আমার আকাশে মেঘ জমেছে
পর্ব:- ১
.
প্রহর ভাই তথা তিতা করল্লার সাথে আমার সাত বছর পর প্রথম দেখা হয় মুবিন স্যারের বাড়িতে। সেবার স্কুলের অর্ধ- বার্ষিক পরীক্ষায় ইংরেজি বিষয়ে ফলাফল আব্বার আশা মোতাবেক হয় নি। ফলে ধরে বেঁধে আমাকে ভর্তি করা হয় মুবিন স্যারের প্রাইভেট ব্যাচে। ইংরেজি বিষয়ে পড়ালেও মুবিন স্যারের বাংলার প্রতি টান ছিল অসম্ভব। তাই তো নিজের প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়েছিলেন ” মুবিন’স প্রাইভেট বাড়ি।” এই নাম নিয়ে ছাত্র- ছাত্রীরা হাসাহাসি করলেও স্যারের কোন ভ্রুক্ষেপ ছিল না তাতে। তিনি ছিলেন মাতৃভাষার প্রতি একাগ্র। ইংরেজি পড়ান বুঝানোর জন্যই হয়ত প্রথমে “মুবিন’স প্রাইভেট ” শব্দ দুটি ব্যবহার করেছিলেন।
.
প্রাইভেটের প্রথম দিনই স্যার আমাকে নিজের অপছন্দের পাত্রী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। শুধু যে স্যার তা নয়, স্যারের সব চেয়ে পছন্দের ছাত্র প্রহর ভাইও আমাকে নিজের অপছন্দ তালিকার শীর্ষে স্থান দেন।
.
প্রহর ভাই ছিলেন মুবিন স্যারের প্রিয় ছাত্র। শহরের ডাক্তার উনি। গ্রামে সপ্তাহে তিনদিন রোগী দেখবেন বলে মুবিন স্যারের বাড়ির পাশের ফাঁকা জায়গায় ঘর তুলছিলেন সেদিন। কিন্তু ওই যে সামনে বাঘ পিছনে সিংহ প্রবাদ আছে না? আমার অবস্থা হয়েছিল ওমন। স্যারের বাড়িতে ঢুকার সময় স্যারের মুখ দেখে ভয় পেয়ে গেছিলাম। হাসি হাসি মুখ নিয়ে তার মনে চলমান কথাগুলো আমি দিব্বি শুনতে পাচ্ছিলাম।
” আসো বাছাধন আসো। হাড় ভেঙে প্লাস্টিক বানাবো। তুই আয় একবার খালি এখানে।”
কলিজা শুকিয়ে গেছিল। উল্টো ঘুরে তাকিয়ে আব্বার লোকদের দেখে আরও ভয় পেয়েছিলাম। তবুও সাহস করে উল্টো হাঁটা ধরি। গাম্বুস সাইজের আব্বার লোক গুলো তখন চোখ বড়বড় করে তাকিয়েছিল। কিন্তু “আহ!” শব্দ শুনে আমার পা ব্রেক কষে। ইন করা শার্ট, প্যান্ট, জুতা পড়া একজন গোবরের স্তুপে পরে আছে। ” প্রহর ভাই।”
প্রহর ভাই যদিও আমাকে চিনতে পারেনি। তাতে কী? এমন সুন্দর চেহারার মানুষকে আমি ঠিক চিনতে পেরেছিলাম। বাংলা সিনেমার সাকিব খানের মতো চেহারা। পুরাই গ্রামের নায়ক ছিল। প্রহর ভাই সেদিন দু -চারটা ইংলিশ গালি শুনিয়ে বিদায় হয়েছিল। আর আব্বার লোকেরা আমাকে ধরে বেঁধে মুবিন স্যারের প্রাইভেটে বসিয়ে দিয়ে গেছিল।
.
মুবিন স্যারকে সবাই পছন্দ করতো উনি অনেক সুন্দর করে পড়াতে পারতেন বলে। উনার এক ব্যাচে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রী পড়ত। স্যারের মতে ওদের সবার চেয়ে ডাল ছাত্রী ছিলাম আমি। বুঝে গিয়েছিলাম এই স্যার এখন উঠতে বসতে আমাকে শাসাবে।
.
মুবিন স্যারের অপছন্দের পাত্র থুক্কু পাত্রী হওয়ার পিছনে অন্যতম কারণ ছিল আমার দুষ্টুমি। একদিন স্যার স্কুলে আমাদের ক্লাস নিচ্ছিলেন। ব্ল্যাকবোর্ডে টেন্সের প্রকারভেদ লিখে দিয়ে আমাদের তুলতে বলেই তিনি ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমিয়ে ছিলেন। আমি ভদ্রভাবেই মার্কার পেন দিয়ে তার দাড়ি মুচ আঁকিয়ে নিজের শৈল্পিক কাজের নিদর্শন দেই। কিন্তু স্যার আমার উপর ক্ষেপে যায়। ক্লাস রুমে ঘুমাচ্ছিলেন দেখে প্রধান শিক্ষককে নালিশ দিতে পারেননি। কিন্তু আব্বাকে ঠিকই নালিশ দেন। ফলাফল, আম্মা আমার পিঠে ডাল ঘুঁটনি দিয়ে গুণেগুণে চারটা বারি দেয়। মুবিন স্যারের মতে আমি হচ্ছি চেয়ারম্যানের বখে যাওয়া সন্তান।
প্রতিশোধ আমিও নিয়েছিলাম। স্যারের সাইকেলের চেইন খুলে দিয়েছিলাম। সেই সাথে চাকার হাওয়া বের করে দিয়েছিলাম।
.
আব্বা আম্মার একমাত্র মেয়ে হয়েও আব্বার করা এই পড়া বিষয়ে নির্যাতন মেনে নিতে পারছিলাম না। একদিন আমরণ অনশনও করেছিল। লাভের খাতায় শূন্য পেয়েছিলাম। আব্বার শখ মেয়েকে ডাক্তার বানানোর। লাখ টাকা লাগলেও ডাক্তার আমাকে হতেই হবে। কঠোর মুবিন স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়াতেও আব্বা তাই দ্বিধাবোধ করেননি। আব্বার ইচ্ছা ছিল সৎ। গ্রামে এতো মানুষ, হাসপাতাল সেই সদরে। অসুস্থ রোগীকে দ্রুত চিকিৎসা দেওয়ার কোন উপায় নেই। আব্বার অনুরোধেই প্রহর ভাই গ্রামে রোগী দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু একজন পার্মানেন্ট ডাক্তার তো লাগবে তাইনা? সেই পার্মানেন্ট ডাক্তার হবো আমি। সন্ধ্যা সাতটায় শুয়েই আমি স্বপ্ন দেখতাম বড় ডাক্তার হয়ে গেছি। নার্স, রোগীর আত্মীয় স্বজন আমাকে ঘিরে রেখেছে। মাঝে মাঝে আবার স্বপ্নে দেখতাম আমি বিরাট কিছু আবিষ্কার করে ফেলেছি। সবাই আমার অটোগ্রাফ নিচ্ছে, ক্যামেরা ম্যানেরা পোস দিতে বলছে বিভিন্ন এঙ্গেলে; টিভিতে টকশো গুলোতে আমার উপস্থিতি সবার কথা কেড়ে নিচ্ছে। প্রহর ভাইয়ের সাথে হাইফাই ভাবে বিয়ে হচ্ছে। বিয়ের পরে হানিমুনে গিয়ে আমরাও রিয়াদ-শাবনুরের মতো কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে নাচছি। এই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য আমি কাজে লেগে গেলাম। উঁহু, পড়াশোনা করে নয়। অন্যভাবে। এই যেমন মুসুরের ডাল বেটে মুখে লাগাতাম, চালের গুড়া দিয়ে হাত- মুখ ডলতাম। আবার গার্মেন্টসে চাকরিকৃত সুলেমন কাকাকে দিয়ে শহর থেকে ফেসপ্যাক, শীটমাস্ক কিনিয়ে আনতাম। গ্রামে থাকলেও আধুনিকতা আমার অঙ্গে ভালো মতো মিশে গেছিল। আম্মা ভাবছিল আমি পাগল হয়ে গেছি। একদিন আম্মা শুকনা মুখ নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
-” হ্যাঁ রে, পাগল হলি নাকি? কী লাগাস এগুলা মুখে?”
আমি বিরক্তির সাথে উত্তর দিয়েছিলাম,
-” ধুর আম্মা জ্বালিয় না তো। আমাকে ডাক্তার হতে হবে। ডাক্তার হলে সব ম্যাগাজিন, পত্রিকা, টিভি চ্যানেল থেকে আমার সাক্ষাতকার নিতে আসবে। এখন থেকেই চেহারা টিপটপ রাখতে হবে।”
আম্মা একরাশ বিস্ময় নিয়ে আমাকে বলেছিল,
-” তোরে তো পড়তেই দেখি না। না পড়ে রূপ চর্চা করলে ডাক্তার হওয়া যায়? ”
আমি অসহ্য বলে উঠে এসেছিলাম। পিছন থেকে আম্মার বলা একটি কথা কানে এসে বেজেছিল।
-” আজ বুঝবি না বুঝবি কাল,
ভাত খাবি আর পাড়বি গাল।
পড় পড়। বাপ-মায়ে না থাকলে কষ্ট কেমন বুঝবি।”
.
মুবিন স্যারের কাছে দশ দিন পড়েই আমার অবস্থা “ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি” ধরণের। টেন্স, ডিগ্রি স্যার বুঝাতেন ঠিকই কিন্তু আমার মাথা অবধি সেই বুঝানো কিছুতেই ঢুকত না। বৃহস্পতিবার, শুক্রবার, শনিবার- এই তিনদিন ছিল আমার জন্য চাঁদমুখ দর্শনের দিন। আব্বা দ্বিগুণ টাকা দিয়ে সপ্তাহে সাতদিন মুবিন স্যারকে দিয়ে আমাকে পড়িয়ে নিত। স্যার পড়াত আর আমি জানলা দিয়ে উঁকি মেরে ডাক্তার প্রহরের রুগী দেখা দেখতাম। নাকের ডগায় চশমা নিয়ে উনি যখন রুগীর প্রেশার মাপতেন তখন আমার মনে প্রেশার কুকারের সিটি শুনতে পেতাম। আহা! কী সুন্দর করে রুগী দেখেন।
আমি ততদিনে বাংলা প্রায় সব কটি ছায়াছবির নাম মুখস্থ করে ফেলেছি। বাবা কেন চাকর, এক টাকার বউ, তুমি আমি পরাণ, মায়ের আঁচল, আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসা সহ আরও অনেক ছায়াছবির কাহিনী আমার নখদর্পণে। কল্পনায় আমি নায়িকা আর প্রহর ভাই নায়ক।
দুজনে পালিয়ে যাচ্ছি, গুণ্ডাদের সাথে প্রহর ভাই মারামারি করছে, হাত পা টেরাবাঁকা করে নাচছি আর কত কী যে ভাবতাম। ফলাফল মুবিন স্যারের কাঠের স্কেলের বারি।
আমার রাজকুমার আবার আমার প্রতি ভীষণ উদাসীন ছিল। মুবিন স্যার তার মাথায় আমাকে গবেট হিসেবে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। প্রায় উনি মুবিন স্যারের ওখানে আসতেন। শুক্রবার দুপুরে মুবিন স্যারের বাসায় খেতেন। আমাদের পড়া ছিল বিকাল চারটা থেকে সন্ধ্যা ছ’টা পর্যন্ত। মাঝে মাঝেই প্রহর ভাইয়ার সাথে দেখা হয়ে যেত। এই একটা দিন আমি কাজল পড়ে, কপালে টিপ দিয়ে, স্নো পাউডার মেখে প্রাইভেটে যেতাম। কিন্তু মুবিন স্যার আমার এই জবরং সাজের তেরোটা বাজিয়ে প্রহর ভাইকে বলতেন,
-” বুঝলে প্রহর, এই হলো চেয়ারম্যানের মেয়ে। মাথায় কিছুই নেই। পড়া ধরলে পারেনা। আরে আমি বুঝি না, এতো পড়াই তাও ইংলিশে দশের উপরে নাম্বার তুলতে পারেনা। তুমিও চেয়ারম্যানের ছেলে ছিলা। কিন্তু কী ব্রিলিয়ান্ট; আমাকে দুটা কটূ কথা কখনো তোমাকে বলতে হয়নি। আর এই মেয়ে! ছি ছি…”
এই সব কথা শুনে আমি মনে মনে প্রার্থণা করতাম, আল্লাহ জমি ফাঁক করে দাও। আমি ধরণীর নিচে আশ্রয় খুঁজে নিব।
ইহা সত্য যে প্রহর ভাইয়ের বাবা আব্বার আগে চেয়ারম্যান ছিল। উনার মৃত্যুর পর আব্বা চেয়ারম্যান হয়েছেন। তাই বলে চেয়ারম্যানের পোলাপানদের অতি বুদ্ধি নিয়ে জন্মাইতে হয় এটা কে বলল?
.
.
চলবে….
[ সবার গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি।]