#আরশি
#Part_14
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
মিনিট দশেক ধরে বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি বাসের জন্য। কিন্তু বাস আসার নাম গন্ধ নেই। আকাশের আজও মেঘ জমেছে৷ দুপুর কি বিকেলের দিকে বৃষ্টি পড়ার সম্ভাবনা বেশি। দামকা হাওয়া বইছে। আমি মনে মনে ভাবছি, এই বুঝি ফাস্ট এট অফিস লেট হয় আমার। আরও পাঁচ মিনিট অপেক্ষার পর বাস আসে। সাথে সাথে শুরু হয় মানুষের ধাক্কাধাক্কি। অনেক কষ্টে বাসে উঠি। উঠে দেখি সব সিট বুক। কোথাও কোন খালি সিট নেই। বেশিরভাগ মানুষই দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ মনে পড়ে এখন অফিস টাইম। ভীড় হওয়া স্বাভাবিক। দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে উপরের হ্যান্ডাল ধরে দাঁড়িয়ে রই। বেশ কিছুক্ষণ পর অনুভব করি কেউ আমার কোমরের নিচের দিকটা স্পর্শ করছে। একবার বা দুইবার নয় বার বার। সাথে সাথে আমি চমকে উঠি। একটু চেপে দাঁড়াই। সর্তক চোখে পিছে তাকাতেই দেখি এক মধ্যবয়স্ক লোক চোরাচোখে আমাকে দেখছে আবার এইদিক সেইদিক চোখ বুলাচ্ছে। আমি তার দিকে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকাই। বুঝার চেষ্টা করি স্পর্শটা কি তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে করেছেন নাকি ভুলবশত। কিন্তু বুঝতে পারলাম না। যার জন্য কিছু বলতেও পারলাম না। কেন না সে যদি ভুলবশত স্পর্শ করে থাকে তাহলে খামাখা তার উপর দোষ পড়বে। আর আমি চাই না আমার ভুল বুঝাবুঝির জন্য কেউ বিনা দোষে হেনেস্তা হোক। তাই আমি এইবারের মত বিষয়টা এড়িয়ে গেলাম। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ পেরুতেই আবার সেই একই ঘটনা ঘটলো। তখন আর আমার বুঝতে দেরি নি এই স্পর্শ ইচ্ছাকৃত নাকি অনিচ্ছাকৃত। সাথে সাথে রাগে আমার শরীর রি রি করে উঠে। আমি পিছে ঘুরে চেঁচিয়ে বলি,
— কি সমস্যা? আমার গায়ে হাত দিচ্ছেন কেন?
লোকটা সাথে সাথে ঘাবড়ে যায়। আমার চেঁচানো শুনে সকলের নজর এসে আটকে আমার উপর। লোকটি তা দেখে অস্ফুট সুরে বলে উঠে,
— মানে কি? আপনার গায়ে আমি কখন হাত দিলাম?
— দেন নি বলছেন? বার বার ইচ্ছাকৃতভাবেই আমার উপর এসে পড়ছেন। গায়ে হাত দিচ্ছেন।
— আজব তো! চলতি বাস হাত বা ধাক্কা লাগতেই পারে। যদি এইসব সহ্য করতে না পারেন তাহলে বাসে উঠেন কেন?
তখন পাশ থেকে একজন বলে উঠে,
— আরেহ এতই যখন খুঁতখুঁত থাকে তাহলে লোকাল বাসে উঠে কেন এরা বুঝি না। উঠবেও আবার একটু হাত লাগলে বিষয়টাকে তিল থেকে তাল বানাবে।
কথাটা শুনে সেই লোকটা বিশ্রী হাসি দিয়ে বলে,
— ঠিক বলসেন ভাই। এইসব মেয়েরা বাসে উঠেই পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করার জন্য।
তাদের কথা বার্তা শুনে আমি ‘থ’ হয়ে যাই। মাথা ঘুরে উঠে। আমি চারপাশ তাকিয়ে দেখি সকলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে আর ফিসফিসিয়ে কিছু যেন বলছে। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসছে না। আমি তখন বুঝে উঠতে পারছিলাম না যে আমার এখন কি করা উচিৎ। প্রতিবাদ করা উচিৎ নাকি অন্য মেয়েদের মত চুপচাপ সব সহ্য করে নেওয়া উচিৎ। মধ্যবিত্ত মেয়েদের তো আবার প্রতিবাদ করতে নেই। সকল জায়গায় চুপ থেকে সব সহ্য করে নিতে হয়। হোক সেটা বাইরে বা ঘরে। এই শিক্ষায় তো তাদের ছোট থেকে দেওয়া হয়। তাই তো তাদের সহ্য করার ক্ষমতাটা অসীম। এইসব ভেবেই বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতে নিলেই মামার একটা কথা টনক নাড়ে,
” হার মেনে নেয়া আমাদের বড় দূর্বলতা। সফল হওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো হার মানার আগে অনেকবার চেষ্টা করা। ”
সাথে সাথে আমার মধ্যে সাহস ফিরে আসে। সিদ্ধান্ত নেই অনেক চুপ থেকেছি আর না। চুপ থেকে তো দেখলাম কিছুই হয় না বরং নিজেকেই সাফার করতে হয়। তাহলে এইবার না হয় প্রতিবাদী হয়েই দেখি। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাই সেই লোকটির দিকে অতঃপর চেঁচিয়ে বলি,
— নিজে দোষ করে আমাকে কথা শুনানো হচ্ছে? দোষ তো আমি করি নি করেছেন আপনি। আর যদি আমি দোষ করে থাকি তাহলে বলুন আমার দোষ কথায়? আমাকে কেন হ্যারাসমেন্ট করা হচ্ছে?
অতঃপর ঘুরে সকলের উদ্দেশ্যে বলি,
— কি হলো কথা বলুন সবাই? আমি তো বোরকাই পড়া আছি সাথে নিকাবও। আপনাদের ভাষা সেফ পোশাক বা সুরক্ষিত পোশাক। তাহলে আমার সাথে এমন হওয়ার মানে নি? আমাকে কেন এইসব নোংরামির শিকার হতে হচ্ছে? আপনাদের সামনে সে আমাকে হেরাস করছে আর আপনারা সব বুঝেও চুপ আছেন। কেন? ছেলেদের কথা না হয় বাদই দিলাম কিন্তু মেয়েরা কেন চুপ? একজন মেয়ে অন্যের মেয়ের বিপদের সময় কেন পাশে দাঁড়াচ্ছেন না? বিবেকে বাঁধছে না? বলুন!
আমার কথা শুনে লোকটা ভরকে যায়। অস্ফুট সুরে বলে উঠে,
— আরেহ এত চিল্লা পাল্লা মানে কি বুঝলাম না। এই কন্ডাকটর একে নামান তো ভাই৷ পুরো পরিবেশই নষ্ট করে দিল সে।
আমি চেঁচিয়ে বলে উঠি,
— নামবো আমি না নামবেন আপনি। নামেন বলছি। ড্রাইভার সাহেব গাড়ি থামান বলছি। গাড়ি থামান৷
তৎক্ষনাৎ কি হলো বুঝলাম না বাসে উপস্থিত এক মেয়ে বলে উঠে, “গাড়ি থামান!” তার বলার সাথে সাথে আরও কয়েক কন্ঠ মিশ্রিত হয়। যার সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। এক সময় সকলেই আমার পক্ষ হয়ে যায়। সকলের আওয়াজের কলধ্বনিতে ড্রাইভার বাধ্য হয় গাড়ি থামাতে। অতঃপর লোকটিকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করার মত করে বাস থেকে বের করে দেওয়া হয়। তাকে নামানোর পরই আমার মধ্যে আত্নবিশ্বাসটা গাঢ় হয়ে আসে। একটা জিনিস বুঝে যাই,
“তুমি যত চুপ থাকবে, যত সহ্য করবে ততই মানুষ তোমায় চেপে ধরবে। মাথার উপর উঠে নাচবে।”
___________________________________________________
একটু জন্য আজ আমার দেরি হয়নি। আল্লাহ এর রহমতে ঠিক সময়েই অফিস এসে পৌঁছেছি। অফিসে এসে জানতে পারি যে, কাজ বুঝার জন্য আমাকে সাদের কাছেই যেতে হবে। কথাটা শুনে আমার মধ্যে বিরক্তি নামক শব্দটি এসে উঁকি মারে। কিন্তু তা প্রকাশ করতে পারলাম না। চুপচাপ সাদের কেবিনের দিকে চলে যাই। কেবিনের সামনে এসে টোকা দিয়ে বলি,
— মে আই কাম ইন স্যার?
ভিতর থেকে শব্দ আসে,
— ইয়েস! কাম ইন।
আমি চুপচাপ ভিতরে চলে যাই। সাদ তখন একটা ফাইল চেক করছিল। ফাইল থেকে মাথা তুলে তাকিয়ে আমাকে দেখতে পেয়ে চওড়া হাসি দিয়ে বলে,
— আরেহ মিস দর্পণ যে! তা মিস দর্পণ কেমন আছ?
আমি দাঁতে দাঁত চেপে বলি,
— আলহামদুলিল্লাহ!
সাদ আমার কথা শুনে ভ্রুকুটি কুঞ্চিত করে বলে,
— তুমি কি দিন দিন ছোট হচ্ছ? নাকি আমার ঘাড়ে তোমাকে সব কাজ শিখানোর দায়িত্ব আছে বলে এখন সামাজিকতাও শিখাতে হবে?
সাদের কথা শুনে আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। অস্ফুটে সুরে জিজ্ঞেস করে উঠলাম,
— মানে?
— না মানে আমাকে তো জিজ্ঞেস করলে না কেমন আছি? সামাজিকতা নামেও কিছু আছে রে ভাই।
আমি ছোট ছোট চোখ করে বলি,
— আপনি কেমন আছেন?
— ভালো মানুষরা সবসময় ভালোই থাকে বুঝলে।
আমি কিছু না বলে চুপ করে থাকি। কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছে না। সাদ তা দেখে বলে,
— ভাই রে ভাই! সময়ের ব্যবধানে কত কিছু বদলে গেল কিন্তু তোমার এটিটিউড আর বদলানো না। এটিটিউডে পাওয়ার আছে বলতে হবে।
সাদের কথা শুনে আমি তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাই। সে যে পিঞ্চ করে কথা বলছে তা বুঝতে দেরি নি। কিন্তু তাও আমি কিছু বললাম না। তা দেখে সাদ গলা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ায়। আমি ওর দিকে তাকাতেই দেখি ও আজ একটা সাদা কালো চেক শার্ট আর ব্ল্যাক ডেনিম প্ল্যান্ট পড়েছে। শার্টটা ইন করা। গলায় কালো টাই। কালো ঘন চুলগুলো ব্রাশ করা। ডান হাতে মেল ওয়াচ। মায়াভরা চোখ দুইটির নিচে হাল্কা কালো দাগ। সাধারণত শ্যাম বর্ণ ছেলেদের চোখে মায়া টুইটুম্বুর থাকে। সাদের বেলায়ও ঠিক তাই। ঠোঁট গুলো সিগারেটের আগুনে পুরে কালছে হয়ে গিয়েছে। তাও একটা মায়া মায়া ভাব আছে মুখখানিতে। লম্বায় হয়তো ৫ ফিট ৯ কি ১০ হবে। দেহের গঠন স্বাভাবিক। একবারে চিকনও না আবার মোটাও না। মিডিয়াম।
কখন যে আমি সাদকে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করি বুঝে উঠতে পারি নি। যখন বুঝতে পারলাম তখনই চোখ নামিয়ে নিতে নেই। কিন্তু তখনই এক জায়গায় আমার চোখ আটকে যায়। সাদ হাসলে ওর গালে গর্ত হয়। বেশ গভীর সেই গর্ত। সেটা চোখে পড়তেই আমার মস্তিষ্কে দুইজনের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে। প্রথম অহনা দ্বিতীয় ফাহাদ। ফাহাদের কথা মাথায় আসতে আমি অস্বস্তিতে পড়ে যাই। হুট করে তিক্ত স্মৃতিগুলো তাড়া করে বেরায়। অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি। ঠিক এমন সময় সাদের ডাক শ্রবণ হতেই আমি চমকে উঠে। সর্তক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাই। সে বলছে,
— আর ইউ ওকে মিস দর্পণ?
আমি মাথা নারাই। লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করে নেই। অতঃপর সাদ আমাকে কিছু বই ধরিয়ে দেয় পড়ার জন্য আর কিছু ফাইল বুঝিয়ে দেয়। সেগুলোই আপাতত দেখতে বলে। হয়তো সে বুঝতে পেরেছে আমার বেসিক কিছু নোলেজ আমার দরকার। হুট করে আমি সব সামলে উঠতে পারবো না।
কাজ বুঝা শেষে আমি বাইরে এসে পড়ি। সাদ আমাকে আগেরদিনই আমার ডেস্ক দেখিয়ে দিয়েছিল তাই আমি আজ সেখানে এসেই বসি। কাধের ব্যাগ নিচে রেখে বই আর ফাইলগুলো টেবিলের উপর রাখি। অতঃপর আমি ফাইলগুলো দেখতে থাকি। গরম লাগছিল বিধায় নিকাবটা খুলে নেই। বেশ কিছুক্ষণ পর আমার পাশে বসে থাকা মেয়েটি বলে উঠে,
— হেই! তুমি কি নিউকামার? মানে যে আজ নতুন জয়েন করেছে?
আমি পাশে ফিরে দেখি একটা মেয়ে। সে হাস্যজ্জ্বল মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। গায়ে লেডিস শার্ট আর জিন্স পড়া। গায়ের রঙ হলদে ফর্সা। চোখগুলো ছোট ছোট। একদম চাকমাদের মত। কালার করা চুলগুলো উঁচু করে ঝুটি করা আর ঠোঁটে নিউড কালারের লিপস্টিক। গাল গুলো একটু ফুলা আর তাতে হাল্কা ব্লাসন দেওয়া। গলার মাঝে ছোট একটি লোকেট আলা চেইন। দেখতে মাশাআল্লাহ। আমি তাকে দেখে হাসি দিয়ে বলি,
— হ্যাঁ সে আমি।
মেয়েটা খুশি হয়ে বলে,
— ওয়েলকাম টু আওয়ার অফিস। আমি জেসমিন তুমি?
— আমি আরশি।
— নাইস নেম।
— থ্যাংক। আপনার নামটাও বেশ সুন্দর।
— হেই আপনি বলছো কেন? আমরা কলিগ রাইট? সো তুমি বললেই হবে আর যদি ভালো ফ্রেন্ড হয়ে যাই তাহলে তুই।
আমি প্রত্যুত্তরে মুচকি হাসলাম। মেয়েটা যে বেশ সহজ সরল মনের মানুষ তা তার কথা বার্তা থেকেই বুঝা যায়। সাথে বেশ মিশুকও বটে। জেসমিন আমার সাথে এই সেই নিয়ে অনেক কথা বলতে থাকে। আমার ব্যাপারে অনেক কিছুই জিজ্ঞেস করেছে। আমিও তার উত্তর দিয়েছি। মেয়েটা কথা বলে বেশি। মানে বাচাল টাইপ। কিন্তু তাও বেশ মিষ্টি। কথায় কথায় জেসমিন বলে উঠে,
— আচ্ছা তুমি কি মেরিড? নাকে যে ফুল পড়ে আছো?
#চলবে
পরের মাসের ১ তারিখ থেকে আমার সেকেন্ড এভুলেশন টেস্ট। আপাতত পড়ালেখা নিয়ে একটু ব্যস্ত আছি। তাই মাঝে মধ্যে একটু গেপ যাবে। রেগুলার দেওয়ার চেষ্টা করবো বাট মাঝে মধ্যে অনিয়ম হবে। এর জন্য আগে থেকেই দুঃখিত।
আর প্লিজ nice,next বা sticker কমেন্ট করবেন না। সেগুলো দেখতে অসহ্য লাগে।
#Part_15
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
— আচ্ছা তুমি কি মেরিড? নাকে যে ফুল পড়ে আছো?
সাথে সাথে আমি চমকে উঠি। ডান হাতটা নিজ শক্তিতে উপরে উঠে আসে আর নাকের ডগায় এসে স্থির হয়। হাত বুলাতেই ছোট সাদা পাথরযুক্ত নাকফুলটার অস্তিত্ব অনুভব করতে পারি। সাথে সাথে মনটা বিষিয়ে যায়। মনের মধ্যে চলতে থাকে হাজারো প্রশ্নের ছুটাছুটি খেলা। এরই মধ্যে জেসমিনের ডাক পড়তেই সে উঠে সেইদিকে চলে যায়। যাওয়ার আগে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে যায়,
— পরে কথা বলি কেমন। আপাতত ওইদিকে একটু যেতে হবে। বায়!
আমি একবার ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মাথা ঘুরিয়ে নেই। নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করতে থাকি,
— আমি এখনো নাকফুলটা পড়ে আছি কেন? হাতের চুড়ি ও গলার চেইন তো ফাহাদের বাসা থেকে আসার সময় খুলে রেখে এসেছিলাম তাহলে এইটা কিভাবে রয়ে গেল? আর এতদিনে আমি এইটা খেয়াল ও করলাম না? যদি জেসমিন না বলতো তাহলে হয়তো খেয়ালই করতাম না। আচ্ছা এই নাকফুলটার জন্যই কি বার বার আমায় ফাহাদের স্মৃতিগুলো তাড়া করে? এই নাকফুলটা কি এখনো আমাকে ওই সম্পর্কে বেঁধে রেখেছে?
প্রশ্নের কিছুটা উত্তর মিললো তো কিছুটা না। অস্থির হয়ে পড়লাম। বিষিয়ে যাওয়া মনটি আরও বিষে যায়। অসহ্য লাগতে শুরু করে সবকিছু। দোটানায় পড়ে যাই, নাকফুলটা কি খুলবো নাকি না? অতঃপর মামার একটা কথা টনক নারে,
“যতক্ষণ না তুই অতীতকে ভুলে যাচ্ছিস, যতক্ষণ না তুই ক্ষমা করতে পারছিস, যতক্ষণ না তুই মেনে নিচ্ছিস অতীত চলে গেছে – ততক্ষণ তুই নিজের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষমতাকে কাজে লাগাতে পারবি না।”
কথাটা স্মরণ হওয়ার সাথে সাথে আমি নাকফুলটা খুলে ফেলি। নাকফুলটা খুলে একটা টিস্যু পেপারে মুরিয়ে ব্যাগের এক কোনে রেখে দিলাম। সাথে সাথে বুক চিরে একরাশ দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে। হঠাৎ মনে হতে থাকে নিজেকে আজ বড্ড হাল্কা লাগছে। মনে হচ্ছে কোন এক অদৃশ্য বোঝা যেন ঘাড় থেকে নেমেছে। বিষিয়ে যাও মনটি তার প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে জানি না শুধু এতটুকু জানি আমি আজ মুক্ত। পুরোপুরি ভাবেই মুক্ত।
______________________________________________
সন্ধ্যা প্রায় নেমে এসেছে। পশ্চিম আকাশের বুকে হেলে পড়েছে রক্তিম সূর্যটি। নিজের রক্তিম আভা ছড়িয়ে দিয়ে আকাশ জুড়ে চলছে লাল হলুদ মেঘের ছিনিমিনি খেলা। পাখিরা খুবই ব্যস্ত ভঙ্গিতে এইদিক সেইদিক ছুটাছুটি করছে। দেখে মনে হচ্ছে তাদের মধ্যে কোথাও যাওয়ার তাড়া লেগে আছে। রাস্তার পাশের এক দেয়ালে বসে একঝাঁক কাক অতি কর্কশ কন্ঠে ডেকেই চলেছে। মাগরিবের আযান প্রতিধ্বনিত হতেই কাকের সেই দলটি তীব্রভাবে কলধ্বনি করে উঠে আর ফুড়ুৎ করে উড়ে যায়। প্রাকৃতিক আলোর আঁধারে বুকে লুকিয়ে পড়তেই শুরু হয় কৃত্রিম আলোর মাখামাখি।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অনবরত বেল টিপছে ফাহাদ। চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। গায়ের শার্টটি ঘামের কারণে শরীরের সাথে লেপ্টে রয়েছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের দানা। চোখে থাকা চিকন ফ্রেমের চশমাটি বার বার নাকের ডগায় এসে ঝুলে পড়ছে। ফাহাদ তা অতি সাবধানে বা হাতে আঙ্গুল দিয়ে ঠেলে পিছে গুচিয়ে দিচ্ছে। বেশকিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর জুঁই এসে দরজা খুলে দেয়। এতক্ষণ অপেক্ষা করানোর জন্য ফাহাদ রেগে জুঁইকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই জুঁই এর আটাতে মাখা চেহেরা দেখে ‘থ’ হয়ে যায়। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে জুঁই এর মুখ পানে৷ অস্ফুটে স্বরে বলে উঠে,
— তোমার এই অবস্থা কেন?
জুঁই এনিয়ে বিনিয়ে বলে,
— ওই আরকি ইয়ে মানে.. তোমার জন্য আলুর পরোটা করতে গিয়েছিলাম। তো ডোহ বানাতে গিয়ে চেহেরায় আটা লেগে যায়।
কথাটা শুনে ফাহাদ উচ্চস্বরে হেসে উঠে। জুঁই তা দেখে মুখ ফুলিয়ে বলে,
— এই একদম হাসবা না বলে দিচ্ছি। তোমার জন্যই আমার এই অবস্থা হয়েছে।
ফাহাদ ঘরের ভিতর ঢুকতে ঢুকতে বলে,
— তো করতে কি আমি বলেছি নাকি?
জুঁই দরজা দিয়ে ফাহাদের উদ্দেশ্যে বলে,
— বাহ রে! এখন কি আমি তোমার জন্য কিছু করতেও পারবো না?
ফাহাদ সোফায় বসে নিজের গলার টাইটা ঢিলে করে বলে,
— তা কখন বললাম? আর তুমি এইসব করতে গিয়েছ বাই কেন? তোমাকে না বলেছি এই অবস্থায় কোন ধরনের কাজ না করতে। আর বুয়া আসে নি আজ?
জুঁই ফাহাদের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
— এসেছিল তো৷ রাতের খাবার রেঁধে গিয়েছে। আর আলু পরোটা তুমি পছন্দ করো বলেই করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারলাম না৷ জানোই তো আমি আটার দলাটা ঠিকমত করতে পারি না। বাকি সব পারলেও এই একটা জিনিসই আমার দ্বারা হয় না।
ফাহাদ জুঁই এর হাত ধরে ওকে নিজের পাশে বসায় তারপর বলে,
— তুমি আমার জন্য এতটুকুই করতে চেয়েছ এইটাই অনেক। বাট ফার্দার মোর তুমি এইসব করতে যাবে না। তোমার প্রেগন্যান্সির ফোর্থ মান্থ চলতাসে জানো না তুমি? এইসময়ে কতটা সাবধান থাকা লাগে জানা আছে তোমার?
জুঁই ফাহাদের হাতে হাত রেখে বলে,
— কিছু হবে না চিন্তা করো না তো। তুমি সবসময় একটু বেশি চিন্তা করো।
— তোমাকে নিয়ে ভয়ে থাকি বলেই চিন্তা করি। নিজের যত্ন নিলে এতটা ভাবতে হতো না আমায়।
— নেই তো।
— হ্যাঁ জানা আছে কতটুকু যত্ন নাও।
— যত্ন নিলেও কি না নিলেও কি? অন্যের সংসার ভেঙ্গে যেখানে আমি আমার সংসার সাজিয়েছি সেখানে কি আদৌ মনের শান্তি মিলে? ভয় তো আমার হয় যদি ওর অভিশাপ আমাদের লেগে যায়? আমাদের বাচ্চার কিছু…
জুঁইকে পুরো কথা শেষ করার আগেই ফাহাদ ওকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়৷
— চুপ! ঠাডিয়ে দিব এক। অনেক বাজে বকা শিখেছ তুমি। তুমি কারো সংসার নষ্ট করো নি। বরং সে মাঝে এসেছিল এখন সরে গিয়েছে। নিজের স্থানে ফেরত চলে গিয়েছে। ব্যাস! এতে অভিশাপ কেন লাগবে? আর এমনেও আমার সাথে আরশি যা ছিল তা আমি আরও দুই মাস আগেই শেষ করে দিয়ে এসেছি। যদি না সম্পর্ক থাকতো তাহলে কোন এক কথা ছিল। বাট নাও আই ইজ নান টু আস। তার কোন অস্তিত্ব নেই আমাদের জীবনে। সো ডোন্ট থিং এবাউট হার এন্ড অলসো ডোন্ট ফিল গিল্টি ওকে?
— হুম!
ফাহাদ মুচকি হেসে বলে,
— যাও মুখ ধুঁয়ে আসো৷ চেহেরার কি অবস্থা হয়ে আছে।
জুঁই তখন মাথা দুলিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। সাথেই ঠোঁটের কোনে ঝুলিয়ে নিয়ে যায় এক রহস্যময় হাসি।
____________________________________________
ব্যস্ত শহরের কোলাহল বেড়েই চলেছে। পথেঘাটে জ্যামের সংখ্যা যেন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অহেতুক হর্ণের শব্দে পরিবেশ হয়ে উঠেছে গরম। সোডিয়াম লাইটের আলোয় রাস্তা ঝলমল করে উঠছে। রাস্তার পাশের রেস্তোরাঁ গুলোতে হাল্কা পাতলা ভীড় দেখা দিচ্ছে। সন্ধ্যার নাস্তা কিনছে সবাই। টং ঘরের সামনে এসে ঝাঁক দিয়ে এক রাশ তরুণদের দল। ধোঁয়া উঠা এককাপ চা হাতে নিয়ে মেতে উঠেছে নিজের আড্ডায়। রাস্তায় ঘুরে বেরাচ্ছে দুই-তিনটে কুকুর। হয়তো খাবারের সন্ধান করছে। ফুচকা,ঝালমুড়ি ও ভেরপুড়ির স্টলে জমেছে মেয়েদের ভীর। হৈচৈ এর শব্দ ভেসে আসছে কোথ থেকে যেন। বেশ জমে উঠেছে রাতের ঢাকা শহর।
আমি বাসের সিটে বসে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছি। সবকিছুই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি। এমন সময় রাস্তার পাশে ফুচকার স্টলের সামনে এক যুগলদের দেখে চোখ আটকে যায়। ছেলেটির গায়ে হলুদ পাঞ্জাবি আর মেয়েটির গায়ে নীল জামদানী শাড়ি৷ মেয়েটি ফুচকা খাচ্ছে আর ছেলেটি তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। তাদের দেখে হঠাৎ হুমায়ূন আহমেদের লিখা সেই বিশ্ব পরিচিত যুগলবন্দীর কথা মনে পড়ে যায়। হিমু আর রুপার কথা। রুপার চরিত্র আমার কাছে ঠিক কেমন ছিল জানি কিন্তু হিমুর চরিত্রটা ছিল অতি অসাধারণ। বলতে গেলে সাধারণের মধ্যে অসাধারণ। হ্যাঁ একটু পাগলাটে টাইপ ছিল কিন্তু তাও তার মধ্যেই যেন ছিল এক রাশ মুগ্ধতা। অবশ্য এইটা ঠিক হিমুরা বাস্তবে হয় না। হয় শুধু কল্পনাতে। ভেবেই মুচকি হাসলাম। আবার তাকালাম সেই যুগলদের দিকে। তাদের দেখতে দেখতেই সিগন্যালের জ্যাম ছেড়ে। ধীরে ধীরে তারা আমার দৃষ্টির অগোচরে চলে যায়।
বাসায় আসতে আসতে আজ একটু দেরি হয়ে যায়। আসলে কাজ বুঝতে আমার একটু সময় লেগে যায়। তার উপর জ্যামে প্রায় আধা ঘন্টার উপর বসেছিলাম যার জন্য বেশ দেরি হয়ে যায়। অফিসে থাকাকালীন জেসমিনের সাথে আর দেখ হয় নি। হয়তো কোন কাজে বেরিয়ে গিয়েছিল। আমার কাছে বাসার চাবি থাকায় আমি লক খুলে বাসার ভিতর ঢুকে পড়ি। সোজা চলে যাই নিজের রুমে। গিয়ে দেখি অহনা ঘুমাচ্ছে। সাথে সাথে আমার ভ্রু কুঁচকে আসে। এইসময় তো অহনার ঘুমানোর সময় না তাহলে? আমি ওর পাশে গিয়ে ওর মাথায় হাত দিয়ে ওর শরীরের তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণ করতে থাকি। না শরীরের তাপমাত্রা ঠিক আছে। আমি স্বস্তির নিশ্বাস নিয়ে বোরকা আর নিকাব খুলে ওয়াশরুমে চলে যাই ফ্রেশ হওয়ার জন্য। বেশ ক্লান্ত লাগছে।
ফ্রেশ হয়ে এসে আমি চলে যাই মামার রুমে। দেখার জন্য তিনি কি করছেন। তার রুমের সামনে এসে দেখি পুরো রুমটি ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঘেরা। দরজা ভেজানো। সাথে সাথে আমার খটকা লাগে। আমি আস্তে করে দরজা খুলে ভিতরে যাই। লাইট বোর্ডের কাছে গিয়ে লাইট জ্বালিয়ে দেই। চারদিকে চোখ বুলাতেই নজর পড়ে ইজি চেয়ারের দিকে। মামা তাতে চোখ বুজে শুয়ে আছে। হাতে তার একটা বাসন্তী রঙের জামদানী শাড়ি। সেই সাথে কয়েকটা হলুদ রঙের চুড়ি। আরও কি যেন আছে। সেইগুলা দেখে আমি খানিকের জন্য চমকে উঠি। গোল গোল চোখে তাকিয়ে রই সেই জিনিসগুলোর দিকে। অতঃপর চোখ তুলে তাকাই মামার দিকে। ইতি মধ্যে মামা চোখ খুলেছে। হয়তো লাইটের আলো তার চোখে বিঁধছে। আমি মামার দিকে ভালো করে তাকাতেই দেখি চোখ তার কেমন লালচে হয়ে আছে। তা দেখে আমি অবাক হলাম তা কিন্তু না। বরং স্বাভাবিক ভাবেই নিলাম বিষয়টা। কেন না মামার হাতে শাড়িটা দেখেই আমি বাকি কাহিনী বুঝে গিয়েছিলাম। আমি স্বাভাবিক কন্ঠেই বলি,
— শাড়িটা মিহি আন্টির না? আজ হঠাৎ এতদিন পর বের করলে যে?
#চলবে
যুগল মানে কাপল/couple। অনেকে হয়তো শব্দটি নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়তে পারেন তাই জানিয়ে দেওয়া হলো।