আমার আকাশে মেঘ জমেছে পর্ব ২

আমার আকাশে মেঘ জমেছে
পর্ব:- ২
.
মাধ্যমিক পরীক্ষার দিন নিকটে আসতে লাগল। সেই সাথে আব্বার প্রেশার বাড়তে লাগল। কিন্তু যার চিন্তায় আব্বার প্রেশার বাড়ছে সেই আমি প্রহর ভাইয়ে মশগুল। ওই যে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলে গেছেন- “পৃথিবীতে নারীর প্রথম প্রেমের মত সর্বগ্রাসী প্রেম আর কিছুই নেই। প্রথম যৌবনে নারী যাকে ভালোবাসে, তার মতো সৌভাগ্যবানও আর কেউই নেই। যদিও সেই প্রেম অধিকাংশ সময় অপ্রকাশিত থেকে যায় কিন্তু সেই প্রেমের আগুন সব নারীকে সারাজীবন পোড়ায়।”
আমার প্রেম তো আমি অপ্রকাশিত রাখবো না। কিছু একটা করতেই হবে।
.
মুবিন স্যারের প্রাইভেট থেকে আমি বাসায় ফিরতাম বান্ধবীদের সাথে। বলে রাখা ভালো বান্ধবী মহলে আমার একটা বিশেষ পরিচিতি হয়ে গিয়েছিল। ওরা আমাকে “প্রহরের ডাক্তারনী” বলে ডাকত। আমিও হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে থাকতাম। এই তো আমি ডাক্তার হয়েছি। হাজার মানুষ দেখে কী হবে? আমি প্রহর ভাইয়ের মন ঠিক করবো।
প্রায় রাতেই বান্ধবীদের সাথে নিয়ে প্রহর ভাইয়ের ডাক্তারখানার পাশ দিয়ে যেতাম আর গলা ফাটিয়ে গান গেতাম,
“তোমাকে চাই আমি আরও কাছে
তোমাকে বলার আরও কথা আছে।”
বা,
“তুমি মোর জীবনের ভাবনা
হৃদয়ে সুখের দোলা।”
কিংবা
“এই মন তোমাকে দিলাম
এই প্রেম তোমাকে দিলাম।”
গান গেতে গেতে গেলেও আমরা দৌড়ে আবার ফিরে আসতাম। প্রহর ভাইয়ের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতাম তার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য। ততদিনে প্রহর ভাই অবশ্য বুঝে গেছেন গান তার জন্য গাওয়া হয়। কিন্তু ধরতে পারেছিলেন না কে গাইছে। কারণ আমি একা গান গাইতাম না; সবাই গাইত। তবে এক একজন একেক গান গাইতাম।
আমার গান শুনে কখনো কখনো টেবিল থেকে ভাইয়ার স্টেথোস্কোপটা মাটিতে পড়ে যেত তো কখনো ঢগ ঢগ করে কয়েক গ্লাস পানি খেতেন। আর আমরা তখন মুখে হাত দিয়ে হাসতাম।
.
প্রহর ভাইয়ের প্রেমে যখন আমি পাগল, বান্ধবীরা তখন আমাকে দারুণ একটা বুদ্ধি দিল। আগে হবু শাশুড়িকে পটাতে হবে। চোখে কাজল দিয়ে, মুখে ফেস পাউডার মেখে আমি চলতাম প্রহর ভাইদের বাড়ি। যে আমি বাসায় জগ থেকে পানি ঢেলে খাইনি সেই আমি প্রহর ভাইদের ওখানে আলু পটল ছিলেছি। ভাবা যায়?
.
প্রহর ভাইয়েরা তিন ভাই, চার বোন। তিন বোন আর এক ভাইয়ের ইতোমধ্যে বিয়ে হয়ে গেছে। ওরা অবশ্য এখানে থাকে না। ছোট ভাই আর বোনটা আমার থেকেও ছোট। আমি অবশ্য প্রহর ভাই থাকলে কখনো ওই বাড়ির দিকে পা বাড়াতাম না। চাচি একদিন কথার ফাঁকে জিজ্ঞেস করেই বসলেন,
-” কী রে অতিথি? প্রহর আসলে তুই আসিস না কেন?”
-” আরে চাচি বুঝ না? তোমার ছেলে শহরের ডাক্তার। ডাক্তার কাছে যায় মানুষ রোগ সারাতে। আমি কী রুগী নাকি?”
চাচি আমার কথায় হাসলেও আমি সেদিন মনে মনে চাচির প্রশ্নের এক আলাদা উত্তর দিয়েছিলাম। ” আমার মন চুরি করেছে তোমার ছেলে। তার সামনে যেতে বুঝি আমার লজ্জা করে না? তোমার ছেলে কে প্রশ্ন করো তো মন চুরি করে কোন লকারে রেখেছে সে?”
.
মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে বিদায় অনুষ্ঠানে প্রহর ভাইকে বিশেষ অতিথি হিসেবে ডাকা হলো স্কুলে। প্রতিবছর উনার বাবা আসতেন। তবে একবছর হলো চাচা মারা গেছেন। এবার তাই প্রহর ভাই গ্রামের কীর্তি সন্তান হিসেবে অংশ নিবেন বিদায় অনুষ্ঠানে। এই নিয়ে আনন্দের বদলে আমার চিন্তা শুরু হলো। প্রহর ভাইকে ইমপ্রেস করার জন্য কী করা যায়? আমি গান গাইতে পারি না, না পারি কবিতা আবৃত্তি করতে।
ঠিক করলাম নাচ দিব। বাংলা সিনেমার ” আকাশে তে লক্ষ তারা চাঁদ কিন্তু একটা রে, ইয়াহ” গানটা ঠিক করলাম।

সিনেমা দেখে দেখে নাচ তুলতে লাগলাম। কিন্তু আম্মা এসে “কোন নাচ টাচ হবে না” বলে দিলেন। আম্মা নাচানাচি পছন্দ করেন না। একে বারে সাদামাটা জীবনে বিশ্বাসী। তাই আমাকে কখনো আম্মার পরিবর্তে আম্মু, আম্মি, মা, মম ডাকতে দেয়নি। সিনেমায় তো নায়িকারা এমন করেই তাদের মা কে ডাকে। আমি আধুনিক হতে চাইলেও আম্মার কারণে আধুনিক হতে পারছিলাম না। নাচতে তো দেন নি, এমনকি সবাই শাড়ি পড়বে জেনেও আমাকে শাড়ি পড়তে দেন নি।
সেবার নাচ না তুলে, শাড়ি না পড়ে মন খারাপ করে স্কুলে গেলাম। প্রহর ভাইয়ের বক্তৃতা শুনলাম এবং সবশেষে এডমিট কার্ড, রেজিস্ট্রেশন কার্ড নিয়ে বাসায় ফিরলাম।
আম্মার উপর আমি রেগে ছিলাম। ভীষণ রাগ যাকে বলে।
.
নিয়ম মাফিক আমাদের মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়। আমি ইংলিশ ব্যতীত বাকী সব বিষয়েই ভালো। না মানে সত্তর আপ হতো। কিন্তু ইংলিশের কারণে সমস্যা হত।
কলেজ ভর্তির আগে তিনমাস ছুটি। ভাবলাম এই তিনমাসে মুবিন স্যারের প্রাইভেট নেই। ওহ বলা হয়নি, টেস্টে আশাজনক ফলাফল পেয়ে আব্বা ঘোষণা দেন আমি উচ্চ মাধ্যমিকেও মুবিন স্যারের কাছে পড়বো। সেই সাথে আরও চারজন কলেজের স্যারের কাছে বিজ্ঞান বিষয়ক সাবজেক্ট গুলো পড়বো।
যদিও আমি ভেবেছিলাম মুবিন স্যারের প্রাইভেট নেই। কিন্তু আমাকে অবাক কিরে দিয়ে আব্বা মাধ্যমিকের ব্যবহারিক শেষের তিনদিন পর মুবিন স্যারকে ডেকে পাঠালেন। ভালো মন্দ খাওয়ালেন, সেই সাথে বিশেষ ভাবে অনুরোধ করলেন, আমি যেন লেটার মার্কস যে ভাবেই হোক আনতে পারি।
ফলে সাতদিনের মধ্যে আবার পড়ালেখার অঞ্চলে ঢুকতে হলো। ছুটির অবকাশ আর পেলাম কই। তবে ওতটাও খারাপ লাগছিল না। প্রহর ভাইকে অনেক দিন পর দেখতে পাবো বলে কথা।
.
দেখতে দেখতে আমার কলেজ ভর্তির সময় চলে আসে। হঠাৎ একদিন শুনি মুবিন স্যার আর নেই। কষ্ট লাগছিল তবে ওত বেশি না। স্যারের হাতের বারির কথা মনে পড়লে আর কষ্ট পানি হয়ে যেত।
টানা দশ দিন আমার ইংলিশ পড়া হলো না। আব্বার চিন্তায় ঘুম আসছিল না। কারণ বাকী সব বিষয়ে সত্তরের উপর নাম্বার থাকলেও ইংরেজিতে আমি টেনেটুনে পাশ করা স্টুডেন্ট। দুই গণিত মিলিয়ে টেস্টে আমার নম্বর ছিল একশো আটান্ন। ইংরেজিতে পাশ নাম্বার পেয়েছি তাও মুবিন স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ার জন্য।
আমি বুঝতাম না এই ইংরেজি কেন পড়তে হয়? আরে দুইশত বছর ইংরেজ আমাদের গোলাম বানিয়ে রেখেছিল। আমাদের সম্পদ লুটে নিয়ে গেছে। আর আমরা সেই ইংরেজদের ভাষা শিখে বেড়াচ্ছি।
ঠিক করলাম ইংরেজি আর পড়বো না। কিছুতেই না।
এবার একে বারে কড়া সিদ্ধান্ত নিলাম।
কিন্তু আমার সব পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়ে আব্বা নতুন শিক্ষক ঠিক করলেন। সেই শিক্ষক আমাকে একসাথে জীববিজ্ঞান, রসায়ন ও ইংরেজি পড়াবে। সপ্তাহে তিনদিন মোট তিনঘণ্টা করে। এরপরও আব্বা আগের কলেজের স্যারদের ছাড়লেন না।

আব্বা জানালেন, নতুন শিক্ষক “প্রহর ভাই”…আব্বার অনুরোধে প্রহর ভাই আমাকে পড়াবেন!
.
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here