#অব্যক্ত_ভালোবাসা
#লেখনীঃআরভি_আহিয়াদ_তিহু
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্বঃ22
আয়াশ রাগে গজগজ করতে করতে কাবার্ডে তুলে রাখা ওর ড্রেস গুলো এলোমেলো করে লাগেজের মধ্যে ঢুকাল। তারপর লাগেজের চেইন লক করে দিয়ে ওটাকে বেড থেকে নামিয়ে রুমের বাইরে যাওয়ার জন্যে উদ্যত হল। দরজা খুলে বের হতে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে শান রুশার হাত ধরে নিয়ে এসে আয়াশের সামনে দাড়াল। আয়াশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার শানের দিকে তাকিয়ে ওদের সাইড কাটিয়ে বাইরে যাওয়ার জন্যে হাঁটা দিল। শান রুশার হাত ছেড়ে দিয়ে এগিয়ে এসে আয়াশের মুখোমুখি দাড়াল। তারপর ভ্রু কুচকে বলল,
–“কোথায় যাচ্ছো?”
আয়াশ চোয়াল শক্ত করে বলল,
–“চলে যাচ্ছি। এখানে আমার আর কোনো কাজ নেই।”
শান একটু বিদ্রুপের ভঙ্গিতে হেঁসে বলল,
–“তোমার বোনের বিয়ে, আর তুমি বলছো তোমার এখানে কোনো কাজ নেই? এখান থেকে চলে গিয়ে কি নিজের দ্বায়িত্ব এড়াতে চাইছো?”
শানের কথায় আয়াশের রাগের মাত্রাটা আরো বেড়ে গেল। ‘ও’ চেঁচিয়ে উঠে বলল,
–“যাস্ট শাটআপ, ওকে? আমার মা, বাবা, বোন, পরিবার, কেউ নেই। আমার কাছে সবাই অনেক বছর আগেই মা’রা গেছে। তাই এসব অযাচিত সম্পর্কে একদম আমাকে জড়াতে আসবে না।”
শান শান্ত দৃষ্টিতে আয়াশের দিকে তাকাল। তারপর শীতল কিন্তু ভারী স্বরে বলল,
–“ওকেহ ফাইন। জড়ালাম না তোমাকে কোনো সম্পর্কে। কিন্তু তুমি ত রুশার সাথে এখানে এসেছিলে, তাইনা? তাহলে রুশাকে এখানে একা রেখে চলে যাচ্ছো কেন? বাই এ্যানি চান্স, তুমি এখান থেকে চলে যাওয়ার পর তোমার বেস্টফ্রেন্ড যদি এখান থেকে হাপিশ হয়ে যায়, তখন তুমি কি করবে?”
আয়াশ তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে শানের দিকে তাকাল। ভ্রু কুচকে বলল,
–“হাপিশ হয়ে যাবে মানে? কোথায় যাবে?”
শান হেয়ালির স্বরে বলল,
–“এই ধরে নেও, তোমার থেকে রিভেঞ্জ নেওয়ার জন্যে আমি নিজেই রুশাকে আমার কাছে আটকে রাখলাম। অথবা ওকে কিডন্যাপ করে দেশের বাইরে কোথাও একটা পাচার করে দিলাম। তখন তোমার কি হবে বলো ত? বেস্টফ্রেন্ডকে ছাড়া থাকতে পারবে ত?”
শানের কথায় আয়াশ হিংস্র দৃষ্টিতে শানের দিকে তাকাল। শান ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে সুক্ষ দৃষ্টিতে আয়াশের দিকেই তাকিয়ে আছে। আয়াশ শানকে কিছু না বলে এগিয়ে এসে রুশার হাত চেপে ধরল। তারপর শক্ত কণ্ঠে বলল,
–“তুইও আমার সাথে চল। এখানে তোর আর থাকতে হবে না।”
রুশা এতক্ষণ চুপচাপ দাড়িয়ে শান আর আয়াশের কথা শুনছিল। কিন্তু আয়াশের এইবারের কথা শুনে ‘ও’ মুখ বাঁকাল। নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,
–“তোর ইচ্ছে হলে তুই যা। আমি কেন তোর সাথে যাব?”
আয়াশ দাঁত কটমট করে বলল,
–“শুনলি না ‘ও’ কি বলল? তারপরেও তুই এই বাড়িতে থাকতে চাস?”
–“হ্যাঁ, চাই। আমার জন্যে তোর চিন্তা হলে তুইও এখানে থেকে যেতে পারিস। কিন্তু আমি এই মুহূর্তে কোথাও যাব না।”
রুশার কথায় আয়াশ বেশ বিরক্ত হল। চোখে-মুখে বিরক্তির ছাপ ফেলে বলল,
–“জেদ করিস না রুশ। আমি কিন্তু ভিষণ রেগে আছি। চল আমার সাথে। এখানে তোর কোনো কাজ নেই।”
রুশা আয়াশের থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
–“বললাম না যাব না? যাব না মানে যাব না, যাব না, যাব না। তোর ইচ্ছে হলে তুই যা। আমাকে একদম জোর করবি না।”
আয়াশ ভালো করেই জানে রুশা ওর কথা জীবনেও শুনবে না। তাই ‘ও’ রুশার দিকে এক পলক রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঘাড় কাৎ করে শানের দিকে তাকাল। শান বুকে দু-হাত গুজে দরজার সাথে কাৎ হয়ে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে। আয়াশ নিজের রাগটাকে কন্ট্রোল করতে না পেরে ওর লাগেজটার উপরে জোরে একটা লা’থি মারল। সাথে সাথে লাগেজ টা দু-হাত দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ল। আয়াশ রাগে ফুসতে ফুসতে শানের দিকে আবারও একটা অ্যাংড়ি লুক দিয়ে গটগট করে হেঁটে ওখান থেকে চলে গেল। আপাতত যে করেই হোক ‘ও’ নিজের রাগটাকে কন্ট্রোল করতে চায়। নিজের এই বেহুদা রাগের জন্যে কারো সাথে ঝামেলা করার ইচ্ছে ওর নেই।
আয়াশ যেতেই শান মুচকি হেঁসে রুশার দিকে তাকাল। তারপর পিঞ্চ করে বলল,
–“যতটা চালাক তোমার ফ্রেন্ডকে ভেবেছিলাম, ততোটাও চালাক সে না। পাঁ থেকে মাথা অবদি শুধুমাত্র রাগ দিয়ে ভর্তি। এই অতিরিক্ত রাগের জন্যেই তোমাদের দুজনের সকল বুদ্ধি বাদরে এসে নিয়ে গেছে। তোমাদের দুজনের উচিৎ নিজেদের রাগ টা একটু কন্ট্রোল করা। নাহলে তোমাদের মাথায় অবশিষ্ট থাকা বুদ্ধি টুকুও কোনো একদিন বাদরে এসে নিয়ে চলে যাবে।”
শানের কথায় রুশা তৈলে বেগুনে জ্বলে উঠল। বড় বড় পাঁ ফেলে শানের দিকে এগিয়ে এসে ওর মুখের সামনে নিজের তর্জনী আঙুল উঠিয়ে রাগি গলায় বলল,
–“একদম ফালতু কথা বলবেন না। আপনার ফালতু কথা শোনার জন্যে আমি মোটেও ইন্টারেস্টেড নই।”
কথাটা বলে রুশা পিছনে ঘুড়ে সামনের দিকে হাঁটা দিল। দু-কদম যেতেই শান পিছন থেকে রুশার হাত টেনে ধরে ওকে নিজের দিকে ঘোরাল। ভ্রু কুচকে বলল,
–“হলুদের অনুষ্ঠানে আশি বছরের নানিদের মতো সাদা লেহেঙ্গা পড়ে ঘুড়ছো কেন? সকালে আমি তোমাকে যেই লেহেঙ্গা টা পড়তে বলেছিলাম, সেটা কোথায়?”
রুশা শক্ত কণ্ঠে বলল,
–“আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছি। আপনি ভাবলেন কীভাবে আমি আপনার কেনা লেহেঙ্গা পড়ব?”
রুশার কথা শুনে শান চোখ ছোট ছোট করে রুশার দিকে তাকাল। তারপর মুখ বাঁকিয়ে বলল,
–“ওটা আমি তোমার জন্যে কিনিনি, আম্মু পছন্দ করে কিনেছে। আমি যাস্ট ওটা তোমাকে দিতে গিয়েছিলাম। আর তুমি আমার কেনা ভেবে একদম ড্রেসটাকে পুড়িয়েই ফেলছো? ইশশ, এইবার আম্মু নিশ্চয়ই ভিষণ কষ্ট পাবে। কত শখ করে তোমার জন্যে আম্মু ড্রেসটা কিনেছিল। তুমি এভাবে ড্রেসটা পুড়িয়ে ফেলে আম্মুকে কষ্ট না দিলেও পারতে রুশা।”
শানের কথায় রুশার মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল। শান রুশার হাতটা ছেড়ে দিয়ে স্যাড ফেস বানিয়ে বলল,
–“যাক গে, ঠিকই করেছো। আমার মা ত আর তোমার নিজের মা না। তুমি তার দেওয়া ড্রেস কেন পড়তে যাবে? তোমার যেটা ভালো লাগে তুমি সেটাই পড়।”
কথাটা বলে শান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হেঁটে ওখান থেকে চলে গেল। রুশা শানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মন খারাপ করে দাড়িয়ে রইল।
_________________________
আশুকে একে একে সবাই হলুদ লাগিয়ে দিচ্ছে। সাউন্ড স্পিকারে হলুদের সফট মিউজিক বাজছে। আশু মাথা টা নিচু করে বিষন্ন মনে বসে আছে। সবাই ওকে একেএকে হলুদ লাগিয়ে নিজেদের মতো ওর সাথে পিক তুলে স্টেজ থেকে নেমে যাচ্ছে। এসবে আশুর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ‘ও’ নিজের মনের মধ্যে চলতে থাকা ঝড় থামাতে ব্যস্ত।
গেস্টদের বসানোর জন্যে স্টেজের সামনেই হলুদের অনুষ্ঠানের থিমের সাথে মিলিয়ে সারিবদ্ধ ভাবে সোফার ব্যবস্থা করা হয়েছে। একদম প্রথম সারির টু বেডের একটা সোফার দুইপাশে শান আর আয়াশ বসে আছে। দুজনের মধ্যেই এক হাত সমান গ্যাপ। দুজনই খুব মনোযোগ দিয়ে ফোন স্ক্রল করে যাচ্ছে। ওদের আশেপাশে এত মানুষের শোরগোল থাকা শর্তেও সেদিকে দুজনের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। দুজন এমনভাবে ফোনের মধ্যে মুখ গুজে আছে, ওদের দেখে মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে ওরা ফোন স্ক্রল করতে না পারলে পৃথিবী উল্টে যাবে।
সামনে কারো উপস্থিতি টেড় পেতেই শান ফোন থেকে চোখ উঠিয়ে সামনে দাড়িয়ে থাকা রমণীর দিকে তাকাল। ইতি শানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাঁসল। বিনিময়ে শানও ইতির দিকে তাকিয়ে টেডি স্মাইল দিল। ইতি খানিকটা ইতস্তত করে বলল,
–“কেমন আছো শান?”
শান ঠোঁটের কোনে হাঁসিটুকু বজায় রেখেই বলল,
–“সবসময়ের মতো বেশ ভালো আছি।”
ইতি আমতা আমতা করে বলল,
–“আমার তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।”
শান নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,
–“হুম, বলুন।”
ইতি আয়াশের দিকে এক পলক তাকিয়ে শানের দিকে তাকাল। চাপা স্বরে বলল,
–“কথাটা একটু প্রাইভেট। যার তার সামনে বলা যাবে না।”
আয়াশের দৃষ্টি ফোনের দিকে থাকলেও ‘ও’ ইতির কথাটা স্পষ্ট শুনতে পেল। তাই কিছু না বলে চোখ-মুখ শক্ত করে উঠে দাড়াল। আয়াশকে দাড়াতে দেখে শানও দাড়িয়ে গেল। আয়াশ ওখান থেকে যাওয়ার জন্যে উদ্যত হতেই শান আয়াশের হাতের বাহু ধরে ওকে থামিয়ে দিল। আয়াশ নিজের হাতের বাহুতে ধরে থাকা শানের হাতের দিকে একবার ভ্রু কুচকে তাকিয়ে শানের দিকে তাকাল। শান শান্ত কিন্তু গম্ভীর স্বরে বলল,
–“হি ইজ মাই ব্রাদার। আপনার যা বলার আপনি ওর সামনেই আমাকে বলতে পারেন। আমার মনে হয়না, আপনার সাথে আমার এমন কোনো প্রাইভেট কথা থাকতে পারে যার জন্যে আমার ভাইকে এখান থেকে উঠে চলে যেতে হবে।”
শানের কথা শুনে আয়াশ অবাক হয়ে শানের দিকে তাকিয়ে রইল। কতটা অধিকার নিয়ে নির্দিধায় শান ওকে ‘ভাই’ বলে পরিচয় করিয়ে দিল, কথাটা ভাবতেই আয়াশের অবাকের মাত্রাটা বেড়ে গেল। আয়াশের মনের মধ্যে শানের প্রতি পুষে রাখা রাগগুলো মুহূর্তের মধ্যে যেন কর্পূরের ন্যায় উড়ে গেল। কানের মধ্যে বারবার শানের বলা কথাটা রিপিড হতে লাগল। ইতি টাস্কি খেয়ে শানের দিকে আছে। শানের বলা কথাটা ওর কোনোভাবেই হজম হচ্ছে না। ইতির অবস্থা দেখে শান মনে মনে বাঁকা হাসল। ইতি শকড হওয়া ভঙ্গিতে বলল,
–“ভাই মানে? ‘ও’ আবার তোমার ভাই হল কীভাবে?”
শান আয়াশের হাত ছেড়ে দিয়ে প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে সটান হয়ে দাড়াল। অ্যাটিটিউড নিয়ে ইতিকে উদ্দ্যেশ্য করে বলল,
–“হি ইজ মাই কাজিন ব্রাদার। আপনার ত ওনাকে চেনার কথা। আফটার অল আপনারা অনেকটা সেম ফিল্ডে কাজ করছেন। আর তাছাড়া আয়াশ দেওয়ান ত বর্তমানের ফেইমাস একটা ফেস। তাকে চেনেনা এমন মানুষ খুব কমই আছে আমাদের কান্ট্রিতে।”
ইতি কি বলবে বুঝে উঠতে পারল না। ওর মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। দুদিন আগেও যাদের শত্রুতা নিয়ে অনলাইন প্লাটফর্ম গুলোতে কন্ট্রোভার্সি হত, আজকে জানতে পারছে সম্পর্কে তারা দুজন নাকি কাজিন? এরকম মিরাক্কেলও সম্ভব? ইতির এসব ভাবনার মধ্যেই রুশা হনহন করে এসে শানের সামনে দাড়াল। শান রুশার পাঁ থেকে মাথা পযর্ন্ত একবার চোখ বুলিয়ে নিল। রুশার গায়ে হলুদ লেহেঙ্গা আর আর্টিফিশিয়্যাল গাধা ফুলের জুয়েলারি। রুশাকে এই সাঁজে দেখে শানের ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাঁসি ফুটে উঠল। শান ভালো করেই জানত রুশাকে জোর করে অথবা হুমকি দিয়ে কোনো কাজই করানো যাবে না। কজ রুশা মারাত্মক একরোখা। কাউকে ভয়ও পায় না আর পরোয়াও করে না। কেউ ওকে যদি হুমকি দিয়ে কিছু করতে বলে, ‘ও’ ঠিক তার উল্টোটাই করে। এই যেমন সকালে শান রুশাকে ওর দেওয়া লেহেঙ্গাটা পড়তে বলে হুমকি দিয়ে এসেছিল। কিন্তু রুশা শানের হুমকির কোনো তোয়াক্কা না করে নিজের ইচ্ছে মতো একটা লেহেঙ্গা পড়ে নিয়েছিল। তাই শান তখন রাহেলা রায়জাদার কথা বলে রুশাকে ইমোশনালি ব্লাকমেইল করেছে। আর রুশাও শানের কথা বিশ্বাস করে ইমোশনাল হয়ে ড্রেসটা পড়ে নিয়েছে। আসলে ওটা শানেরই পছন্দ করা ড্রেস ছিল। সকালবেলা ডিজাইনারেরা যখন বাসার সবার জন্যে হলুদের লেহেঙ্গা দেখাতে নিয়ে এসেছিল। তখন শান ওটা পছন্দ করে রুশার জন্যে রেখে দিয়েছিল।
রুশা অগ্নি দৃষ্টিতে শানের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–“আপনি আমাকে মিথ্যা বললেন কোন সাহসে? এই লেহেঙ্গা টা বড়-মা না, আপনি পছন্দ করে কিনেছেন। তাহলে তখন বড়-মার কথা কেন বললেন?”
শান বলল,
–“আমার কথা বললে ত তুমি পড়তে না। তাই বাধ্য হয়ে তোমাকে মিথ্যা বলতে হল।”
রুশা রেগে শানকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আয়াশ সাইড থেকে বলে উঠল,
–“এটাই যখন পড়বি, তখন সকালবেলা এত কষ্ট করে আমাকে দিয়ে সাদা লেহেঙ্গা টা কেনালি কেন? শুধু শুধু আমার টাকা নষ্ট হল।”
শানের জন্যে রুশার মেজাজ এমনিতেই বিগরে ছিল। আয়াশের কথা শুনে ওর রাগ তুংঙ্গে উঠে গেল। ওর ইচ্ছে করল সামনে দাড়িয়ে থাকা এই দুই মানবকে ভয়ংকর কিছু গালি শুনিয়ে দিতে। কিন্তু আশেপাশে এত লোক থাকায় ‘ও’ মনের ইচ্ছেটাকে মনেই চেপে রাখল। বিরবির করে ঠোঁট নেড়ে দুটোকে ইংলিশে কয়েকটা গালি দিয়ে জ্বলন্ত চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে রাগে ফুশতে লাগল। রুশার অবস্থা দেখে শান ওর দিকে একটু এগিয়ে এসে মুচকি হেঁসে বলল,
–“এত রাগে না সুইটহার্ট। অতিরিক্ত রেগে গেলে তোমাকে রা’ক্ষ’সীর মতো লাগে।”
শান রুশাকে সুইটহার্ট বলায় আয়াশ আর ইতি দুজনেই শকড হল। ইতি খানিকটা উত্তেজিত হয়ে শানকে উদ্দ্যেশ্য করে বলল,
–“তুমি ওকে সুইটহার্ট বললে কেন?”
ইতি প্রশ্নটা করার সাথে সাথে শান ওর দিকে বাঁকা চোখে তাকাল। এই প্রশ্নটার অপেক্ষায়ই শান ছিল। শান খানিকটা ভুলে যাওয়ার ভান করে বলল,
–“Ooops সরি মিস ইতি, আপনাকে ত ওর সাথে পরিচয়ই করানো হয়নি। মিট মাই ফিয়ন্সে ডাঃ রুশানি সিকদার। ডটার অফ ইমদাদ সিকদার।”
শানের কথায় ইতি চারশো চল্লিশ বোল্টের শকড খেল। আয়াশ টাস্কি খেয়ে ‘থ’ হয়ে দাড়িয়ে রইল। রুশা ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে শানের দিকে তাকিয়ে মনে মনে শানকে গালি দিতে লাগল। ইতি খানিকটা উচ্চ স্বরে বলল,
–“হোয়াট? আর ইউ কিডিং উইথ মি শান? এই মেয়েটা যদি তোমার ফিয়ন্সে হয়, তাহলে আমাকে তুমি এখানে কেন ডেকেছো? তোমার মাথায় উঠে ডান্স করার জন্যে?”
ইতির কথায় শানের চোখে মুখে বিদ্রুপের ছাপ ফুটে উঠল। ‘ও’ মুখ বাঁকিয়ে বলল,
–“নো, আপনাকে এখানে ডাকা হয়েছে আমার গেস্টদের সামনে ডান্স করার জন্যে। কেনো? আপনি কি ভেবেছিলেন? আমি আপনাকে এখানে ইনভাইট করেছি আমার সাথে সংসার করার জন্যে? এরকম ভাবনা আপনার মাথায় আসলোও বা কীভাবে? শান রায়জাদার টেস্ট এতটাও খারাপ না যে সে একটা শস্তা মডেলের সাথে সংসার করবে।”
শানের কথাগুলো ইতির কানের মধ্যে সুচের মতো গিয়ে বিধল। শান ইতির ব্যাপারে সবটা জানার পর ইতি এতবছরে কখনো আর শানের সামনেই আসেনি। ইতির জানা মতে শানও ওকে খুজে বের করে শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করেনি। ইতির রিয়েলিটি মিডিয়ার লোকদের হাতে আসার পরপরই ইতি পালিয়ে গিয়েছিল। তার কিছুদিন পর শুনেছিল শান ইনজুরড অবস্থায় হসপিটালে ভর্তি আছে। শানের অসুস্থতার খবর শুনে ইতি আত্মগোপন থেকে বের হয়ে নিজের কাজকর্ম শুরু করে। তারপর আর শানের সাথে ওর কখনো দেখা হয়নি। কাল যখন শান ইতিকে ফোন করেছিল, তখন ইতি ভেবেছিল শান আগের সবকিছু ভুলে নতুন করে সবটা শুরু করতে চাইছে। কিন্তু শানের মুখে এখন এসব কথা শুনে অপমানে ইতির কান গরম হয়ে গেছে। ইতি মুখ ভার করে থমথমে গলায় বলল,
–“শান তুমি কিন্তু এইবার আমাকে অপমান করছো। আমাকে এভাবে ডেকে এনে সবার সামনে অপমান করলে তার ফল কিন্তু ভালো হবে না।”
ইতির কথা শুনে শান চোয়াল শক্ত করে ওর দিকে তাকাল। এতদিনে ওর মনের মধ্যে পুষে রাখা সমস্ত রাগ, ঘৃনা সব যেন উপচে একসাথে বেড়িয়ে আসলো। ‘ও’ গলা ছেড়ে হুংকার দিয়ে বলল,
–“শাটআপ! মুখে মুখে কথা বললে জিহ্বা টেনে একদম ছিড়ে ফেলব। আমার পার্টিতে দাড়িয়ে আমাকেই হু’ম’কি দিচ্ছিস? তোর মতো ‘শ’ খানেক মডেলকে আমি চাইলে এক ঘন্টার মধ্যে কিনে আবার বিক্রি করে ফেলতে পারি। যেই সুপার মডেল হওয়ার জন্যে তুই আমাকে চিট করেছিস, সেই সুপার মডেলদের আমি চাইলে আমার আঙুলের ইশারায় নাচাতে পারি। তোর মতো একটা মডেল সারা মাসে যেই টাকা ইনকাম করে, তার দশগুন টাকা আমি প্রত্যেকমাসে দুঃস্থ অসহায় মানুষদের দান হিসেবে দিয়ে দেই। আর তুই আমার সামনে দাড়িয়ে আমাকেই হুমকি দিচ্ছিস? শান রায়জাদাকে হুমকি দেওয়ার আগে তোর ত এটা দেখা উচিৎ ছিল, তুই তার পায়ের জুতো হওয়ারও যোগ্য কিনা।”
শানের এসব কথায় অপমানে ইতির চোখের কোনে পানি চলে আসলো। রাগে ওর হাত-পাঁ কাপতে লাগল। শানের মুখ থেকে কখনো যে এরকম তেঁতো কথা শুনতে হবে সেটা ইতি কখনো ভাবেনি। রিলেশন চলাকালীন শান সবসময় ইতির সাথে মার্জিত হয়ে কথা বলত। মেয়েদের সাথে নম্র ভাবে কথা বলাটাই শানের স্বভাব ছিল। হুটহাট কারো সাথে রুড হয়ে যাওয়া, কাউকে অপমান করা, এসব গুন কখনো শানের মধ্যে দেখেনি ইতি। শান রাগি হলেও ‘ও’ কখনো কারো সামনে নিজের রাগটা প্রকাশ করত না। সব সময় মেজাজ ঠাণ্ডা রেখে সব সিচুয়েশন হ্যান্ডেল করার চেষ্টা করত। সেই শানের মুখে এত অপমান জনক কথা শুনে ইতি যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। ওর মনে হচ্ছে আগের শান আর এই শানের মধ্যে আকাশ পাতালের তফাৎ।
ইতির অবস্থা দেখে আয়াশ বাঁকা হাসল। শানের বলা কথাগুলো আর কারো পছন্দ হোক বা না হোক আয়াশের বেশ পছন্দ হয়েছে। রুশা কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। মিউজিক ইতিমধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গেস্টরা সবাই কৌতূহলী দৃষ্টিতে ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে সবাই এখন বসে বসে তামাশা দেখছে। শানের চেঁচামেচির শব্দ শুনে মিসেস রাহেলা রায়জাদা এগিয়ে এসে শানের সামনে দাড়ালেন। চাপা স্বরে শানকে উদ্দ্যেশ্য করে বললেন,
–“এখানে অনেক গেস্টরা আছে শান। খবরদার এখানে বসে কোনো সিনক্রিয়েট করবে না। ওই মেয়েকে এখান থেকে চলে যেতে বলো। আর তুমিও শান্ত হও। ওই অসভ্য মেয়েটার জন্যে তুমি তোমার মান-সম্মানে দাগ লাগতে দিও না।”
রাহেলা রায়জাদার কথা কর্নগোচর হতেই শান চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেলল। পরপর দুটো নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে একদম শান্ত করে নিল। এমন একটা ভাব করল যেন এখানে এতক্ষন কিছুই হয়নি। আগের মতো ঠোঁটের বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে ইতিকে উদ্দ্যেশ্য করে বলল,
–“মিস ইতি আমার গেস্টরা সবাই বোর হচ্ছে। প্লিজ আপনারা গিয়ে আপনাদের পারফরম্যান্স শুরু করুন। টাকা নিয়ে চিন্তা করবেন না, আপনাদের পারফরম্যান্স সবার পছন্দ হলে আপনাদের ডিমান্ড অনুযায়ী আপনাদের সবাইকে পে করা হবে।”
কথাটা বলে শান ফোশ করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে পাঁয়ের উপর পাঁ তুলে সোফায় বসে পড়ল। রাহেলা রায়জাদা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওখান থেকে চলে গেলেন। রুশাও শানের দিকে একটা বিরক্তির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দ্রুত ওই জায়গা থেকে প্রস্থান করল। আয়াশ কিছু না বলে আবারও আগের জায়গায় বসে ফোন স্ক্রল করায় মনোযোগী হল। হঠাৎ করেই ওর মনটা আজকে ফুরফুরে হয়ে গেছে। ইতির অশ্রুসিক্ত চোখ জোড়া দেখে ওর মনের মধ্যে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনগুলো মূহুর্ত্তের মধ্যে নিভে গেছে। নিজেকে কেমন রিল্যাক্স মনে হচ্ছে।
#চলবে……