আমার সংসার পর্ব ৮

আমার সংসার
পর্ব-০৮
Sara Mehjabin

ফারহান আজমীর হাতে স্পর্শ করে বলল, আজমী চলো না সবকিছু নতুন ভাবে শুরু করি? অতীতটাকে ভুলে যাওয়া যায় না? মানুষ মাত্রই তো ভুল হয়। আমি বুঝতে পেরেছি আজমী আর আমি কত বড় অন‍্যায় করেছিলাম। কিন্তু দ‍্যাখো নিয়তির টানেই এতো বছর প‍র আমরা আবার এক হয়েছি। অতীতে যা হয়েছে তা তো কখনো ফিরে আসবে না; অতীত ভুলে আমরা একটা নতুন জীবন শুরু করি। আমাদের সুখী সংসার হোক। প্লিজ আজমী।”

“ভুল? সেটা আপনার কাছে শুধুই একটা ভুল হতে পারে। কিন্তু আপনার সেই ভুলটাই আমার পুরো জীবন ধ্বংস করে দিয়েছিল। আর কি বললেন আপনি আপনার ভুল বুঝতে পেরেছেন! লজ্জা থাকলে আমাকে এই কথা বলতেন না। আপনার ভুল বুঝতে পারা দিয়ে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আমি আপনাকে ঘৃণা করি আর সারাজীবন তাই করব। আপনার সঙ্গে সংসার করার একটাই কারন-রিশান। এর বেশি আমার কাছে কিছু আশা করবেন না। আর যদি মনে করেন আমাকে একবার বিপদ থেকে বাঁচিয়েছেন বলে আমি আপনার অতীতের সব অন‍্যায় মেনে নিয়েছি তাহলে খুব বড় ভুল করছেন। আমি কোনদিন আপনাকে মেনে নিতে পারব না। আর আপনাকে মেনে নেওয়া কি আমার পক্ষে সম্ভব? আপনার ব‍্যান্ডেজ করা শেষ; তাড়াতাড়ি চলুন। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। আমাদের ফিরতে হবে।”

ফারহান দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবতে থাকে সত্যিই যা সে করেছিল আজমীর পক্ষে কি তাকে মেনে নেওয়া সম্ভব?

অতীত

ফারহান ভার্সিটি থেকে সবেমাত্র বাসায় ফিরল। দেখে বাসার পরিবেশ ভীষণ থমথমে। রিমা দরজা খুলেই বলল, “ফারহান তাড়াতাড়ি আয়। সিফাত কেমন যেন করছে। দরজা খুলছে না।”

রিমার কথা শুনে ফারহান যেন আকাশ থেকে পড়ল, কিহ্? সিফাতের আবার কি হলো? এমন তো কখনো হয় না ওর কোন সমস্যা আর আমি জানি না। তাছাড়া এমন কি’ই বা হলো যে ও দরজা বন্ধ করে বসে আছে? তোরা আবার কেউ কিছু বলেছিস নাকি? আম্মু কিছু বলেছে?”

“আরে না রে আমরা বলার সময় পেলাম কৈ! বাসায় আসল ঢাস করে ব‍্যাগটা ফেলে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর সে কি ভাঙচুর! কিছুক্ষণ আগে ভাঙচুর থেমেছে। কিন্তু কোনো শব্দ করছে না। আমি আম্মু অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কাচ্ছি। কোন কথা বলে না। আমার খুব টেনশন হচ্ছে রে। বাইরে কারো সাথে কিছু হয়েছে কিনা।”

“দাঁড়া তুই। আমি দেখছি। সমস্যা কি ওর?”

ফারহান বাইরে থেকে এসে সেই অবস্থাতেই সিফাতের রুমের সামনে গেল। দরজা বন্ধ ভেতর থেকে। ফরিদা খাতুন চিন্তিত মুখে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। ফারহানকে দেখে যেন একটু ভরসা পেলেন।

ফারহান বলল, কি হয়েছে আম্মু? ওর দরজা বন্ধ কেন?”

“দ‍্যাখ না তুই। আমাদের কে ও কিছু বলে নাকি। ও ওর সমস্যার কথা বললে একমাত্র তোকেই বলে। আমার খুব চিন্তা হচ্ছে। হঠাৎ এমন করছে কেন ও?”

ফারহান দরজা ধাক্কাতে শুরু করল, “সিফাত..এই সিফাত,,, দরজা খোল্। বহুত ঢঙ হয়েছে। মহিলা মানুষের মতো দরজা আটকে বসে আছিস কেন। এই সিফাত, খোল্ দরজা। সিফাত।”

কোন শব্দ নেই। ফারহান অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করল কিন্তু ভেতর থেকে সিফাত নিশ্চুপ। এবার সবার মধ্যেই চাপা টেনশন শুরু হলো। সিফাত যে কোনো একটা সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে কয়েকদিনে ওর আচরনে সেটা ভালোই বুঝতে পেরেছিল ফারহান। ইদানিং অন‍্যসময়ের মতো কিছু অপছন্দ হলেই রাগ দেখাচ্ছিল না; কথায় কথায় ফারহানের সঙ্গে ঝগড়াও লাগাচ্ছিল না; সবসময় চুপচাপ থাকত- কিছু একটা নিয়ে বিরক্ত থাকত। কেউ কিছু বললে কারন ছাড়াই রেগে উঠছিল। কিন্তু সেই সমস‍্যাটা কি খুবই বড়? সিফাত কি দরজা বন্ধ করে কোন দুর্ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা করছে? এটা মনে হয়াতে ফারহানের মনে হলো দরজা দ্রুত ভাঙা প্রয়োজন। বারবার আঘাত করার ফলে দরজাটা ভেঙে গেল। সবাই দেখল হাতে একটা ধারালো ছুরি নিয়ে সিফাত দাঁড়িয়ে আছে। সেটা দিয়ে হাতের রগ বরাবর কাটার চেষ্টা করছে। এরকম দৃশ্য দেখবে কেউ চিন্তাও করতে পারে নি। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। শুধু ফারহান দৌড়ে গিয়ে সিফাতের হাত থেকে টান দিয়ে ছুরিটা ফেলে দিল। ঠাস করে থাপ্পড় মারল। সিফাতের এই কাজ দেখে ফারহানের কোন হুশ নেই সে কি করছে। এই প্রথম ফারহান সিফাতের গায়ে হাত তুলল। ছোটবেলা থেকে সিফাত ঝগড়া লাগলেই ফারহানের গায়ে হাত তুলত। কিন্তু ফারহান কখনো পাল্টা একটুও মারত না। আজকে রাগে-কষ্টে নিজেকে সামলাতে পারল না। ফারহান আরো মারতে যায় তার আগে রিমা আর ফরিদা এসে সিফাতকে সরিয়ে নিলেন।

“সিফাত কি হয়েছে তোর বাবা? এইরকম কেন করতে যাচ্ছিলি?” সিফাতকে জড়িয়ে ধরে ফরিদা কাঁদতে শুরু করেন। সবাই যথেষ্ট ভয় পেয়ে গেছে। হাজারবার জিগ্যেস করেও কেউ সিফাতের মুখ থেকে কোনো কথা বের করতে পারল না কেন সে সুইসাইড করতে যাচ্ছিল‌। সে রাগান্বিত চোখে ফারহানের দিকে তাকিয়ে আছে আর বারবার এক-ই কথা বলছে, “কেন আমাকে আটকালি তুই? আমি মরতে চাই? এই অপমানের চেয়ে মৃত‍্যুও ভালো। আমি মরে যেতে চাই। মরে যেতে চাই।” রাগে পাগলের মতো আচরন শুরু করেছে। সমানে চিৎকার করছে। কিন্তু ওর এই অদ্ভুত আচরনের কারন কেউ বুঝতে পারছে না। এমনকি ও কোন অপমানের কথা বলছে তাও কেউ বুঝছে না।

ফারহান বলল, তোমরা সবাই যাও। আমি ওর সাথে একা কথা বলব।

সবাই জানে সিফাত যদি কাউকে মনের কথা খোলাখুলি বলে সেটা একমাত্র ফারহান। তাই সবাই বেরিয়ে গেল। ঘরে শুধু ফারহান আর সিফাত।

ফারহান দরজা আটকিয়ে সিফাতের মুখোমুখি বসে। “এইবার বল্ কি হয়েছে তোর?”

সিফাত আচমকা ফারহানকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কাঁদতে শুরু করল।
“সিফাত এই কাঁদছিস কেন তুই? কি হয়েছে? কেউ কিছু করেছে তোকে?”

“ফারহান আমি আর বাঁচতে চাই না। বেঁচে কি হবে বল্। সবকিছু দিয়ে যাকে ভালবাসলাম সেই আমাকে বুঝল না। তার কাছেই আমার ভালবাসার কোন মূল্য নেই। তাহলে বেঁচে থেকে কি করব!”

” সিফাত তোর কি হয়েছে। কে তোকে কি করেছে বল্। কেউ তোর সঙ্গে বেঈমানি করে থাকলে আমাকে বল্। ভয়ংকর শাস্তি পাবে সে।”

“ফারহান জানিস কলেজে একটা নতুন মেয়ে এসেছে। একদম গ্রামের। মাত্র শহরে এসেছে ওদের পরিবার। শহরের চাল-চলন আদব-কায়দা কিছুই জানে না। কিন্তু যেদিন ওকে প্রথম দেখলাম মনে হলো ওর জন‍্য-ই আমি এতবছর অপেক্ষা করেছি। একদিনেই সে আমার পুরো হৃদয় দখল করে নিল। ওকে সবসময় সাহায্য করতাম জানিস। প্রতিদিন ওর বাড়ি থেকে নিয়ে আসতাম আবার কলেজ ছুটির পর পৌঁছে দিতাম। ভয় করত শহরে নতুন যদি হারিয়ে যায় বা কোন বিপদে পড়ে। ওর বা ওর ফ‍্যামিলির যেকোনো বিপদে সবার আগে ওদের পাশে দাঁড়িয়েছি। ধীরে ধীরে আমরা খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠি। বাট আমি তো ওর বন্ধু হয়ে থাকতে চাই নি, ওর জন্য যে ফিল করি আমি। তাই ঠিক করলাম আজকেই ওকে আমার মনের কথা বলব। ভেবেছিলাম ও আমার প্রপোজাল এ্যাক্সেপ্ট করবে। কিন্তু ওকে প্রপোজ করার পর ও পাব্লিক প্লেসে সবার সামনে আমাকে থাপ্পড় মেরেছে। বলেছে আমি ওর যোগ‍্য নই। ও আমার মতো সস্তা প্লে-বয় টাইপ ছেলেকে ও বিশ্বাস করে না। ওর পরিবার কখনো আমাকে মেনে নেবে না। আর ও ওর পরিবারের বিপক্ষে কিছু করতে পারবে না। হ‍্যা আমি প্লেবয় ছিলাম‌। অনেক মেয়ের সঙ্গে রিলেশন করেছি। কিন্তু ওর সাথে মেশার পরে আমি এইসব থেকে দূরে সরে গিয়েছিলাম। নিজেকে বদলানোর চেষ্টা করেছি শুধু ওকে পাওয়ার জন্য। তবুও নাকি ওকে পাওয়ার যোগ্য হতে পারি নি। বিশ্বাস কর এই মেয়েটার মতো আমি দুনিয়াতে কাউকে ভালবাসি নি; ওর জায়গা কোনদিন কাউকে দিতেও পারব না। কিন্তু ও আমাকে এইভাবে অপমান করল! ওর জন্য এত কিছু করে আমি এটা ডিসার্ভ করি!”

ফারহান আর শুনতে পারছিল না। সহ‍্য হচ্ছিল না ওর। মাথায় আগুন জ্বলছিল‍।
“মেয়েটার ছবি দে। নাম-ঠিকানা পরিচয় সব বল্।”

“কেন? ওর ঠিকানা দিয়ে তুই কি করবি? আমি বুঝতে পারছি ফারহান তুই খুব রেগে গেছিস। তোর মাথায় নিশ্চয়ই কোন প্ল‍্যান চলছে। প্লিজ ভাই এসব ভুলে যা। দ‍্যাখ জোর করে তো আর ভালোবাসা হয় না। ওর ভালো থাকাই আমার কাছে সবচেয়ে বড়।”

“তুই কথা কম বল্। যেটা করতে বলেছি সেটা কর্।”

“না কিছুতেই না। আমি বুঝতে পেরেছি তুই ওর উপর প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করবি। কিন্তু সেটা আমি হতে দেব না। আমি কাউকে ওর কোন ক্ষতি করতে দেব না‌।”

“একদম চুপ। ঐ মেয়ের জন্য এখনো ভাবছিস? ও তোর ভালবাসার যোগ‍্য-ই নয়। ঐ মেয়ের এত সাহস কিভাবে তোকে অপমান করে! কি করে ভাবলি আমি ওকে ছেড়ে দেব। ওর জীবনটা জাহান্নাম না বানানো পর্যন্ত আমার শান্তি নেই।”

ফারহানের নিজের জীবনের চেয়েও প্রিয় সিফাত। ও যতটা ভালবাসে সিফাতকে নিজেকেও ততটা ভালবাসে না। সেই সিফাতের এত বড় অপমান ও কি করে মেনে নেবে? মেয়েটার কারনে সিফাত এতোটাই কষ্ট পেয়েছে যে সুইসাইড করতে যাচ্ছিল। মেয়েটাকে সে কিছুতেই ছাড়বে না।

সিফাতের কাছ থেকে আজমীর ছবিসহ সব ডিটেইলস জোর করে জেনে নিল ফারহান। ছবিতে আজমী একটা লাল থ্রিপিস পড়া মাথার চুল কোমর পর্যন্ত ছড়ানো। আজমীর মায়াবী মুখটা দেখে তখন যে কেউ ওকে ভালবেসে ফেলবে। কিন্তু ফারহানের মনে কোন মায়া জন্মাল না। ফারহান ঠিক করল এই মেয়েটাকে সে কঠিন শাস্তি দেবে। কাউকে ভালবেসে তাকে না পাওয়ার কষ্ট বুঝিয়ে দেবে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here