#অনূসুয়া
#পর্ব৮
#রাউফুন
বর্তমান
এসব ভাবতে ভাবতেই এক পর্যায়ে চেঁচিয়ে উঠলো সুসমা। সে আর অতীত ভাবতে চাই না। দিনকে দিন মানসিক রোগীতে পরিণত হচ্ছে সে। তার অতীত কেন তার পিছু ছাড়ছে না? কেন চাইলেও ভুলে উঠতে পারেনা তিক্ত অতীতটা? মস্তিষ্ক বিকল হয়ে যাচ্ছে বিষাক্ত স্মৃতি চারণে। মাথার স্নায়ুতে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে বিশ্রি ভাবে।
‘এই যে হ্যালো মিস, সেই যে এসে চুপ হয়ে গেলেন আর তো কথা বললেন না? এক ঘন্টা হয়ে গেছে আমি অপেক্ষা করছি, কিন্তু আপনার মুখ থেকে কথায় বের হলো না! আপনার কথা তো দেখছি ভারী মুল্যবান! কথার ই যদি এতো দাম হয় না জানি আপনার একটা হাসির কত দাম বাপরে। এমন গোমরা মুখো মেয়ে আমি জীবনে দেখিনি। চুপ করে বসে থাকতে থাকতেই আবার হুট করেই চেঁচিয়ে উঠলেন এটা কোনো কথা? কানের মাথা খেলেন আমার। অবশ্য আমার আপনাকে দেখতে মন্দ লাগছিলো না। যেহেতু আমি আপনার ব্যাপারে সবটাই জানি, তাই আপনাকে প্রস্তুত হওয়ার জন্য সময় দিতে চাইছিলাম। কিন্তু আমি দেখি আপনার সময় নেওয়া শেষ হয় না। এক বছরও হয়নি আপনার ডিভোর্স হয়েছে সেক্ষেত্রে আপনার এরকম রিয়াকশনই আশা করা যায়।’
সুসমা অস্থির হয়ে উৎকন্ঠা নিয়ে সামনে থাকা সুপুরুষ এর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘দেখুন মিষ্টার বিহান চৌধুরী আপনি চলে যান। আমি আর দ্বিতীয় কোনো পুরুষ মানুষের সান্নিধ্য পেতে চাই না।আমি আপনাকে বিয়ের ব্যাপারে না বলতেই এসেছিলাম। কিভাবে বলবো ভেবে না পেয়েই চুপ করেছিলাম। দেখুন আমি মায়ের কথায় এখানে এসেছিলাম। কিন্তু আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না। আমি আজীবন এভাবেই কা’টাতে চাই, একা!স্যরি আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করে বিভ্রান্ত করার জন্য!’
উঠে চলে এলো সুসমা। বিহান হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। ফোস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বিরবির করলো,
‘এ কেমন মহিলা হ্যাহ্? যাক গে, উফফ বাঁচা গেলো। এমন গম্ভীর মেয়ে আমার মোটেও পছন্দ না। ভালোই হয়েছে চলে গেছে।’
রাস্তায় এসেই সুসমা রাস্তার অপর পাশে মেরাজকে লক্ষ্য করলো। এই লোককে কোনো ভাবেই বোঝানোটা টাফ হচ্ছে। বুঝ পাতা বে’টে খাওয়ালেও এই লোক বুঝবে না। সুসমা রাস্তা ক্রস করে ভেতরের সমস্ত রাগ মেরাজের উপর উগ্রে দিলো। মেরাজ সুসমাকে সব সময় এর মতো মুগ্ধ হয়ে দেখে গেলো। সুসমা রাগ ঝেড়ে বললো, ‘লজ্জা করে না আপনার? কোনো লজ্জা নাই না? এভাবে কেন অপেক্ষা করছেন আমার জন্য? মিনিমাম সেল্ফ রেস্পেক্ট টা অন্তত যার মধ্যে নেই তার আমার জীবনে কোনো জায়গা নেই। মানে টা কি হ্যাঁ? আমি যেখানে যাচ্ছি হেংলার মতো দাঁড়িয়ে আছেন। কাজ নেই? বাউন্ডুলের মতো ঘুরে ঘুরে আমাকে ফলো করছেন। আমাকে কি একটু শান্তিতে বাঁচতে দিতে চান না? এমন নরক যন্ত্রণা কেন দিচ্ছেন আপনারা সবাই মিলে! আমি ডিভোর্সি, আমার কোনো কিছুর ঠিক নেই। আর আপনি সেই ছ্যাচড়ার মতো আমার পিছু নিয়েই যাচ্ছেন, নিয়েই যাচ্ছেন! কি করলে মুক্তি দিবেন বলুন তো? কেন আপনারা সবাই আমার পিছনে হাত ধুঁয়ে পরেছেন?’
‘আমি তোমার কোনো কথায় শুনতে চাই না। আমি কেমন ধ্যাটা সেটা নিশ্চয়ই জানো? আর আমি যদি বলি তোমার কষ্টের কারণ তুমি নিজেই তাহলে? তুমি তোমার জীবনে হইতো অনেকটা এগিয়ে গেছো কিন্তু আমি সেই একই জায়গায় পরে আছি, সেই নয় বছর আগের অনুভূতিতে। সেই একই হৃদয় দোলানে প্রেমে মত্ত আছি। আমি আমার প্রথম অনুভূতি ভুলতে চাই না। কারণ এতেই যে আমি সুখ পায়! আজও তোমাকে দেখলে আমি নয় বছর আগে ফিরে যায়, আমার প্রথম অনুভূতি, প্রথম প্রেমে পরাতে ফিরে যায়। আমি সেই ঘুরে ফিরে তোমাতেই আটকে যাচ্ছি, আমার মনটা আটকে যাচ্ছে শুধুই তোমাতে। প্রতিনিয়ত দগ্ধ হচ্ছি, তোমায় না পাওয়ার যন্ত্রণায় ছটফট করছি একি কম বেদনার? এর চেয়েও বেদনা যদি তুমি আমায় দাও তবুও আমি সেই তোমাকেই চাইবো।’
মেরাজের ফোন ম্যাসেজ পড়ে চেয়েও শক্ত থাকতে পারলো না সুসমা৷ কঠিন মানবীর মতো আচরণ করতে পারলো না। ভেতরের দূর্বল চেতনা তাকে দমিয়ে দিচ্ছে। এই লোকের কাছে তার কোনো রকম রাগ, ক্ষোভ খাটে না। সে শেষ চেষ্টার মতো করে বুঝাতে চাইলো মেরাজকে। বলল,
‘শুনুন, এসব পা’গ’লামি বাদ দিন। আমি যে একজন খু’নি জানেন? আমার মতো খু’নির সঙ্গে থাকবেন না। আপনার জীবনটা ধ্বংস হয়ে যাবে। একদম নিঃশেষ হয়ে মিশে যাবেন, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন এই পৃথিবী থেকে। সুন্দর একটা মেয়েকে বিয়ে করুন,বাচ্চা কাচ্চার বাবা হোন, সুখে সংসার করুন। বাবা মাকে আর কষ্ট না দিয়ে তাদের পছন্দ সই বিয়ে করে নিন প্লিজ! আমার মতো নগন্য একজনের জন্য কেন এমন করছেন? আমি কোথা থেকে উঠে এসেছি তা কি জানা নেই আপনার?’
‘নিশ্চিহ্ন? সে তো অনেক আগেই হয়ে গেছি। তোমার চোখের ধারালো চাহনিতে নিঃশেষ হয়ে গেছি, সর্বহারা পথিকের মতো নিঃশেষ হয়ে গেছি তোমার প্রেমে। প্লিজ এই অধমকে ফিরিয়ে দিও না আর। ভৃঙ্গরাজ ফুল যত্ন ছাড়াও সুন্দর! তুমি আমার কাছে সেই অযত্নের ভৃঙ্গরাজ ফুল! তুমি কে, কি ছিলে কোথা থেকে এসেছো, তা জেনে আমার লাভ কি? আমার সেই অযত্নে বেড়ে উঠা সুন্দর ফুল টাই চাই! আর আমি জানি আমার পছন্দ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়! আমার পরিবারের সবাই তোমাকে সাদরে গ্রহণ করবে বলে অপেক্ষায়মান সেই কবে থেকে! আর তোমার এই সুন্দর হাত কখনোই কোনো খু’নির হাত হতে পারে না। তুমি আমার থেকে দূরে যাওয়ার জন্য আর কত বাহানা দেবে সুসমা? যদি তুমি পৃথিবীতে সর্বোচ্চ, শ্রেষ্ঠ খারাপও হও তবুও আমার এই তোমাকেই চাই। আমি কখনোই তোমাকে ছাড়বো না তুমি কি তা এতোদিনেও বুঝো নি?’
আবারও একটা ফোন ম্যাসেজ এলো মেরাজের নাম্বার থেকে। সুসমা কোনো কিছুর পরোয়া করলো না। মেরাজকে পাশ কাটিয়ে নিজের গন্তব্যে চলে গেলো৷ মেরাজ সুসমার যাওয়ার পানে তাকিয়ে অশ্রু মুছে নিলো। চোখ মুছতে মুছতে পাগলের মতো হাসলো। মনে মনে ভাবলো, ‘তুমি আমার কাছে বাঁধা পরেও পরতে চাইছো না। আমি কি তোমায় পাবো না? তবে কেন তোমার প্রতি আমার এই টান? আমার ভালোবাসা যদি খাটি হয় তোমায় আমি ঠিক পাবো আমার বিশ্বাস!’
মেরাজ সুসমাকে ম্যাসেজ লিখলো আরও একটি।
‘তুমি সবাইকে ফেরাতে পারলেও আমাকে পারবে না,পারোও নি। কারণ তুমি মানো আমি সবার মতো না। আমাকে হটানো এতো সহজ হবে না। শেষ অব্দি চেষ্টা করে দেখতে পারো আমাকে তোমার পিছু নেওয়া থেকে আটকাতে পারো কি না। আমি আসবো তোমার বাড়িতে। এবার আর তোমার অনুমতির অপেক্ষা নয়, তোমার অনুমতির তোয়াক্কা আর করতে পারছি না। এর জন্য আমায় যে শাস্তি দেবে মাথা পেতে নেবো। কিন্তু তোমায় হারানোর মতো শাস্তি আমি গ্রহণ করতে পারবো না। তোমার মুখ চেয়ে এতোদিন তোমার পরিবারকে জানাইনি, সম্বন্ধ নিয়ে যায়নি কিন্তু এখন যাবো। তৈরি থাকো।’
মন মেজাজ বিক্ষিপ্ত নিয়ে বাড়ি ফিরে ঘরের দরজাটা আটকে দিলো সুসমা। সে কি করবে এখন? বাঁচার যে কোনো পথ অবশিষ্ট নেই। একদিকে অতীত তার পিছু ছাড়ছে না, অন্যদিকে মেরাজ আঠার মতো লেগে আছে। নাম্বার চেঞ্জ করে ফেললেও মেরাজ তার নাম্বার ঠিক পেয়ে যায়। এই এক বছরে এতো সীম চেঞ্জ করেছে যে বলার বাহিরে। কিন্তু তবুও কোনো না কোনো ভাবে নাম্বার ঠিক জোগার করে নিয়েছে মেরাজ৷ সে মেরাজকে আর কঠিন বাক্য ছুড়তে পারছে না। একটা মানুষকে আর কিভাবে, কত ভাবে বোঝানো সম্ভব? তার কথার তীরে প্রতিনিয়ত মানুষটা ক্ষ’ত বি’ক্ষ’ত হচ্ছে। তবুও হার মানছে না। আফসোস সে এমন ভালোবাসার একজন কাঙালকে নিজের জীবনে জায়গা দিতে পারছে না। পারছে না নিজের বিষাদে ভরে যাওয়া জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে তাকে বিষাক্ত করে দিতে৷ সেদিন সুসমা বিবাহিত জানার পর মেরাজ আর সামনে আসেনি কিন্তু নিয়মিত চিঠি দেওয়া বন্ধ করেনি। সেগুলো সে পড়ে আবার পুঁড়িয়ে ফেলতো যখন রাশেদ অফিসে থাকতো। শাশুড়ী মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে চিঠি পড়াটা ছিলো সবচেয়ে কঠিন। কেন যেনো সে মেরাজের দেওয়া চিঠি গুলো না পড়ে থাকতে পারতো না। মনের বিরুদ্ধে গিয়েও চিঠি গুলো পড়তো। চিঠি গুলো পুঁড়ানোর সময় তার মনে হতো চিঠি নয় তার অন্তর ই পুঁড়ে যাচ্ছে।
কারিমা দরজার বাহিরে পায়চারি করছে। মেয়েকে নিয়ে ভীষণ চিন্তায় দরদর করে ঘামছেন তিনি৷ তার মেয়ে যা ধ্যাটা হয়েছে নিশ্চিত এবারের ছেলেটাকেও অপমান করে ফিরিয়ে দিয়েছে। মেয়েকে নিয়ে পরেছেন মহা বিপাকে। এই মেয়ের সঙ্গে কিভাবে পারা যায়? বোবার সঙ্গে কি কেউ পারে? সর্বক্ষণ গাম্ভীর্যের সঙ্গে মুখটা সেটে বসে থাকে। মেয়েকে এখন তিনি ভয় পান, মেয়ের রাগ, মেয়ের মেজাজকে ভয় পান তিনি।
দপদপ শব্দ শুনে সুসমা দরজা খুলে গম্ভীরমুখে দাঁড়িয়ে পরলো। মায়ের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বুকের সঙ্গে হাত ভাজ করার পর কারিমা পায়চারি থামিয়ে আমতা আমতা করে বললেন,
‘ওখানে গেলি, ফিরে এসে কিছু তো বললি না। ছেলে পছন্দ হয়েছে?’
সুসমা সন্তর্পণে বললো, ‘ছেলে সুন্দর!’
কারিমার চোখ জোড়া চকচক করে উঠলো৷ মেয়ে ডিভোর্স এর পর এই প্রথম কোনো ছেলেকে সুন্দর বলেছে। খুশিতে বললেন, ‘তার মানে তোর ছেলে পছন্দ হয়েছে? আল্লাহ আমার কথা শুনেছেন। আমি যায় তোর বাবাকে খবরটা দিয়ে আসি।’
‘আমি বলেছি আমি বিয়ে করবো? ছেলেটা অনেক সুন্দর। তারপর আবার অবিবাহিত! আমার উনত্রিশ আর ছেলেটার ত্রিশ৷ আমার চেয়ে মাত্র এক বছরের বড় আবা প্রথম পাত্র! এমন ছেলের জীবন আমি নষ্ট করতে চাই না। তাই মানা করে দিয়ে এসেছি!’
কারিমা হতাশ হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মেয়ের গম্ভীর মুখ দেখে আর কিছু বলতে ইচ্ছে করলেও পারলেন না। আপন মনে বিরবির করে চলে গেলেন। সুসমা মায়ের যাওয়া দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
#অনূসুয়া
#পর্ব৯
#রাউফুন
সুসমাদের বাড়িতে বিয়ে বিয়ে আমেজ৷ মেরাজ সত্যিই পরদিন তার বাবা মাকে সাথে করে নিয়ে এসেছে। সুসমা টু শব্দ টি করেনি বাবা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে৷ তবে সে সিদ্ধান্ত নিলো যেভাবেই হোক বিয়েটা আটকাবে। মেরাজের জীবনটা এভাবে নষ্ট করে দেওয়ার মানেই হয় না৷ মেরাজ সুসমার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। সুসমার অস্বস্তি বাড়ছে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে৷ এতো গুলো মানুষের সামনে কি বলবে না বলবে ভেবে পাচ্ছে না। পাছে নিজের বাবা মায়ের শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। এদিকে সুসমা সুযোগ খুঁজছে কখন সে মেরাজকে একলা পাবে৷ সে লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে ময় মুরুব্বীর সামনেই বলল,’আমি কি উনার সঙ্গে একটু আলাদা কথা বলতে পারি?’
মেরাজের ছোট বোন, বাবা মা, দাদি সহ সবাই মিটমিট করে হাসলো। আরও আত্মীয় স্বজনরা এসেছে। মোট কথা মেরাজ সকল প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে যেনো সুসমা না করতে না পারে৷ এমন ব্যবস্থা করবে তা সুসমার ভাবনার বাহিরে ছিলো। মেরাজের কথা আর কাজে যারপরনাই অবাক হয়ে গেছে সুসমা। সবাই অনুমতি দিলে মেরাজ আর সে ছাদে চলে গেলো। ত্রস্ত পায়ে হেঁটে গিয়ে সুসমা মেরাজের পাশে দাঁড়িয়ে পরলো। মেরাজ সুসমার মুখোপানে তাকিয়ে মুগ্ধ হয় সেই প্রথম দিনের মতোই৷ দৃষ্টি স্থির রেখেই টেক্সট করলো মেরাজ। লিখলো,’তোমার বারণ শুনতে আসিনি আমি আজকে। আজ এই বাড়ি থেকে তোমায় না নিয়ে এক পা ও নড়ছি না আমি! আজ কিছু তো হবে, হয় আমার সঙ্গে তোমার বিয়ে হবে নয় তোমার আমার সঙ্গে বিয়ে হবে।’
টেক্সট পেয়ে সুসমা ফোন চেক করে কটমট করে তাকালো। ব্যাপারটা কি হলো তবে? বিয়েটা হবেই। সুসমার চাহনিতে মেরাজ বিস্তর হাসলো। চোখে মুখে দুষ্টুমির ছাপ স্পষ্ট! গজগজ করতে করতে সুসমা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল, ‘ আপনি কেন এসেছেন এখানে? সেদিন তো আমি আপনাকে আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি তারপরও এই জেদের মানে কি বলবেন?’
‘তোমার আমাকে নিয়ে কি সমস্যা একটু ক্লিয়ার করবে? আমাকে কেন এভাবে বার বার ফিরিয়ে দিচ্ছো?’
‘কারণ আমি আপনাকে ভালোবাসতে পারবো না। এক পাক্ষিক ভাবে আপনি আমার সংসার ভাঙার জন্য দায়ী এটা আমি ভুলবো কিভাবে?’
ভ্রু কুচকে যায় মেরাজের। সে কি করে দায়ী? সঙ্গে সঙ্গে লিখলো, ‘তুমি আমাকে কোন দিক ভেবে দায়ী করছো আমি জানি না? আমি ভাবতেও পারিনা তোমার সংসার ভাঙুক, তোমার জীবনে অন্ধকার নামুক আমার জন্য। আমার যদি ক্ষমতা থাকতো সেসময় তোমার পায়ের কাছে সমস্ত সুখ এনে দিতাম। আর তুমি কিনা সংসার ভাঙার জন্য আমাকে দায়ী করছো? কেন সুসমা? কেন? আমি কিভাবে দায়ী বলো না? কসম লাগে খোদার বলো! তোমার কথা শুনে যদি মনে হয় আমি দায়ী তবে আমি কখনোই তোমার সমকক্ষ হবো না কথা দিচ্ছি!’
সুসমা বলতে না চেয়েও কসম শুনে বলতে বাধ্য হলো। তবে তাই হোক। কতদিন আর বুকের কষ্টটা বাড়াবে? সে নরম চোখে মেরাজের দিকে তাকালো। মেরাজের উৎসুক দৃষ্টি সুসমার মুখ মন্ডলে বিচরণ করছিলো। সুসমা তাচ্ছিল্য করে হেসে বললো, ‘এমন ভাব করছেন যেনো কিছুই জানেন না। তাহলে আমি মনে করিয়ে দিই? আমি বিবাহিত জানানোর পরেও আপনি রোজ আমায় চিঠি লিখতেন কেন? আমার সংসার ভাঙতে চাইছিলেন যেনো আপনি আমাকে পেয়ে যান সহজেই। কেন এমন করেছেন বলবেন?
‘কোন চিঠির কথা বলছো সুসমা?’ মেরাজ লিখলো।
‘কোন চিঠি মানে? আপনি পাঠাতেন সেগুলোই। আপনার দেওয়া চিঠি আমি পুঁড়িয়ে ফেলতাম ভয়ে যেনো রাশেদ কিচ্ছুটি টের না পায়। কিন্তু একদিন চিঠি পোঁড়ানোর সময় আমার শাশুড়ী মায়ের চোখে পরে যায়। আর এটা নিয়ে নানান অশান্তির মধ্যেও আরেকটা অশান্তির উৎপত্তি হয়। আমার বাচ্চাকে পর্যন্ত রাশেদ মানতে অস্বীকার করে শুধু মাত্র আপনার সেইসব চিঠির জন্য৷ সেখানে সবাই জেনে গেলো আমি চরিত্রহীনা মেয়ে মানুষ। স্বামী থাকতেও পরকীয়া করি। আমার বাচ্চার সাত মাসের সময় আল্ট্রা করার পর শুনি মেয়ে হবে। এরপরে আমার বাচ্চাটা জন্মের আগেই পেটের মধ্যেই মা’রা যায়। আমি ভীষণ ভীষণ ভাবে মূর্ছা যায়। আমার শাশুড়ির আমাকে জ্বালানোর পরিমাণ এতোটাই বাড়িয়ে দিয়েছিলেন যে আমি মাঝে মধ্যে অজ্ঞান হয়ে পরে থাকতাম। কেউ-ই দেখার ছিলো না। জ্বালাতন বে’ড়ে দুই গুন হয়ে গেছিলো আমার মেয়ে হবে শুনে। স্বামীর আঘাত, স্বামী বাইরে পরকীয়া করে ঘরে এসে বলতো, ‘তুই করলে দোষ নাই আমি করলেই সব দোষ?’ আমার বাচ্চা মা’রা যাওয়ার পর আমার শাশুড়ী খুব খুশি হয়েছিলো জানেন? আমার স্বামী সর্বক্ষণ বলতো, “পাপ কি আর গর্ভে টিকে? তুই পাপ করেছিলি আল্লাহ শাস্তি দিয়ে দিলো।”রোজ চুল ধরে মা’রা, গায়ে হাত তোলা ছিলো নিত্য দিনের কাজ। মে’রে রক্তাক্ত করে দিতো। দিনের পর দিন অসুস্থ হয়ে পরে থাকলেও একটা ওষুধ পেতাম না সুস্থ হওয়ার জন্য! আমার শ্বশুর মশাই লুকিয়ে আমার ঘরে এসে মাঝে মধ্যে ওষুধ, খাবার দিয়ে যেতেন। আমার শ্বশুর মশাই ছাড়া কেউ-ই আমাকে সেই বাড়িতে কদর করে নি। এতো কিছুর পরেও যখন সংসার না ছাড়লাম, মাটি কা’ম’ড়ে পরে রইলাম তখন বদনাম ছড়ালো আমার শ্বশুরকে নিয়ে। আমি না-কি শ্বশুরের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত। বাবার মতো বয়সী একজন লোকের সঙ্গে এমন ঘৃণ্য অপবাদ মানতে না পেরে কেস করলাম নারী নির্যাতনের। মামলা দিলাম আমার স্বামী আর শাশুড়ীর নামে। দুই বছর কেস চললো। সেসময়ও আমি ঐ বাড়িতেই থেকে ছিলাম।
শেষে রাশেদ বললো, ‘এখনো তোর নাগরে চিঠি দেই, তোরে নিয়া সংসার করবো না। তালাক তোরে।’
এরপরও বলবেন আপনি দায়ী নন? বলুন? আমাদের সম্পর্কের অবনতির সবকিছুই তো আপনার জন্যই হয়েছে। না-হলে তো রাশেদ আমাকে ডিভোর্স দিতে চাইনি।’
মেরাজ ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে লিখলো, ‘আমি সেদিনের পর কোনো দিন তোমায় চিঠিই লিখিনি তবে তুমি চিঠি পেতে কিভাবে? আশ্চর্য না?’
‘তাহলে কে লিখতো? আপনি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে কি অবলীলায় মিথ্যা বলছেন বাহ!’
‘বিশ্বাস করো সুসমা তুমি সেদিন নিজেকে বিবাহিত বলায় আমি উম্মাদের মতো হয়ে যায়। খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে এক ভাবে ঘরে বসে থেকেছি কত। বাবা মায়ের পছন্দের কত পাত্রীকে রিজেক্ট করেছি। তোমায় আমার হৃদয়ে রেখেছিলাম। মনে মনে পণ করেছিলাম আর কোনোদিন অন্য কোনো মেয়েকে আমার মনে স্থান দিবো না। এক মনে ক-জনের জায়গা দিবো বলো তো? আমি তো আমার জীবন তোমার তরে সপে দিয়েছিলাম সেই প্রথম দেখাই। কিন্তু তুমি বিবাহিত এটা আমি আগে জানলে তোমায় চিঠিই লিখতাম না। তোমার মুখ থেকে সত্যিটা জেনে কি করে চিঠি লিখতাম বলো তো? আমি সত্যি বলছি গত আট বছর আমি তোমায় চিঠি লিখিনি। তবে হ্যাঁ তোমার খোঁজ খবর আমি সব সময় নিতাম। তোমার বিয়ের দশ বছরের মাথায় তোমার বিয়ে ভেঙে গেছে জেনে আমি আবার আশার আলো দেখি। এরপর তোমার ঠিকানা পেয়ে তোমার বাড়ির পাশের ফ্ল্যাটে উঠি। তুমি বিশ্বাস করো আর না করো এটাই সত্যিই। আমি অন্তত মিথ্যা বলি না।’
ম্যাসেজ পড়ে সুসমা কিয়ৎক্ষণ স্তব্ধ হয়েছিলো। মেরাজকে দেখে মনে হচ্ছে না সে মিথ্যা বলছে। মেরাজ আবার লিখলো, ‘এতো নির্যাতনের পরেও কেন মুখ বুজে সব সহ্য করেছো তুমি? উত্তর দাও!’
সুসমা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
‘ আমার বাবার জন্য সব সহ্য করেছি। সেই সময় আমার শ্বশুর মশাই আর আমাকে নিয়ে এতো বড় অপবাদ, আমার অনাগত বাচ্চার মৃ’ত্যু এসব সইতে না পেরে ওঁদের নামে মা’র্ডা’র কেস করি। এখনো রাশেদ নারী নির্যাতন আর মার্ডার কেস ফেসে আছে। একদিন আমার মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারি বাবা স্ট্রোক করে প্যারালাইজড হয়ে গেছে। যার জন্য এতো কষ্ট করে মাটি কা’ম’ড়ে পরে রইলাম সেই যখন অসুস্থ তখন আমি আর থাকবো কেন? রাশেদের নামে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে চলে আসি। এসে দেখি বাবা কথা বলতে পারেন না। হাত পা না’ড়াতে পারেন না। এই বাবাকে তো আমাকেই দেখে চলতে হবে তাই না?’
মেরাজের কেন যেনো মনে হলো সুসমা তাকে পুরো সত্যি বলছে না। এখানে অনেক বড় কিছু লুকিয়ে আছে। যা মেরাজের সুক্ষ্ম মস্তিষ্কে ঠিকই ধরা দিয়েছে। কিন্তু কি সেটা?
‘এখন তোমার আমায় বিয়ে করতে আপত্তি নেই তো?’
নারীমন ঠিক পদ্মকোমলের ন্যায় নমনীয়। আর এর নিগূঢ় প্রতীকী প্রণয়। যেটা নারী ছেড়ে দিতে পারে, ছিনিয়ে নিতেও পারে। কখনো বা হাসি মুখে মেনে নিতে পারে আবার মানিয়ে নেওয়া শিখাতেও পারে। তরল পদার্থের ন্যায় নিজের অবস্থা, স্থান ভেদে আকার ধারণেও পটু। সুসমার মন নরম হলো মেরাজের কথা শোনার পর। কিন্তু গাম্ভীর্যের কাছে তার নরম মন হেরে গেলো। সে আরও একটা ভাবনায় পরলো, তাহলে মেরাজের নাম করে কে চিঠি দিতো রোজ? সুসমা শান্ত স্বরে বললো, ‘আমি হইতো ভুল বুঝেছিলাম আপনাকে। তার জন্য ক্ষমা চাইছি। কিন্তু তবুও আপনাকে স্বামী রুপে গ্রহণ করতে পারবো না।’
মেরাজ গাট করে তপ্ত দুপুরের রোদে গরম হওয়া ছাদের উপর বসে পরলো। তারপর লিখলো, ‘তোমায় বিয়ে না করে আমি এক পা ও নড়বো না। এই যে বসলাম আর উঠবো না আমি।’
সুসমা অবাক হয়ে মেরাজকে পেছনে ফেলে চলে গেলো। মেরাজ সেদিকে তাকিয়ে থাকে নির্নিমেষ! কাঠ ফাটা রোদে ছাদে অল্প দাঁড়িয়ে থাকা দায় সেখানে উত্তপ্ত ছাদের ফ্লোরে সে বসে আছে। সারা শরীরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছড়িয়ে গেলো। মেরাজ তার বোন আঁখিকে ম্যাসেজ লিখলো, ‘আমি না বলা পর্যন্ত তোরা ড্রয়িং রুম থেকে নড়বি না। আমিও দেখবো আজকে আমাকে কেউ কি করে না করে। বউ না নিয়ে আমি এই বাড়ি কিছুতেই ছাড়বো না।’
মেরাজ যা বলবে তার কথার এদিক থেকে সেদিক হবে না। মেরাজের বাবা মাও তাই। উনারা একটা রুমে ঢুকে গেলেন কারিমা বেগমের কথায়। অপমানে থমথমে মুখ নিয়ে বসে রইলেন। সুসমা নিচে নামলে দেখলো ড্রয়িং রুমে কেউ-ই নেই। নিশ্চয়ই বাকিরা চলে গেছে। সে মায়ের পাশে বসতে বসতে বললো, ‘উনারা চলে গেছেন? উফফ বাঁচলাম।’
‘উনারা যান নি। বরং আমাকে বলেছেন, ছেলের বউ না নিয়ে বাড়ি ফিরবেন না। তাই পাশের রুমটায় ঢুকে শুয়ে পরেছেন।’
সুসমা বিরবির করলো। বললো,’যেমন ছেলে তেমন তার বাবা মা! এমন জেদের বহর সে জীবনেও কারোর দেখেনি।’
সুসমা মুসিবতে পরে মায়ের দিকে তাকাতেই তিনি উঠে চলে গেলেন ঘরে।
#চলবে
বেস্টুর বিয়ের তোরজোড়ে সময় হয়ে উঠছে না লেখার। একটু একটু লিখে রেখে আজকে পোস্ট করছি। কালকে পাবেন না গল্প৷ আমি ২৪ তারিখ থেকে রেগুলার হবো ইন-শা-আল্লাহ্।
#চলবে