অপ্রেমের প্রিয় অধ্যায় পর্ব -১৩

#অপ্রেমের_প্রিয়_অধ্যায়
#পর্ব_১৩ (কনে পালানো!)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

হলুদের অনুষ্ঠানে আর শুদ্ধ তনুজার সামনে যায়নি। চোখ-মুখের যা অবস্থা! তনুজা দেখলে অবশ্যই তাকে সেই বাচ্চা ভাববে; যেই বাচ্চা ঝাল খেতে জানে না। এগুলো মুখে না বললেও ভাববে। তনুজার ভাবনাতেও তার কোনো খুঁত সে চায় না।

শাওন শুদ্ধর এই অবস্থা দেখে ক্রমাগত শুধিয়ে যাচ্ছে, “কী হইছে তোর? আমার এক্সের বিয়াতে আইসা তুই কানতাছিস ক্যান? বাল, ক কী হইছে!”

শুদ্ধ আর বলে না। নিজেকে ধাতস্থ করতে বেশ সময় লাগাল। ততক্ষণে অনুষ্ঠান শেষ। সময়ের দিকে খেয়াল দিতেই দেখল, এখন রাত সাড়ে দশটা বাজে। শুদ্ধ চকিতে শাওনের দিকে তাকাল। মাথা থেকে তনুজার কথা প্রায় বেরিয়েই গিয়েছে তার।

জলদি দৌড়িয়ে ভেতরের দিকে এলো, প্রায় সব জায়গায়ই তনুজাকে খুঁজল; পেল না। সময় আর অপচয় না করে সে কমিউনিটি সেন্টার থেকে বেরিয়ে গেল। ঠিক সামনের রাস্তাটিতে সিএনজির আশায় তনুজাকে গুটিশুটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, শুদ্ধ স্বস্তির শ্বাস ফেলল। পাশেই ফুলের দোকান আছে, সেখান থেকে একটা ডার্ক পার্পেল রঙা ডেইজি ফুল কিনে তনুজার দিকে ঘুরল। দেখল—সে হেঁটে হেঁটেই এগিয়ে যাচ্ছে। শুদ্ধ বিরক্ত সূচক ‘চ’ উচ্চারণ করে নিজেও পিছু পিছু গেল। তন্মধ্যে শাওনকে ম্যাসেজ করে দিলো, ‘আমি ম্যাডামকে নিয়ে যাচ্ছি। তুই একাই চলে যাস।’

শুদ্ধ কিছুটা এগিয়ে তনুজার থেকে এক হাত দূরত্ব বজায় রেখে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটতে লাগল। ব্যাপারটা খুবই আকস্মিক হওয়ায়, তনুজা খেয়াল করেনি। শুদ্ধ হেসে ফুলটা নিয়ে পেছন থেকে তনুজার কানের পিঠে গুঁজে দিলো। তৎক্ষনাৎ তনুজা কিংকর্তব্যবিমুঢ় বনে কানে হাত রাখল।

শুদ্ধ ত্বরিতে বলে উঠল, “ফেলবেন না, ফেলবেন না। মানাচ্ছে আপনায়।”

তনুজা ফেলল না। রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ল। শুদ্ধর দিকে মুড়ে বলল, “কী হচ্ছে?”

শুদ্ধ কাঁধ উঁচিয়ে ঠোঁট উলটে বলল, “কী হবে?”

তনুজার মস্তিষ্ক বড্ড উত্তেজিত হয়ে আছে। কিছু বলতে পারছে না। কানে বেজে যাচ্ছে শুদ্ধর একটা কথাই, “ফেলবেন না, ফেলবেন না। মানাচ্ছে আপনায়।”

ইতিহাসের পূনরাবৃত্তি সে যায় না। তাই আর রাখল না। কানের পিঠ থেকে ফুলটি নিয়ে হাতে মুচড়ে নিচে ফেলে দিলো। শুদ্ধ তাতে কিছু মনে করল না। নিজ মনে বলে উঠল, “নো প্রবলেম। ফুলের কানে ফুলের প্রয়োজন নেই।”

তারপরই মিনমিনে স্বরে বলল, “অলকানন্দার জন্য ডেইজি নয়, বরং শুদ্ধ এক পুরুষের প্রয়োজন।”

তনুজা শুনতে পেল না। এতক্ষণে একটা রিকশা পেল। ডাক দিয়ে উঠে বসল। শুদ্ধ হাত উঁচিয়ে বলে উঠল, “সাবধানে যাবেন, ম্যাম। আল্লাহ হাফেজ!”

তনুজা একটু এগিয়ে যেতেই, আরও একটি রিকশা এলো। রিকশাটাকে ডাক দিয়ে শুদ্ধ তড়িঘড়ি করে পড়ে থাকা ফুলটা হাতে তুলে নিল। ধুলো ঝেড়ে বুকপকেটে পুড়ে, এইবারের রিকশাটিতে শুদ্ধ চড়ে বসল। আর বলে উঠল, “শতরূপা হাউজিং-এ চলুন।”

তনুজা রিকশার হুড নামিয়ে দিলো। গভীর এক শ্বাস নিল। বিয়ের প্রথম প্রথম সিদ্দিক তাকে হুট-হাট ঘুরতে নিয়ে যেত। খুব দূর অবশ্য না। এ-ই, রাত করে রাস্তায় হাঁটতে নিয়ে যেত! এমনই এক রাত ছিল। সিদ্দিক অফিস থেকে সন্ধ্যের আগেই বাড়ি ফিরল। বরাবরের মতোই ঘর্মাক্ত শরীরে তনুজাকে জড়িয়ে ধরল, কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে বলে উঠল, “রেডি হয়ে নিন, ম্যাম। একটু হাওয়া খেয়ে আসি।”

তনুজা নেতিবাচক জবাব দিলো, “সবে এলেন, খুব টায়ার্ড আপনি, রেস্ট নিন। পরে যাওয়া যাবে।”

সিদ্দিক বাচ্চাদের মতো জেদ করল, “উঁহু। এখনই। ঝটপট শাড়ি চেঞ্জ করে ওই হলুদ কুর্তাটা পরুন।”

তনুজা হাসল। একদম সিদ্দিকের পছন্দানুসারে তৈরিও হয়ে নিল। এরপর তারা বেশ রাত অবধি ঘুরল। শহরের কোনো এক গলিতে ছিল তখন তারা। এত রাতে রাজধানীতে ফুলের দোকান খোলা পাওয়াটা খুব একটা আশ্চর্যের বিষয় না। আশ্চর্যের বিষয় হলো সিদ্দিককে সেই দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে এবং ক্ষণকালের মধ্যে একটা হলুদ ডেইজি আনতে।

তনুজা শুধাল, “ফুল?”

সিদ্দিক তনুজার কানে ফুলটা গুঁজে দিয়ে বলল, “আমার ফুলের জন্য একটা ফুল। এই ফুলের সৌন্দর্য আপনার ছোঁয়ায় দ্বিগুণ বেড়ে গেল!”

হাত বাড়িয়ে নিজের কানের ফুলটা ধরতে গেলেই সিদ্দিক বলে ওঠে, “ফেলবেন না, ফেলবেন না। আপনাকে মানাচ্ছে খুব।”

তনুজা কেবল হাসল তখন। তার মতো সুখী মেয়ে কেউ ছিল না, কেউ না। এই-যে এত ভালোবাসা, কে পায়? আর পেয়েও বা কে হারায়? তনুজা ছাড়া কেউই নয়।

সেই কথা মনে করেই তনুজা চুপ হয়ে গেল। সুখ! সে তো সাময়িক রূপ কেবল। জীবন ভিন্ন।
রিকশা অ্যাপার্টমেন্টের সামনে থামতেই, তনুজা ভাড়া মিটিয়ে ভেতরে চলে গেল। আস্তে-ধীরে হেঁটে একদমই মিলিয়ে গেল।

ঠিক একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে আরও একটি রিকশা। রিকশাওয়ালা তখন শুদ্ধকে বলে উঠলেন, “মামা, নামবেন না?”

শুদ্ধ সংবিৎশক্তি ফিরে পেল। তারপর খেয়াল করল, তনুজার ফ্লোরের দিকে। লাইট জ্বলে উঠল, জানালা দিয়ে দেখা গেল তা। সেটা দেখে নিশ্চিন্তমনে রিকশাওয়ালাকে বলল, “না, মামা। কলেজ-রোড চলেন।”

____
ফিরে দেখতে পেল, শাওন ইতোমধ্যে বাসায় চলে এসেছে। তার মুখটা বরাবরের চেয়ে একটু বেশিই ঝলমল করছে। শুদ্ধ জিজ্ঞেস করল, “কী হইছে? আরও কয়েকটা মেয়ে পটাইছিস নাকি?”

শাওন জবাবে কেবল মুচকি হাসল। কিছু বলল না। শুদ্ধ তা দেখে এগিয়ে গেল। শক্ত করে শাওনকে জড়িয়ে ধরল। বাহুবন্ধনী শক্ত করল শাওনও। আনমনে দুজনেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শাওন হাসি থামাল এবার। একপ্রকার ছিটকে এলো শুদ্ধর কাছ থেকে। নাক কুঁচকে বলল, “গোসল করোস না কয়দিন ধইরা?”

এতে শুদ্ধ নিজেও কপাল কুঁচকে ফেলল। অনিশ্চয়তার বশে পড়ে একবার নিজের পরনের কাপড় শুকে দেখল। নাহ! বাজে স্মেল আসছে না! নিশ্চিত হয়ে শাওনকে বলল, “কী হইছে, গর্ধব?”

শাওন হাত নেড়ে বলল, “উহহু! ফাকে যা, ব্যাটা।”

শুদ্ধ বিরক্ত হলো। শাওন অলস ভঙ্গিতে হাত-পা নেড়ে নিজের রুমে চলে গেল। শুদ্ধও গেল। পকেটের ফুলটা নিয়ে নিজের টেবিলে রাখল। ডায়েরি বের করল। অফ-হোয়াইট কাগজ। তার মাঝে লাল কলম দিয়ে লিখতে থাকল,

“প্রিয় অনুশোচনা,
আপনাকে ভালোবাসা থেকে নিজেকে আটকানোর অনেক চেষ্টা করে গিয়েছি আমি। কিন্তু পারিনি। এবার যেহেতু ভালোবেসেই ফেললাম, তাই আর নিজেকে সামলাব না। কিছুটা বেসামাল হব। বেখেয়ালি তো আমি সেই শুরু থেকেই ছিলাম!
ইতি
আপনার শুদ্ধ-পুরুষ”

লেখাটা শেষ করে কাগজে চোখ বোলাল বেশ কয়েকবার। পড়ল অনেকটা সময় নিয়ে। এরপর কাগজটা ডায়েরি থেকে ছিঁড়ে নিল। দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া ফুলটি অতি যত্নে এই কাগজে রেখে, কাগজটি ভালোভাবে ভাঁজ করল। তারপর কাবার্ডের সেই ড্রয়ারটিতে রেখে দিলো। সাথে পকেট থেকে বের করে একটা টিস্যুও রাখল। ফুচকা খাওয়ার সময় যখন ঝালে চোখে জল এসে গিয়েছিল প্রায়, তনুজা কিছু না বলেই এটা এগিয়ে দিয়েছিল। মুচকি হেসে ড্রয়ারটি আঁটকে ফেলল। ঠিক সেভাবেই, যেভাবে আঁটকেছে সে এই পাষণ্ডীর মায়ায়।

_______
পরদিন শুদ্ধর সাথে তনুজার দেখা হলো দিশার বিয়েতে। বড্ড বাজে এক পরিস্থিতিতে। কনে পালানো মুহূর্তে! সাথে আছে শুদ্ধ নিজেই। শাওন এ-ব্যাপারে ঘুণাক্ষরেও জানে না। সে বিয়েতে আসার পর থেকে খেয়ে যাচ্ছে। আর বলছে, এক্সের বিয়েতে কবজি ডুবিয়ে খাওয়ার মজা, তুম ক্যায়া জানোগে, শুদ্ধ বাবু?

শুদ্ধ সেখান থেকে সরে দিশাকে কল দিয়েছিল। দিশার ফোনে শুদ্ধর নম্বর সেভ করা ছিল। কল রিসিভ করেই বলেছে, “ভাইয়া, তুমি এসেছ কি?”

তখন, শুদ্ধ বলল, “হ্যাঁ, তুমি কই?”

“আমি আমার রুমেই আছি। আপাতত একা। ও কী করছে?”

শুদ্ধ শাওনের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল, “খাচ্ছে।”

ওদিকে দিশার রাগ হলো। দাঁতে দাঁত পিষে বলল, “খাক ও, জন্মের খাওয়া খাক। তুমি শোনো।”

“হুম, বলো।”

“একটা হেল্প করো তো!”

শুদ্ধ এটারই অপেক্ষায় ছিল। বাকিটা সে জানে। দিশা কী বলবে—তা-ও জানে। জেনেই বলল, “রুম কোনদিকে?”

দিশা জানাল, “দেখো, ভেতর থেকে বুঝতে পারবে না। বাইরে থেকে দক্ষিণের এই বারান্দাসহ রুমটা।”

“বাহ! বারান্দা আছে! মেঘ না চাইতেও জল-ঠাডা সবই পড়ছে!”

“হ্যাঁ, কিন্তু বারান্দা তো বাইরে থেকে লাগানো। লাগানো বলতে বিভিন্ন জিনিসপত্র রাখায় আটকে আছে।”

“সেটা ব্যাপার না। আমি এসে সরাচ্ছি।”

ততক্ষণে শুদ্ধ হাঁটতে হাঁটতে দক্ষিণে চলে এলো। চোখ কুঁচকে বলল, “এদিকটায় এত ফাঁকা কেন?”

“ভাইয়া, বাড়ির পেছন দিক তো! এজন্য কেউ আসে না। তাছাড়া, ওখানে দুটো কবর আছে, দাদার বাবা আর তার দাদার। এজন্য বাচ্চারা খেলার ছলেও আসে না।”

“আচ্ছা, সমস্যা নেই তা। তুমি বিয়ের পোশাকের উপরে বোরকা জড়িয়ে নাও। এক্সট্রা সিকিউরিটি।”

“আচ্ছা, ভাইয়া।”

“জুয়েলারি সব খুলে রেখে এসো। শব্দ হলে সমস্যা হবে।”

“কিন্তু..”

“বেশি কথা বোলো না তো! বি ফাস্ট! আর দরজাটা আটকে নিয়ো। ওয়েট! বিয়ের কনেকে তো একা রাখা হয় না! তুমি একা কী করো?”

“আমি একা ছিলাম না। খালাতো বোন সাথে ছিল। বিয়েতে আমার ফ্রেন্ডের নাম করে ওর বয়ফ্রেন্ডও এসেছে। এখন সেখানে গেছে ও তার সাথে কথা বলতে, লুকিয়ে।”

“আচ্ছা। আমি এসে গেছি। এগুলো সরাচ্ছি। তুমি রেডি হয়ে নাও।”

মিনিট পনেরোর মধ্যেই শুদ্ধ দরজাটা খুলে দিলো। দিশাও দাদির সুন্নতি বোরকা পরে তৈরি। শুদ্ধকে দেখে দিশা নিকাপের আড়ালে এক গাল হেসে বলল, “উফ! তুমি না থাকলে যে কী হতো, শুদ্ধ ভাইয়া! শাওনের মতো তুমিও আমাকে মানা করে দিলে সিরিয়াসলি বলছি, সুইসাইড এটেম্পট করতাম!”

চলবে…

শব্দসংখ্যা- ১৩৩১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here