তখন শক্ত করেই মেয়ের হাতটা ধরুক, রিয়া মনে মনে চায়।
রিয়া জানালার গ্লাসটা একটু খানি খুলে দিলো। বাইরে অনেক ঠান্ডা।
ট্রেনটা মনে হয় থেমেছে কোন স্টেশনে।
কোন স্টেশন এটা ?
ইন্টারসিটি ট্রেন সব স্টেশনে থামেনা।
নির্দিষ্ট স্টেশনে ট্রেনটা থামে খুব অল্প সময়ের জন্য। ছোট স্টেশনগুলোতে কেমন টিমটিমে আলো জ্বলে।
ছোট খাট দু’একটা চা,পান,সিগারেট, চিপস,কলা,পাউরুটির দোকান থাকে।
শীতের রাতে কিছু যাত্রী ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করে আর গরম চা- সিগারেট খায়।
সারারাত খোলা থাকে দোকানগুলো।
স্টেশনের বেঞ্চের নীচে একটা কুকুর শুয়ে আছে কুন্ডলী পাকিয়ে।
আহা বেচারার শীত লাগছে বোধহয় খুব।
রিয়ার খুব মায়া হলো।
অল্প বয়সী এক দম্পতি তাদের ছোট্ট মেয়েটিকে নিয়ে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিল স্টেশনে।
ট্রেনে উঠার পর মেয়ের জন্য চিপস্ কিনতে কিনতেই ট্রেন ছাড়ার হুইসেল দিয়ে দিলো। ছোট্ট মেয়েটা ‘বাবা.. বাবা..ট্রেন ছেড়ে দিলো, চলে এসো তাড়াতাড়ি…’ বলে কাঁদতে শুরু করলো।
রিয়া মেয়েটিকে এখন আর দেখতে পাচ্ছেনা।
মনে হয় পাশের কেবিনে উঠেছে ওরা।
বাবা কিন্তু মেয়ের জন্য চিপস কিনে নিয়ে তবেই দৌড়ে এসে ট্রেনে উঠলো।
ট্রেনটা ততক্ষণে আস্তে আস্তে চলতে শুরু করেছে। বাচ্চা মেয়েটি নিশ্চয় শেষ মূহুর্ত্যে চিপস কেনার বায়না করেছিল।
রিয়ার খুব ভাল লাগলো দৃশ্যটি দেখে।
সেইসাথে বুকের ভেতর একটা হাহাকার অনুভব করলো। কারণ,রায়না এই ছোট ছোট আনন্দ গুলো পায়নি তার জীবনে।
আজ রায়নার স্কুল খুলেছে।
বছরের প্রথম দিন ওদের স্কুল থেকে আজ নতুন বই দেবে।
কোন্ সেকশন, কত রোল নম্বর, সব জানতে পারবে আজ ক্লাসে গেলেই।
রিয়ারও আজ অনেক ব্যস্ততা স্কুলে।
সাতটার আগেই ওরা স্কুলে চলে এসেছে।
আজ অনেকটা স্বাভাবিক লাগছে রিয়ার।
ছুটিতে যাওয়ার আগে যা অবস্হা হয়েছিল !
ঐ বিষয় গুলো থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে একটু একটু করে।
গ্রামের বাড়ীতে থাকতে একদিন মেঝো খালা মাকে ফোন দিয়েছিলেন।
কি বলেছেন কে জানে। তবে, মা খালাকে বলেছেন, ‘মেঝোআপা আমি ঢাকায় এসে তোমার সাথে কথা বলবো।’
মা রিয়াকে কিছু বলেননি।
তবে বড় আপু একদিন বলেছিল,কি সিদ্ধান্ত নিলি রে রিয়া ? যা করবি খুব ভেবে চিন্তেই করিস।
রিয়া মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিয়েছিল।
গতকাল খুব ভোরে ওরা ঢাকায় পৌছে গিয়েছিল।
স্টেশন থেকে ওদেরকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন বাবা আর ভাইয়া।
রায়না তার মামুকে জড়িয়ে ধরে থ্যাঙ্কস্ দিয়েছিল রাতের ট্রেন জার্নি করতে পেরেছে বলে। রায়নার জন্যেই রাতের ট্রেনে আসা।
বড় আপুরা চিটাগং ফিরে গেছে গতকালই।
ভাইয়া দেশে থাকবে মাস খানেক…
টিচার্স রুমে ঢুকতে না ঢুকতেই মায়ের ফোন।
রিয়া ফোন রিসিভ করে বললো, ‘মা আমি তোমাকে বাসায় ফিরে ফোন দিবো। এখন অনেক ব্যস্ত, মা।’
মা বললেন, মনে করে ফোন করিস কিন্তু।
রিয়া ব্যাগটা টেবিলে নামিয়ে রেখে চেয়ার টেনে বসে পড়লো। চা খেতে ইচ্ছে করছে খুব।
টিচার্স রুমের আয়া পারুলকে ক্যান্টিন থেকে চা আনতে বললো।
পারুল চট্ করে চা নিয়ে এলো।
চায়ে চুমুক দিয়েই মনে পড়লো আশিককে জানানো হয়নি ওরা ঢাকায় ফিরেছে।
ইস্ ! ইভাকেও একটা ফোন করা হয়নি।
ঢাকায় ফিরেই ফোন দিতে বলেছিল ইভা।
বাসায় ফিরে সবাইকে ফোন করতে হবে।
ঘন্টা পড়তেই রিয়া আবার ক্লাসের দিকে ছুটলো।
ইভার সাথে কথা হয়েছে।
আজ রায়নাকে নিয়ে যাবে ওর বাসায়। রাতে ডিনার করিয়ে নিজেই আবার দিয়ে যাবে।
একটু পরেই আসবে ইভা।
রায়না রেডী হচ্ছে। ফুপির বাসায় যাবে বলে।
রিয়া শাওয়ার নিয়ে বারান্দার রোদে বসেছে।
শীতের রোদে বসে থাকতে বেশ ভাল লাগছে।
ইভার গাড়ীর আওয়াজ পাওয়া গেল।
ইভা উপরে এসে রায়নাকে নিয়ে গেল।
রিয়া বারান্দায় দাড়িয়ে ওদের চলে যাওয়া দেখলো।
গত এক বছরে এই পরিবর্তন গুলো এসেছে রায়নার জীবনে। সে তার পরিবারকে ফিরে পেয়েছে। তার চাচ্চু-ফুপি নিয়মিত যোগাযোগ এবং আসা-যাওয়া করে। রায়নাও অনেক সহজ হয়েছে। ওর হতাশাও অনেকটা কমেছে বলেই মনে হয় রিয়ার।
স্কুল থেকে ফিরে আসার পর রায়না তার বাবার সাথে কথা বলেছে। নতুন ক্লাস, নতুন বই নিয়ে কত কথা যে তার বলার ছিল বাবাকে ! রায়নার এই ছোট ছোট আনন্দ গুলো রিয়াকে ছুঁয়ে যায়। আহা ! এভাবেই ভাল থাকুক তার মেয়েটা।
রুমে এসে মাকে ফোন করলো রিয়া।
মা ওপ্রান্ত থেকে নরম গলায় বললেন, ‘তোর মেঝো খালার সাথে কথা হয়েছে। ওদের কোন ডিমান্ড নেই। তবে তোর খালা বলেছে আমরা নিজে থেকে কিছু দিলে ওরা নিশ্চয় খুব খুশীই হবে। এখন তুই বললেই একটা ডেট ঠিক করা হবে। এটা শুধু কাজগে-কলমেই হবে, তুই চিন্তা করিস না …’ মা আরো কি কি যেন বলছিলেন।
রিয়ার কানে আর কিছু যাচ্ছিলনা।
ওর শরীরটা খারাপ লাগতে শুরু করলো।
পরে কথা বলবে বলে মোবাইলটা রেখে দিল।
রিয়া ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিল।
খুব কষ্ট হচ্ছে রিয়ার।
আশিকের সাথে কথা বলা দরকার।
রিয়া বারান্দার চেয়ারে বসে দূরের কামিনী গাছটার দিকে তাকিয়ে রইল।
মনে মনে বললো,এমন জীবন কি চেয়েছিল রিয়া ?
নিজেকে খুব অসহায় লাগছে।
রিয়া চোখ বন্ধ করে ফেললো। রায়নার মুখটা ভেসে উঠলো।
রিয়া সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো।
মোবাইলটা বেজেই চলেছে।
রিয়া শুনতে পাচ্ছেনা। বারান্দার চেয়ারে বসে গভীর চিন্তায় ডুবে ছিল সে।
সিদ্ধান্তটা নিতে পারার পর খানিকটা স্বস্তি ফিরে এসেছে ওর মনে।
হট্যৎ ই খেয়াল করলো, মোবাইলটা বাজছে অনেকক্ষণ ধরেই। ইভার ফোন।
বললো, ‘ভাবী, তুমি জলদি ধানমন্ডি সাতাশে চলে এসো। চাইনিজ রেস্টুরেন্টের ঠিকানা এসএমএস করে দিচ্ছি। ওয়েটিং ফর য়্যু।
প্লিজ জলদি এসো…’
রিয়া না করতে পারলো না।
ইভা বললো, ‘আমি তোমার জন্য গাড়ী পাঠিয়েছি সন্ধ্যা হয়ে গেছে বলে। প্লিজ, না করো না। আমার গাড়ীতেই এসো।’
রিয়া হাসলো,’প্রয়োজন হতো না। আমি চলে আসতে পারতাম ট্যাক্সিতে। পাঠিয়েই দিয়েছো যখন, তখন তোমার গাড়ীতেই আসবো। ধন্যবাদ।’
রিয়া একটা নীল শাড়ী পরলো।
নীল টিপ্ আর নীল শেডের কাজল পরলো।
রিয়া সবসময় খুব গুছিয়ে পরিপাটি করে সাঁজে। স্কুলের প্রোগ্রাম গুলোতে শাড়ী পরতে হয় ওদের। সবাই ওর পরিমিত স্নিগ্ধ সাজ খুব পছন্দ করে।
রায়না মাকে শাড়ী পরতে দেখলে খুব খুশী হয়। আজ মেয়েটার জন্যেই শাড়ী পরলো রিয়া। নীল রঙের শাড়ী পরলে রায়না খুব খুশী হয়। আজ মেয়েটার পছন্দের সবকিছু পরতে ইচ্ছে করলো রিয়ার।
অনামিকায় ছোট্ট নীল পাথরের আংটি।
গাড়ীতে বসে মাকে ফোন করে জানালো,আমি কাল একবার বাসায় আসবো। তখন কথা হবে।’
রিয়া বাসায় যাবে শুনে মা খুশী হলেন।
রেস্টুরেন্টটা খুব সুন্দর। টিপটপ করে সাজানো। হালকা নিলাভ আলোয় মায়াবী একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
রিয়া রিসেপশনে পরিচয় দিতেই একজন ওয়েটার ওকে দোতলায় নিয়ে এলো।
এখানে একটু নিরিবিলি।
কোনার দিকে একটি সুন্দর টেবিল দেখিয়ে বললো,’ম্যাম আপনি বসুন। এই টেবিলটাই আপনাদের জন্য বুকিং দেয়া হয়েছে।’
রিয়া কিছু বলার আগেই চলে গেল ওয়েটারটা।
রিয়া টেবিলটার দিকে তাকালো।
ধবধবে সাদা চাদরের উপরে আরো একটি ছোট চারকোনা হালকা নীলাভ চাদরে ঢাকা টেবিলের দু’পাশে দু’টো মাত্র চেয়ার।
টেবিলের মাঝখানে এক গুচ্ছ নীলাভ অর্কিড জাতীয় ফুল। অর্কিডের মাঝে মাঝে সাদা সাদা হাসনাহেনা ফুল দিয়ে সাজানো।
মিষ্টি একটা সুবাস এসে লাগছে নাকে।
রিয়ার ভাল লাগছে।
তবে, তারচেয়েও অবাক লাগছে বেশী।
রায়না কোথায় ? রাশিক, ইভা.. এরা সব কোথায় ? সবাই থাকবে বলেছিল।
মোবাইল বের করার জন্য হ্যান্ডব্যাগে হাত দিলো রিয়া। ফোনটা বের করার আগেই শুনতে পেলো, ‘ কেমন আছো রিয়া ? ‘
ঝট্ করে মুখ তুলে সামনের তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল রিয়া।
আশিক দাড়িয়ে আছে সামনে।
কেঁপে উঠলো রিয়া ভিতরে ভিতরে।
কিভাবে সম্ভব ?
আশিক কবে আসলো দেশে ?
একবারও বলেনি তো দেশে আসবে সে ?
‘খুব অবাক হয়েছো তাইনা ?’
-বলতে বলতে বসলো আশিক।
রিয়া কোন কথা বলতে পারলো না।
আশিক মিষ্টি করে হাসলো,
‘আমার মেয়েকে কথা দিয়েছিলাম,ওকে দেখতে আসবো এসময়। আর তোমার সাথে দেখা করাটাও জরুরী হয়ে পড়েছিল। তাই চলে এলাম।’
রিয়া আস্তে করে বললো, খুব ভাল হয়েছে।
কিছুক্ষণ কোন কথা বললো না ওরা।
রিয়া মুখ নিচু করে বসে থাকলো।
আশিক মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে রিয়ার দিকে।
নীল শাড়ীতে ওকে অপরুপ লাগছে।
আশিক ভাবছে, কিভাবে শুরু করা যায় কথা।
নীরবতা ভাঙ্গলো রিয়া।
রায়না, ইভা এরা কোথায় ?
-প্রশ্নটা আশিককেই করলো রিয়া।
আশিক জানালো, সে দেশে এসেছে গতকাল রাতে। রায়নার সাথে বিকেলেই দেখা হয়েছে।
বাবাকে দেখে প্রচন্ড অবাক এবং খুশী হয়েছে মেয়েটা। কি করবে, কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। সারাবিকেল রায়নার সাথেই খুব আনন্দে সময় কাটিয়েছে আশিক।
আশিক হাসলো,’তোমাকেও অবাক করে দিতে ইচ্ছে করলো,তাই এই আয়োজন।’
রিয়া হাসলো, হুম খুব অবাক হয়েছি।
আশিক বললো, কফি হতে পারে ?
রিয়া মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, হতে পারে।
আশিক কফি অর্ডার করলো।
পাঁচ মিনিটেই কফি চলে আসলো।
বহু বছর পর আবার দু’জন একই সাথে
কফি খেতে খেতে কথা বলা শুরু করলো।
আশিক বললো, বহু বছর পর- বহু ঘটনা আর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আজ আমরা এখানে এসে দাড়িয়েছি। এখন আর এমন কিছু করতে চাইনা যা তোমাকে -আমাকে ভয়াবহ কষ্টের মধ্য ঠেলে দিতে পারে।
রিয়া তাকিয়ে থাকলো আশিকের মুখের দিকে। কোন কথা বললো না।
সত্যিই তো !
ওদের সম্পর্কটা সহজ হয়েছে।
কিন্তু আজ ওরা কঠিন একটা অবস্হার মুখোমুখি এসে দাড়িয়েছে।
রিয়া বললো, ‘আমরা রায়নার বাবা-মা, এই
সম্পর্কটা কিন্ত কখনোই মিথ্যা হয়ে যায়নি এবং হবেও না।
আমি এই সম্পর্কটাকে খুব সম্মান করি।
তবে, ফিরে আসার পথটা খুব সহজ নয়।’
আশিক সাথে সাথেই বললো, ‘তোমাকে নতুন করে কোন কষ্ট দিতে বা অসম্মান করতে চাইনা আমিও।’
রিয়া কৃতজ্ঞ চোখে তাকালো আশিকের দিকে।
আশিক বললো, আমাদের অপরিণত সিদ্ধান্তের ফলে রায়নাকে এত দূর্ভাগ্যের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে।
তবে আর রায়নাকে কষ্ট পেতে দেবো না। আমরা দু’জন একসাথেই রায়নাকে মানুষ করবো।
রিয়া দুঃখী গলায় বললো, তোমার খুব কাছে না আসতে পারলেও, আমরা পাশাপাশি পথ চলতেই পারি।
আশিক আলতো করে রিয়ার হাতে হাত রেখে প্রগাঢ় কন্ঠে বললো, ‘পারি.. অবশ্যই পারি।”
রিয়া নিজের বুকের ভিতরে নদীর পাড় ভাঙার শব্দ শুনতে পেলো…
গভীর বিষাদে আচ্ছন্ন আশিক, বিষর্ন্ন চোখে তাকিয়ে আছে রিয়ার চোখে। রিয়ার হাত ওর হাতের মুঠোয় ধরা..
কি গভীর মায়া রিয়ার চোখে !
রিয়ার চোখ টলটল করছে জলে,
একবার পলক পড়লেই টপ্ টপ্ করে ঝরে পড়বে ফোঁটা ফোঁটা জল !
প্লিজ..রিয়া, পলক ফেলো না…
এত জল আমি রাখবো কোথায় ?????
( সমাপ্ত )
মাশাওফি আমিন
১৯/০৩/২০১৮