আমার আকাশে মেঘ জমেছে
পর্ব:- ৩
.
আব্বার চিন্তাভাবনা ছিল অনেকটা এমন, ” ডাক্তারের কাছে পড়লে ভবিষ্যতে ডাক্তার হওয়ার চান্স দ্বিগুণ।”
আর আমার চিন্তাভাবনা ছিল আব্বার ঠিক উল্টো।
প্রহর ভাইয়ের কাছে পড়াশোনা করলে উনাকে পটানো সবচেয়ে সোজা হবে এমন।
.
আব্বা জানায়, যে তিনদিন প্রহর ভাই রুগী দেখবেন আমিও সে তিনদিন পড়বো। উনার ওই ডাক্তারখানায় আমাকে পড়াবেন। সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত নয়টা। আমি পড়লাম মহা চিন্তায়। ব্যাটা রুগী দেখলে আমি প্রেমালাপ করবো কখন?
.
অবশেষে বহু প্রত্যাশিত সেই দিনের আগমন ঘটে।
প্রহর ভাইয়ের কাছে পড়তে যাওয়ার আগে মুখে ভালো মতো ফেস পাউডার ঘোষলাম। কালো দেখালে ফার্স্ট ইমপ্রেশন লাস্ট ইমপ্রেশন হয়ে যাবে।
আব্বা নিজের একজন লোক পাঠালেন আমাকে নজরে রাখার জন্য। এতে আমি ঠিক মতো পড়ছি কিনা জানা যাবে। আবার শিয়ানা মাইয়্যা জোয়ান পোলার লগে একলাও রইলো না। গ্রামের মানুষ তো এক কথা দুই কথা বলতে বলতে যে কারও সম্মান নিয়ে টানাটানি শুরু করে। আব্বার কাছে সম্মান অনেক প্রিয় ছিল। আর আব্বার সম্মান ছিলাম আমি, বাড়ির একমাত্র মেয়ে। আমার গায়ে কাদা ছিটলে তা আব্বার গায়েও লাগবে।
প্রহর ভাইয়ের ডাক্তারখানা ছিল অনেকটা দোকানের মতো। মাঝখানে সাদা পর্দা টাঙিয়ে দুটি অংশ করা হয়েছে। লাল রঙের অর্ধ চাঁদওয়ালা পর্দার বাইরে রুগী অপেক্ষা করে নিজের সিরিয়ালের জন্য। আর পর্দার ভিতরে প্রহর ভাই একে একে রুগী দেখেন। সিরিয়াল লিখার জন্য একজন লোকও ছিল।
.
পড়া শুরুর আগে প্রহর ভাই আমাকে আমার নাম জিজ্ঞেস করেছিল। আমি তখন চোখে সর্ষে ফুল দেখছিলাম। বলে কী? যার জন্য আমি পাগল হতে বসলাম সে আমার নামই জানে না? মুখ ফুলিয়ে উত্তর দিয়েছিলাম,
-” অতিথি।”
-” কেউ নাম জিজ্ঞেস করলে সম্পূর্ণ নাম বলতে হয় জানো না?”
কথা বলার ধরণ দেখে আমার কান্না পাচ্ছিল। রাগী রাগী গলায় আমার সাথে কথা বলছিল। কোণা চোখে আব্বার পাঠানো লোকটাকে দেখছিলাম। মুচকি মুচকি হাসছিল ব্যাটা। ভাবটা ছিল এমন
” এইবার এই বিচ্ছু বুঝবে কত ধানে কত চাল। একেবারে ঠিক লোককে টিচার বানানো হয়েছে।”
বুঝতে পারছিলাম প্রহর ভাই আমায় বেইজ্জত করছে।
-” সিদ্রাতুল জান্নাত অতিথি।”
-” কী বললা? শুনতে পাইনি।”
আমি চিল্লিয়ে উত্তর দিয়েছিলাম,
-” সিদ্রাতুল জান্নাত অতিথি।”
আমার চিল্লানী শুনে আব্বার পাঠানো লোকটা হয়ত ভয় পেয়ে গেছিল। তাই ধীরে সুস্থে কেটে পরে ওখান থেকে। উনার দিকে তাকিয়েই চিল্লিয়ে ছিলাম। রাগটা আমার প্রহর ভাইয়ের থেকে বেশি ওই লোকটার উপর ছিল। হাসবে কেন উনি?
প্রহর ভাই আব্বার পাঠানো লোকটার উঠে যাওয়া দেখে আমার খাতা টেনে নেয়। কিছু একটা লিখছিলেন। আমি হা করে তাকে দেখছিলাম। মাথায় বিচিত্র চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল।
যেমন -প্রহর ভাই কী সুন্দর করে কথা বলে। কী সুন্দর দেখতে। মাথা ভর্তি ঝাঁকরা চুল, ফর্সা মুখ, চোখে চশমা, ক্লীন সেভ দাড়ি। আচ্ছা এতো এতো বই পড়েও মাথা ভর্তি চুল কীভাবে রইলো? উনাকে মোটেও সাকিব খানের মতো দেখতে না। উনাকে দেখতে উনার মতোই সুন্দর। ইশ প্রহর ভাই নায়ক হলো না কেন? এমন আরও শত শত চিন্তা।
প্রহর ভাই খাতাকে রোল করে আমার মাথায় বারি মেরেছিল। অনেক লেগেছিল। প্লাস্টিকের ক্লিপের উপর বারি মেরেছিল যে। এই রকম একটা বারি খেয়ে আমি অবাক হয়ে গেছিলাম। আমি সারাদিনে যা না পড়ি প্রহর ভাই তিন ঘণ্টায় আমাকে তা পড়িয়ে ছিলেন। একরাশ ক্লান্তি নিয়ে আমি উনার টেবিল ছেড়ে উঠে ব্যাগে বই খাতা ঢুকাই। উনি তখন চেয়ারে হেলান দিয়ে কী একটা যেন বই পড়ছিলেন। বাইরে কোন রুগী নেই। সে আমাকে পড়াতে পড়াতে আটজন রুগী দেখেছেন। পর্দা সরিয়ে বের হতে যাব যখন তখন শুনতে পাই,
-” গান গাওয়া খারাপ না। তবে ভেড়া গলায় গান খাওয়া অন্যায়। এতে গানকে অপমান করা হয়।”
আমি চোখ বড় বড় করে সেদিন পিছনে ঘুরে প্রহর ভাইয়ের দিকে তাকাই।
প্রহর ভাই বই থেকে চোখ সরিয়ে চশমা খুলে টেবিলের উপর রাখে। তারপর দুই হাত ভাজ করে বুকের উপর রেখে আমাকে চোখ দিয়ে ইশারা করে পাশের দেয়ালে তাকানোর জন্য। একটা বিশ ইঞ্চির আয়না লাগানো সেখানে। আয়নায় প্রতিফলিত হচ্ছে ঘরের জানলা। এমা ধরা পড়ে গেলাম? আমার হেচকি উঠে যায়। কোন রকমে চোখ নামিয়ে চোরা চোখে প্রহর ভাইয়ের দিকে আবার তাকাই।
এক গ্লাস পানি আমার সামনে এগিয়ে দেয় সে। পানির গ্লাস টেবিল থেকে তুলতে যাওয়ার আগেই নিজে সেই গ্লাস তুলে ঢগ ঢগ করে পানি খেয়ে নেয়। আমার হেচকি আরও বেড়ে যায়। গ্লাস রেখে আবার চেয়ারে হেলান দেয়। রাগে দুঃখে আমি সেখান থেকে যেই বের হতে যাব কানে এসে লাগে,
” তোমাকে চাই আমি আরও কাছে
তোমাকে বলার আরও কথা আছে।”
আমার কাকের গলায় গাওয়া সেই দিনের গানটা প্রহর ভাই গাইছে। তবে কাকের গলায় না, সুরেলা গলায়। চোখে মুখে দুষ্টামি ভাব ফুটে রয়েছে। আশ্চর্যের ব্যাপার সেই গান শুনে আমার হেচকি গায়েব হয়ে যায়।
-” এর পরেরবার কোন গান আর গেও না বোন।”
বোন? আমি উনার বোন। অপমানে চোখে জল চলে এসেছিল। কাঁদতে কাঁদতে সে রাতে আমি অসংখ্য চোখের জল জলাঞ্জলি দেই।
শেষ রাতে ছক করি বোন থেকে কীভাবে প্রেমিকা হওয়ার।
.
পরেরদিন ছিল শুক্রবার। পড়তে যাওয়ার আগে আমি মুখে কিছুই মাখিনি। খুব সিধাসাধা ভাবে গেছিলাম। আব্বার ঠিক করা লোকটা ওই দিন আর ভিতরে বসেনি ভয়ে। পর্দার বাইরে বসেই সে পাহারা দিয়েছে। আগের দিনের আমি আর পরের দিনের আমির মাঝে ছিল বিস্তর তফাৎ।
প্রহর ভাই আমাকে সাইটোপ্লাজমের রাসায়নিক প্রকৃতি ও বিপাকীয় ভূমিকা লিখতে দিয়ে রুগী দেখছিলেন। কিন্তু খাতা কলমকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আমি সারাটাক্ষণ তাকে দেখছিলাম। উনি যে বেশ অস্বস্তির মধ্যে ছিলো তা আমি ভালোই বুঝতে পেরেছিলাম। এটা উনার শাস্তি ছিল।
-” এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”
এমা রুগী কখন চলে গেল? এবার?
-” রোগী চলে গেছে।”
আমি চোখ বড় বড় করে উনার দিকে বোকার মতো তাকিয়ে ছিলাম।
-” দেখি কী লিখেছ?”
-” কিছুই লিখিনি।”
-” কেন?”
-” চিন্তা করছিলাম।”
-” কী চিন্তা করছিলা?”
-” মন বসে না পড়ার টেবিলে,
শয়তানে খালি নাড়াছাড়া করে।”
-” মানে?”
-” ছায়াছবি। শাবনুর রিয়াজ অভিনিত বাংলা ছায়াছবি।
প্রহর ভাই আমার জবাব শুনে হা করে তাকিয়ে ছিলেন। আমি ভীষণ লজ্জা পাচ্ছিলাম। সত্যি বলছি ভীষণ লজ্জা পাচ্ছিলাম। আমি জানতাম আমি দেখতে সুন্দর। কিন্তু তাই বলে এভাবে তাকিয়ে থাকতে হবে?
.
চলবে…