#অব্যক্ত_ভালোবাসা
#লেখনীঃআরভি_আহিয়াদ_তিহু
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্বঃ18
শান ছাদের রেলিংয়ের উপর হাত রেখে শূন্যের দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ নিচ থেকে খটখট করে দরজার লক খোলার আওয়াজ কানে আসতেই ওর কপালে ভাঁজ পড়ল। এত রাতে কে দরজা খুলছে সেটা দেখার জন্যে সামনের দিকে একটু ঝুকে নিচে তাকাতেই পিছন থেকে ধরাম করে একটা আওয়াজ আসলো। শান চমকে পিছনের দিকে তাকাল। দেখল, ছাদের দরজার কাছে রুশা পাঁ চেপে ধরে ফ্লোরে বসে ব্যাথায় আর্তনাদ করছে। শান তড়িঘড়ি করে এগিয়ে গিয়ে রুশার সামনে দাড়াল। কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করল,
–“পড়লে কীভাবে?”
রুশা চোখ-মুখ কুচকে ব্যাথাতুর গলায় বলল,
–“সিড়ি দিয়ে ছাদে উঠতে গিয়ে দরজার নিচের গ্রিলের সাথে পাঁ আটকে ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলেছি।”
রুশার কথায় শান মুখ থেকে বিরক্তিসূচক ‘চ’ শব্দ উচ্চারণ করে হাটু গেড়ে রুশার সামনে বসল। তারপর রুশার আঘাতপ্রাপ্ত পাঁ টা হাত দিয়ে ধরে উল্টেপাল্টে দেখতে লাগল। এতে রুশার বেশ অসস্তি হলেও ‘ও’ শানকে কিছুই বলল। হঠাৎ নিচ থেকে একটা গাড়ি স্টাডের শব্দ শোনা গেল। শান কান খাড়া করে শব্দটা শুনে ভ্রু কুচকে ফেলল। এত রাতে কে গাড়ি নিয়ে বাইরে যাচ্ছে সেটা দেখার জন্যে ‘ও’ রুশার পাঁ টা ছেড়ে উঠে দাড়ানোর জন্যে প্রস্তুতি নিল। ওকে উঠতে দেখে রুশাও দাড়ানোর জন্যে উদ্দ্যত হল, তারপর ব্যালেন্স হারানোর নাটক করে একদম শানের উপরে গিয়ে পড়ল। আচমকা এমনটা হওয়ায় শান রুশাকে নিয়ে সোজা ফ্লোরে পড়ে গেল। রুশার মাথা গিয়ে ঠেকলো শানের বুকের মাঝ বরাবর। আকষ্মিক ঘটনায় শান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। রুশা দাঁতে দাঁত চেপে বিরবির করে বলল,
–“পায়েশের বাচ্চা তোর জন্যে আজকে আমাকে কি কি করতে হচ্ছে দেখ। একবার তুই শুধু ফিরে আয়। তারপর দেখ আমি তোর কি অবস্থা করি। অসভ্য, বেয়াদব ছেলে, তোর গুষ্ঠির পিণ্ডি চটকাব আমি।”
বিরবির করে কথাটা বলে রুশা শানের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে ওর মুখের দিকে তাকাল। দেখল, শান চোখ ছোট ছোট করে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। রুশার মনে পড়ল কিছুক্ষণ আগের ঘটনা। আয়াশ যখন সৃজাকে নিয়ে বাইরে যাওয়ার কথা বলছিল তখন রুশা নিচের দিকেই যাচ্ছিল। কিন্তু আয়াশের কথা শুনে ‘ও’ নিচে না গিয়ে দ্রুত দৌড়ে ছাদে চলে এসেছে। আর শানের মাইন্ড ডাইভার্ট করার জন্যে পড়ে যাওয়ার নাটক করেছে। যাতে শান, সৃজা আর আয়াশের বাইরে যাওয়াটা না দেখে সেইজন্যে। রুশা জোরপূর্বক একটা মেকি হাঁসি দিয়ে বলল,
–“সরি, আসলে আমি বুঝতে পারিনি এভাবে পড়ে যাব।”
কথাটা বলতে বলতে রুশা শানের উপর থেকে উঠে শানের থেকে কিছুটা দূরত্বে গিয়ে ফ্লোরে বসে পড়ল। শান ফ্লোর থেকে উঠতে উঠতে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
–“ইটস ওকে! ইট’স যাস্ট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট।”
বলেই শান উঠে দাড়াল। তারপর সোজা সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে ছাদের রেলিংয়ের উপর আবারও হাত রাখল। নিচের দিকে দৃষ্টি পড়তেই দেখল সিকিউরিটি গার্ডেরা বাড়ির মেইন গেট লক করছে। কিন্তু আশেপাশে কোনো গাড়ি দেখতে পেল না। শান একটু উচ্চ স্বরে ওদেরকে উদ্দ্যেশ্য করে জিজ্ঞেস করল,
–“এত রাতে বাইরে কে বেড়িয়েছে?”
একজন গার্ড স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
–“আয়াশ স্যার বেড়িয়েছেন। ওনার নাকি মিটিং আছে।”
এত রাতে মিটিং? শানের ব্যপারটা কেমন যেন খটকা লাগল। ‘ও’ ঘাড় ঘুড়িয়ে পিছনে তাকাতেই দেখল রুশা নিঃশব্দে পাঁ টিপে টিপে সিড়ির দিকে যাচ্ছে। শান উঁচু গলায় বলে উঠল,
–“রুশা!”
শানের হঠাৎ ডাকে রুশা চমকালো। ইতস্তত করতে করতে ঘাড় ঘুরিয়ে শানের দিকে তাকাল। শান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রুশার দিকে তাকিয়ে বলল,
–“তুমি না পাঁয়ে ব্যাথা পেয়েছো? চলো তোমাকে কোলে করে তোমার রুমে দিয়ে আসি।”
রুশা জোরপূর্বক হেঁসে বলল,
–“তার কোনো দরকার নেই। আমি নিজেই চলে যেতে পারব।”
–“একটু আগেই ত ঠিকভাবে দাড়াতে পারছিলে না বলে আমাকে নিয়ে ফ্লোরে পড়ে গেলে। তাহলে এখন এতগুলো সিড়ি বেয়ে নিচে নামবে কীভাবে?”
রুশা শুকনো মুখে বলল,
–“গ্রিল ধরে ধরে ঠিক নেমে যেতে পারব। আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।”
শান রুশার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
–“না, তুমি অনেকটা ব্যাথা পেয়েছো। নামতে পারবে না। চলো আমি তোমাকে দিয়ে আসি।”
–“নো থ্যাংক্স, আমি নিজেই যেতে পারব।”
কথাটা বলে রুশা ফুড়ুৎ করে দৌড়ে সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল। শান ছাদের দরজার কাছে এসে কোমড়ে হাত দিয়ে রুশার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
–“সবগুলো মিলে নির্ঘাত আবার কোনো খিচুরি পাকাচ্ছে।”
_________________________
আয়াশের গাড়ি দাড়িয়ে আছে একটা শূনশান ব্রিজের উপরে। ব্রিজের পাশে থাকা ল্যাম্প পোস্টের আলোতে ব্রিজ টা স্পষ্ট দেখা গেলেও দুজন মানব-মানবী ছাড়া আশেপাশে আর কাউকেই তেমন দেখা যাচ্ছে না। ব্রিজের সাইডের সিমেন্ট দিয়ে কাড়ুকাজ করা ছোট্ট রেলিংয়ের উপর আয়াশ এক হাতে ভর দিয়ে দাড়িয়ে অন্য হাত দিয়ে সিগারেট টানছে। ওর থেকে কয়েক হাত দূরে সৃজা একই রেলিংয়ের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাড়িয়ে দাড়িয়ে রাতের অন্ধকার আকাশ উপভোগ করছে। দুজনের মধ্যেই নিরবতা। দুজনই নিজেদের একান্ত ব্যাক্তিগত ভাবনায় ব্যস্ত। হঠাৎ নিজের ভাবনা থেকে বের হয়ে এসে আয়াশ সৃজাকে উদ্দ্যেশ্য করে বলল,
–“স্মোক করবে? ট্রাস্ট মি এটা খেলে অনেক রিলিফ লাগে।”
আয়াশের প্রশ্নে সৃজা ভ্রু কুচকে ওর দিকে তাকাল। কি অদ্ভুত ছেলে। নিজে ত এসব বাজে জিনিস খাচ্ছে, আবার একটা মেয়েকেও এসব খেতে অফার করছে? সৃজা বিরক্তিতে নাক কুচকে বলল,
–“আপনি কি রেগুলার স্মোক করেন?”
আয়াশ সিগারেটে টান দিয়ে ধোয়াগুলো শূন্যে ছেড়ে বলল,
–“না, মাঝে-মাঝে। যখন রুশ আশেপাশে থাকে না তখন। স্মোক করতে দেখলে অথবা ধোয়ার স্মেল পেলে ‘ও’ ভিষণ রেগে যায়।”
আয়াশের কথায় সৃজার মুখটা মলিন হয়ে গেল। ‘ও’ সামনের দিকে তাকিয়ে শূন্যে দৃষ্টি রেখে উদাসীন গলায় বলল,
–“আপনি রুশা আপুকে ভিষণ ভালোবাসেন, তাইনা?”
আয়াশ স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
–“হ্যাঁ, নিজের থেকেও বেশি।”
সৃজার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। বুকের কোথাও একটা অদৃশ্য চিনেচিনে ব্যাথা শুরু হয়ে গেল। যাকে কখনো পাবে না জেনেও এতগুলো দিন ধরে ভালোবেসে গেছে, তার মুখ থেকে অন্য কাউকে ভালোবাসার কথা শুনে ওর এত কষ্ট হচ্ছে কেন? ‘ও’ ত জানত ‘ও’ যাকে ভালোবাসে সে অনেকটা আকাশের চাঁদের মতো। যেই চাঁদ কখনো ওর কাছে এসে ধরা দিবে না। সবটা জেনেই ত ‘ও’ আয়াশকে ভালোবেসেছে। তাহলে আজকে আয়াশের রুশাকে ভালোবাসার কথাটা শুনে ওর বুকের ভেতরটা এভাবে দুমড়ে-মুচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে কেন? সৃজা নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়ে শুকনো গলায় বলে উঠল,
–“কবে বিয়ে করবেন আপনারা?”
–“আপনারা কারা?”
আয়াশের পাল্টা প্রশ্নে সৃজা বিরক্তির স্বরে বলল,
–“আপনি আর রুশা আপু!”
আয়াশ ভ্রু কুচকে সৃজার দিকে তাকাল। তারপর মুখ বাঁকিয়ে বলল,
–“আমি কোন দুঃখে রুশকে বিয়ে করতে যাব?”
আয়াশের কথায় সৃজার গাঁ জ্বলে গেল। ভালোবাসে অথচ বিয়ে করবে না? এটা কেমন কথা? সৃজা ঝাড়ি মেরে বলল,
–“একটু আগেই ত বললেন আপনি রুশা আপুকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসেন। তাহলে বিয়ে করবেন না কেন?”
আয়াশ চোখ ছোট ছোট করে সৃজার দিকে তাকাল। ‘ও’ বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে সৃজাও বাকিদের মতো রুশাকে ওর গার্লফ্রেন্ড ভেবেছে। সৃজা রাগে গজগজ করতে করতে একা একাই বলতে লাগল,
–“আসলে আপনাদের মতো ছেলেরা না এরকমই লাফাঙ্গা টাইপের হয়। এরা দুই চারটা করে প্রেম করতে পারে। কিন্তু বিয়ে করার কথা উঠলেই একদম ইনোসেন্ট হয়ে যায়। এতটাই ইনোসেন্ট হয়ে যায় যে এদের দেখলে মনে হয়, বিয়ে করা ত দূরের কথা, এরা বিয়ে শব্দটাও কখনো নিজের কানে শুনেনি। আপনিও হচ্ছেন সেই লাফাঙ্গা ছেলেদের দলের লোক।”
সৃজার কথা শুনে আয়াশ ফিক করে হেঁসে দিল। হাতে থাকা সিগারেটের গোড়া টা নদীর পানির দিকে ছুড়ে মেরে সৃজার দিকে পূর্ন দৃষ্টি রাখল। ঠোঁটের কোনের হাসিটুকু বজায় রেখেই প্রশ্ন করল,
–“তুমি জানো রুশ আমার কে হয়?”
সৃজা বলল,
–“শুধু আমি না, দুনিয়ার সবাই জানে রুশা আপু আপনার গার্লফ্রেন্ড। আমি যদি খুব ভুল না হই, তাহলে ফুচকা স্টলে যে মেয়েটার সাথে আপনাকে স্পট করা হয়েছিল সেটা আর কেউ না, রুশা আপু।”
আয়াশ ঠোঁট প্রশস্ত করে আবারও হাঁসল। বলল,
–“সবাই সেটাই জানে যেটা ওদের ধারনা। কিন্তু আসল সত্যিটা জানে কজন?”
সৃজা প্রশ্নবিদ্ধ চোখে আয়াশের দিকে তাকাল। আয়াশ বলল,
–“রুশ আমার সবকিছু। ‘ও’ আমার বাবা-মা, পার্সনাল ডাক্তার, বেস্টফ্রেন্ড, গার্ডিয়ান, ফ্যামিলি, সব। ওর থেকে ইম্পরট্যান্ট ব্যাক্তি আমার লাইফে আর কেউ নেই। আমি সবথেকে বেশি ওকে ভালোবাসি। তবে গার্লফ্রেন্ড বা বউ হিসেবে না। আমার একান্ত, ব্যাক্তিগত পৃথিবী হিসেবে। ‘ও’ আমার জন্যে যতটা করেছে ততটা হয়ত আমার মাও আমার জন্যে কখনো করতে পারেনি। ইতির সাথে সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার পর আমি যখন নিজের লাইফটাকে একেবারে হেল বানিয়ে ফেলেছিলাম, তখন ‘ও’ আমাকে সামলেছে। আমার যত্ন নিয়েছে, আমাকে বুঝিয়েছে। যখন অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থেকেছি তখন নিজের সব কাজ ফেলে আমার সেবা করেছে। ড্রাংক অবস্থায়, রাগের মাথায় ওর উপরে কত চিল্লাচিল্লি করেছি, তাও কখনো বিরক্ত হয়ে আমাকে ছেড়ে যায়নি। সবসময় বট গাছের মতো ছায়া দিয়ে আমাকে আগলে রেখেছে।”
কথাগুলো বলতে বলতে আয়াশ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সৃজা এক দৃষ্টিতে আয়াশের মুখপানে তাকিয়ে আছে। আয়াশ আবারও বলা শুরু করল,
–“রুশ না থাকলে হয়ত আমি নদীতে ভাসমান আগাছার মতো ভাসতে ভাসতে একটা সময় গভীর সমুদ্রে তলিয়ে যেতাম। ওর জন্যেই আমি এত বড় একটা ধাক্কা খাওয়ার পরেও আয়াশ দেওয়ানের ব্যাক্তিত্ব টা ধরে রাখতে পেরেছি। জানো, সবাই বলে প্রত্যেকটা ছেলে বেস্ট ফ্রেন্ড নাকি জীবনে একবার হলেও তার মেয়ে বেস্ট ফ্রেন্ডের প্রেমে পড়ে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল আমি এত বছর ধরে রুশার কাছাকাছি থাকার পরেও ওর প্রেমে কখনো পড়িনি। ওর প্রতি আমার তেমন কোনো ফিলিংসও কখনো আসেনি। ওর কাছে গেলে আমি সবসময় একটা শান্তি খুজেঁ পাই। মনে হয় ‘ও’ এমন একটা বটগাছ যে সমস্ত ঝড়, তুফান, বৃষ্টি থেকে আমাকে এখন অবদি আগলে রেখেছে।”
আয়াশের কথা শুনে সৃজা যতটা না খুশী হল, তারথেকে বেশি মুগ্ধ হল। আজকাল এরকম বন্ধুত্ব দেখা যায় না বললেই চলে। এই স্বার্থপরদের জগতে এমন নিঃস্বার্থ বন্ধু থাকাটা ভাগ্যের ব্যাপার। এই ত সৃজারই ছোটবেলায় কত কত বন্ধুরা ছিল। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে আজকে তারা কেউ ওর সাথে নেই। সবাই নিজেদের লাইফ নিয়ে ব্যস্ত। কল দিয়ে এক মিনিট কথা বলার মতোও সময় কারো কাছে নেই। অথচ আয়াশ আর রুশার বন্ধুত্বের সম্পর্কের ডেফিনেশন টা কতটা সুন্দর, কতটা গভীর।আজকাল এরকম বন্ধুত্ব খুজেঁ পাওয়াটা রেয়ার ব্যাপার।সৃজার মনে হল, জীবনে এরকম একটা বন্ধু থাকলেই হয়ত সমস্ত পৃথিবীটা জয় করে আসা যায়।
আয়াশ সামনের অন্ধকারে দৃষ্টি রেখে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। সৃজা কোনো কিছু না বলেই ছুটে এসে আয়াশের গলা জড়িয়ে ধরল। আয়াশ চমকালো! চোখ দুটো বড় বড় করে হাত জোড়া স্যারেন্ডার করার মতো উপরে উঠিয়ে ফেলল। সৃজা আরো শক্ত করে আয়াশের গলা জড়িয়ে ধরল। বেশ কিছুটা সময় পাড় হওয়ার পর আয়াশ নিজের গলা থেকে সৃজার হাত জোড়া সরিয়ে দিয়ে বলল,
–“এত রাতে একটা ছেলের সাথে এরকম একটা শূনশান জায়গায় দাড়িয়ে তার এতটা কাছে আসা ঠিক না। যেকোনো সময় একটা অঘটন ঘটে যেতে পারে।”
সৃজা আয়াশের থেকে খানিকটা দূরে সরে গিয়ে মাথা নিচু করে মুচকি হাঁসল। অতিরিক্ত খুশী সামলাতে না পেরে ‘ও’ আয়াশকে এসে জড়িয়ে ধরেছে। আয়াশ ভ্রু কুচকে সৃজার দিকে তাকাল। সৃজা গলা খ্যাকারি দিয়ে মিনমিনে কণ্ঠে বলল,
–“আমি আপনাকে ভিষণ ট্রাস্ট করি। আমি জানি আপনি আমার সাথে কিচ্ছু করবেন না।”
আয়াশ কঠিন গলায় বলল,
–“ভুল জানো। পৃথিবীর সব মেয়েরা আমার কাছে সেফ হলেও তুমি আমার কাছে মোটেও সেফ নও। কজ তুমি ওই মোহনা সিকদারের ভাতিজি আর শান রায়জাদার বোন। ওদের থেকে রিভেঞ্জ নেওয়ার জন্যে আমি যেকোনো সময় তোমার ক্ষতি করতে পারি। তাই এত নিশ্চিত হয়ে আমার কাছে আসার কথা ভুলেও ভেবো না।”
আয়াশের কথা শুনে সৃজা ভেংচি কেটে বিরবির করে বলল,
–“খারুচ কোথাকার।”
_________________________
রাত 2:00
রুশা ঘুমিয়ে ছিল। ঘুমের মধ্যেই শুনতে পেল কেউ ওর দরজায় নক করছে। ‘ও’ ঘুমুঘুমু চোখে শোয়া থেকে উঠে এলোমেলো পাঁয়ে গিয়ে দরজার লক খুলে দিল। বাইরে তাকিয়ে দেখতে পেল সৃজা ওর রুমের সামনেই দাড়িয়ে আছে। আর আয়াশ নিজের রুমে ঢুকে দরজা লক করছে। রুশা সৃজাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে তারআগেই সৃজা লাফিয়ে এসে রুশার গলা ঝাপটে ধরল। আকষ্মিক ঘটনায় রুশা দু-পা পিছিয়ে গেল। সৃজা টুপ করে রুশার গালে একটা চুমু দিয়ে ওর গলা ছেড়ে দৌড়ে গিয়ে ধপাস করে ওর বিছানার উপর শুয়ে পড়ল। ঘটনার অকষ্মিকতায় রুশা হতবম্ভ হয়ে গেল। সৃজা দাঁত বের করে হেঁসে কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল। রুশা হাঁ করে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে সৃজার দিকে তাকিয়ে রইল। এরমধ্যেই ওর চোখের পাতায় ঘুমেরা এসে আবারও ভর করল। ‘ও’ আর কোনো কিছু না বলে বেড থেকে একটা বালিশ নিয়ে কাউচের উপর গিয়ে শুয়ে পড়ল। কারন সৃজা হাত-পাঁ ছড়িয়ে পুরো বিছানা একাই দখল করে নিয়েছে।
_________________________
ঘুমের মধ্যে নাকে সুরসুরি অনুভব করতেই ধরফরিয়ে উঠে বসল রুশা। হাউচ্চু-হাউচ্চু করে পরপর চারটা হাঁচি দিয়ে হাঁচি থামানোর জন্যে হাত দিয়ে নিজের নাক চেপে ধরল। তারপর কোনো রকম নিজেকে সামলে নিয়ে ঘোলা চোখে পাশে তাকাল। কাউচের সামনে রাখা ছোট কাচের টেবিলটার উপর শানকে বসে থাকতে রুশা শকড হল। চোখের ভ্রম নাকি সত্যিই শান ওখানে বসে আছে সেটা বোঝার জন্যে ‘ও’ কয়েকবার চোখের পলক ঝাপটাল। রুশার অবস্থা দেখে শান ঠোঁট চেপে হাসল। মস্তিষ্ক একটু সচল হতেই রুশা বুঝল এটা ভ্রম না, শান সত্যিই ওর সামনে বসে আছে। ব্যস্ত ভঙ্গিতে একবার নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে দ্রুত কাউচ থেকে উঠে বেডের কাছে ছুটে গেল। তারপর ব্যতিব্যাস্ত হয়ে বেডের সাইড থেকে ওড়নাটা হাতে নিয়ে গায়ে জড়িয়ে নিল। কিন্তু সৃজাকে বেডের কোথাও দেখতে পেল না। চিন্তিত ভঙ্গিতে দাড়িয়ে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করল, “সৃজা কোথায়? রাতে ত ‘ও’ এখানেই ছিল।”
রুশার চিন্তার রেশ ওর মাথা থেকে না যেতেই শান বলে উঠল,
–“রাতে না তোমার পাঁয়ে ভিষণ ব্যাথা ছিল? এইটুকু সময়ের মধ্যেই ব্যাথা ভালো হয়ে গেছে? কীভাবে ভালো হল?”
রুশা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে শানের দিকে তাকিয়ে বলল,
–“দ্যাটস নন অফ ইউর বিজনেস। আপনি কেন আমার রুমে ঢুকেছেন?”
শান কাচের টেবিলটার উপর থেকে উঠে দাড়াল। তারপর এগিয়ে এসে রুশার মুখোমুখি দাড়িয়ে বলল,
–“দরজা এরকম চিচিংফাক করে খোলা রাখলে আমি কেন, যে কেউ তোমার রুমে ঢুকে যাবে। তোমার ভাগ্য ভালো অন্যকেউ তোমার রুমে ঢুকেনি।”
রুশা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–“অন্যকেউ আমার রুমে কেন ঢুকবে? সবাই কি আপনার মতো ম্যানারলেস না-কি?”
শান মুখ বাঁকিয়ে বলল,
–“ভাগ্যিস আমি ম্যানারলেস। তাই ত তোমার রুমে ঢুকে এতক্ষণ বসে বসে তোমাকে পাহাড়া দিচ্ছিলাম। যাতে অন্যকেউ তোমার রুমে ঢুকতে না পারে সেইজন্যে।”
রুশা বলল,
–“ইন্টেনশন ভালো হলে ত বাইরে থেকেই দরজা টা টেনে দিয়ে চলে যেতে পারতেন। আর নাহলে অন্তত আমাকে একটা ডাক দিতে পারতেন।”
শান বিরক্ত হয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
–“আমার ইন্টেনশন ভালো ছিল না ত। তোমাকে রুমে একা ঘুমিয়ে থাকতে দেখে আমি তোমার সাথে অসভ্যতা করতে চেয়েছিলাম। তোমার সুযোগ নিতে এই রুমে ঢুকেছিলাম। হ্যাপি?”
রুশা কর্কশ গলায় বলল,
–“আমি জানতাম আপনার চরিত্রে গন্ডগোল আছে। আপনার উপর আমার অনেক আগে থেকেই সন্দেহ ছিল।”
শান চোখ গরম করে রুশার দিকে তাকাল। ওর চরিত্র নিয়ে কেউ কথা বললে ওর ভিষণ রাগ হয়। এই রুমে আসার পিছনে ওর তেমন কোনো উদ্দ্যেশ্য ছিল না। ‘ও’ যাস্ট কড়িডোর দিয়ে যাচ্ছিল তখনই দেখল দরজাটা একদম খোলা অবস্থায় আছে। রুশার রুমের দরজার সামনে কিছু বাচ্চারা লাফালাফি করছে। শান রুমের সামনে এসে উকি দিতেই দেখল রুশা ওড়না ছাড়া এলোমেলো হয়ে কাউচের উপর শুয়ে আছে। তাই ‘ও’ বাচ্চাগুলোকে ওখান থেকে তাড়িয়ে দিয়ে নিজে রুমে ঢুকে বেডে বসে বসে এতক্ষণ ফোন স্ক্রল করছিল। রুশা উল্টাপাল্টা কিছু ভাবতে পারে তাই রুশার গায়ে ওড়ানাও দিতে যায়নি। প্রায় এক ঘন্টার মতো এখানে বসে ছিল। তারপর কিছুক্ষণ আগে ওর ফোনে একটা কল আসে। আর ওকে নিচে যাওয়ার জন্যে বলে। তাই রুশাকে উঠানোর জন্যে শান রুশার চুল দিয়ে ওর নাকে সুরসুরি দিয়েছিল। ভেবেছিল রুশাকে একটু রাগাবে। কিন্তু রুশা রেগে এভাবে কথা বলবে সেটা ‘ও’ ভাবেনি। শানকে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকতে দেখে রুশা আবারও বলল,
–“অনেক উপকার করেছেন আমার। এইবার আপনি এখান থেকে যেতে পারেন। প্লিজ যান এখান থেকে।”
রুশা কথাটা বলার সাথে সাথে শান এগিয়ে এসে রুশার গাল চেপে ধরে বলল,
–“তোমার সুযোগ নেওয়ার ইচ্ছে থাকলে সেদিনই নিতে পারতাম, যেদিন তোমাকে প্রথমবার তুলে নিয়ে গিয়েছিলাম। তারজন্যে তোমার রুম খুলে ঘুমিয়ে থাকা পযর্ন্ত আমাকে অপেক্ষা করতে হত না। তবে আজকের পর থেকে তুমি কেয়ারফুল থেক। কারন এরপর আমি এরকম সুযোগ পেলে মোটেও হাতছাড়া করব না।”
কথাটা বলে শান ঝাড়া মেরে রুশার গাল ছেড়ে দিয়ে রুমের দরজা খুলে বের হয়ে গেল। রুশা চোখ জোড়া বন্ধ করে লম্বা নিঃশ্বাস নিল। ঘুমের ঘোরে রেগে শানকে ‘ও’ যা তা বলে ফেলছে। এখন ওরই কেমন গিলটি ফিল হচ্ছে। কারো বিষয়ে না বুঝে এভাবে তার ক্যারেক্টার নিয়ে বলাটা অন্যায়, সেটা রুশা জানে। কিন্তু ওরই বা দোষ কি? ‘ও’ ঘুমের ঘোরে আচমকা শানকে এখানে দেখে তিরিক্ষি মেজাজের জন্যে এসব বলে ফেলেছে।
#চলবে…..