আমার আকাশে মেঘ জমেছে
পর্ব:- ৯
.
-” আসবো ম্যাডাম?”
আনোয়ার হোসেনের কথায় ডা. সাবরিনা আক্তারের ধ্যান ভাঙে। ডা. সাবরিনা অতিথির দিকে একবার তাকিয়ে আনোয়ারের দিকে তাকান।
-” ম্যাডাম একজন আপনার সাথে দেখা করতে এসেছে।”
-” অতিথি আই এম এক্সট্রিমলি সরি। আসলে..”
-” ইট’স ওকে ম্যাডাম। এমনিতেও আমাকে উঠতে হবে। পিহুর ছুটির সময় হয়ে গেছে।”
-” ওহ, আমি কিন্তু পরবর্তী গল্প শুনবো। আমি তোমার গল্পে মোহিত হয়ে পড়েছি। আজ রাতে ঘুম আসবে না কিছুতেই তোমার গল্প না শুনলে। বিকালে আছো তো?”
অতিথি হালকা হেসে বলল,
-” আমি তো সারাদিন হাসপাতালেই পড়ে থাকি। কিন্তু আপনার ডিউটি টাইম..”
-” আমি ম্যানেজ করে নিব। তাহলে বিকাল ৫ টায় দেখা হচ্ছে ডা. আতিকা ফেরদৌস অতিথি।”
-” ঠিক আছে। আসি ম্যাডাম।”
অতিথি সালাম জানিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসলো। ও নিজেও নিজের গল্পে বুদ হয়ে পড়েছিল। কী সুন্দর দিন ছিল সে সময়গুলো! প্রহর কে নিজের করে পেয়েছিল ও।
কিছুক্ষণ ব্রিথ ইন, ব্রিথ আউট করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করলো। সময় একদমই নেই। পিহুর ছুটি ৩ টায়।
সেখানে এখন বাজে ২ টা ৪৫। সেই ভোর সাতটা থেকে নিজের গল্প বলা শুরু করেছিল ও। ডা. সাবরিনা আক্তারের সাথে থাকতে খারাপ লাগছিল না। মনের কথাগুলো এভাবে আলাপন করতে পেরে ভালোই লাগছে অতিথির।
.
ডা. সাবরিনা আক্তার একটু আগে তার চেম্বার থেকে বের হওয়া রূপবতী মেয়েটিকে নিয়ে ভাবছেন। মেয়েটিকে মহিলা বলা চলে না কোন দিক দিয়েই।
বয়সে উনার চেয়ে অতিথি প্রায় বিশ বছরের ছোট। অথচ এই অল্প বয়সেও মেয়েটিকে কত কিছু সহ্য করতে হয়েছে।
ডা. সাবরিনা আক্তার সম্পর্কে অতিথির অধ্যাপক ছিলেন। এই তুখোড় মেধাবী মেয়েটির পরিশ্রম দেখে তিনি প্রতিনিয়ত মুগ্ধ হতেন। ডা. প্রহরকে তিনি ব্যক্তিগত ভাবে চিনতেন না, অতিথির মাধ্যমে চিনে ছিলেন। পরবর্তীতে এই হাসপাতালেই শল্য চিকিৎসক হিসেবে প্রহর জয়েন করে। তখন কলিগ সম্পর্ক হওয়ায় ভালো সক্ষতা গড়ে উঠেছিল ওদের মাঝে। আপা বলে ডাকত প্রহর।
.
ডা. সাবরিনা বিদেশ থেকে মনোরোগ বিদ্যায় উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে এসেছেন। সরকারি হাসপাতালসহ বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে তিনি নিয়মিত রোগী দেখেন।
‘‘গর্ভকালীন ও প্রসব পরবর্তী মানসিক স্বাস্থ্য” নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন বিভিন্ন সংস্থার সাথে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, সহকারী অধ্যাপক,
মনোরোগবিদ্যা বিভাগ।
আজ কোথাও রোগী দেখেননি তিনি। লিভ নিয়েছিলেন। নিজের সকল পেশেন্ট পারদর্শী সহকর্মী ডা. তারানা সিদ্দিকীন কে হস্তান্তর করেছে। এক আত্মীয় অনেকবার করে রিকুয়েস্ট করেছিল দেখা করার জন্য। তাই তাকে সময় দেওয়া।
অতিথির গল্প শোনার জন্য ডা. সাবরিনা খুব ইন্টারেস্টেড। আগে ইচ্ছা থাকলেও শোনা হয়নি।
-” ম্যাডাম আপনি নাকি ডেকেছিলেন উনাদের। পাঠাব?”
-” হুম আসতে দাও আনোয়ার।”
.
অতিথি তাড়াহুড়া করে সিএনজি থেকে নামল। গাড়ি নিয়ে আসলে হয়ত আরেকটু আগে পৌঁছানো যেত। কিন্তু সেই সুযোগ আর আছে? ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই ওর। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে লাইসেন্স নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। সেই অপেক্ষার কোন শেষ নেই। দালাল এখন সব জায়গায় নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করেছে। আবার ওদের ড্রাইভার হাসপাতালে ভর্তি।
-” আমি কী খুব দেরি করে ফেললাম? ”
পিহু একবার মায়ের দিক তাকিয়ে নিজের বা’ হাতের গোলাপি রঙের সিনড্রেলা ঘড়িটার দিকে তাকাল। ওর মা পুরো পনেরো মিনিট দেরি করেছে।
স্কুলের ভিতরে অফিস রুমে বসে ছিল পিহু। অতিথির দিকে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল।
-” মা অনেক সরি সোনা। মা হাসপাতালে ছিল।”
ছোট্ট পিহু এবার ছয়ে পা দিবে। তবে বুদ্ধি সম্পূর্ণ বাবার মতো। মায়ের মতো হুটহাট সিদ্ধান্ত সে নেয়না। ভেবে চিন্তে এগোয়।
-” ইট’স ওকে মা।”
-” সোনা বাচ্চা আমার। ব্যাগটা দাও।”
অতিথি পিহুর থেকে ব্যাগ নিল। এই ছোট বাচ্চাদের ব্যাগের ওজন কত ভারী।
-” মা জান আজ আমি গোলাপি হ্রদ দেখেছি।”
-” তাই? কোথায় দেখলা?”
-” তুমি আসছিলা না। অফিস রুমে বসেছিলাম। এখানে টিভিতে দেখাচ্ছিল। অস্টেলিয়ার গোলাপি হ্রদ।”
-” অস্ট্রেলিয়া হবে মা। ঠিক উচ্চারণ করো।”
-” অ স্ট্র লি য়া। ”
-” এইতো হয়েছে এবার। আর কী কী দেখলা?”
-” ওখানে অনেক গুলো হ্রদ দেখাচ্ছিল। অস্ট্রেলিয়ার ওই হ্রদটার নাম হিলিয়ার লেক। গোলাপি পানি ওই হ্রদের। আচ্ছা মা গোলাপি পানি হয়?”
-” না সোনা হয়না। লেক হিলিয়ারের রয়েছে ১০ ধরনের ব্যাকটেরিয়া ও বিভিন্ন প্রজাতির অ্যালগি যার অনেকগুলো আবার গোলাপী। স্যালিনিব্যাকটের রাবার নামক ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতিই হ্রদের পানিকে করেছে পিংক।”
-” তুমি জানো? মা আমি যাব ওখানে। কোথায় ওটা।”
-” ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার মিডল আইল্যান্ডে। তুমি যাবে তো। বড় হলে যাবে।”
-” আর কত বড়?”
-” আরও অনেক বড়। আমার মতো। আর কী কী দেখছ?”
-” ওহ একটা ঝরনা দেখেছি। ওরা বলছিল এই ঝরনা নাকি বউয়ের মতো দেখতে। কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছিল ঝরনা শাড়ি না পরে ফ্রক পরা ছিল।”
অতিথি হাসল মেয়ের কথা। এইটুকু একটা একরত্তি মেয়ে। অথচ জানার কী অদম্য ইচ্ছা তার!
-” হুম এই ঝরনা পেরুতে রয়েছে। ব্রাইডাল ওয়াটাফল বলে ডাকে স্থানীয় মানুষেরা। খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের বিয়েতে মেয়েরা শাড়ি পরে না। ওরা ফ্রক ( গাউন ) পরে। আর ওই দেশে খ্রিষ্ট ধর্মীয় মানুষ বেশি। তাই…”
-” ওহ আচ্ছা। মা আমি ওসব জায়গায় যেতে চাই।”
-” নিজের পায়ে যেদিন দাঁড়াতে পারবে সেদিন যাবে।”
-” আমি তো নিজের পায়েই দাঁড়িয়ে আছি। এই দেখো। ”
অতিথি হাসছে মেয়ের কথায়। এই ভাবে পায়ে দাঁড়ানোর কথা তো ও বলেনি।
.
-” আসমা তুই বাসায় যে! হাসপাতালে মনি মা একা? একা ফেলে এসেছিস মানুষটাকে?”
-” আমি কী করতাম ভাবি? খালাম্মা জোর করে আমাকে পাঠায়ে দিলেন। আপনেগো খাবার রাঁধতে হইবো। আপনে একা কেমনে সব সামলাবেন? তাই।
আমি সব রান্ধন রাইধা রাখসি। খাবার বাড়ুম?”
-” না তুই বাটিতে বেড়ে দে। মনি মা’ র সাথে খাবো। ”
-” ভাবি বাবুকি আমার লগে থাকবে?”
-” হ্যাঁ। ওকে দেখে রাখিস।”
-” জে আচ্ছা।”
.
.
চলবে…