অনূসুয়া পর্ব -০৬+৭

#অনূসুয়া
#পর্ব৬
#রাউফুন

(অতীত)
বাড়ির সকল কাজ সেরে ঘেঁমে জুবুথুবু হয়ে সুসমা একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্য ক্লান্ত শরীর খানা বিছানায় এলিয়ে দিয়েছিলো। তখনই শাশুড়ী মায়ের ডাক পরলো। সে তো সব কাজ শেষেই রুমে এসে শুয়েছে তবে আবার ডাকছে কেন? হ্যাঁ এখন সে প্রায় সব কাজই শিখে গেছে। আগে না পারলেও এখন প্রায় সব রান্নায় পটু হয়ে গেছে। তার রান্নাও রাশেদ খুবই পছন্দ করে৷ রাশেদ যখন থেকে তাকে কলেজ ভর্তি করিয়েছে তখন থেকেই শাশুড়ী মায়ের তার উপর আরও রাগ বেড়েছে। এক বছরে জীবনটা বিষাক্ত হয়ে গেছে তার। এখন তাকে ডাকার পর যদি না যায় তবে আরেকটা ঝামেলা হবে যেটা সে চাইছিলো না। ঢাকায় এসে রিয়া আর মিথুনকে স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছে! রিয়া ক্লাস নাইনে আর মিথুন ক্লাস সিক্সে পড়ছে। সুসমার বিরতিহীন কাজ করার ফলে শরীর প্রচন্ডভাবে দূর্বল লাগছে। সে নিজের দূর্বল শরীর টাকে টেনে তুলে শাশুড়ী মায়ের সামনে দাঁড়ালো। আস্তে করে শুধালো,

‘হ্যাঁ মা বলুন মা!’

‘কাজ ফেলে শুয়ে আছো যে। কাজ না করে সারাদিন শুয়ে বসে তো এই বাড়িতে খাওয়া চলবে না বৌ! এই রুপ কতদিন থাকবে শুনি? রুপ আর কয়দিনের? নিমতা ফুল যতদিনের। নিমপাতা যেমন সক্কাল বেলা ফুটে আবার রোদ উঠলে ঝর ঝর করে ঝড়ে পরে, তেমনই রুপ ক্ষনস্থায়ী বুঝছো। এতো বসে থেকে রূপ বাড়িয়ে লাভ নাই।’

সুসমা শাশুড়ী মায়ের মুখের উপর কথা বলেনা৷ লোকে শুনলে কি বলবে? লোকে বলবে বউ শাশুড়ী কাটকী৷ কি লজ্জার কথা! সে নমনীয় ভাবে বললো,

‘মা সব কাজ তো করা শেষ!’

‘বললেই হলো সব কাজ শেষ? চাল বেছেছো?’

‘হ্যাঁ বেছেছি মা।’

‘তাহলে কাপড় ধুয়ে দাও!’

‘এটাও করেছি!’

‘ভাত রান্না হইছে, তরকারি, সবজি, রাশেদের জন্য পাবদা মাছ রেধেছো? ঘর মুছেছো?’

‘ হ্যাঁ মা!’

‘এতো তারাতাড়ি? আচ্ছা, এখানেই দাঁড়াও আসছি!’

প্রজা রুমে গেলেন। আলমারি খুঁজে একটাও কাপড় পেলেন না। তিনি ক্রোধে গর্জন করে উঠে বললেন, ‘আমার কাপড় চোপড় সব কই? আর রিয়া মিথুনের কাপড়ও তো দেখছি নেই।’

‘কোনো কাপড়ই নেই ধোঁয়ার!’

হতভম্ব প্রজা কিয়ৎক্ষন দাঁড়িয়ে সুসমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই মেয়েকে এতো জ্বালাতন করেও কাজ হচ্ছে না। কোনো ভাবেই ছেলের ঘাড় থেকে নামাতে পারছেন না তিনি৷ এই বউ বিদেয় করে টাকাওয়ালা বাবার কোনো মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়ের দেবেন ভেবে রেখেছেন কিন্তু বিয়ের পর থেকে এই এক বছর পর্যন্ত এতো অত্যা’চার করার পর এই মেয়ে পরে আছে এখানে।

সুসমাকে আরও জ্বালাতে পুরো ঘরে ছাঁই ছিটিয়ে দিলেন৷ এই ছাই গুলো রাশেদ এনেছিলো মাছ কাটার কাজে লাগবে বলে। ছোট মাছ বা বড় মাছ এগুলো তো আর ছাঁই ছাড়া কা’টা সম্ভব না। শাশুড়ী মা যে এমন একটা কাজ করবে সেটা তার ধারণাও ছিলো না। তাই বলে ইচ্ছে করে এভাবে ঘর নোংরা করবে? এটা কি শুধুই তাকে বসে থাকতে দেখতে চাই না সেজন্যে?

‘ঘরটা নোংরা, দেখছো না? মুছে ফেলো। আমি এক্ষুনি আসছি! এসে যেনো দেখি ঘর মোছা শেষ।’

বলেই সুসমার হতবিহ্বল হওয়া মুখ খানা পেছনে ফেলে চলে গেলেন প্রজা। ছাদে গিয়ে রাগে জেদে ধোঁয়া কাপড় গুলো ছাদেই ফেলে পা মা’ড়িয়ে নোংরা করে হাতে নিয়ে ফিরে এলেন।

‘এই নাও তোমার কাজ! কাপড়ে এক ফোঁটা ময়লাও যেনো না থাকে। না হলে বুঝতেই পারছো কি হবে! এখন কাজ আছে? তো বসে থাকা লাগবে না। কাজ করে নাও। রাশেদ আসবে খেতে! সময় মতো যেনো টেবিল রেডি থাকে!’

সুসমার ঘর মোছা শেষ হয়নি আবার এরকম একটা
কাজ এসে হাজির হলো। এই মুহুর্তে অবাকের চরম পর্যায়ে চলে গেছে সুসমা। এতোটা বিকৃত মন মানসিকতা কারোর কি করে হয়? এই মহিলার মন কি সে কখনোই পাবে না? সে ঘর মুছা শেষ করে কাপড় নিয়ে ধুঁয়ে দিলো। কাপড় ধোঁয়া শেষে আবার ছাদে গেলো৷ কিন্তু এবারে একটা কৌশল অবলম্বন করলো। কাপড় গুলো না শুকাতে দিয়ে ওভাবেই ছাদে রেখে চলে এলো। গোসল করে বাথরুম থেকে সুসমার কাছে কাপড় চাইলো প্রজা। কাপড় এনে দিতে বললে সুসমা এনে দিলো। ভেজা কাপড় দেখে গর্জে উঠলেন প্রজা। দাঁত কিড়মিড় করে বললো, ‘এই ভেজা কাপড় আমি পরবো?’

সুসমা একটু হেসে উত্তর দিলো, ‘আমি তো জানি না মা। এগুলো তো পরে ধুয়ে দেওয়া হয়েছে তাই হইতো শুকাইনি। কারণ আপনার কাপড় ধুয়ে শুকাতে দেওয়ার পর রোদ ছিলো না। আপনি যদি দ্বিতীয় বার না ধুঁতে দিতেন তাহলে তো কাপড় শুকাতোই।’

কথা শেষ করে সুসমা রান্না ঘরে চলে গেলো। প্রজা অনেকক্ষন থম মেরে দাঁড়িয়ে ভেজা কাপড়ই পরে নিলো। কারণ অবশিষ্ট আর একটিও কাপড় ছিলো না। ভেজা কাপড় পরে থাকার পর তার ঠান্ডা লাগছিলো তবুও জেদ করে রুমের দরজা আটকে বসে রইলো।

রাশেদ আগের চাকরি ছেড়ে দিয়েছে দুই মাস হলো।কারণ আগের থেকে এখন চাকরিটা ভালো ছিলো। ভালো মাইনে মাস গেলে হাতে পাবে। রাশেদ সঠিক সময় এসে দুপুরের খাবার খেয়ে চলে গেলো। সুসমা গোসল করে এসে খেতে গেলো। বাড়ির কেউ-ই তার সঙ্গে খাবার খাই না। সবার শেষে খাবার টা সেই খাই। খিদেতে পেটে মোচড় দিচ্ছে বার বার। সে পাতিলের তলানিতে উচ্ছিষ্ট ভাত পেলো। চোখের জল ফেলে ঐটুকু ভাতই খেয়ে নিলো। ভাত তো সে কম রান্না করেনি তবুও কম পরলো কেন? খিদেতে অল্প ভাতই যেনো তার কাছে অমৃত লাগছিলো। সে ভাবলো আজ হইতো কেউ বেশি খেয়ে ফেলেছে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে এঁটো বাসন কোষন মেজে ক্লান্ত হয়ে পানি পান করলো৷

রাশেদ সন্ধ্যায় ফিরলো মুখ থমথমে করে। রুমে ঢুকে গলা ফাঁটিয়ে ডাকলো সুসমাকে বার কয়েক।
প্রতিদিনের মতোই রাশেদ আসার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডা পানি নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো সুসমা। স্বামী নামক মানুষটার মন পেতে কত কিছু না করছে সে। তার বিশ্বাস রাশেদ একদিন তাকে ঠিক বুঝবে। কিন্তু নতুন চাকরি পাওয়ার পর রাশেদের মতিগতি আরও পালটে গেছে। অফিস থেকে এসে দুটো ভালো মন্দ কথাও জিজ্ঞেস করে না। সে খেয়েছে কি না, সারাদিন কি কি করেছে, কেমন কা’টিয়েছে সে বাড়িতে। অফিস গিয়ে আগে যেটুকু দুই মিনিটের জন্য কল দিতো এখন তাও বন্ধ করে দিয়েছে। এখন অফিস থেকে এসেই অফিসের কাজ করবে নয়তো ফোনে কথা বলবে। ঘন্টার পর ঘন্টা হেসে হেসে কথা বলবে কোনো সমস্যা নেই কিন্তু তাকে দেখতেই বিরক্তিতে মুখটা পাংশুটে করে ফেলে। সে কিছু জিজ্ঞেস করলেও বলবে, ‘অফিস থেকে কত জরুরি কল আসে জানো? বাড়িতে তো শুধু বসে বসে খাও। আমি কাজ করে এসে রোজ রোজ তোমার এসব ন্যাকামো সহ্য করতে পারি না৷ আমি অনেক টায়ার্ড আমাকে একা ছেড়ে দাও।’

এই সময়ে সে রাশেদকে একই সঙ্গে ভালোওবাসে আবার ঘৃণাও করে। কোনো ব্যাক্তিবিশেষের প্রতি এরকম দ্বৈত অনূভুতি হওয়ার কারণ সে জানে না। অবশ্য রাশেদই প্রথম নয় তার শাশুড়ী মায়ের প্রতিও সে এরকম অনূভব করে। সে প্রতিবাদও করতে পারে না আবার এখান থেকে পালাতেও পারে না বাবার সম্মানের কথা চিন্তা করে৷ এক বছর হয়েছে বিয়ের এর মধ্যে যদি শরীরে ডিভোর্সি তকমা লেগে যায় তবে যে লোকে তাকে আর তার পরিবারকে ছিঃ ছিঃ করবে। এই সমাজে বেঁচে থাকাটা তার জন্য দূর্বিষহ হয়ে উঠবে।

কিন্তু আজকে রাশেদ অফিস থেকে আসার পর অত্যন্ত ভয়ে রুমে যেতে পারছিলো না সুসমা। রাশেদকে অদ্ভুত লাগছে। সে রুমে যেতেই সুসমার হাতে গ্লাস দেখেই আছড়ে ফেলে দিলো রাশেদ। রাগে, ক্রোধে ভাঙা কাচ তুলে তার হাতে বসিয়ে দিলো৷ সুসমা চিৎকার করে উঠলো। হাত থেকে গল গলিয়ে র’ক্ত পরতে লাগলো। সুসমার চেঁচানোই প্রজা জানালা দিয়ে দেখলো ঘটনাটা। কোনো রকম ভ্রুক্ষেপ না করে আবার নিজের ঘরে গিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বসে রইলো। রিয়া, মিথুন ভয়ে গুটিশুটি মেরে বসে ছিলো এক জায়গায়। সুসমার শ্বশুর বাড়িতে ছিলো না৷ উনি থাকলে হইতো এতো কিছু ঘটানোর সুযোগ পেতো না রাশেদ। ঘটনার আকস্মিকতায় হঁকচকিয়ে গেলো সুসমা। কি হচ্ছে সে কিছুই বুঝলো না। রাশেদ সুসমাকে চেপে ধরে হিসহিসিয়ে বললো, ‘তোর নাগরে যে রোজ রোজ চিঠি দেই আমি কি জানি না? আজকে আবার দেখি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কলেজে ভর্তি করিয়েছি কি তোকে এগুলো করার জন্য? তোর নোংরামি আজ আমি বন্ধ করে দিবো।’

কিছু বুঝে উঠার আগেই রাশেদ নিষ্ঠুরের মতো বিছানায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো সুসমাকে৷ হাটু ভেঙে গলা চেঁপে ধরেছে পা-টা। সুসমার দম বন্ধ হয়ে প্রাণ পাখি বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। গোঙানির শব্দ ছাড়া মুখ দিয়ে শব্দও বের হচ্ছে না। সেই মুহুর্তে শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ঠেলেও সরাতে সক্ষম হয়নি সুসমা। মুখ দিয়ে ফেনা বেরিয়ে আসে তার৷ রিয়া আর মিথুন এসব দেখে ছুটে বাবাকে ডাকতে চলে যায়। শেষ সময়ে সুসমার চোখ বেয়ে পানির কণা উপচে পড়ছিলো। চোখ বন্ধ হওয়ার আগে তাকে ছেড়ে দিয়েছিলো রাশেদ।
#অনূসুয়া
#পর্ব৭
#রাউফুন

সেদিন সুসমার শ্বশুর মশাই তাকে বাঁচিয়ে নিয়েছিলো সময় মতো। সুসমা সহ্য করতে না পেরে নিঃস্পৃহ হয়ে, নেতিয়ে গেছিলো। সাত দিনের মধ্যে বিছানা থেকে উঠার জো ছিলো না। করিম সাহেব স্ত্রীর উপর কড়া নজর রাখতে লাগলেন। এই বয়সে স্ত্রীর গায়ে হাত তুলেছেন। যদি সুসমার জায়গায় নিজের মেয়ে হতো তবে কি প্রজা ঐভাবে ঘর বন্দী হয়ে থাকতে পারতো? নিজের চোখে ছেলেকে একটা বাচ্চা মেয়ের উপর নির্মম ভাবে অত্যাচার করতে দেখেও কিভাবে ঘরের দরজাটা আটকে গো ধরে বসে ছিলো? একজন মা কি করে এরকম নিষ্ঠুর হতে পারে? প্রজাও স্বামীর প্রথম বারের মতো ওমন ভয়ংকর রুপ দেখে আর সাহস করে নি দ্বিতীয় কথা বলার। সুসমাকে কাজের হুকুমও দেননি৷ সুসমা কিছু টা সুস্থ হলেও শরীর দূর্বল হয়ে গেছে অনেকটাই। সেদিনের আঘাতের পর সুসমা মাটিতে বিছানা করে শুয়ে পরে। রাশেদ কথা বলার চেষ্টা চালালেও সুসমা বোবার মতো ছিলো। দিনকে দিন দূরত্ব বাড়ছিলো রাশেদের সঙ্গে। প্রথম দুই দিন রাশেদ কথা বলতে চাইলেও আর বলার চেষ্টা করেনি। সুসমাকে ওঁর মতো ছেড়ে দিয়েছিলো। সে আর পরোয়া করতো না সুসমাকে৷ ঘরের বাহিরে যদি অন্য নারীর প্রতি টান থাকে তবে কি ঘরের বউকে আর ভালো লাগে? দরকার পরতে পারে?

সুসমা ঘর থেকে বাইরেও বের হয়নি এই কদিন। রিয়া সময় মতো খাবার দিয়ে যায় রুমে। এক বেলা খাবার দিলে তো অন্য বেলায় খাবার আসতো না। সুসমা বুঝতে পারতো শাশুড়ী মা রিয়াকে আসতে দিচ্ছে না। অনাহারে থাকতে থাকতে পেট পিঠ শুকিয়ে এক হয়ে যাচ্ছিলো৷ অবশ্য সে তো কাজ করে না তবে খাবার পাবে কিভাবে? তবুও চুপচাপ সয়ে যাচ্ছে সবটা। সে কেন সহ্য করছে এসব নিজেও জানে না। সে শক্ত হতে পারছে না। কোনো কিছু হারানোর একটা ভয় কু’ড়ে কু’ড়ে খাচ্ছে।

সুসমা সপ্তম দিনে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। বেরিয়েই দেখলো সোফায় শাশুড়ী মা বসে আছে টিভি ছেড়ে। তাকে দেখে মুখ ভেংচি দিয়ে বললেন,

‘নবাবজাদার বেটি ঘর থেকে বেরোলেন তবে? অনেক আরাম করছেন যান ঘরের কাজ করুন।’

সুসমা মাথা নেড়ে চলে গেলো। রান্না ঘরে যেতেই উটকো গন্ধে পেটের নাড়ী ভুড়ি উলটে আসছিলো তার। কোনো রকমে গন্ধের উৎস খুঁজে বের করে দেখলো মাছ কা’টার ময়লা ফেলেনি তার শাশুড়ী। নাকে কাপড় চেপে সবটা পরিষ্কার করে কাজে লেগে পরলো সে। যতোই হোক সংসার টা তো তারই।

তার শ্বশুর মশাই বেশির ভাগ সময় বাড়ি থাকেন না। অল্প বিস্তর পড়াশোনা থাকায় একটা ছোট খাটো চাকরি জুটাতে পেরেছেন গার্মেন্টসে।


পরের দিন সুসমা বাসন মাজছিলো। রান্না ঘরে গিয়ে সুসমাকে অবধারিতভাবে ইশারা করে ডাকলো রিয়া। এই বাড়িতে এই মেয়েটা আর তার শ্বশুর মশাই তাকে একটু আদর যত্ন করে। মাঝে মাঝে মাকে লুকিয়ে রিয়া তার সঙ্গে গল্প করে। তার সঙ্গে কথা বলতে আসলেই শাশুড়ী মায়ের খোঁচানো কথা শুনতে হয় তাই রিয়া তার সঙ্গে গল্প করতে আসে না খুব একটা! রিয়া চাইতো না তার জন্য সুসমাকে কোনো রকম কথা শুনতে হোক। সুসমা আঁচলে হাত মুছে বললো, ‘কিছু বলবে?’

‘আজ সবাই দু-খানা করে মাছ ভাজা খেয়েছে আর তুমি খেলে না কেন ভাবি?’

এইরকম একটা প্রশ্নের ঠিক কি উত্তর দেবে ভেবে পেলো না সুসমা। বলল, ‘মাছের কা’টা’য় আমার ভয় আছে। মাছ বেছে খেতে পারি না গলায় কা’টা আটকে যায়!’

‘তুমি কি আমাকে বোকা পেয়েছো? আমি জানি মাছ তোমার কতটা পছন্দ! এতোটা ছাড় দিও না ভাবি। মায়ের এসব নাফরমানি আমি সহ্যও করতে পারি না আবার কিছু বলতেও পারি না৷ যতই হোক মা তো। এরপর থেকে মাছ ভাজার সময় একটা করে পিস উঠিয়ে রাখবে নিজের জন্য! মা দেখার আগেই সেটা আবার খেয়ে ফেলবে। এভাবে না খেলে এই বাড়িতে ভালো কোনো খাবারই তুমি খেতে পারবে না ভাবি। এই নাও মা এই মাছ ভাজা লুকিয়ে রেখেছিলো আমি তোমার জন্য এনেছি। মা কিছু জিজ্ঞেস করলে আমি বলবো এটা আমি খেয়েছি!’

রিয়ার সমাদরে সুসমার চোখ বেয়ে মুক্তোর ন্যায় অশ্রুদানা গড়িয়ে পরলো৷ চোখ মুছে বললো, ‘আমি এভাবে খাবার খেতে চাই না রিয়া৷ আমার গলা দিয়ে নামবে না। মা যদি কোনো দিন নিজে থেকে আমাকে মাছ মাংস খেতে দেন তবেই খাবো। আমি এতোটাও খাওয়া পা’গ’ল না যে লুকিয়ে খাবার খাবো।’

‘মা তোমাকে কোনোদিন ও ভালো ভালো খাবার খেতে দেবে না। যেহেতু তোমার আমার কথা ভালোই লাগলো না তবে এভাবেই থাকো গে। আমার আর কি? আমরা খাবো আর তুমি রেঁধে বেড়ে দিয়েও খেতে পারবে না। কি সুন্দর না ব্যাপারটা?’ কথা শেষ করে রিয়া গটগট করে হেঁটে চলে গেলো নিজের রুমে।

সুসমার বাবার কথা মনে পরলো। তার বাবা সব সময় বলতো, ‘মা আমার মানুষ চিনতে কখনোই ভুল হয় না। আমি জানি রাশেদ অনেক ভালো ছেলে। শাশুড়ীর সঙ্গে একটু মানিয়ে নাও মা। মেয়েদের বিয়ে একবার ই হয়। জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে এসব একবার ই হয়। ‘

এদিকে তার বাবার হার্টের অসুখ। রাশেদ এতোটা নোংরা লোক এটা যদি তার বাবা শুনে তবে অনেক কষ্ট পাবে। তাই বাবার কথা চিন্তা করে মুখ বুঝে, দাঁত দাঁত কামড়ে পরে রইলো শশুড় বাড়িতে। রাশেদ অবৈধ সম্পর্ক গুলো এতোটাই নিখুঁত ভাবে করতো যে সুসমা টেরই পেতো না। কলেজ যাওয়ার পর এক বছর ধরে তাকে রোজ একটা ছেলেকে তাকিয়ে থাকতে দেখতো। একদিন সে সুযোগ পেয়ে ছেলেটার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি রোজ রোজ এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন কেন? আমি বিবাহিত, আমার স্বামী সংসার আছে। আমাকে আর এভাবে দেখবেন না। আমার থেকে দূরে থাকলে আপনারই ভালো হবে। আর হ্যাঁ আর কক্ষনো যদি আপনি আমাকে চিঠি দিয়েছেন তো তার ফল ভালো হবে না৷ শুধু মাত্র আপনার জন্য আমার সাজানো সংসারে অশান্তির সৃষ্টি হয়েছে!’

সুসমা সেদিনও জানতে পারেনি ছেলেটা আসলে কথা বলতে জানে না তাই চিঠি লিখে নিজের মনের কথা ব্যাক্ত করে। ছেলেটা যখন জানলো সুসমা বিবাহিত তখন সুসমা খেয়াল করেছিলো ছেলেটার চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পরছে অশ্রুদানা। একটা ছেলে যে এভাবে কাঁদতে পারে তা দেখে যারপরনাই অবাক হয়েছিলো সুসমা। সেদিন ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাড়ি আসার পর তুখোড় জ্বরে পনেরো দিন বিছানায় পরে ছিলো। জ্বর নিয়ে তিন বেলা রান্না ছিলো নিত্য দিনের সঙ্গী। জ্বর সারবে কি তড়তড় করে বেড়ে যেতো রাতে। আর এতো অসুস্থতার মধ্যে রাশেদের শারিরীক চাহিদা তো আছে। পরদিন রাশেদ কিভাবে যেনো সেই ছেলে আর সুসমার ছবি পেয়েছিলো। যার কয়েক কপি আর চিঠি দিয়েছিলো সুসমার বাবার হাতে তুলে। যার দরুন দূরত্ব বেড়ে গেছিলো সুসমার বাবার বাড়ির সঙ্গে। বাবা মা কেউ-ই আর খোঁজ নিতো না। এদিকে সুসমা সত্যিটা বোঝাতে চাইলেও শুনতে রাজি হয়নি। ছবি আর চিঠি দেখেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো তার বাবা তার থেকে। এরপর দেখতে দেখতে কত গুলো বছর কে’টে গেছিলো। বিয়ের চার বছরের মাথায় সে কন্সিভ করেছিলো এরপরই বদলে গেছিলো তার জীবন। রাশেদ কোনো ভাবেই মানছিলো না বাচ্চাটা তার। এটা সেটা নোংরা, মিথ্যা অপবাদ চাপিয়ে দিচ্ছিলো। যেটা মেনা নেওয়া ছিলো সুসমার জন্য জীবন মৃত্যুর সমান।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here