#আমার_মনকাননে_ভ্রমর_তুমি
#পর্বঃ০২
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি
কয়েক কদম হেঁটে থেকে গেলো হেমসিনী। রাস্তার বাম পাশে থাকা নীলরঙা বাড়িটার দিকে আড়চোখে একবার তাকালো৷ পরমুহূর্তেই দ্রুত চোখ সরিয়ে নিয়ে মাথায় থাকা ওড়নাটা আরেকটু টেনে পুনরায় এগিয়ে যেতে লাগলো৷ বাড়িটার কাছাকাছি আসতেই হাঁটার গতি বাড়ালো হেমসিনী তবে বেশিদূর এগোতে পারলোনা।
” এই বাড়ির সামনে এলেই আপনার হাঁটার গতি বেড়ে যাই কেন হেমসিনী? এই বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় আপনার মাঝে শক্তি চলে আসে নাকি?”
হেমসিনী আবারো হতাশাভরা নিশ্বাস নিলো। প্রতিদিনই সে চেষ্টা করে মাহাতিবের চোখ এড়িয়ে চলে যেতে তবে কোনদিনও সে সফল হতে পারেনা। মাহাতিব হেমসিনীর সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো। তার দিকে তাকালো হেমসিনী। গায়ে জগিং শুট পরিহিত, ঘামে চুলগুলো কপালে লেপ্টে আছে।
” পথ আটকালে কেন?” সরাসরি মাহাতিবের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো হেমসিনী।
” আপনি সবসময় আমার থেকে পালিয়ে বেড়ান কেন হেমসিনী?”
” আমার পথ ছাড়ুন মাহাতিব, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
হাতে থাকা ফোনটার দিকে একপলক তাকিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে হেমসিনীকে বললো,
” দু’মিনিট দাঁড়ান, আমি একমিনিটে আসছি।”
মাহাতিব গেট দিয়ে ভেতরে চলে গেলে হেমসিনী তার কথা অমা’ন্য করে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াবে কিন্তু সেটা হলোনা।
” হেমসিনী আপনি কিন্তু বড়দের কথা অমা’ন্য করছেন। এটক কিন্তু ব্যা’ড ম্যানার’স।”
গেটের ভেতর থেকে গলা বের করে বললো মাহাতিব। হেমসিনী অবাক চোখে পেছন ফিরে তাকালো।
” আপনি যাননি?”
” আমি জানতাম আপনি দাঁড়াবেন না, তাই যাইনি। যদি দেরি করতে না চান তাহলে ভালো মেয়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকুন, আমি এখুনি আসছি।”
ঠিক দু’মিনিটের মাথায় মাহাতিব বেরিয়ে এলো। জগিং শুট পরিবর্তন করে সাদামাটা পোশাক পড়ে এসেছে।
” চলুন।”
” আপনি আমার সাথে কেন যাচ্ছেন? আপনাকে যেতে হবে না।”
মাহাতিব শুনেও না শোনার মতো হাঁটা শুরু করলো। হেমসিনী রাস্তা পার হয়ে ডানপাশে গেলো এবং দ্রুত হেঁটে মাহাতিবের আগে চলে গেলো।
কিছুসময় পর পাশে কারো অস্তিত্ব বুঝতে পেরে হেমসিনীর কিছুটা রা’গ হলো।
” মাহাতিব আপনি কেন আমার পেছনে পড়ে আছেন? আপনি কিছুদিন পর ভোটে দাঁড়াবেন, ইতিমধ্যেই রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে পড়েছেন অন্যদিকে আমি এবং আমার পরিবার এসব থেকে বহুগুণ দূরে। আপনাকে এসব মোটেও মানাই না, বৃথা চেষ্টা ছেড়ে দিন মাহাতিব।” মাহাতিবের দিকে না তাকিয়ে কথাগুলো বললো হেমসিনী। তবে কোন প্রতিউওর না পেয়ে পাশে তাকিয়ে দেখলো মাহাতিব ফোনে গেইম খেলছে।
রাস্তা পার হওয়ার জন্য দাঁড়ালো হেমসিনী। তবে এতো গাড়ি যে তার পার হতে ভ’য় লাগছে৷ সে সময় নিজের হাতে কারো স্পর্শ পেলো হেমসিনী৷ মাহাতিব তার হাত ধরে সাবধানে রাস্তা পার করিয়ে দিলো।
গেটের সামনে এসে তার হাত ছেড়ে দিলো মাহাতিব। মাথার ওড়নাটা আরেকটু ঠিক করে দিলো সে।
” মন দিয়ে পড়াশোনা করবেন, সামনে ফাইল পরীক্ষা আপনার। যান এবার।”
” আপনি যাবেন না?”
” না এখানেই দাঁড়িয়ে ঝালমুড়ি বিক্রি করবো আর আমার প্রথম ক্রেতা হবেন আপনি।”
” আপনি অনেক বা’জে মাহাতিব।”
হেমসিনীর বিরক্তমাখা কথা শুনে হালকা শব্দ করে হেসে উঠলো মাহাতিব। মেয়েটাকে বিরক্ত করতে তার বেশ লাগে।
ফোন বেজে উঠলে মাহাতিব ঘড়ির দিকে তাকালো এবং মূহুর্তেই সে স্বাভাবিক হয়ে গেলো।
” ক্লাসে যান হেমসিনী। সাবধানে বাড়ি ফিরে যাবেন, আমি আপনার সাথে পরে দেখা করছি।”
” দরকার নেই দেখা করার। আপনি আমার সামনে না এলেই আমি খুশি হবো।”
” আপনি খুবই নি’ষ্ঠুর হেমসিনী।”
” আপনার থেকে আমি জানতে চাইনি মাহাতিব।”
” এগারোটা বাজতে আর পাঁচ মিনিট বাকি।”
সময় শুনে হেমসিনীর চোখ কপালে। সে ব্যাগটা শক্ত করে ধরে ভেতরে ছুটে গেলো। তার ভীত মুখশ্রী দেখে হালকা হাসলো মাহাতিব।
.
.
মাহাতিব চেয়ারে বসতেই মুকিত কয়েকজন ছেলেকে এনে মাটিতে বসিয়ে দিলো। চুইংগাম চিবোতে চিবোতে ফোনে গেইম খেলছে মাহাতিব, তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে খুবই চিল মুডে আছে। তার এধরণের হাবভাব দেখে মুকিতের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো।
” ভাই ওদের এনেছি।”
কিছুসময় অপেক্ষা করলো মুকিত। মাহাতিবের কোন প্রকার সাড়া না পেয়ে আবার ডাকলো।
” ইশ…..। মুকিত দেখছো আমি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছি, এতোবার ডাকছো কেন? তোমার জন্য আমি হেরে গেলাম।” বেশ বিরক্ত নিয়ে বললো মাহাতিব।
” ওদের এভাবে মাটিতে বসিয়ে রেখেছো কেন? ওনারা কত শ্রদ্ধেয়বান ব্যক্তি, ওনাদের কি মাটিতে শোভা পাই?”
ছেলেগুলো মূহুর্তেই মাহাতিবের পায়ের কাছে ঝাঁপিয়ে পড়লো।
” ভাই আমাদের ক্ষমা করে দিন। আমরা জীবনেও আর এধরনের ভুল করবোনা। মায়ের দিব্বি, আমরা আর এধরনের কাজ করবোনা।”
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো মাহাতিব, কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই পাশ থেকে মোটা লাঠিটা উঠিয়ে তাদের মা’রা শুরু করলো। মাহাতিবের রাগী মুখশ্রী দেখে সবাই পিছিয়ে গেলো। কিছু সময় পর ক্লান্ত হয়ে থেমে গেলে মাহাতিব। লাঠিটা তাদের দিকে উঁচিয়ে বললো,
” কথায় আছে কুকুরের লেজ কখনো সোজা হয়না৷ তার প্রমাণ আবারো পেয়ে গেলাম। তোদের আমি সুযোগ দিয়েছিলাম, ভালো হওয়ার জন্য আমার দলে রেখেছিলাম কিন্তু তোরা তো কুকুরের লেজের মতো, সোজা আর হলি না। মুকিত ওদের নিয়ে যাও আর বড় বড় কয়েকটা কে’স ঠুকে দাও। এদের দ্রুত আমার চোখের সামনে থেকে নিয়ে যাও, না হলে আমি এবার হাড় ভে’ঙে ফেলবো।”
.
.
অন্য একটা মেয়ের সাথে কথা বলতে বলতে সিঁড়ি দিয়ে নামছিলো হেমসিনী। মেয়েটা চলে গেলে সে দ্রুত নেমে এলো।
” সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় মানুষের মুখের দিকে নয় চোখ সিঁড়ির দিকে থাকা প্রয়োজন।”
বাম দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে কালো রঙের পাঞ্জাবি পরিহিত মাহাতিবকে দেখতে পেলো হেমসিনী। সে আশেপাশে তাকিয়ে পুনরায় মাহাতিবের দিকে তাকালো৷ মাস্ক থাকায় বেশি কেউ চিনতে পারেনি। মাহাতিবের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে তার কাজকর্ম দেখছে হেমসিনী।
” এতো মনোযোগ দিয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে যেন তিনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন। নাটকবা’জ লোক একটা।” বিরবির করে বললো সে। কাঁধে থাকা গিটারের ব্যাগটা আরেকটু ঠিক করে মাহাতিবের কাছে এসে দাঁড়ালো।
” আপনি এখানে কেন এসেছেন? আপনার কি কোন কাজ নেই?”
” আছে তো, তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজই করতে এসেছি৷ চলুন আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আমাকে আবার একটা ঝা’মে’লা মিটাতে যেতে হবে।”
” তো প্লিজ যান, কেউ আপনাকে ধরে রাখেনি।”
ফোন বন্ধ করে পকেট রেখে হেমসিনীর হাত ধরে হাঁটা শুরু করলো মাহাতিব।
” কে বলেছে রাখেনি? লোহা যেমন চুম্বককে আর্কষণ করে তেমনি হেমসিনী নামের একজন মেয়েরূপী লোহা আমাকে অদৃশ্যভাবে আটকে রেখেছে।”
মাহাতিবের কথার বিপরীতে হেমসিনী কিছু বলতে পারলোনা। সে চাইনা মাহাতিব তার আশেপাশে থাকুক কিন্তু লোকটা থেকে সে যতই দূরে থাকতে চাই লোকটা ততই কাছে কাছে থাকে। মাঝে মাঝে মাহাতিব এমন এমন কথা বলে যা হেমসিনীকে চুপ করিয়ে দেয়, চাইলেও বিপরীতে সে কঠিন কথা বলতে পারেনা।
” জানেন মাহাতিব আমার না এখন সত্যিই নিজেকে লোহা মনে হচ্ছে আর আপনি হচ্ছেন সেই চম্বুক যে কিনা লোহার সংস্পর্শে এলে তার সাথে আটকে যায়। কিন্তু আমি যে চাইনা সেই লোহা হতে, যে লোহা আপনাকে আর্কষণ করবে। যে লোহার কাছাকাছি এলে আপনি তার দিয়ে আর্কষিত হবেন। আমি তো চাই সেই বস্তু হতে যার প্রতি আপনি কোন আর্কষণ অনুভব করবেন না। তার কাছাকাছি থাকলেও তার প্রতি কোন অনুভূতি আপনার হবেনা।” মাহাতিবের দিকে তাকিয়ে ভাবলো হেমসিনী। তার এই ভাবনার বিন্দু মাত্র আঁচ পেলোনা মাহাতিব। সে তো হেমসিনীর ছোট হাতটা সযত্নে নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
চলবে…..