#অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤️
#অন্তিম_পর্ব:৪৬
#কায়ানাত_আফরিন
রাতের গহীনে ফারহান আর আফরা দুজনেই এখন আছে রাতারগুলের ওয়াচটাওয়ারে। বাইরে চলছে ঝমঝমিয়ে মুষলধারে বৃষ্টি। তাই বাতাসের দাপটে দুজনেই বৃষ্টিকণার ছোয়ায় ভিজে যাচ্ছে বারবার। ঘড়িও এখন যেনো ধীরগতিতে এগিয়ে যেতে মগ্ন। কিছুতেই সময় যেনো দ্রুত বেগে যাচ্ছে না। আফরা প্রথম প্রথম ভেবেছিলো সময়টা দ্রুত চলে যাক। এখানেকার মায়া নিয়ে কিছুতেই সে অ্যামেরিকায় ফিরে শান্তিতে থাকতে পারবে না। তাই দ্রুত যাওয়ারটাই শ্রেয়। ক্রমান্বয়ে সময় যত এগিয়ে যেতে থাকলো, পরিবর্তন হলো আফরার মনের ধারনাটুকু। এখন ওর শুধু মনে হচ্ছে যে এই সময়টা এখানেই থেমে থাকলে ভালো হবে। কেননা এই বৃষ্টি, এই উঁচু টাওয়ার থেকে দেখা দৃশ্য তাক লাগিয়ে দিচ্ছে ওর চোখে।
ফারহান স্থির। দৃষ্টি নিবদ্ধ মুগ্ধ হয়ে থাকা আফরার দিকে। ওর পরনে সবুজ সালোয়ার কামিজ যেন ওকে আরও মায়াবী করে দিয়েছে। বৃষ্টির প্রতিটি ফোটা ওর গায়ে মিশে থাকাতে জানান দিচ্ছে নিখুঁত গড়নের। তবে অন্যসময়ের আফরা আর আজকের আফরার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে পাহাড়সমান। এখনকার আফরা কেমন যেন নিস্তব্ধ, অনুভূতিহীন। ফারহান ঠোঁট নাড়ালো এবার। বিড়বিড়িয়ে ডাক দিলো,
‘ আফরা!’
আফরা পিছে তাকালো এতে। চোখর দৃষ্টি নিষ্প্রভ। মেয়েটার এমন চাউনি ভালোলাগছে না ফারহানের। আচমকা সে বলে ওঠলো,
‘ কোনোদিন যদি শুনতে পারেন আমার কোনো ক্ষতি হয়ে গিয়েছে, আপনি ব্যাপারটা কেমন ভাবে নিবেন?’
আফরার মনে জমে ওঠলো প্রবল আক্রোশ। বললো,
‘ আমি ব্যাপারটা নেওয়ার কে? তাছাড়া আপনার কোনো ক্ষতি হলে আমি জানবো কিভাবে সেটা? আমি কি আপনার আপন কেউ? ‘
‘ তাহলে আপনি কি আমার?’
আফরা চুপ হয়ে রইলো৷ ফারহান ম্লান হেসে জিজ্ঞেস করলো,
‘ আপনি যদি আমার আপন কেউ হোন, তাহলে আমার দুরবস্থা সহ্য করতে পারবেন তো?’
‘ আপনার কি হবে এমন? এমন কথা বলছেন কেনো?’
আফরা নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারলো না আর। হুট করে এ প্রশ্ন ছুড়তেই ফারহানের ম্লান হাসি আরও যেন প্রসার হয়ে গেলো। বলে ওঠলো,
‘ আমার জীবনটা অনিশ্চয়তায় ঘিরা আফরা। আমি এর আগেও কারনটি বলেছি আপনাকে। তবুও কেনো রাজনীতিতে টিকে আছি জানেন? কারন এখানেকার মানুষগুলো ভালোবাসে আমায়। ওইযে নিচে যেই বাচ্চা ছেলেটাকে দেখলেন না? ও হলো পৃথিবীর সেরা ভীতু। সাপ- জোঁক এগুলো প্রচন্ড ভয় পায়। আমি যখন বললাম যে তাহলে তোর আসার দরকার নেই, নৌকাটা আমায় দে, পিচ্চিটা যেনো তেড়ে ওঠলো। কেন জানেন? কারন ওর ধারনা আমি এখানে একা আসলে কোনো বিপদে পড়ি তবে সাহায্য করবে কে! তাই এত ভয় পাওয়া সত্বেও এখানে এসে পড়লো। ওর মতো আরও অজস্র মানুষ আছে যারা প্রচন্ড ভালোবাসে আমায়। আমার চাচী বারবার বলছে যে নেলসন টি এস্টেট আমায় উনার কাছে দ্বিগুন দামে বিক্রি করে দিতে। তবুও আমি করিনি। এটা সত্য যে আমার দাদাজনের কাছ থেকে পাওয়া শেষ উপহার এটি, সেই সাথে আমার বেড়ে ওঠার জায়গা। তবুও এই জায়গাটি আমি নিজের আয়ত্বে রেখেছি যাতে আমায় যারা ভরসা করে এখানে কাজ করছে তারা যেনো ন্যায্য পাওনা পেতে পারে। এতগুলো মানুষের মন এভাবেই জয় করিনি আমি। মুখোমুখি হয়েছি নানা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির। হয়তো সামনেও পড়তে পারি। তাইতো বলছি যে আমার কোনো ক্ষতি সহ্য করতে পারবেন তো?’
মিহিয়ে গেলো আফরা। মুখ ফুটে বলতে পারলো না যে মরে যাবে সে। ফারহানের দৃষ্টি গম্ভীর হলো আরও। দিগবিদিক তাকিয়ে দেখে নিলো বৃষ্টিস্নাত পরিবেশ। তারপর আচমকা পরিস্থিতি আরও উত্তাল করে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ধরলো আফরাকে।
স্তব্ধ হয়ে গেলো আফরা। ফারহানের এতটা কাছাকাছি যেনো তোলপাড় করে তুলেছে ওর মন।বেসামাল মনে হলো ওর নিজেকে। বৃষ্টির দরুন ঠান্ডা বাতাস যেনো ছড়িয়ে পরলো সারা রাতারগুলে। আফরার শরীরর শিরশিরানি দ্বিগুন মাত্রায় বেড়ে গিয়েছে এতে। বৃষ্টির ঝিরিঝিরি শব্দের থেকে বেশি স্পষ্ট শুনতে পারছে ফারহানের বুকের ঢিপঢিপ শব্দ। আফরা অস্পষ্ট স্বরে বলে ওঠলো,
‘ ফ….ফারহ….’
‘ ভালোবাসি আফরা!’
আফরাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই আচমকা নিজের পছন্দের মানুষটার এমন কথা শোনাতে আফরা যেন অনুভূতিশূণ্য হয়ে গেলো। এতদিন ওর কান এই কথাটি শোনার জন্য হাসফাস করছিলো, আজ এই কথাটা শুনে ওর হাত পা রীতিমতো নড়াচড়া যেনো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ফারহান নিষ্প্রভ। আফরার ঘাড় বরাবর আছড়ে পড়ছে ওর উষ্ণ নিঃশ্বাস। ফারহান আবার বললো,
‘ আমার অনিশ্চয়তার প্রয়োজন নেই আফরা। আমার শুধু আপনাকে প্রয়োজন৷ আমার….আমার ভয় ছিলো আমার সাথে যদি আপনারও কিছু হয়ে যায়? কি জবাব দিবো আমি আপনার বাবা-মা’কে? আপনার পাগলামি, উলট-পালট কথা, হুটহাট রাগ করা, গভীর প্রগাঢ় দৃষ্টি এসব কিছু শুধু আমার আফরা৷ আপনি আপাদমস্তক মানুষটিই আমার। এতদিন আপনি যা পাগলামি করেছেন, আপনাকে পাওয়ার জন্য দ্বিগুন পাগলামি করতে পারবো আমি। তবুও আপনাকে যেতে দিবো না। কারন আমি ভালোবাসি আপনাকে!’
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে দিলো ফারহান। পাগলাটে লাগছে মানুষটাকে। আফরার যেন অভিমান আরও দৃঢ় হয়ে গিয়েছে এতে। ফারহানের বুকে মাথা গুঁজে দু’তিনটা কিল ঘুষি মারতে মারতে বলতে থাকলো,
‘ আই উইল কিল ইউ ব্লাডি বিচ! এতদিন কোথায় চেপে রেখেছিলেন এসব কথা? আমায় এত কষ্ট দিয়ে এসব এসেছেন লাভ কনফেস করতে। আই….আই উইল কিল ইউ কমরেড! ইউ হ্যাভ টু ডাই !’
কেঁদে দিলো আফরা। তবে খুশিতে। ফারহান মুখ চেপে সহ্য করে যাচ্ছে আফরার সকল আঘাত। মুখে আজ ওর প্রাপ্তির হাসি।
আফরা এবার ফারহানের কলার টেনে নিচে নামিয়ে গভীরভাবে ঠোঁটজোড়া মিলিয়ে দিলো আবেশে।
আফরার এমন কাজে শিরদাঁড়ায় ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো ফারহানের। শরীর অবশ হয়ে এলো ক্রমশ। বাইরে চলছে ঝমঝমিয়ে মুষলধারে বৃষ্টি। তাই বাতাসের দাপটে দুজনেই বৃষ্টিকণার ছোয়ায় ভিজে যাচ্ছে বারবার। আফরা ফারহানের থেকে দূরে আসতেই ফারহান অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে তাকালো আফরার দিকে। মেয়েটার চোখ-মুখ নির্বিকার। জন্মসূত্রে অ্যামেরিকায় বড় হওয়া এই মেয়েকে দেখলে মনেই হয়না যে এই মেয়ে বাঙালি। তবুও আজ ওকে সবুজ সালোয়ার কামিজে সুন্দর লাগছে। রাতের আধারে লালচে চুলগুলো কালো দেখাতে আরও আবেদনময়ী মনে হলো ফারহানের কাছে।
ফারহান তীব্র সুরে বললো,
”আমার ঠোঁট কি খাবারের জিনিস মনে হয় আপনার কাছে?”
আফরা হাসে আলতোভাবে। মিহি স্বরে বলে ওঠলো,
”উহু ! তার থেকেও বেশি কিছু ।”
ফারহান কিছু না বলে আবার ওয়াচটাওয়ার দিয়ে বাইরের দৃশ্যে মনোনিবেশ করলো। এত ঠান্ডায়ও গরম লাগছে আফরার হঠাৎ কাছে আসাতে। এদিকে মোবাইলে অনবরত রিং বেজে চলছে। শামসু কল দিয়েছে । এত রাতে ওর কাছ থেকে নৌকা নিয়ে এখানে আসার জন্য চিন্তা করছে বোধহয়।
আফরা একটু এগিয়ে আসলো ফারহানের বরাবর। দুজনে এবার সমানতালে বৃষ্টিতে ভিজছে।আফরা এবার বললো,
–আমাদের সম্পর্ক যেমনই হোক না কেন , আমি চাই সবসময় আমরা যেন একে অপরকে আপনি করে বলি।
–কেনো?
ফারহানের গম্ভীর কন্ঠ। আফরা তার কাধে ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো। ঠোঁটদুটো আলতো ভাবে নাড়িয়ে বললো,
–আপনার মুখে আপনি ডাকটা মারাত্নক। এককথায় যাকে বলে ইনক্রেডিবল। সরি ! ইনক্রেডিবল এর বাংলা আমি জানি না।
ফারহানের কাছে এ টা তেমন কিছু না। এই মেয়ে অ্যামেরিকা থেকে বাংলাদেশে এসেছে এক মাস হয়েছে আর এর মধ্যেই ফারহান অবগত যে আফরা বাংলায় ভীষণ পটু। একটু আধটু কথা বলতে আটকে গেলেও তা ধরা বেশ কঠিন।ফারহানের শ্যামবর্ণের মুখটিতে বৃষ্টির পানি লেপ্টে আছে। ঠোঁটের কাছে জমে আছে বিন্দু বিন্দু পানি। লাল ঠোঁটগুলোকে দেখে আফরার হঠাৎ ”টুয়ালাইট” মুভির ভ্যাম্পায়ার এডওয়ার্ডের সেই ঠোঁটদুটোর কথা মনে পড়লো। সেই মুভি দেখে একবার আশাও করেছিলো এমন ভ্যাম্পায়ার বয়ফ্রেন্ড থাকলে মন্দ হতো না। আর আজ সেসব মনে পড়লে হাসি আসে।
আফরা আবার বললো,
–জানেন আমার ড্যাড কেন আমায় বিডিতে পাঠিয়েছে?
–জানি তো। তবুও আপনার মুখেই নাহয় শুনি। ‘
–আমি নাকি অ্যামেরিকায় একটা অগোছালো লাইফ লিড করি। আমার অস্তিত্বে ওয়েস্টার্ণ কালচার মিশে যাওয়াটা উনার পছন্দ না। আর বাংলাদেশই নাকি পারবে আমায় লাইফটা গুছিয়ে দিতে। সত্যি?
মিহি হাসলো ফারহান। তাই ধীরপায়ে আফরার একটু কাছে দাঁড়ালো সে। বললো,
‘ তা জানিনা, তবে ভালোবাসা মানুষের সবকিছু পাল্টে দেয় আফরা। যেমনটা আমি হয়েছি।’
আফরা আবারও হাসলো ফারহানের চোখে চোখ রেখে। মৌনতা কাটিয়ে ফারহানের কানে ফিসফিসিয়ে বললো,
–হয়তো আমাদের মতো দুজন অগোছালো মানুষের ভাগ্য একসাথেই লিখা আছে। নাহলে কি হিসেবে অ্যামেরিকা থেকে এখানে আসলাম আমি? বিষয়টা কি কাকতলীয়?অতঃপর এভাবেই তো শুরু হতে পারে নতুন কোনো গল্পের?❤
আফরা মেয়েটার কথাগুলো বৃষ্টির ছন্দের মতো বাজতে থাকলো ফারহানের কানে। আসলেই তো। কই আফরা অ্যামেরিকায় বড় হওয়া একটু পাশ্চাত্য ধরনের মেয়ে আর কই শ্রীমঙ্গলে বড় হওয়া রাজনীতিবিদ ফারহান জুবায়ের।মেয়েটা তো এসেছে মাসকয়েকের জন্য ঘুরতে। তবুও এই ২৯ বছরের জীবনে প্রথম এই মেয়ে ওকে ঘায়েল করলো। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে ফারহানের। কেমন যেন এক হিমশীতল অনুভূতি!!!
আফরা হেসে বললো,
‘ আমাকে বড্ড কষ্ট দিয়েছেন আপনি কমরেড সাহেব। এর শাস্তি তো আপনাকে পেতেই হবে। আমি তাই ফিরে যাবো আপনাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য৷ আজই যাবো। রাত সাড়ে তিনটার ফ্লাইটেই যাবো। তাছাড়া ওদিকে মম-ড্যাডের সাথে কথা পাকাপাকি করতে হবে তো!’
ফারহান দুর্বল চাহিনী নিক্ষেপ করতেই আফরা বলে ওঠলো,
‘ ডোন্ট ডেয়ার! এই চাহিনী তো দিবেনই না। তাচাড়া এই শাস্তি আপনার প্রাপ্য মিঃ কমরেড। ‘
তারপর ফারহানের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো,’ তাই চলে যাবো, চলে যাবো আপনার বুকে পুনরায় ফিরে আসার জন্য! ‘
ফারহান কোনো কথা বললো না এতে। আফরা তপ্ত শ্বাস ছাড়লো তাই। বললো,
‘ আরও থাকবেন? আমার যাওয়ার যে সময় হয়ে গিয়েছে? ‘
বলে আফরা নিচে নামার চেষ্টা করতেই ফারহান আফরার হাত টেনে নিজের সামনে দাঁড় করালো। গভীরভাবে ওষ্ঠ্যদ্বয় স্পর্শ করলো আফরার কপালে। আফরার ঠোঁটে এক বিরাট প্রাপ্তির হাসি।
রাত হয়েছে অনেক। সেই সাথে কমে গিয়েছে বৃষ্টির গতি। তবে বাতাসের আনাগোনা আগের মতোই বহমান। ক্ষণে ক্ষণে ফুলের সুবাস পরিবেশ মাতাল করে দিচ্ছে। সেই সাথে জানান দিচ্ছে আফরার বিদায় প্রহরের। ফারহান শীতল কন্ঠে বলে ওঠলো,
‘ দেখা হবে আবার তাহলে।’
‘ হুম, দেখা হবে তো! যেই চায়ের রাজ্য গল্পের সূচনা হয়েছিল, সেখানেই দেখা হবে। আবার দেখা হবে শ্রীমঙ্গলে!’
_______সমাপ্ত_______
অন্তিম বার্তা: উফফ! অবশেষে ইতি টেনেই দিলাম এটার। খারাপ লাগছে, তবে ভালোও লাগছে বেশ৷ একেতো আপনােদর আর এত অপেক্ষা করাতে হবে না আর দ্বিতীয়ত, বারবার শ্রীমঙ্গল যেতে মন চাবে না৷ যদিও এটা বিশাল একটি প্লট। কিন্ত ফেসবুকে কারনবশত খুবই সংক্ষিপ্ত করে লিখেছি আমি। ইচ্ছে আছে ভবিষ্যতে কোনো একটি সময় কিছু তথ্য সংযোজন বিয়োজন করে নতুনভাবে লিখার৷ আপনাকে ভালোবাসার প্রতি অলরেডি এডিক্টেড হয়ে গিয়েছে এই লেখিকা। আপনাদের এই গল্পের জন্য শেষ একটা কমেন্টের মাধ্যমে আরও এক দফা এডিক্টড হতে চাই৷
ভালোবাসা সবার জন্য। আজ সবার মন্তব্য চাই কিন্তু।