অপ্রেমের প্রিয় অধ্যায় পর্ব -১৪

#অপ্রেমের_প্রিয়_অধ্যায়
#পর্ব_১৪ (চিঠি)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

শুদ্ধ দিশার মাথায় হাত রেখে বলল, “একদম এরকম কথা বলবে না। কোনো চিন্তা করবে না। আমি আছি না? এবার চলো।”

রুম থেকে বেরোনোর সময় শুদ্ধ খেয়াল করল, দিশার হাতের ব্যাগটি। কৌতুহল নিয়ে শুধাল, “এটা কী, দিশা?”

দিশা জানাল, “আমার কিছু জামা-কাপড় আর গয়না।”

শুদ্ধ বলল, “ব্যাগ ওখানেই রেখে এসো। একটা হ্যান্ড ব্যাগে প্রয়োজনীয় ডক্যুমেন্টস নিয়ে নাও। আর ফোন কোথায় তোমার?”

দিশা হাতের ফোনটি শুদ্ধর দিকে বাড়িয়ে দিতেই শুদ্ধ সিম খুলে সেই ব্যাগে রেখে দিলো। তারপর দিশাকে বলল, “এবার চলো।”

রুম থেকে বেরিয়েই শুদ্ধ আবার জিজ্ঞেস করল, “দরজা কি ওই একটাই আছে? তোমার দাদার এই বাড়িটা পুরোনো আমলের তৈরি। অবশ্যই একটা দরজা থাকার কথা নয়!”

দিশা বলল, “ঠিক ধরেছ। ওদিকে আরও দুটো আছে। একটা দিয়ে বাগানের রাস্তা, অন্যটা একটা সরু গলির। সেই গলির রাস্তা ভালো না। গাড়ি আসে-যায় না। খুবই সরু। হেঁটে মাইল তিনেক যেতে হবে। যেটা অসম্ভব প্রায়।”

“বাগানের দিকটা? ওখান থেকে যাওয়ার ওয়ে নেই?”

“আছে। বলছি। গাছে উঠে দেয়াল টপকাতে হবে।”

বিষয়টা কেমন যেন এডভেঞ্চারাস লাগল শুদ্ধর কাছে। তবে, সমস্যা আছে কি না জানতে শুধাল, “গাছে উঠতে পারো?”

দিশা ইতিবাচক মাথা নাড়ল। তবে নেতিবাচক এক কথা বলল, “কিন্তু!”

শুদ্ধ শুধাল, “কী?”

“বাগানের রাস্তাটা আমার স্টেজের পেছনের দিকে। ওদিকে লাইটিং হয়নি। গেলে অবশ্য কেউ ধরতেই পারবে না। কিন্তু যেতে হবে সবার সামনে দিয়েই।”

শুদ্ধ কপালে হাত রেখে বলল, “আচ্ছা! সমস্যা নেই। চলো।”

এই বলে দুজন এগোল। ঠিক গুনে গুনে সাত কদম এগোতেই শুদ্ধ তনুজার মুখোমুখি হলো। শুদ্ধকে দেখে তনুজা পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেও, পাশে বোরকা পরা মেয়েকে দেখে থেমে গেল। এক নজর নিজের দিকে চাওয়া ছেলেটাকে তনুজা বেশ পাত্তা দিলো আজ, যেখানে ছেলেটা নিজেই চাইছে, ম্যাম চলে যাক! যায় না। সব চাওয়ানুযায়ী হয়ও না।

তনুজা একবার শুদ্ধকে দেখে পাশে তাকাল। মিনিট খানেকের মাঝেই ধরে ফেলল, বোরকা পরিহিতা রমনীটা কে!
কিছু বলবে না বলবে না ভেবেও, বলে উঠল, “বাবা-মা কষ্ট করে পেলে-পোষে বড়ো করেছে কি এই দিনটা দেখার জন্য?”

জবাব দিলো শুদ্ধ, “বাবা-মা নিজ স্বার্থ দেখে যদি এক আধবুড়ো সরকারি চাকরিওয়ালা দেখে মেয়ের মর্জি ছাড়া বিয়ে দিতে চায়, তবে সেখানে সন্তানের এটুকু স্বার্থপর হওয়া অন্যায় না।”

“বাবা-মা ছাড়া কিন্তু বিয়ে হয় না!”

“বিয়েতে কনের মত নেওয়াটাও কিন্তু এক প্রকার নিয়ম।”

তনুজা আর কিছু বলল না। শুদ্ধ বলে উঠল, “বাবা-মা কখনও নিজ স্বার্থ দেখে না। তারা সন্তানের ভালোর জন্য স্বার্থপরতা করে ওঠে। কিন্তু বোঝে না—এতে কোনো ভালো নেই। চিন্তা করবেন না, এখন বিয়ে হলেও একসাথে থাকা হবে না। পরিবারকে মানিয়ে আবারও সবটা হবে।”

তনুজা বলল, “যদি ধরা পড়ে যাও এখনই?”

“এত কাঁচা খেলা খেলি না।”

“যদি আমি বলে দিই?”

“আপনাকে অবিশ্বাস করি না।”

এই জায়গায় দিশা বলে উঠল, “আপু, একটু হেল্প করবে আমাদের, প্লিজ! চলো আমাদের সাথে।”

“না না, আমি এসবে জড়াতে চাই না।”

দিশার আরও অনুনয় বিনয়ের পর তনুজা রাজি হলো। ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বলল, “চলো!”

তিনজনে মিলে বাগানের দিকে গেল। নিচু দেয়াল। গাছে ওঠার প্রয়োজন নেই। ইটের ফাঁক দিয়ে পা ফেলে ওপাশে যাওয়া যাবে। প্রথমে শুদ্ধ গেল। ওপাশে সব ঠিক আছে কি না দেখে, আবার ফিরে এলো। এবার দিশাকে যেতে বলল। দিশা যেতেই তনুজাকে যেতে বলল। তনুজা এখনও দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে। ঘটনাগুলো এত জলদি ঘটছে, মস্তিষ্ক কাজ অবধি বন্ধ করে দিচ্ছে। এভাবেই দেয়ালে পা রাখল। উঠতে যেতেই এক পা ফসকে গেল। তবে তনুজা বুঝল না—সে ইটে নয়, এক কড়াপড়া শক্ত হাতে পা ফেলেছে। সেভাবেই অন্য ইটের ফাঁকে পা ফেলে দেয়াল পার হলো। শুদ্ধও এক লাফে গেল।

কিছুটা এগোতেই দেখল, একটা কালো রঙের মাইক্রো দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভিংয়ে তুহিন, পাশে প্রাপ্তি। সকালেই শুদ্ধ প্রাপ্তিকে ফিরতে বলেছে। শুদ্ধ বলেছে, প্রাপ্তি শুনবে না—এমনটা হয়? হয় না তো! তাই সকালেই চলে এসেছে। আর দিশার কল পেতেই সে তুহিনকে ম্যাসেজ করে দিয়েছিল এসে দাঁড়াতে।

মাইক্রোর দরজা খুলতেই দিশা ভেতরে ঢুকল, এরপর তনুজা। শুদ্ধ গিয়ে পিছে বসল। প্রাপ্তি এবং তুহিন, দুজনই তনুজাকে এখানে দেখে অবাক হয়েছে। তবে ভড়কে দেওয়ার জন্য কোনোরূপ প্রশ্ন করে ওঠেনি।

মাইক্রো চলতে শুরু করল। এর মধ্যেই তনুজা শুধিয়ে উঠল, “প্ল্যান কী?”

শুদ্ধ জানাল, “এখান থেকে কাজি অফিসে যাওয়া হবে।”

“আজই বিয়ে?”

“হ্যাঁ। দিশার দাদার হাত বড়ো আছে। খুঁজে পেতে বেগ পোহাতে হবে না। আজ রাতটা আমাদের হাতে সময় আছে। একবার বিয়ে হয়ে গেলে, আর সমস্যা হবে না। ছেলে-মেয়ে দুজনেই অ্যাডাল্ট!”

তনুজা বলল, “পালানোরই যেহেতু ছিল, তবে বিয়েতে রাজি হয়ে গেলে কেন?”

দিশা মাথানত করে বলল, “শেষ অবধি মানানোর চেষ্টা করে গেছি।”

“তবে আগেই চলে যেতে। এখন বিয়েতে সবাইকে জানানো হয়ে গেছে, তোমার প্যারেন্টস ইনসাল্টেড হবে না?”

“কার হাত ধরে পালাব? অনিশ্চিত সম্পর্কে জড়িয়েছিলাম যে!”

দিশা কিছু বলল না। তনুজা রিয়ার ভিউ মিররে এক পলক শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে জানালার বাইরে চোখ দিলো। হয়তো সে ভেবে নিয়েছে অন্য কিছু। শুদ্ধ তা বুঝতে পেরে মিহি হেসে ফোন বের করল। কল লাগাল শাওনকে। ওদিকে দিশার চলে যাওয়ার ব্যাপারটা ইতোমধ্যে সবাই জেনে গিয়েছে। খোঁজাখুঁজি চলছে। অবাক হয়ে শাওন কান্ড দেখছিল। এমন সময় ফোনে কল আসায় সে তড়িঘড়ি করে পকেট হাতড়ে কল রিসিভ করল।

শুদ্ধ ভঙচঙ না করে সোজা কথায় এলো, “জলদি ওখান থেকে বেরিয়ে বিএসজি কলেজের সামনে আয়।”

শাওন অন্যমনস্ক গলায় বলল, “জানিস! এদিকে দিশাকে পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই খুব খুঁজছে। আমার তো মেয়েটার জন্য রীতিমতো টেনশন হচ্ছে, ভাই। কই যে গেল!”

“আমার সাথে আছে।”

“মজা নিস না। ইট’স সিরিয়াস।”

শুদ্ধ ফোনটা সামনের দিকে এগিয়ে দিতেই দিশা বলে উঠল, “বেশি কথা না বলে এসো।”

“মানে! তুমি..”

শাওনকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে শুদ্ধ ফোনটা নিজের কাছে এনে বলল, “টাইম বিশ মিনিট দিলাম। আয়। বাকিটা পরে বোঝাব তোকে।”

ততক্ষণে তুহিন গাড়ি থামাল কাজি অফিসের সামনে। মিনিট দশেকের মাঝে শাওনও চলে এলো। শুদ্ধ সব কাগজপত্র রেডি করে রেখেছিল। শাওন অবিশ্বাস্য চোখে শুদ্ধর দিকে তাকাল। তাতে শুদ্ধ আড়মোড়া ভেঙে বলল, “তোর ভাগ্য ভালো দেখে এখনও এখানে অক্ষত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছিস। আমার ফুল ফর্মে এসে গেলে, হসপিটালের লায়েকও থাকতিস না।”

শাওন মুচকি হাসল কেবল। আধ ঘন্টার মাঝেই বিয়ে হয়ে গেল। সাক্ষী হিসেবে তুহিন, শুদ্ধ এবং প্রাপ্তি আর তনুজা আছে। তনুজা ব্যাপারটা চুপচাপ দেখে গেল। হয়তো মন তাকে বলেছে, “সবাই সুখী হতে পারে না। প্রকৃতি সবাইকে সুখী করে না। তাই যারা নিজ থেকে সুখ খুঁজতে বের হয়, তাদের রাস্তায় শান্তি এনে দিতে না পারলেও আটকে যেন না ধরা হয়। প্রকৃতি আবার এতে গোসা করে।”

ভালোয় ভালোয় বিয়েটা শেষে শুদ্ধরা তনুজাকে তার অ্যাপার্টমেন্টের সামনে ড্রপ করে দিলো। দুই মিনিট অপেক্ষা করতে বলে, নেমে পড়ল শুদ্ধ নিজেও। বড্ড আলগোছে একটা চিঠি তনুজার শাড়ির শেষ প্রান্তে বেঁধে নিল। তনুজা আঁচলে টান পড়তে ফিরে তাকাল, শুদ্ধকে দেখে ভ্রু-দ্বয় কুঞ্চিত করল। কণ্ঠ স্বাভাবিক রেখে বলল, “ফিরে যাও।”

বিনিময়ে শুদ্ধ মাথার চুলগুলো চুলকোতে চুলকোতে হাসল। তনুজার দিকে তাকিয়েই পেছাতে লাগল। তার চোখ-মুখে উপচে পড়ছে কিছু একটা। বছর কয়েক আগে এই ‘কিছু একটা’ সে আরও একজনের ঘোর লাগানো চোখে দেখতে পেয়েছিল। সেই একজনের সাথে বন্ধনটা ছিল খুবই জোড়াল, খুবই দৃঢ়। অদৃশ্য শিকলে বাঁধা সম্পর্কটা অদৃশ্য ভাবেই ভেঙে যেতে লাগল। সেই ভাঙনই তনুজা রোধ করতে পারেনি।
এখানে শুদ্ধর তো এক তরফা অনুভূতি; নেই কোনো জোর, কোনো দায়বদ্ধতা। মুছে যেতে সময় নেবে না।
কথাগুলো ভাবতেই তনুজার অধরকোণ প্রসারিত হলো। শুদ্ধ তা দেখে আনমনেই নিভে আসা হাসিটা স্থায়ী করল। তনুজা আর না দাঁড়িয়ে চলে গেল। সে যেতেই, শুদ্ধও ফিরল।

দিশাকে প্রাপ্তির বাসায় রাখা হয়েছে। শাওন এতে কিছু বলেনি। সে নিজেও প্রস্তুত নয় দিশাকে নিয়ে এক ছাদের নিচে থাকার জন্য। সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে, সে এখনও বাপের টাকায় খায়! টিউশনি হলেও, আজ থেকে করতে হবে। অনার্সটাও শেষ হয়নি! এজন্য বিয়ে করার সাহস পাচ্ছিল না। তাছাড়া! ভেবে নিল, বাকিটা যেভাবেই হোক ম্যানেজ করে নেবে। আর কৃতজ্ঞ রইল শুদ্ধর প্রতি। ভালো বাসে কী না—জানে না। তবে দিশার প্রতি ভারি দূর্বল সে। এই দূর্বলতাটাই ধীরে ধীরে প্রণয় গেঁথে দেবে!

_____
রাতে শাড়ি পালটাতে যেয়ে তনুজা খেয়াল করল, আঁচলের কোনাটা বাঁধা। খুলতেই সেখানে জড়োসড়ো হওয়া একটা কাগজ পেল। বিস্ময় হয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে খুলতে লাগল সেই কাগজ। বুঝতে পারল, এটা একটা চিঠি। এখানে কী সুন্দর হাতের লেখায় গুটি গুটি শব্দে লেখা আছে—

“অলকানন্দা,
কেউ একজন বলেছিল, একটি চিঠি দিতে। সময়ে-অসময়ে একটি করে চিঠি দিতে। সেই চিঠিতে অপ্রকাশিত সব আবেগ ঝাড়তে। গলায় শব্দ করে তো কত কথাই হয়! সে চেয়েছিল, তাকে নিয়ে লিখে যেতে। সে বলেছিল, মুখে ভালোবাসি বলার চেয়ে চিঠিতে তার নাম লিখে একটা স্মাইলি ইমোজি দিলেও সে ভালোবাসার চেয়ে গভীর অনুভূতি পাবে। আফসোস! পত্রপ্রিয়া কোনোদিন পত্র পেল না। সে বলেছিল, ‘চিঠিগুলো রঙচটা হবে, সেই চিঠিগুলোর ভাঁজে শুকিয়ে যাওয়া বেলী ফুলের মালা দেবে’। বেলী ফুল তো নেই, আপাতত এটাই না হয় রাখুন। আপনার না-পাওয়া সব সুখ পূরণের দায়িত্ব আমি নিলাম।
ইতি
আপনার শুদ্ধ-পুরুষ।”

চলবে?

শব্দসংখ্যা-১৪১০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here